জানা-অজানার গোলগাছ

জানা-অজানার গোলগাছ

ফিচার ফকির আব্দুল্লাহ আল ইসলাম ডিসেম্বর ২০২৩

গোলগাছ কিংবা গোলপাতা কোনোটিই গোল নয়। তাহলে এই গাছ ও পাতার অঙ্গে-সঙ্গে গোল শব্দটি যুক্ত হলো কিভাবে? সাধারণত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফুল অথবা ফলের নামানুসারে কোনো গাছ বা উদ্ভিদের নাম নির্ধারণ করা হয়। তো গোলগাছের ফল তথা গোলফল কি তবে গোল? না ফলও পুরোপুরি গোল নয়, কিছুটা লম্বাটে। তাহলে ব্যাপারটি কেমন যেন অদ্ভুত নয়? আর দেরি না করিয়ে গোলের সূত্র-বীজ এবার প্রকাশ করেই দিই! গোলফল যখন ছড়ায় থাকে তখন দেখতে ঠিক পরিপাটি গোলগাল কাঁঠাল এবং কেয়া ফলের মতো লাগে। মূলত ছড়ায়-ছড়ায় ঝুলতে থাকা দিল-জুড়ানো এমন নান্দনিক দৃশ্যশিল্পের কারণেই অজানা সুপ্রাচীন কাল থেকে ফলটির নাম গোলফল, সেই অনুপাতে উদ্ভিদের নাম গোলগাছ এবং এর পাতার নাম গোলপাতা মানুষের মুখে-মুখে জারি হতে হতে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। তবে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় গোলফলকে গাবনা বলা হয়। ফলটি অপরিপক্ব অবস্থায় বাদামি রঙের হয় এবং ধীরে ধীরে কালচে বর্ণ ধারন করে। ফলের কোষগুলোর আকৃতি-প্রকৃতি ঠিক যেন গোখরা সাপের ফণার মতো! প্রতিটি বীজ ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি লম্বা হয়। পরিণত প্রতিটি স্বাভাবিক গোলফলের ওজন ৫০-১০০ গ্রামের হয়ে থাকে। প্রত্যেক কাঁদিতে প্রায় ৫০-১৫০টি পর্যন্ত বীজ-ফলের দেখা মেলে। কাঁচা অবস্থায় গোলফলের শাঁস খাওয়া যায়, যা অনেকটাই তাল শাঁসের মতো লাগে। গোলফল অধিক পরিমাণ ভিটামিন ও মিনারেলের উৎস। যাতে কৃমি দমন, পানি শূন্যতা পূরণ, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি এবং চর্মরোগের চিকিৎসা-উপকরণ বিশেষভাবে বিদ্যমান। বাণিজ্যিকভাবে গোলফলের কেনাবেচার রেওয়াজ সামগ্রিকভাবে এখনো চালু হয়নি। সুন্দরবনে যাওয়া বনজীবী ও উপকূলের মানুষেরাই গোলফলের শাঁস খান; এবং ডাঙ্গা এলাকার মেহমান গেলে তাঁদেরকে খাওয়ান। তবে সম্প্রতি গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় উভয় পা হারানো আব্দুর রহমান শেখ নামের এক লোক গত চার বছর ধরে বিশ্বঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ এলাকায় পর্যটকদের কাছে গোলফল বিক্রি করে সংসার চালান। গোলফলের কাঁদিতে ফলকে কেন্দ্র করে প্রথম দিকে গোলফুল ফোটে। স্প্যাডিক্স জাতীয় এসকল ফুল ১-১.৫ মিটার লম্বা হয় এবং ফুলের মাথার অংশের ব্যাস প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার। বছরব্যাপীই গোলফুল-ফলের উৎপাদন চোখে পড়ে। তবে আষাঢ়  মাসে কাঁদিতে-কাঁদিতে মৌসুমি ফল ধরে। গোলগাছের বৈজ্ঞানিক নাম নাইপা ফ্রুটিক্যান্স (ঘুঢ়ধ ভৎঁঃরপধহং) এবং ইংরেজিতে নিপা পাম (ঘুঢ়ধ ঢ়ধষস) বলা হয়। বাংলাদেশ এবং ভারতের বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ এলাকায় গোলগাছ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া উদ্ভিদটি বিশ্বের নানান অঞ্চলের স্থানীয় বিভিন্ন নামে পরিচিত। মিয়ানমার- দানী, শ্রীলঙ্কা- জিং পল, মালয়েশিয়া- বুআহ নিপাহ, ইন্দোনেশিয়া- বুআহ আতপ, সিঙ্গাপুর- আত্তপ, ফিলিপাইন- নিপা, ভিয়েতনাম- দুয়া নুয়ক প্রভৃতি।

সৃষ্টি জগতে গোলগাছের প্রধানতম উৎপত্তিস্থল ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উপকূলীয় লবণাক্ত স্বল্প বারিধারার কাদা-মাটির থরে-থরে। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে গোলগাছ তার মূল জেনাস নিপা হতে উদ্ভূত একমাত্র প্রজাতি যার উপ-প্রজাতি নিপোডিয়া। 

চির-সুমহান স্রষ্টা আল্লাহর রহমতে বিশ্ব ঐতিহ্যের লীলাভূমি আমাদের জাতীয় বন, সুন্দরবনের স্বল্প ও মধ্যম লবণাক্ত পরিবেশে বিপুলায়তনে গোলগাছের বাহারি পাতার দৃষ্টিনন্দন সৃজনকাব্য রচিত হয়েছে।

বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মিয়ানমার,     থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, বোর্নিও, পাপুয়া নিউগিনি, কম্বোডিয়া অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ বন ও উপকূল-জুড়ে গোলগাছের সুবিস্তার ঘটেছে। বাংলাদেশের সুন্দরবনের পাশাপাশি এ বন ঘেঁষা উপকূলীয় জেলা বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালীর নদী-খাল-বিলের ধারে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া ও চাষাবাদকৃত গোল-বাগানের দর্শন পাওয়া যায়। এছাড়াও গোলের কৃষ্টি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বঙ্গোপসাগর ও নদী-তীরবর্তী অন্তত ১৬-১৯ জেলায়। কথায় আছে, হাতি বাঁচলেও লাখ টাকা, মরলেও লাখ টাকা! অর্থাৎ হাতির বাঁচা-মরা দুটোই সমান। আর এমন নাম হয়েছে হাতির মূল্যবান দাঁত বা আইভরির জন্য। যা থেকে তৈরি হয় অনেক নামিদামি সামগ্রী। ঠিক একইভাবে গোলগাছের কোনো কিছুই ফেলনা নয়। গোলপাতা সচরাচর ২০-২৫ ফুটেরও বেশি লম্বা ও ১.৫-২.০ মিটার চওড়া হয়ে থাকে। সাধারণত প্রতিটি গাছে ৭-১০টি গোলপাতা পাওয়া যায়। গোলের চারার বয়স ৪-৫ বছর হওয়ার পর সেসব গাছ থেকে গোলপাতা আহরণ শুরু হয়। সবুজাভ এসব পাতা দেখতে নারকেলের পাতার ন্যায়। নারকেলের পাতার মতো প্রত্যেক পত্রে বিপরীতমুখী জোড়ায়-জোড়ায় ৬০-১২০টি পত্রক বা লিফলেট থাকে। আবার পূর্ণ-বয়সী গোলগাছ দেখতে ঠিক ৩-৪ বছরের নারকেল-গাছের আকৃতি বিশিষ্ট। গোলগাছ ঝাড় আকারে বেড়ে ওঠে। এদের রাইজোম বা কাণ্ড মৃত্তিকা থেকে প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার উঁচু হয়। গোলগাছের আদর্শ জন্মস্থান জোয়ার-ভাটার পলিযুক্ত লবণাক্ত স্বল্প বারিধারার কাদা-মাটি।

এরা ফল থেকে গাছ হওয়ার পাশাপাশি রাইজোম প্রক্রিয়ায় এক গাছ থেকে অন্য গাছের সৃষ্টি করে। এভাবে গোলগাছের প্রাণ বেঁচে বা টিকে থাকে কাল থেকে কালান্তরে। যাঁরা সুন্দরবনের গোলপাতা আহরণের মাধ্যমে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে, তাঁদেরকে বাওয়ালী বলা হয়। অজানা কাল হতেই উপকূলের মানুষেরা এই পেশার সাথে জড়িত। আর এভাবেই খুলনাঞ্চলে বাওয়ালী বংশের উৎপত্তি হয়েছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময় সুন্দরবনের গোলপাতা সংগ্রহের মৌসুম। এ বনের গোলপাতা আহরণের জন্য ফরেস্ট অফিসের পাসের প্রয়োজন হয়। আগে গোলপাতা কুইন্টাল প্রতি ২৫ টাকা হারে রাজস্ব দিতে হতো। বর্তমানে যা বাড়িয়ে ৬৮ টাকা করা হয়েছে। মৌসুমে প্রায় ৩০ হাজার বাওয়ালী পাসে উল্লেখ করা নির্ধারিত কূপ বা জোনের গোলপাতা সংগ্রহের মিশনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

গোলপাতা কেটে কেটে বিশেষ পদ্ধতিতে নৌকায় মজুদ করা হয়। এ কাজে ছোট-বড় মিলিয়ে কমপক্ষে ৫ হাজার নৌকা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বছরে সুন্দরবনের ৭০ থেকে ৮০ হাজার মেট্রিক টন গোলপাতা সংগৃহীত হয়। গোলপাতা আহরণের সময় অত্যধিক মৃত্যু ঝুঁকিতে ভোগে বাওয়ালীগণ। কারণ চির অকুতোভয় রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাংলার বাঘ গোলগাছের ঝুপড়ির মাঝে ঘাপটি মেরে বসে থাকে, যা সহজে অনুমান করা যায় না। সুযোগ বুঝেই বাঘ মামা মানব ভাগ্নেদের ওপর বজ্রশক্তিতে আক্রমণ করে।

এভাবে বাঘের থাবায় এ যাবৎকাল অনেক মানুষই মারা গেছেন এবং বাঘ-মানুষে বাঁচা-মরার লড়াই শেষে কেউ কেউ আল্লাহর রহমতে গাজী হয়ে বেঁচে ফিরে পঙ্গুত্ব বরণ করে জীবন-যাপন করছেন। এছাড়া ভয়াল কুমির ও অজগর সাপসহ হরেক রকম জন্তু-জানোয়ারের ভয় তো রয়েছেই। তবুও যে খেয়ে-পরে জীবন ধারণের তাগিদে কতভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। এমন অসংখ্য পেশাজীবীদের প্রাণের মায়া ত্যাগের বিনিময়েই আমাদের সভ্যতা নির্মিত হয়েছে।

গোলপাতা প্রধানত ঘরের ছাউনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আদিম পর্ব থেকে কয়েক যুগ আগ অবধি বাংলাদেশের উপকূলীয় জনপদ এবং তৎসংলগ্ন আশপাশের মহকুমা মিলিয়ে বর্তমানের অন্তত ২০ থেকে ২৫টি জেলার বসত-ঘরের প্রধানতম ছাউনি ছিল গোলপাতা। সকল প্রকার ছাউনি, ঘরের বেড়া দেওয়াসহ আমাদের জীবনধারার কৃষ্টির নানান রকম সামগ্রী সৃষ্টিতে গোলপাতার নান্দনিক ভূমিকা ছিল।

১৯৭২ সালে গোলপাতার ছাউনিতে তৈরি হয়েছিল বঙ্গোপসাগরের পাদদেশ পটুয়াখালীর জনতা কলেজ। যা পরবর্তীতে পটুয়াখালী    কৃষি কলেজ হয়ে দক্ষিণবঙ্গের শিক্ষা-সভ্যতার আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত বর্তমান পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। এভাবে গোলপাতার ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের স্বনামধন্য বহু শিক্ষালয় ছাড়াও অগণিত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের হৃদাঙ্গে। সময়ের নানাবিধ স্রোতে গোলপাতার ঘর উল্লেখযোগ্য হারে বিলীন হয়েছে। বলা চলে আধুনিক কালে সোনালি দিনের গৌরবগাথা গোলপাতার ব্যবহার ৭৫ শতাংশই হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে একেবারে উপকূল ঘেঁষা এলাকার আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারে গোলের ঘরের দেখা যায়। আর এ গোলের ঘরের কারণে এখনকার দিনে তাদেরকে অন্যান্য মহলের লোকজন পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে। যে কারণে তারা সামাজিকভাবে অমর্যাদার শিকার হন। তাছাড়া মাছের ঘেরের বাসা, পোলট্রি মুরগির ঘর, কিছুটা গরু-ছাগল-মহিষের গোয়াল ও সুন্দরবনের পেশাজীবীদের নৌকার ছাউনি প্রভৃতি তৈরির ক্ষেত্রে গোলপাতার ব্যবহার চোখে পড়ে। গোলপাতার ঘর উষ্ণতার দিনে শীতল আরাম এবং শীতকালে গরম। গোলপাতার ছাউনি সাধারণত ৩-৫ বছর টেকসই হয়। তারপর সেগুলো অপসারণ করে জ্বালানির কাজে লাগানো হয় এবং নতুন পাতায় আবার ছাউনি গড়ে ওঠে। বরিশালে জন্মগ্রহণ করার সুবাদে হয়তো জীবনানন্দ দাশের ‘গোলপাতা ছাউনির বুক চুমে’ শিরোনামে কবিতা লেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। জাতীয় চেতনার কবি মতিউর রহমান মল্লিকের ছোঁয়ায় সুস্থধারার সাংস্কৃতিক জাগরণের সংগঠন বাগেরহাটের খানজাহান শিল্পীগোষ্ঠীর মুখপত্র হিসেবে গোলপাতা নামের ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। অতীত ঐতিহ্যকে ধারণ করে সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলপাতার ছাউনিতে ক্যাফেটেরিয়া গড়ে তোলা হয়েছে। গোলগাছের কীর্তিমালা এখানেই শেষ নয়... মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি আলাওল একসময় আরাকান রাজসভার কবি ছিলেন। বার্মিজ রাজা বোদোপয়া এই আরাকান রাজ্য জয় করার ফলে সহিংসতা থেকে বাঁচার জন্য আরাকানের রাখাইন সম্প্রদায়ের কিছু সংখ্যক লোক ১৭৮৪ সালে কক্সবাজার ও পটুয়াখালীতে পালিয়ে আসেন। কাল পরম্পরায় রাখাইনদের একটা অংশ এতদঞ্চলে এখনো বসবাস করছেন। এদের  হাত ধরেই উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীতে গোলগাছের রস ও গুড় আবিষ্কৃত হয়ে বিস্তার ঘটেছে। গোলগাছের রস সংগ্রহের প্রস্তুতি স্বরূপ গাছিগণ অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতে গোলফলসহ ডগা বা ডাণ্ডি নুইয়ে দেয়। এসময় মানুষের পা দ্বারা ডাণ্ডিটি আলতো লাথি দিয়ে দোয়ানো বা ম্যাসাজ করা হয় রসে ভার আনয়নের জন্য। এভাবে দুই সপ্তাহ পা দিয়ে মালিশ করার পর ডাণ্ডির মাথা থেকে গোলফলের থোকাটি ধারালো দা দিয়ে এক কোপে কেটে ফেলা হয়। এরপর ডাণ্ডির কাটা অংশটুকু প্রাকৃতিকভাবে ৩-৪ দিন শুকিয়ে নিয়ে পরপর কয়েকদিন দুই বেলা সকাল-বিকেল হালকা করে কাণ্ড চাঁছা হয়। তারপরই ডাণ্ডিতে কাক্সিক্ষত স্বপ্নের রস আসতে শুরু করে। রসোধারা বহমান হওয়ার পর ডাণ্ডির রসোভাণ্ডারে যথানিয়মে একবার চাঁছ দেওয়া হয় রোজ বিকেলে। অগ্রহায়ণ থেকে শুরু হয়ে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত বহমান থাকে এই রস সংগ্রহের ধারা। প্রতিদিন ভোরে গোলবাগান থেকে রস সংগ্রহ করে বাড়িতে এনে ভালোভাবে ছেঁকে নেওয়া হয়। পরে সেগুলো তাফালে ঢেলে অগ্নি-দহনের মাধ্যমে গুড়ে রূপ দেওয়া হয়। খেজুরের রসের তুলনায় গোলের রসের ঘনত্ব দ্বিগুণ। যেখানে খেজুরের ১৬ কলস রসে ১ কলস গুড় হয়, সেখানে গোলের ৮ কলস রসে ১ কলস গুড় পাওয়া যায়। এসব গুড় সাধারণত কেজি প্রতি ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। 

শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে গোলের রস ও গুড়ের মিষ্টতাও বেড়ে যায়। এ রস থেকে শুধুই যে গুড় হয় তা কিন্তু নয়। সুস্বাদু পিঠা-পায়েসও তৈরি করা হয়। তাছাড়া কাঁচা রস খাওয়ার জন্য তো ছোটবড় সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। গোলের রস ও গুড়ের জন্য সবচেয়ে বড় পাইকারি হাট সমুদ্রের ঢেউয়ে দোল খাওয়া পটুয়াখালীর কলাপাতা উপজেলা। এখান থেকেই চাহিদা মতো সারা দেশে ও পার্শ^বর্তী দেশ ভারতে গোলের গুড় সরবরাহ করা হয়। এছাড়া পটুয়াখালীর অন্যান্য উপজেলা ও বরগুনার কিছু অংশজুড়ে গোলের রসের কৃষ্টি বিস্তৃত হয়েছে। গোলের গুড় তৈরির সঙ্গে জড়িত এসব এলাকার শত শত পরিবার। বরগুনার তালতলী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, তালতলী উপজেলায় বছরে অন্তত ১০ হাজার টন গোলের গুড় উৎপাদিত হয়। সুন্দরবনের প্রবেশ দুয়ার বাগেরহাটের মংলা উপজেলার মিঠাখালী ইউনিয়নের খোনকারবেড় গ্রামে বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটের তদারকিতে গোলের গুড় উৎপাদন প্রকল্প চালু করা হয়েছে। কিছুটা নোনতা ভাবযুক্ত গোলের রসে ঔষধিগুণ বিদ্যমান এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি নেই এমন ধারণা পোষণ করেন অনেকে। বিষয়টি নিয়ে অ্যাকাডেমিকভাবে গবেষণা করা প্রয়োজন, তাহলে হয়তো আমাদের জন্য উপকারী অনেক তথ্য-তত্ত্বের ভাণ্ডার মিলতে পারে। গোলগাছের জনপ্রিয়তার কারণে জেলেদের মুখে-মুখে ছড়িয়ে গোলপাতার মতো পিঠের কাঁটাযুক্ত একটি সামুদ্রিক মাছ গোলপাতা নাম ধারণ করেছে। একসময় গোলগাছ থেকে উপকূলীয় এলাকায় খাওয়ার লবণ প্রস্তুত করা হতো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এবং ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় মোটা দানার সেই লবণের চাহিদা বেড়ে যায়। এ কাজে পেশাদারি ব্যক্তিরা সমাজে মলঙ্গী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মলঙ্গী বংশের উৎপত্তিও এভাবে হয়েছে। বর্তমানে বাগেরহাটের রামপাল উপজেলাসহ কিছু-কিছু এলাকায় এই মলঙ্গী বংশের সন্ধান পাওয়া যায়। গোলগাছের উপকারিতার শেষ আছে নাকি? এর মেথিও নাকি রান্না করে খাওয়ার উপযোগী। গোলগাছের শিকড় মাটির ক্ষয় রোধ করে এবং গোলপাতা ঝড়ের গতিবেগ কমিয়ে দেয়। সুন্দরবনের জেলেরা নদীতে জাল ফেলার কালে রশিতে গোলপাতার ডাণ্ডি বেঁধে ভাসনা হিসেবে ব্যবহার করেন। উপকূলীয় জনপদের ছেলেমেয়েরা গোসলের সময় নদী-খাল-বিল-পুকুরে গোলের ভেলায় অনাবিল আনন্দে ভেসে বেড়ায়। 

গোলগাছ মহান স্রষ্টার এক অনন্য সৃষ্টি! এত কিছুর পরেও যদি আমরা গোলগাছের সঠিক মর্মার্থ বুঝতাম, তাহলে সুন্দরবনসহ উপকূলীয় অঞ্চল তথা বাংলাদেশ থেকে গোলগাছ নানামুখী বাধায় ক্রমশই বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হতো না। উল্লেখ্য, গোলগাছ শুধুই যে লবণাক্ত এলাকায় হয় তা কিন্তু নয়, মিষ্টি পানি-কাদায়ও হয়ে থাকে; সেক্ষেত্রে গাছগুলো একটু ধীরগতিতে বিস্তার লাভ করে। আসুন সকলে মিলে মহামূল্যবান সম্পদ গোলগাছ লাগাই, ঐতিহ্যের ধারা জাগাই।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ