জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া ছেলেটি

জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া ছেলেটি

ফিচার আহমেদ বায়েজীদ জুলাই ২০২৩

৮ বছরের নান্টে নাইমি। ক্লাস টু এর ছাত্র। বাড়ি যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাষ্ট্রের হার্লে শহরে। ছোট্ট একটি শহর হার্লে। কয়েক হাজার লোকের বাস। এই শহরেরই হার্লে স্কুল ডিস্ট্রিক্টের অধীন একটি প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র নাইমি।

কিছুদিন আগে পরিবারের সাথে সপ্তাহের শেষে নাইমি বেড়াতে গিয়েছিল পাশের অঙ্গরাষ্ট্র মিশিগানের একটি জঙ্গলে (৫০টি অঙ্গরাষ্ট্র বা স্টেট মিলে গঠিত যুক্তরাষ্ট্র দেশটি)। মিশিগানের পর্কুপাইন মাউন্টেনস ওয়াইল্ডারনেস স্টেট পার্ক নামের জায়গাটি পাহাড়, ঝরনা, জঙ্গল আর লেকের সমন্বয়ে গড়া চমৎকার একটি প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থান। আশপাশের মানুষদের কাছে ছুটি কাটানোর জন্য জায়গাটি খুবই পছন্দের। লেক সুপিরিয়র নামে একটি লেক আছে সেখানে, যার পানি বছরের বেশির ভাগ প্রচণ্ড ঠান্ডায় বরফ হয়ে থাকে। প্রচুর তুষারপাতও হয় অঞ্চলটিতে।

বেশ কিছু হাইকিং ট্রেইল আছে। হাইকিং মানে পাহাড় বা জঙ্গলের ভেতর পায়ে হেঁটে যাত্রা। হাইকিং করার পথকে বলা হয় হাইকিং ট্রেইল। হাইকিং করতে আসা লোকদের কাছে এই পার্কে তাঁবু গেড়ে রাত্রিযাপনও বেশ জনপ্রিয়।

তোমরা নিশ্চয়ই জানো, যুক্তরাষ্ট্রে সাপ্তাহিক ছুটির দিন রবিবার। তাই শনিবার বিকেল থেকেই শুরু হয় তাদের ভাষায় ‘উইকেন্ড’। সপ্তাহ শেষের ছুটির দিনটা উপভোগ করতে নান্টে নাইমি তার পরিবারের সাথে এক শনিবারে চলে যায় পর্কুপাইন মাউন্টেনস ওয়াইল্ডারনেস স্টেট পার্কে।

জঙ্গলের পাশে খোলা জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে রাত কাটানোর আয়োজন করে তারা। জায়গাটিতে প্রচণ্ড ঠান্ডা। বছরের বেশির ভাগ সময়ই সেখানে বরফ পড়ে। তাঁবুর পাশে আগুন জ্বালানোর জন্য নাইমি ও তার পরিবারের লোকেরা শুকনো কাঠ খুঁজতে শুরু করে।

এখান থেকেই বিপত্তির শুরু। কাঠ খুঁজতে খুঁজতে ৮ বছরের নাইমি একা একা অনেক দূরে চলে যায়। যখন তার পরিবারের লোকেরা দেখলো যে, নাইমি নেই- ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আশপাশে কোথাও খুঁজে তাকে পাওয়া গেল না। দ্রুত জরুরি সেবার নম্বরে ফোন করে তারা পুলিশের সাহায্য চায়।

একটি বাচ্চা জঙ্গলে হারিয়ে গেছে শুনে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। বেশ কয়েকটি উদ্ধারকারী দল পাঠায় তারা। নাইমির হারিয়ে যাওয়ার খবরে তার স্কুল কর্তৃপক্ষ ও বন্ধুরা ফেসবুকে পোস্ট করে সবার দোয়া ও সহযোগিতা চায়।

পুলিশ ও স্থানীয় জরুরি সেবা দলের ১৫০ জন সদস্য বিশাল জঙ্গল চষে বেড়ায় নাইমির সন্ধানে। তাদের সাথে ছিল ৯টি উদ্ধারকারী কুকুর। আকাশ থেকে হেলিকপ্টার ও ড্রোনের সাহায্যে জঙ্গলে নজর রাখা হয়। লেকের পানিতে নামানো হয় স্পিডবোট।

শনিবার রাত, রবিবার সারা দিন ও রাত শেষে নাইমিকে পাওয়া গেল সোমবার দুপুর দেড়টার সময়। শেষ পর্যন্ত তাকে পাওয়া যায় তাঁবু থেকে দুই মাইল দূরে এবং দিব্যি সুস্থ অবস্থায়। যা দেখে উদ্ধারকারী দল খুব অবাক হয়েছে।

দুই দিন আগে জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া একটি শিশু সুস্থ থাকতে পারে এটা কারো কল্পনায় ছিল না। এমনিতেই সাথে কোনো খাবার ও পানি ছিল না, তারপর ভয়েই তো কুঁকড়ে যাওয়ার কথা! কিন্তু সাহসী নাইমি ভয়, ক্ষুধা ও প্রচণ্ড ঠান্ডাকে হার মানিয়ে সুস্থভাবেই টিকে ছিল। এমন পরিবেশে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা সময় সে একা কাটিয়েছে।

তাকে প্রথম যে পুলিশ সদস্য দেখতে পেয়েছেন, তিনি জানান- নাইমিকে কোলে করে ফিরিয়ে আনতে চাইলে সে শুরুতে রাজি হয়নি। হেঁটেই আসতে শুরু করে। পুলিশ সদস্যরা খাবার ও পানি দিলে সে জানায়, তার ক্ষুধা নেই।

উদ্ধারকারী পুলিশ সদস্যরা জানিয়েছেন, নাইমিকে যেখানে পাওয়া গেছে সেই জায়গাটি তার তাঁবুর কাছ থেকে একটি ট্রেইলের শেষ মাথায়। ওই খাড়া দুর্গম ট্রেইল ধরে সে হাঁটতে হাঁটতে সেখানে পৌঁছে যায়।

ওই অঞ্চলে সে সময় তাপমাত্রা ছিল ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চারদিকে প্রচুর বরফ জমে গিয়েছে। তার মধ্যে গায়ে সাধারণ একটি হুডি পরেই দুটি দিন কাটিয়েছে নাইমি। পরনে ছিল জিন্স প্যান্ট আর পায়ে বুট। মাটিতে পড়ে থাকা মোটা একটি গাছের নিচে সে দু’টি রাত কাটিয়েছে। রাতে কিছু গাছের ডাল ও পাতা জোগাড় করে গায়ের ওপর চাপিয়েছে। কাছেই একটা জলাশয় ছিল; কিন্তু অসুস্থ হওয়ার ভয়ে সেটার পানি খায়নি নাইমি। বরং আকাশ থেকে পড়া তুষার খেয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করেছে। এ থেকে বোঝা যায়, ছেলেটি যেমন সাহসী তেমনি বুদ্ধিমান।

উদ্ধারকারী দলের সদস্য এলি টালসমা সাংবাদিকদের বলেছেন, আমরা তাকে সোমবার দুপুরে যখন খুঁজে পাই তখন সে পুরোপুরি সুস্থ ও স্বাচ্ছন্দ্য অবস্থায় ছিল। আশপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। আমাদের পেয়েই বিভিন্ন প্রশ্ন করতে শুরু করে।

নান্টে নাইমির মুক্তির খবরে উৎসব শুরু হয় তার শহর ও স্কুল জুড়ে। দুনিয়ার বড়ো বড়ো সব পত্রিকা আর টিভি চ্যানেল তার সাহসিকতার গল্প নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে। সবাই উদ্ধারকারী দলকে ধন্যবাদ দেয়। আর নাইমির প্রশংসা করে সাহসিকতার সাথে জঙ্গলের প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য। কারণ, বিপদে পড়লে হা.. হুতাশ না করে সাহস আর বুদ্ধির সাহায্যে যে বাঁচার চেষ্টা করে সেই তো শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ