ছোটো মামার এক্সপেরিমেন্ট

ছোটো মামার এক্সপেরিমেন্ট

সাইন্স ফিকশন রফিক মুহাম্মদ সেপ্টেম্বর ২০১০

শরতের বিকালটা মারিয়ার খুবই প্রিয়। এ সময় প্রায় প্রতিদিনই সে স্কুল থেকে এসেই ড্রেসটা কোন রকমে চেঞ্জ করে ছাদে ছুটে যায়। ছাদের ছোট্ট বাগানটার গাছগুলো এখন এক্কেবারে সতেজ আর সবুজ। গাছের দিকে তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যায়। শুধু কি তাই শরতের আকাশটাও কত সুন্দর। স্বচ্ছ সুনীল আকাশটায় মেঘের দল ভেসে বেড়াচ্ছে। আকাশটাকে দেখলে মনে হয় কোনো শিল্পীর হাতে আঁকা এক ছবি। মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলে কত রূপে যে ওগুলোকে দেখা যায় তা ভাবতেই মারিয়ার ভালো লাগে। আকাশে উড়ে বেড়ানো মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে মারিয়া দেখে পাল তোলা নৌকা যেন ভেসে বেড়াচ্ছে। মারিয়া ভাবে এই নৌকা কোথায় যাচ্ছে? আবার অন্য একটি মেঘের টুকরোর দিকে তাকালে মনে হয় যেন একটি ঘোড়া ছুটে চলছে। আচ্ছা ওটা কি পঙ্খিরাজ ঘোড়া? বিকেলে ছাদে এসে প্রায় প্রতিদিনই আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘগুলোকে নিয়ে এসব নানা বিষয় ভাবে মারিয়া। ভাবতে যে তার ভালোই লাগে।

গত কয়েক দিন ধরে মারিয়া আর আকাশ নিয়ে, মেঘ নিয়ে ভাবছে না। তার ভাবনার বিষয় এখন গাছ। এই গাছ নিয়ে ভেবে এখন তার প্রতিটি বিকেল কাটছে। ওর সবচেয়ে প্রিয় ছোটো মামা আবিদুর রহমান আবিদ ওকে এই ভাবনার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ছোটো মামা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিষয়ে পড়ছে। সে সারাক্ষণ নানা ধরনের গাছ নিয়ে বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে। এই ছোটো মামার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলেই গত তিন চার দিন হলো ওদের ছাদ বাগানের গোলাপ গাছে তিনটি গোলাপ ফুটেছে। এই তিনটি ফুলের রঙ তিন ধরনের। একই গাছের তিনটি শাখায় তিন রঙের ফুল এটা কী করে সম্ভব হলো? তাছাড়া এখনতো গোলাপ ফুল ফোটার সময় নয়। মাস তিনেক আগে ছোটো মামা এই গোলাপ গাছের দুটি ডালে কীভাবে যেন শিউলি এবং কামিনী ফুলের ডাল বেঁধে দিয়েছিল। মামা তখন বলেছিল, দেখিছ এবার এই গোলাপ গাছে তিন রঙের ফুল ফোটবে। মারিয়ার তখন বিশ্বাস হয়নি। ভেবেছিল মামা তাকে বোকা বানানোর জন্য এসব বলছে। মামাতো মাঝে মাঝেই নানা প্রশ্ন করে, ধাঁধা দিয়ে তাকে বোকা বানায়। এটাও হয়তো সে রকমই তাকে বোকা বানানোর জন্য বলছে। কিন্তু এখন তো দেখছে সত্যি সত্যি একই গোলাপ গাছের তিনটি ডালে তিন রঙের গোলাপ ফুটেছে। একটি ডালে আগের মতোই লাল রঙের গোলাপ ফুটেছে। আর অন্য দুটি ডালের একটিতে শিউলি ফুলের রঙের মতো আর একটি কামিনী ফুলের মতো। এটি দেখে মামাতো ভীষণ খুশি। যেদিন প্রথম ফুল ফুটেছে সেদিনতো মামা মিষ্টি এনে বাড়ির সবাইকে খাইয়েছে। আব্বু আম্মুকে সালাম করে বলেছে, দুলাভাই, আপা আমার এবারের এক্সপেরিমেন্টও সফল হয়েছে। দোয়া করো আমি যেন আমার পরবর্তী যে এক্সপেরিমেন্ট করতে যাচ্ছি তাতে সফল হতে পারি।

মামার পরবর্তী এক্সপেরিমেন্ট কী? মারিয়া সে রাতেই মামাকে ঘিরে ধরে, মামা তোমার পরের এক্সপেরিমেন্ট কী? মামা একটু মুচকি হেসে বলেন সেটা অনেক কঠিন বিষয়রে মা। ওটা তে যদি সফল হতে পারি তাহলে সেটা হবে বিশ্বের সেরা এক আবিষ্কার।

- তাই নাকি! বলো না মামা, সে বিষয়টা কী?

- আজ থেকে দু’তিন শ’ বছর পরের পৃথিবীর কথা চিন্তা করে আমি এই বিষয়টা নিয়ে এক্সপেরিমেন্টের কথা ভাবছি। 

- সে বিষয়টা কী মামা?

- আমার পরবর্তী গবেষণার বিষয় হচ্ছে ‘অক্সিজেন ফ্যাক্টরি’। 

- বলো কি মামা! মারিয়া অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে, তুমি গাছ-গাছড়া নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করো। এখন তা রেখে অক্সিজেন ফ্যাক্টরি বানাবে। সেটা কীভাবে সম্ভব মামা।

- হ্যাঁ, বিষয়টা একটু জটিল এবং কঠিন। তবে অসম্ভব নয়।

- তুমি বলছো কী মামা? আমি তো কিছুই বুঝতেছি না। বিষয়টা আমাকে একটু বুঝিয়ে বলো না?

- তোকে বোঝাতে হলে তো আমাকে এখন অনেক কিছু বলতে হবে। আচ্ছা তাহলে শোন বলছি। তবে বিষয়টা কিন্তু খুবই সিক্রেট। এখনই এটা কাউকে বলা যাবে না। এমনকি তোর আব্বু-আম্মুকেও নয়। ঠিক আছে?

- ঠিক আছে মামা, আমি কাউকে কিচ্ছু বলবো না।

- শোন তাহলে। আচ্ছা তোদের বাগানে একটি গোলাপ গাছে তিন রঙের ফুল ফুটেছে তা তো দেখেছিস?

- হ্যাঁ দেখেছি, এবং অবাক হয়ে ভাবছি এটা তুমি কীভাবে করলে।

- এটা হলো কলম পদ্ধতি। এক গাছের ডাল অন্য গাছের সাথে জোড়া দিয়ে তৈরি করেছি। তেমনিভাবে আমাদের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বিলুপ্ত প্রায় অনেক মাছের জাতকে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে নতুন করে আবিষ্কার করেছে। এক জাতের ফলের সাথে অন্য জাতের ফলের কৃত্রিম সংমিশ্রণের মাধ্যমে আরও উন্নত এবং বড়ো আকারের ফল আবিষ্কার করেছে। যেগুলোকে আমরা হাইব্রিড বলি। এই হাইব্রিড জাতের ফল বা সবজির ফলনও বেশি হয় আবার পুষ্টিগুণেও সমৃদ্ধ। আবার খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে উন্নত ধানের জাতও আবিষ্কার করছে। ব্রি-২৮, ব্রি ২৯ এসব ধানের ফলন অনেক বেশি এবং সময়ও কম লাগছে। এসব বিভিন্ন বিষয়ে সফলতার পর আমি এখন নতুন এই বিষয়টি নিয়ে ভাবছি। গাছতো আমাদের অক্সিজেন দেয় সেটাতো তুই জানিস?

- হ্যাঁ জানি?

- তাহলে গাছকে আমরা অক্সিজেন ফ্যাক্টরি বলতে পারি তাই না?

- হ্যাঁ এক অর্থে তো তাই।

- গাছ কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে, আর অক্সিজেন ত্যাগ করে তাই না?

- হ্যাঁ মামা।

- বর্তমানে সারা বিশ্বে জলবায়ুর যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটছে। শিল্পায়ন অর্থাৎ কলকারখানা যে হারে বৃদ্ধি পেয়ে পরিবেশের দূষণ হচ্ছে, বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়ছে। তাতে প্রকৃতি হুমকির মুখে পড়েছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে দাবদাহে পুড়ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। আবার অনেক দেশে অনাবৃষ্টি, খরা। অনেক দেশ ঝড়, প্রবল বর্ষণ, বন্যায় বিপর্যস্ত। এসব কারণে খাদ্য উৎপাদন ক্রমেই ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। গাছপালা বন উজাড় হচ্ছে। এতে আগামী কয়েক শতাব্দী পরে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে ফসলি জমিগুলো মরুভূমি হয়ে যাবে। তখন খাবারের অভাবে কোটি কোটি মানুষ মারা যাবে। এমন এক ভয়াবহ দুর্যোগময় সময়ের মুখোমুখি যাতে মানুষকে পড়তে না হয় সে জন্যই আমি এ নিয়ে গবেষণা করতে চাচ্ছি। যদি এমন গাছ আবিষ্কার করতে পারি যে গাছ বর্তমানে যে পরিমাণ অক্সিজেন ত্যাগ করে সেটা তার চেয়ে ১০ গুণ, ২০ গুণ বেশি অক্সিজেন দেবে। অর্থাৎ প্রতিটি গাছ হবে একেকটা অক্সিজেন ফ্যাক্টরি। এ ধরনের অক্সিজেন ফ্যক্টরি শহরের প্রতিটি বাড়ির ছাদে থাকবে। গ্রামে-গঞ্জে সবখানে প্রচুর পরিমাণে থাকবে। তাহলে এই পৃথিবী থাকবে সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা। এক সুন্দর নির্মল পৃথিবীতে বাস করতে পারবে আমাদের আগামী প্রজন্ম।

ছোটো মামার নতুন এক্সপেরিমেন্টের বিষয়টি জানার পর থেকে মারিয়ার চোখে ঘুম নেই। সে শুধু ভেবেই চলছে। আচ্ছা মামাতো বলেছে কোন গাছের পাতায় বেশি ক্লোরোফিল আছে, কোন গাছের পাতা বেশি অক্সিজেন দেয় সেটা আগে খুঁজে বের করতে হবে। এ ব্যাপারে মারিয়াকেও সাহায্য করতে বলেছে ছোটো মামা। কিন্তু মারিয়া কীভাবে ছোটো মামাকে সহায্য করবে? সে তো ভালো করে গাছই চেনে না। ওদের বাগানে থাকা গোলাপ গাছ, পেয়ারা গাছ আর লেবু গাছ দেখেছে সে। এ ছাড়া দাদু বাড়ি গেলে পুকুর পাড়ে বড়ো বড়ো আম গাছ আর জাম গাছ দেখে। এ ছাড়া অন্য গাছতো সে চেনে না। যাই হোক ছোটো মামাতো বলেছে সে যেখানে যাবে সেখান থেকে যেন গাছের পাতা নিয়ে আসে। মামা সব ধরনের পাতা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে নতুন অক্সিজেনের ফ্যাক্টরি তৈরি করবে। আর সেই অক্সিজেন ফ্যাক্টরির মাধ্যমে এই পৃথিবী থাকবে সুন্দর ও নিরাপদ। এসব ভাবতে ভাবতে মারিয়া পড়ার টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ে। 

মারিয়া এক নদীর পাড় দিয়ে হাঁটছে। স্বচ্ছ টলটলে পানি বয়ে যাচ্ছে নদীতে। নদীর স্রােতের উজানে যাচ্ছে একদল হাঁস। নদীর পাড়ের রাস্তায় গাঢ় সবুজ রঙের পাতার গাছ। না না এগুলো হলো ছোটো মামার অক্সিজেন ফ্যাক্টরি। নদীর ওপারে কাশবন। শাদা কাশবন কী সুন্দর বাতাসে দুলছে। মহান আল্লাহ এই পৃথিবীকে কত সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন। মারিয়া মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। যে দিকে চোখ যায় তার সৃষ্টির অপার সৌন্দর্য চোখে পড়ে। অথচ আমরা নির্বিচারে গাছ কেটে, নানাভাবে প্রকৃতিকে ধ্বংস করছি। আর তা করে আমরা আমাদের বিপদের মধ্যে ফেলে দিচ্ছি। ছোটো মামা এই পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে যে নতুন অক্সিজেন ফ্যাক্টরি আবিষ্কার করছে তা সত্যিই মানুষের জন্য বড়ো কল্যাণকর হবে। আর এই কল্যাণকর কাজে সে ছোটো মামাকে সাধ্যমত সাহায্য করবে। হিপ হিপ হুররে, ছোটো মামা জিন্দাবাদ।

মারিয়া.. এই মারিয়া পড়ার টেবিলে এভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিস? ওঠ... ওঠ...। মায়ের ডাকে ঘুম থেকে ওঠে মারিয়া। মাকে জিজ্ঞেস করে ছোটো মামা কোথায়?

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ