ঘুড়ি

ঘুড়ি

উপন্যাস জুলাই ২০১২

কাজী মাসুম বিল্লাহ্...
সুতাটা ধরতো।
আমি হাত বাড়িয়ে সুতা ধরলাম।
একটু দূরে সরে দাঁড়া।
আমি সুতাটা দুই হাতে ধরে অনেকটা দূরে সরে দাঁড়ালাম। ও সুতা নাটাইতে প্যাঁচাতে লাগলো। সুতার কার্টিসের মাঝখানে একটি ছোট কাঠি ঢুকিয়ে সেটাকে দুই হাতে ধরে ঘোরাতে সুবিধা করে দিলাম। ও নাটাইতে সুতা প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে একটা নারকেলগাছের গোড়ায় গিয়ে বসলো। ওর বসা দেখে আমিও পেছনে ঘুরে তাকালাম। পড়ে থাকা একটি গাছের গুঁড়ি দেখতে পেলাম। আমি সেদিকটায় এগিয়ে গেলাম। গাছের উপরটা হালকাভাবে ঝেড়ে সেখানে বসলাম।
আমি সুতা ছাড়ছি আর ও সুতা প্যাঁচাচ্ছে। সুতা প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে ও আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তোর নাম কিরে?
আমার মুখে একটু হাসি ফুটে উঠলো। অনেকক্ষণ এখানে বসে আছি কিন্তু ও আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করছিল না। আমি জবাব দিলাম, মিলন। তবে সবাই আমাকে মিলু বলে ডাকে।
মিলু, না? তুইতো এই বাসায় বেড়াতে এসেছিস, তাই না?
আমি মাথাটা উপরে-নিচে নাড়লাম।
কী হয় তোর? আবার জিজ্ঞেস করল।
আমি বললাম, খালা বাড়ি। আপনার নাম কী?
সে কোনো জবাব দিলো না। আমি তার উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলাম।
কিরে মিতা, কী খবর? কথা শুনে ডানে ঘুরে তাকালাম। মোটাসোটা একটি ছেলে এগিয়ে আসছে। নাটাই ঘোরাতে ঘোরাতে জবাব দিলো, তোকে আমি সেই সকাল থেকে খুঁজছি। এই বুঝি তোর আসার সময় হলো? মোটা ছেলেটি প্রতিবাদ করে জবাব দিলো, আমার তো আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই সেই সকাল থেকে তোর এখানে এসে বসে থাকি। কথা বলতে বলতে মোটা ছেলেটি আমার পাশে গাছের গুঁড়ির ওপরে বসলো। বসেই জানতে চাইলো, এই ছেলেটি কে রে? একে তো আগে কখনও দেখিনি?
লিপিদের বাসায় বেড়াতে এসেছে।
এবার আমাকে উদ্দেশ করে মোটকু জিজ্ঞেস করলো, লিপি কী হয়?
খালাতো বোন।
কালু খুঁজতে শুরু করলো। আমিও খুঁজলাম। এদিক-ওদিকে তাকিয়ে যখন আমি দেখতে পেলাম ঘুড়িটা আমার পায়ের নিচে, তখন আমি সেটাকে একপাশে ঠেলে দিয়ে চুপ করে বসে রইলাম যাতে ওরা না দেখতে পায়। কালু আমার সামনা-সামনি থাকায় সেটাকে দেখতে ওর বেশি দেরি হলো না। উঠে এসে ঘুড়িটা হাতে নিয়ে দেখলো একজায়গা থেকে হালকা ছিঁড়ে গেছে। আমি অবশ্য দেখতে পাইনি, দেখলে এমনটি করতাম না। সে কথা কে শোনে? ওরা দু’জন আমাকে ভীষণভাবে বকাবকি শুরু করে দিলো। মোটকু আমার দিকে এগিয়ে এলো মারবে বলে। কালু ওকে থামিয়ে দিলো। আমি পাশে সরে গেলাম। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো।
ওরা ঘুড়িটি কত কষ্ট করে তৈরি করেছে! আর আমি সেটাকে ছিঁড়ে ফেললাম! কালু সেটাকে নিয়ে মাটিতে বসে আবার ঠিক করতে লাগলো। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে কোনোরকমে ঠিক করলো। আমি দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কাছেও এলাম না আবার চলেও গেলাম না। পেছন থেকে কেউ একজন কালুকে ডাকছে শুনতে পেলাম। আমার খালা। কালুকে উদ্দেশ করে বলল, ওকে খেলতে নিস। ও কিন্তু তোদের খালাতো ভাই।
কালু খালার কাছে নালিশ ছুড়ে দিলো, কাকি দেখেন ও আমার ঘুড়িটা ছিঁড়ে দিয়েছে।
না খালা আমি ইচ্ছে করে ছিঁড়িনি। আমি ওটাকে দেখতে পাইনি।
খালা এগিয়ে এলেন। কই দেখি। কোন্ জায়গা থেকে ছিঁড়েছে?
কালু বলল, কাকি আমরা ঠিক করে ফেলেছি।
তাহলে আবার সমস্যা কী? ও তো দেখতে পায়নি তাই না? এক জায়গায় থাকলে একটু আধটু সমস্যা হবেই। মিলু তুমি ওদের সাথে থেক। এ কথা বলে খালা চলে গেলেন।
আমি সেখানে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলাম। ওরা নাটাই ঘুড়ি নিয়ে মাঠের দিকে এগিয়ে চলল। আমি ওদের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করলাম। মোটকু খেপে গেল। দূরে থাক দূরে দশ হাত দূরে থাকবি। আবার কোন্ সমস্যা বাধিয়ে ফেলে কে জানে!
আমারও তাই মনে হল কখন কী সমস্যা বাধিয়ে ফেলি কে জানে। দূরেই দাঁড়িয়ে রইলাম।
আমাকে না ডেকে কালু মোটকুকে দিয়ে সুতার কার্টিস ধরাল। আমার জায়গাটিতেই বসলো মোটকু। কালু তার জায়গাতে। মোটকু আমাকে উদ্দেশ করে বললো, দ্যাখ এখনো দাঁড়িয়ে আছে। ওরা হাসতে শুরু করলো।
আমি অন্য দিকে ঘুরে তাকালাম। ওদের দেখছি না, এমন ভাব করলাম।
অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। আয় এদিকে আয়।
আমি কালুর দিকে ঘুরে তাকালাম। মনের অজান্তেই মুখে একটু হাসি ফুটে উঠলো।
মোটকু বলে ফেলল, ইস, কী সুন্দর হাসি! আ হা হা। দেখলে পরান জুড়িয়ে যায়।
আমি আবার অন্য দিকে ঘুরে তাকালাম। মুখ থেকে হাসি ফুরিয়ে গেল।
কালু মোটকুকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলো। মোটকু আর কোনো কথা বললো না। আসলে মোটকুটা যে কেন কালুর মতো হলো না। আমি এদিকে ওদিকে তাকাতে তাকাতে সেখান থেকে ঘরে ফিরে এলাম। ঘরে কেউ নেই। সব ফাঁকা।
সামনের বারান্দায় শুয়ে রইলাম।
আমার বন্ধু রাকিব। আজ যদি ও এখানে থাকতো তবে ওদের দু’জনকেই মেরে আলুভর্তা বানিয়ে দিতো। একবার আমাকে একটি ছেলে হুমকি দিয়েছিল তারপর রাকিব যখন বিষয়টি জানতে পারলো তখন ছেলেটিকে যা মারলো তা ভাষায়...
কী অবস্থা? তুই এখানে শুয়ে আছিস কেন? ওরা কোথায়?
আমার ধ্যান ভঙ্গ হলো, চটজলদি উঠে বসলাম। ওরা আমাকে...।
কোথায় ওরা? খালার এমন অবস্থা দেখে আমিও ভয় পেয়ে গেলাম। জানি না! মুখ থেকে বেরিয়ে গেল।
দাঁড়া, আমি একটু আসছি। খালা এ কথা বলে আমার সামনে থেকে চলে গেল। আমি বুকের ওপর হাত দিলাম। এখনও ধুকধুক করছে। একবার উঁকি দিয়ে দেখলাম খালা কতদূর গেল। নাহ, দেখা যাচ্ছে না। বিছানা থেকে নেমে দরজা পেরিয়ে সোজা সামনে হাঁটতে লাগলাম। উঠোন পেরিয়ে সামনে একটি সুপারি বাগান তারপর ধানক্ষেত। ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে সজোরে হাঁটতে লাগলাম। সূর্য অনেকটা পশ্চিমে। তারপরও রোদটা মাথায় লাগে।
অদূরে একটি বাগান। সেটাকে লক্ষ্য করে হাঁটলাম। পথ এগুচ্ছে না দেখে ছোট্ট করে দৌড় দিলাম। একবার পেছনে ঘুরে তাকালাম। কেউ আমাকে দেখছে কি না। ডান দিক থেকে মিলু বলে ডাক শুনলাম। আমার খালাতো বোন। স্কুল থেকে আসছে। গুরুত্ব দিলাম না। সামনে এগিয়ে গেলাম। বাগানের কাছাকাছি চলে এলাম। সেখানে দু’টি ছেলে আমার চোখে পড়লো। অপরিচিত নয়। কালু আর মোটকু। মোটকু আমাকে দেখে চ্যাঁচাতে লাগলো, দেখ দেখ আবার এখানে আসছে।
আমি শুনেও শুনলাম না। সামনে এগিয়ে গেলাম। মোটামুটি বড় একটি আমগাছ। সেটাতে উঠে বসলাম। আমি জানতাম এটা লিপিদের বাগান। তাই ওদেরকে শুনিয়ে বললাম, আমি অন্য কারো জায়গায় আসিনি। এটা আমার খালার জায়গা।
মোটকু আমার কথার জবাব দিলো, দেখ দেখ ও ওর খালার জমির বাহাদুরি দেখাচ্ছে।
কালু বলল, থামতো। তুই বেশি বাড়াবাড়ি করছিস। ও ওর খালার জায়গায় বসে থাকলে আমাদের কোনো সমস্যা আছে?
আমি বসে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম। মাঝে মাঝে আড়চোখে ওদের দেখলাম। প্রচণ্ড বাতাস, গাছে বসে আমার খুব ভালো লাগছিলো। আড় চোখে তাকালাম ওরা কী করে সেটা দেখার উদ্দেশ্যে। মোটকু ঘুড়ি নিয়ে মাঠের দিকে এগিয়ে চলল। নাটাই হাতে দাঁড়িয়ে রইলো কালু। মোটকু চিৎকার করে বললো, সুতা ছাড়িস না কেন?
কালু বললো, দাঁড়া, ছাড়ছি। এত ব্যস্ত হলে চলবে!
ওরা আমার দিকে তাকাচ্ছে না দেখে আমি ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মোটকু ঘুড়িটাকে দুই হাত দিয়ে উপরের দিকে ছুড়ে মারলো। নাটাই নিয়ে পেছনের দিকে ছুটে গেল কালু। ঘুড়িটা আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠতে লাগলো। মনের ভেতর এক অজানা অনন্দ অনুভব করলাম। তাকিয়ে রইলাম ঘুড়িটার দিকে। মনের আনন্দে ঘুড়িটা এদিকে ওদিকে বারবার পাক খাচ্ছে। পাশ থেকে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম হয়তো ওরা ঘুড়িটিকে বন্ধু হিসেবে মেনে নিয়েছে। পাখিদের জগতে ঘুড়িটি নতুন হলেও ভালভাবে উড়তে না পারলেও পাখিরা কিছু মনে করছে না। আর মোটকু? ওতো আমাকে দেখতেই পারে না।
ঘুড়িটা আমি এখন আর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না। গাছের পাতার কারণে দেখতে অসুবিধা হচ্ছে। আমি গাছ থেকে নামলাম। নেমে ধানক্ষেতের পাশে গিয়ে বসলাম। দেখতে দেখতে ঘুড়িটি অনেক উপরে উঠে গেল। কালু সুতা ছাড়ছে না দেখে মোটকু বললো, সুতা ছাড়, যা আছে সব সুতা ছাড়বি। আজকে ঘুড়ি মেঘের উপরে উঠাবো। যা আছে কপালে!
সব সুতা ছেড়ে ওরা বাগানের পাশে এসে বসে রইলো। ঘুড়ি তার আপনমনে উপরে উড়তে লাগলো।
বেলা পড়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে বাতাস কমে আসছে। মোটকু চেচিয়ে উঠলো, সুতা টান, ঘুড়ি পড়ে যাচ্ছে। ওরা দুজন সুতা টানতে থাকলো। উপায় হলো না, শেষ পর্যন্ত ঘুড়িটা পাক খেয়ে একটি আমগাছের ওপরে পড়লো।
কালু দাঁড়িয়ে রইলো। মোটকু দৌড়ে গেল গাছটির কাছে। আমিও গাছটির দিকে ছুটলাম। কিভাবে পড়লো সেটা দেখার জন্য গাছটি কম দূরে নয় যখন দৌড়াচ্ছিলাম তখন টের পাচ্ছিলাম। অনেক পথ দৌড়ে আমরা গাছটির কাছে পৌঁছালাম। মোটকু ঘুড়িটাকে গাছের উপরে খুঁজছিল। আমি দেখলাম ঘুড়িটা গাছে নয় গাছের উপরে শুধু সুতা আর ঘুড়ি গাছ ওভার করে অদূরে মাঠের ওপরে। আমি ওকে বললাম, ভাইয়া ঘুড়িটা গাছে নয়, ওই যে।
মোটকু আমার কথা মত সেদিকে তাকাল। ঘুড়িটা দেখতে পেয়ে ও সেদিকে দৌড়ে গেল। সামান্য বাতাস ছেড়েছে। আমরা ঘুড়িটার কাছে গেলাম। সেখান থেকে কালুকে দেখা যাচ্ছে না। আমি মোটকুকে বললাম, ভাইয়া আপনি এখানে দাঁড়ান, আমি ওদিকে এগিয়ে কালু ভাইয়াকে সুতা টানতে বলবো আর তখন আপনি ঘুড়িটা উপরের দিকে ছুড়ে মারবেন। মোটকুর উত্তরের অপেক্ষা আমি করলাম না। সোজা যে পথে এসেছি সেই পথের দিকে ছুটলাম। কিছুদূর এগিয়ে কালুকে উদ্দেশ করে বললাম, কালু ভাইয়া, আপনি সুতা টানুন। তাহলে ঘুড়ি উপরে উঠবে।
বুঝতে পারলাম শুনতে পায়নি। তাই মুখের সামনে মাইকের মত করে হাত দিয়ে তারপর বললাম। এবার সে শুনতে পেল। পেছনে ঘুরে মোটকুকে বললাম, আপনি এবার ওটাকে উপরে ছেড়ে দিন। ঘুড়িটি উপরে উঠতে শুরু করলো। কিন্তু বাতাস বন্ধ হওয়ার কারণে ঘুড়িটি উঠে আবার পড়ে গেল। আমি গলা ছেড়ে কালু ভাইয়াকে বললাম, ভাইয়া বাতাস ছাড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
কিছুক্ষণ পর বাতাস ছাড়লো। তখন আমার বলার আগেই আমি দেখতে পেলাম মোটকু ঘুড়িটি উপরে ছেড়ে দিয়েছে। কালু সুতা টানতে শুরু করেছে। একটাই ভয়, গাছটির ডালে সুতাটি আটকে না যায়।
ঘুড়িটা আস্তে আস্তে উপরে উঠছে, আমার উত্তেজনাও বাড়ছে। এদিক সেদিক দৌড়াতে থাকলাম। ঘুড়িটি উপরে ওঠার কারণে আস্তে আস্তে গাছটির উপর থেকে সুতা উপরে উঠতে শুরু করলো। আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলাম। উঠছে উঠছে.... উঠছে... হ্যাঁ এইতো। ঘুড়িটি উপরে উঠে গেল। আমি একবার মোটকুর দিকে তাকালাম। ও ওখানে নেই। কোথায় গেল? এদিক- সেদিক তাকাতে লাগলাম। নাহ! কালুর দিকে তাকালাম। হ্যাঁ, ওইতো মোটকু দৌড়ে মাঠের মাঝামাঝি চলে গেছে। আমি আর দেরি করলাম না। দৌড়াতে থাকলাম।
মোটকু কালুর কাছে পৌঁছে গেছে। কালু আর মোটকু ঘুড়িটাকে দেখছে আর আনন্দে লাফাচ্ছে। ওদের লাফালাফি দেখে আমি দৌড়াতে দৌড়াতে পেছনে ঘাড় ঘুড়িয়ে ঘুড়িটার দিকে তাকালাম। ঘুড়িটা অনেক ওপরে উঠেছে। ঘুড়ি দেখতে গিয়ে আমি ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলাম। উঠে বসলাম। কিসের সাথে পায়ে লেগেছিল সেটাকে খুঁজলাম। একটি ইটের টুকরা। ওরা কেউ দেখে ফেলেনিতো? প্রশ্নটা মনে জাগতেই আমি ওদের দিকে ঘুরে তাকালাম। ওরা দু’জন আমার থেকে অনেকটা দূরে। তারপরও আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে ওরা আমাকে দেখে হাসছে। মাথার ডান পাশটাতে সামান্য ব্যথা অনুভূত হতেই আমি হাত দিয়ে পরীক্ষা করলাম। তেমন কিছু বুঝতে পারলাম না। ওরা হাসছে তাই খুব দ্রুত উঠে বসলাম। আমার কিছুই হয়নি ভান করে আবার দৌড়াতে শুরু করলাম। ওদের কাছাকাছি চলে আসতেই মোটকু বলে উঠলো, ধপাস! তারপরে আবার হাসতে শুরু করে দিলো।
কালুও এবার ওর হাসির সাথে যোগ দিলো।
আমি বললাম, তেমন একটা ব্যথা পাইনি।
তেমন একটা ব্যথা পাইনি! মুখ ভেংচিয়ে দিলো মোটকু। কেউ ব্যথা পেলে বলে যে আমি ব্যথা পেয়েছি? ওরা আবার হাসতে শুরু করলো।
আমিও ওদের হাসির সঙ্গে যোগ দিয়ে হাসতে থাকলাম আর বললাম, তোমাদেরকে আমি যদি বলি যে আমি ব্যথা পাইনি তাহলে মনে হয় আমি ব্যথা পেলেও আমার ব্যথা ভালো হয়ে যাবে?
আবার বাতাস ছাড়ার কারণে ঘুড়ি অনেক উপরে উঠে গিয়েছে। সুতা যা ছিল সব ছেড়ে দিয়েছে কালু। মোটকু বলছে, আর মনে হয় বাতাস বন্ধ হবে না।
ওরা ঘুড়ির দিকে মনোযোগ দিলো, আমার কথা শুনলো না। আমিও ওদের মতো ঘুড়ির দিকে মনোযোগ দিলাম। কত উপরে ঘুড়িটা উড়ছে! ও হয়তো আমাদের বাড়ি দেখতে পাচ্ছে। বাড়িতে এখন কেউ নেই। মা নেই বাবা নেই। মার এখন কী অবস্থা কে জানে! কাল অপারেশন হবে। মা আমাকে দেখতে চেয়েছিল। আমারও কেমন যেন মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কত কাঁদলাম ‘মা আমাকে নিয়ে যাও’। মা আমাকে নিতেও চেয়েছিল কিন্তু আমার দাদি আমাকে রেখে যেতে বলল। আমাকে শেষ পর্যন্ত যেতেই দিলো না। মা তুমি কি আমাকে স্মরণ করছো? কেমন আছো তুমি? কেন তোমাকে অসুখে ধরেছে? কে দেয় অসুখ?
আমার কানে কিছু একটা লেগেছে। মনে হলো যেন আমার কান ছিঁড়ে গেছে। পেছনে ঘুরে তাকালাম। মোটকুর হাতে নাটাই, ও ঘুড়ির সুতাটা আমার কানে লাগিয়ে দিয়েছে। হাত দিয়ে পরীক্ষা করলাম, কান কাটেনিতো? ওরা দু’জন আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
কী ভাবছিস, অ্যাঁ? আমাকে প্রশ্ন করলো মোটকু।
হাত দিয়ে চোখের পানি মুছলাম। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। কিছু বললাম না। একপাশে সরে গেলাম। লিপি আমাকে ডাকছে। সাড়া দিলাম না।
কালু আমাকে উদ্দেশ করে বলল, তোকে ডাকছে শুনতে পাচ্ছিস? আমি কোন জবাব দিলাম না।
লিপি ডাকতে ডাকতে আমাদের দিকে আসছিল। আমি ভালো একটি জায়গা দেখে বসলাম। দেখতে দেখতে ও আমাদের কাছে চলে এলো। ভাইয়া তোমাকে মা ডাকছে?
আমি বললাম, তুই যা আমি আসছি।
কালু ভাইয়া ঘুড়িটা তো অনেক উপরে। লিপি কালুকে উদ্দেশ করে বলল।
কালু বলল, কাল কাঁঠালতলির হাট থেকে সুতা এনেছিতো!
লিপি বলল, ভাইয়া তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু। বলে চলে গেল।
আমি বসে রইলাম। মনটা ভালোই লাগছে না। বারবার মায়ের কথা মনে পড়ছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। চারদিকটায় একবার তাকিয়ে তারপর বাড়ির দিকে যেতে উদ্যত হলাম। আস্তে আস্তে এক পা দু’পা করে হাঁটছি।
পূর্বের মতো কানে কিছু লেগেছে টের পেলাম। এবার তেমন লাগেনি। কিন্তু নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। ওদের দিকে ঘুরে তাকালাম। দু’জনেই হাসছে। মোটকু বলল, দেখ দেখ আমাদের দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! ওই, এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছিস কেন?
একদম সহ্য হলো না। ছুটে গেলাম মোটকুর দিকে। ও দুপা পেছনে সরে গেল। আমি বিলম্ব না করে ওর নাকের ওপরে বসিয়ে দিলাম এক ঘুষি। ও নাটাইটা ছুড়ে দিয়ে আমার দিকে তেড়ে এলো।
এসব কী হচ্ছে? পাশে বসে চেঁচাচ্ছিল কালু। ওর কথা কে শোনে? আমিও নাছোড়বান্দা। জড়িয়ে ধরলাম মোটকুকে। পায়ে প্যাঁচ মেরে ফেলে দিলাম মাঠের মধ্যে। মোটা শরীর তাই ও আর তেমন নড়াচড়া করতে পারলো না। আমি ওর পেটের ওপরে বসে মনের মত মারলাম।
কালু কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। কাছেও আসছিল না। আমার সাথে ফাজলামো করিস? আজ তোর...।
কালু আমাকে বাঁচা, কালু দোস্ত, কালু!
কালু কিছুই করছিল না। আমি বললাম, বল আর ফাজলামো করবি? বল!
শেষ পর্যন্ত ও আমার কাছে ক্ষমা চাইলো। আমি ওকে ছেড়ে দিয়ে পাশে দাঁড়ালাম। মোটকু খানিকটা কেঁদে ফেলল।
আমার সাথে ফের যদি... তবে আমি একটাকেও ছাড় দেব না, মনে রাখিস।
মোটকুর নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম। মোটকু মুখে হাত দিয়ে সামনে এনে দেখলো রক্ত। ও সজোরে চিৎকার দিলো। আমি কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। কালু এগিয়ে এলো। এ যে রক্ত! হায় হায়!
মোটকু আমাকে বলল, তোকে আমি খুন করবো। তুই আমার নাক দিয়ে রক্ত বের করে দিয়েছিস।
কালু মোটকুর দিকে এগিয়ে গেল। তুই আমার দিকে আসবি না। তুই আমার বন্ধু না।
কালু আমার দিকে তেড়ে এলো। আমিও ওকে ধরলাম। কিন্তু ও মোটকুর মতো অতো সহজ নয়। ও আমাকে মাঠে ফেলে দিলো। আমি শত চেষ্টা করেও আর উপরে উঠতে পারলাম না। মোটকুও এসে আমাকে ইচ্ছে মত ধোলাই দিলো। ওরা দু’জনই আমার বুকের ওপর বসে আমাকে মারতে লাগলো। আমিও ইচ্ছে মত হাত পা ছুড়লাম। কিন্তু তাতে তেমন কোনো ফল হলো না।
কেউ একজন চিৎকার দিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কারা ওখানে, কী হচ্ছে?
কালু ঘুরে তাকাল। মোটকুকে টেনে তুলে বলল, লোক আসছে। পালা!
মোটকু বলল, আসুক লোক। আমি ভয় পাই না।
কালু মোটকুকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। আমি মাঠের ভেতর শুয়ে রইলাম।
একজন মহিলা চিৎকার দিয়ে বলছে, পালাচ্ছিস কেন? দাঁড়া, দাঁড়া বলছি।
ওরা দাঁড়ালো না। মহিলা আমার কাছে এসে আমাকে দেখে হাত ধরে তুললো। এই, তুমি কে? ওরা তোমাকে মারছিল কেন?
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম।
আরে আরে কাঁদে কেন, থামো! আমি এসেছি না। তোমাকে কেউ কিছু বলবে না।
লিপি আবার আমাকে ডাকছে। ডাক শুনে মহিলা সেদিকে তাকালো। মাঠের ওই প্রান্তে। ভালো দেখা যাচ্ছে না।
তোমার বাড়ি কোথায়?
আমি কাঁদতে কাঁদতে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলাম।
তোমাকে তো আমি কখনও ওই বাড়িতে দেখিনি। কী হয় তোমার?
খালা বাড়ি।
তোমার খালুর নাম কী?
জানি না।
চল তোমাকে আমি দিয়ে আসি। এ কথা বলে তিনি আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে শুরু করলেন। ওরা তোমাকে কেন মারছিল? কী করেছিলে তুমি?
আমি কিছু করিনি। ওরা আমাকে শুধু শুধু মারছিল।
লিপি আমাদের কাছাকাছি চলে এসেছে। ও আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। মহিলা লিপিকে দেখামাত্র জিজ্ঞেস করলো, একে চেন?
লিপি বলল, কী হয়েছে কাকি?
তিনি বলতে লাগলেন, ছোট মানুষ তোরা। একসাথে খেলবি তা না। তোরা করিস মারামারি। কী যে অবস্থা!

অনেক রাত হয়েছে। এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি কালু আর মোটকুকে। একজনও ঘরে ফেরেনি। সবাই খুঁজছে ওদের। আমার কাছে বারবার একই প্রশ্ন করা হচ্ছিল, ওরা তোকে কেন মেরেছে? আমার একটাই উত্তর- ওরা আমাকে বাড়ি যেতে বলেছে আমি যাইনি তাই। তারপরে আবার প্রশ্ন, তোকে কেন বাড়ি যেতে বলবে? আমি ঘুড়ি ওড়াতে পারি না তাই। উত্তর দিলে প্রশ্ন আরো বেড়ে যায়। তাই চুপ করে থাকাটা নিরাপদ মনে হলো।
বারান্দা থেকে ঘরে উঁকি দিলাম। কেউ নেই। সামনের দরজার দিকে এদিয়ে গেলাম, বাইরেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। খুব আস্তে ডাক দিলাম, লিপি?
কোনো সাড়া শব্দ এলো না। নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হতে লাগলো। আমার জন্যই আজ ওদের এই দুর্দশা। আবার মনে মনে শান্তিও পাচ্ছিলাম যাক ওদের একটা উচিত শিক্ষা হলো।
ঘর থেকে নেমে সামনে এগোলাম। অদূরে কেউ একজন কালু বলে ডাক দিলো শুনতে পেলাম। খুঁজে না পেয়ে হয়তো ডাকাডাকি করছে। আমার কী করার আমি তো অপরাধ করিনি!
ডান দিকে কিসের যেন শব্দ হল। ঘুরে দাঁড়ালাম। কে? কে ওখানে?...
কোনো সাড়াশব্দ এলো না। আমি খানিকটা ভয়ও পেয়ে গেলাম। ঘুরেই ঘরের দরজার দিকে যেতে শুরু করলাম।
মিলন!
আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। কে?
দু’টি ছেলে দৌড়ে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরলো। ওদের চিনতে আমার বেশি বেগ পেতে হলো না। কালু প্রচণ্ড কাঁপছে। মোটকুও।
আমি কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কালু আমাকে উদ্দেশ করে বলছে, মিলন, আমরা ভুল করেছি ভাই, আমাদেরকে মাফ করে দে। আমরা আর জীবনে এমন কাজ করবো না।
কথা বলতে বলতে ঘরের ওপাশ থেকে কেউ আসছে। আমিও এরকম কারো অপেক্ষায় ছিলাম। দু’জন মহিলা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। কালু মোটকু আমার পা ছেড়ে দিয়ে পালাতে উদ্যত হলে আমি ওদেরকে ধরে ফেলি। একজন মহিলা বলল, পা ছেড়ে দিলি কেন? ধর পা ধর। বেয়াদব কোথাকার! ও যাই হোক, এ বাড়ির মেহমান, তোরা পারিস ওর গায়ে হাত দিতে?
কালু এক ঝটকায় আমার কাছ থেকে ছুটে গেল। ও কিভাবে আমাদের গায়ে হাত দিলো? কালুর পাল্টা প্রশ্ন। মোটকু সজোরে কেঁদে ফেলল, ও আমাকে মেরে রক্ত বের করে দিয়েছে। তাতে কিছু হয়নি, আমরা মেরেছি এখন আমাদের দোষ!
দেখতে না দেখতে উঠোন ভরে গেল লোকজনে। একে একে সবাই ফিরে এসেছে। সবাই কত কথা বলছে। সবচেয়ে আমার কাছে ভালো লাগছিলো একটি বিষয় সেটা হল সবাই আমার প্রশংসা করছিলো। সবার সিদ্ধান্তক্রমে আমাদেরকে আবার মিলিয়ে দেয়া হলো। সবাই যার যার ঘরে ফিরে গেল। আমরাও ঘরে ফিরে এলাম।
সবার মুখই গম্ভীর। কারণ জানতে ইচ্ছে করছিলো খুব। কার কাছে জিজ্ঞেস করবো ভাবছিলাম। মনে পড়ে গেল লিপির কথা। খুঁজলাম ওকে। না পেয়ে রান্নাঘরে যেতেই খালা বললেন, কোথায় যাও?
খালার আচমকা প্রশ্নে আমি ‘থ’ মেরে গেলাম। খালা লিপি...।
খালা ‘লিপি’ বলে উচ্চস্বরে ডাক দিলেন। পাশের কোনো এক রুম থেকে ও সাড়া দিলো। খালা বললেন, ওর পড়ার ঘরে যাও।
লিপির ঘরের দরজার কাছে যেতেই ও আমাকে উদ্দেশ করে বললো, ও ভাইয়া, এসো।
আমি গিয়ে ওর খাটের ওপর বসলাম। কিছুই বললাম না। ও কিছু একটা করছে তা দেখছি কিন্তু কী করছে তা দেখছি না। বলল, ভাইয়া, ওরা যা ভয় পেয়েছে জীবনে আর এরকম কাজ করবে না।
আচ্ছা লিপি সবার মন খারাপ কেন?
ও নিচে তাকিয়ে কাজ করছিলো, সেখান থেকে আমার দিকে তাকালো। মন খারাপ?
ওর অবাক হওয়া দেখে আমিও অবাক হয়ে গেলাম। তুই কিছু জানিস না?
ও স্বাভাবিকভাবে জানিয়ে দিলো, না তো!
আমি ওকে অনুরোধের সাথে বলতে শুরু করলাম, তুই একটু খালার কাছ থেকে জেনে আয় না কী হয়েছে?
ও একটু চিন্তিত ভাব নিয়ে আমার সামনে থেকে উঠে গেল। আমি একটু সুযোগ পেলাম ও কী করছিলো তা দেখার। তেমন কিছু না। একটা ছবি আঁকছিলো। আমি ওর চেয়ারটাতে বসলাম। ওর আঁকা দৃশ্যটাকে আরো সুন্দর করে আঁকতে শুরু করলাম।
লিপি কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো। আমাকে কিছু না বলে ও আমি কী এঁকেছি সেটা দেখতে লাগলো। আমি ওকে দেখামাত্রই জানতে চাইলাম, কী হয়েছে?
ও আমার কোনো প্রশ্নের জবার দিল না।
মোটা গলায় ‘মিলন’ বলে কে যেন ডাক দিলো। আমি দরজার দিকে তাকালাম। খালু আমাকে ডাকছেন। হঠাৎ তার ডাকতে আসাতে আমি একটু অবাক হলাম। তিনি আমার কাছে এসে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, মন খারাপ?
আমি মাথা ডানে-বামে ঘোরালাম।
মন খারাপ কর না। তোমার মা সুস্থ হয়ে যাবেন। তার কিছু হবে না।
আমার মায়ের কী হয়েছে? আমি অবাক হয়ে গেলাম।
তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, কিছু হয়নি। রাতে তার অপারেশন হবে। এরপরে তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন। শীঘ্রই বাড়ি ফিরে আসতে পারবেন।
আমি আর কিছু না জানলেও এটা জানতাম যে অপারেশন মানে ভূরি ভূরি ইনজেকশন। তাই একটু বেশিই বিচলিত হলাম। আমার দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো।
আরে বোকা, কাঁদছিস কেন? দুর পাগল! তোর আম্মু তো সুস্থ হয়ে যাবে। তুই খুশি হবি তা না কাঁদছিস! এটা একটা কথা হলো?
কোনো কথাই আমার মন মানছিলো না।
খালুর চেঁচামেচি শুনে খালা ছুটে এলেন। কী ব্যাপার, তুমি ওকে কী বলেছ?
খালু কথা এড়িয়ে যেতে চাইলেন, আমি আবার কী বললাম?
আয় মিলন তুই আমার কাছে আয়। আয় আয়। চল আমার সঙ্গে শুবি। চল। দুর বোকা, তোর আম্মুর কী হবে? আমরা আছি না।
আমি কোনো কথাই বলতে পারলাম না।

ওরা ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল। আমি বসে বসে দেখছিলাম। ভালোই লাগছিলো। ঘুড়িটা স্বাধীনভাবে উপরে উড়ে বেড়ায়। বাতাসে দোল খায়। ডানে যায় বামে যায় আবার নিচে নামে। কালু সুতাটাকে ধরে রেখেছে। কী দরকার! ওটাকে ছেড়ে দিলে ও কত উপরে উঠতে পারতো! উড়তে উড়তে কোনো এক অজানায় মিলিয়ে যেত! তখন হয়তো ওরা আর ওটাকে খুঁজে পাবে না তাই নাটাই থেকে সুতা ছাড়ছে না।
খালার আগমনে আমি আকাশ থেকে চোখ নামালাম। তিনি আমাদের জন্য আচার বানিয়ে নিয়ে এসেছেন। তেঁতুলের আচার। আমি অবশ্য এটা পছন্দ করি।
কালু আমাকে ডেকে নাটাই হাতে ধরিয়ে দিলো। আমি বুঝতে পারলাম, খালার সামনে ভালো থাকার জন্যই ও এই কাজটা করেছে।
আমার খুব ইচ্ছে হলো ঘুড়িটাকে ছেড়ে দিতে। খালা চলে যাচ্ছেন। ঘুড়িটা প্রচণ্ড বেগে উপরের দিকে টানছে। আমি আর ওটাকে ধরে রাখতে চাইলাম না। এক টানে সুতাটা ছিঁড়ে ফেললাম। ঘুড়িটা পাক খেতে শুরু করলো।
মোটকু চেঁচিয়ে উঠলো, আমি ওকে দিতে না করেছি। এই তুই এখানে কেন এসেছিস? কী চাস আমাদের কাছে? আমরা তোর কী ক্ষতি করেছি যে তুই আমাদের এত ক্ষতি করছিস?
কালু তেড়ে এলো, তোকে ভালো পেয়ে দিলাম আর তুই সেটা ছিড়ে ফেললি? দাঁড়া, আজ তোকে...
আমি পেছনে ঘুরে তাকালাম। সেখানে মা দাঁড়ানো। মা তুমি! মা তুমি আমাকে ওদের হাত থেকে বাঁচাও। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে মা, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। ওরা আমার কাছে আসছে কিন্তু মা কিছুই বলছে না। মা তুমি কথা বল, মা...
এই মিলন, এই মিলন... মিলন...মিলন...। আমার ঘুম ভেঙে গেল। খালা আমাকে ডাকছে। মিলন, কী হয়েছে বাবা? এমন করছিস কেন? খারাপ কিছু স্বপ্নে দেখেছিস?
আমি খালাকে জড়িয়ে ধরলাম। খালা আমি মায়ের কাছে যাব। খালা আমি মাকে দেখবো। আমি মায়ের কাছে যাবো। আমি মায়ের কাছে যাব।
খালু উঠে এসেছেন। আহা কাঁদে না বাবা। তোমার আম্মুর কিচ্ছু হয়নি।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসলাম। লিপি আমার পাশে দাঁড়ালো। ভাইয়া, এসো তোমাকে আম্মু ডাকছে।
তুই যা আমি আসছি।
তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু। ও চলে গেল।
আমি একটু পরে ঘরের দিকে যেতে শুরু করলাম। লিপিকে আবার ঘর থেকে বের হয়ে আসতে দেখলাম। ভাইয়া, চল সুফিয়াদের বাড়িতে যেতে হবে একটু।
কেন?
আম্মু যেতে বলেছে।
আমি বললাম, তুই দাঁড়া, আমি একটু ঘর থেকে আসছি।
ও আমাকে যেতে বাধা দিলো।
কী হল, হাত ছাড়।
তুমি কিসের জন্য ঘরে যাচ্ছো?
তুই দাঁড়া, আমি আসছি তো।
ও আমাকে যেতে দেবেই না, তুমি যদি কিছু আনো তাহলে আমাকে বল আমি গিয়ে নিয়ে আসি।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ওর হাত ছাড়িয়ে ঘরে যেতে শুরু করলাম। বারান্দায় পা রাখতেই খালার কণ্ঠ আমার কানে ভেসে এলো। জলদি কর। মিলন দেখে ফেলবে।
কেন ওকে লিপিকে নিয়ে যেতে বললাম না!
আমি আর দেরি করলাম না। দৌড়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম। আমি খালুর সঙ্গে ঢাকা যাবো।
তারা দু’জনেই অবাক হয়ে গেল। আমি কোনো দিকে দৃষ্টি না রেখে সজোরে চেচাতে লাগলাম। অবশেষে বাধ্য হয়ে খালু আমাকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন।
আমার সবকিছুই ব্যাগে গোছানো ছিলো। জামা-কাপড় পরে বাসা থেকে বের হলাম। বাড়ির অনেকেই আমাদের এগিয়ে দিতে এলো। আমি একটিবারের জন্যও কারো দিকে তাকালাম না। কে কী বলছে তা গুরুত্ব দিয়ে শুনলামও না। হাঁটছি আর হাঁটছি।
খালা আমাকে দাঁড়াতে বললেন। আমি দাঁড়ালাম। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আমাকে মায়ের মতই আদর করতে লাগলেন। কেঁদেও ফেললেন। তার কান্না দেখে আমিও কান্না থামিয়ে রাখতে পারলাম না। খালুর পিড়াপীড়িতে বিদায় নিতে হল।
খালু সামনে হাঁটছেন। আমি তার পিছে। একবার পেছনে ঘুরে তাকালাম। এখনো সবাই দাঁড়িয়ে আছে।
সামনে তাকিয়ে আমি আবার হাঁটতে শুরু করলাম। ছোট একটা জামগাছের দিকে আমার দৃষ্টি পড়লো। সেই ঘুড়িটা, হ্যাঁ, সেটাইতো! আমি অবাক হয়ে ঘুড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। খালু ফিরে এসে আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন।
মায়ের কাছে পৌঁছাতে সন্ধ্যা। বিছানায় শুয়ে আছেন। আমার কথা শুনে তিনি আমার দিকে তাকালেন। হাত বাড়িয়ে আমাকে টেনে নিলেন তার বুকের মাঝে। আমিও মায়ের বুকের মাঝে মাথা রেখে নিশ্চুপ হয়ে রইলাম। কেন যেন আমার মনে হতে লাগলো এই মা আমাকে নাটাইয়ের মতো ধরে না রেখে সুতাটা ছিঁড়ে দিয়েছিল।
(সমাপ্ত)
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ