গ্রামে যাব

গ্রামে যাব

গল্প দেওয়ান মোহাম্মদ শামসুজ্জামান ফেব্রুয়ারি ২০২৪

অস্পষ্ট একটা শোরগোল শোনা যাচ্ছে। কথাবার্তায় মার মার কাটকাট শব্দ সুস্পষ্ট। কোনোকিছু বুঝে উঠতে পারছি না। কিছু সময় থম মেরে থাকলাম। তবুও কোনোকিছু বোধগম্য হচ্ছে না। একটা অজানা আতংকে বিছানায় উঠে বসলাম। ঘরের বাইরে লাগোয়া একটা বারান্দা, হট্টগোল সেখানেই বেশি। আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে জানালার কাছে গেলাম। পাল্লা একটু ফাঁকা করলাম। উঁকি মারলাম। মুহূর্তে দৃষ্টি থমকে গেল। বুকটা ধক ধক করে উঠল। এখন সকাল সাতটা কিংবা সাড়ে সাতটা হবে। বাইরে কী কারণে যেন একটা জটলা। উৎসুক মানুষজনের ভিড়। জোয়ান মানুষের থেকে ছেলে ছোকরাদের সংখ্যাই বেশি। সবার হাতে হাঁসুয়া, বর্শা কিংবা লাঠি ঠ্যাংগা। এরপরে আরও একটা দৃশ্য ঝাপটা মারল চোখে। এদের মাঝে কয়েকজন উপজাতি সাঁওতালও আছে। লাঠিয়াল বাহিনীর মতো তীর ধনুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ঘটনাটা কী সামান্য না বড়ো, চিন্তায় পড়ে গেলাম। দু’পা পিছিয়ে এলাম। এমনতো হবার কথা নয়। এটা আমাদের গ্রামের বাড়ি। অর্থাৎ বাপ-দাদা সাত পুরুষের ভিটেমাটি। আব্বা চাকরিজীবী হওয়ায় প্রথম থেকেই আমরা কেউ থাকতাম না এই বাড়িতে। এখনও থাকি না। আব্বার মৃত্যুর পর শুধুমাত্র ছোটো ভাই জমাজমি দেখভাল করার জন্য এই বাড়িতে বসবাস করে। এখন সেও নেই। দিঘিতে গেছে। মাছগুলোকে খাবার দিতে। ওর স্ত্রীও নেই, গেছে বাপের বাড়িতে, নাইওরে। এখন আমি একা। একদম একা। তবে প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের বাড়িটা কেন ঘেরাও হবে? শত্রুতা তো কারও সাথে ছিল না। এখনও নেই। এমনকি গ্রামের অনেককেই চিনি না। ঈদ উৎসব কিংবা আব্বা-আম্মার কবর জিয়ারত করতে এসে শুধুমাত্র কিছু কিছু আত্মীয়-স্বজন আর বয়স্ক মুরব্বিদের সাথে কথাবার্তা হয়, কুশল বিনিময় হয় এই পর্যন্তই। তাহলে কি শত্রুতা আমার ছোটো ভাইয়ের সাথে? ধন্দে পড়ে গেলাম কোনোকিছু গভীরভাবে চিন্তা করতে পারছি না। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। গতকাল যখন ইজিবাইকে বাড়ির গেইটে নেমেছি, তখন ছিল ভর সন্ধ্যা। কাছাকাছি একটা মুদির দোকান খোলা ছিল। খদ্দের বলতে কে একজন সিগারেট ফুঁকছিল। কারও সাথে কোনো ঝুটঝামেলা তো দূরে থাকুক, কোনোরকম কথাবার্তাও হয়নি। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম। সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। আমার ভাবনা তখনও শেষ হয়নি, এমন সময় দরজায় জোরে জোরে টোকা পড়ল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। ভড়কে গেলাম। ভেবে পাচ্ছি না কী করব? দরজা খোলার সাথে সাথে যদি কোনো অঘটন ঘটে, যদি হাঁসুয়ার একটা কোপ এসে ঘাড়ে পড়ে, তাহলে? ভয়ে ভেতরে ভেতরে একদম শুকিয়ে গেলাম। আবারও চিন্তা করতে লাগলাম। উপায় খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু ওদিকে ওরা অস্থির হয়ে উঠেছে। বারবার টোকা দিচ্ছে, কতক্ষণ আর চুপচাপ থাকা যায়? সুতরাং ভয়ার্ত কণ্ঠে বললাম, কে আপনারা? কী চান এখানে?

- আমরা, কে একজন উত্তর দিলো? আমরা সকলেই এই পাড়ার মানুষজন।

- কিন্তু এত সকালে কেন? কী হয়েছে আপনাদের? প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম।

- গাবড়া, গাবড়া ম্যারবার জন্য আসিছি। দরজা খোলেন, খসখসে গলায় উত্তর দিলো আরেকজন।

- গাবড়া! সে আবার কে? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

হঠাৎ সমস্বরে হাসির রোল ছড়িয়ে পড়ল। হাসির দমক সামলাতে সামলাতে লোকটি বলল, গাবড়া চেনেন না? আর চিনবার পারবিন বা ক্যামুন করে! এই গাঁয়েতো থাকেননি। আমরা পাড়াগাঁয়ের লোকজন গাবড়া বুলি। ওর আসল নাম বনবিড়াল।

এতক্ষণে আমার ভেতরে সব খোলাসা হলো। বুক থেকে দুশ্চিন্তার পাথরটা সরে গেল। লুঙ্গি, গেঞ্জি ঠিকঠাক করতে করতে দরজা খুলে দিলাম। ওরা আমার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকল। তারপর চার-পাঁচজন ভেতরে ঢুকে পড়ল। সাথে ঝাঁকড়া চুলের গাট্টাগোট্টা কালো কুচকুচে চেহারার একজন সাঁওতালও ছিল। কিছু সময় আমাকে নিরীক্ষণের পর ঐ উপজাতি ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, এ্যাই বাবু হামরা তুর মাটির ঘরেত যামু। তালায় উঠমু।

- কেন, প্রশ্ন করলাম তাকে।

- ওখানে গাবড়া লুকাই আছে। হামরা মারমু।

ওর কথা শোনার পর সাথে সাথে মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না। রক্তকণিকাগুলো কেমন শিরশির করে উঠল। আহাম্মক বলে কী? যেখানে বন্যপ্রাণী রক্ষা করতে পরিবেশবাদীরা আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করছে, সেখানে এরা আসছে বিলুপ্ত এক প্রাণিকে হত্যা করতে। ভেতরে ঝড় বইতে শুরু করল। ইচ্ছে হলো ওর গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে। তবুও নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিলাম। বললাম, তোমরা বোধ হয় ভুল করছ। এই বাড়িতে কোনো বনবিড়াল নেই। এবার তোমরা যেতে পারো।

উপজাতি ছেলেটি এবার দম দেওয়া পুতুলের মতো নড়েচড়ে উঠল। তার ভ্রমর কালো চোখের মনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলতে লাগল, এ্যাই বাবু, তুই কি হামার থিকে বেশি জানিস। হামরা সব পাকা খবর লিয়েই আসিছি। তুর মাটির ঘরেই গাবড়া আছে। এবার যাবার দে।

কত বড়ো সাহস! রাগে বুকটা কেঁপে উঠল। ওকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে ইচ্ছে করল। কিন্তু দমে গেলাম। নিঃশ্বাসটা গলার কাছে আটকে গেল। ভেবে দেখলাম, বনবিড়াল হত্যার ইচ্ছেটা ওদের মনে নেশার মতো জড়িয়ে ধরেছে। সরাসরি বাধা দিতে গেলে ওরা পাগলের মতো আচরণ করবে। উলটো আমাকেই অপমান করে ছাড়বে। সুতরাং জ্ঞানী-গুণীদের কথামতো হট্টগোল এড়িয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলাম। কাজেই ভেতর থেকে কৃত্রিম আত্মপ্রত্যয়ের হাসি ফুটিয়ে তুললাম। মৃদু হেসে বললাম, ঠিক আছে তোমরা দাঁড়াও। আগে আমি যাচাই করে দেখি। যদি সত্যি সত্যি বনবিড়াল থাকে, তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে, কী করা যায়। কথাটা ওদের মনে ধরল। একে অপরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। শেষে উপজাতি ছেলেটি বলল, ঠিক আছে বাবু সাবধানে পরখ করিস। গাবড়া খুব চালাক ছতুর জন্তু। দেখিস ভাগি না যায়।

মাটির ঘরটা একেবারে মামুলি ধরনের। টিনের চালের তিন কামরার ঘর। আগের দিনে যখন আমরা শহর থেকে গ্রামে আসতাম, তখন এই ঘরেই উঠতাম। এর ওপর একে আঁতুড় ঘরও বলা যায়। সেই সময় পাড়া গাঁয়েতো দূরে থাকুক, ছোটোখাটো শহরগুলোতেও তেমন কোনো ডাক্তার, ক্লিনিক, হাসপাতাল ছিল না। মায়েদের ডেলিভারির কাজ গ্রামের অভিজ্ঞ ধাত্রীরা সমাধা করত। এ কারণে আমার আম্মা বারবার ছুটে এসেছেন এই গ্রামে। বলতে গেলে আমাদের সব ভাইবোনের জন্ম এই মাটির ঘরেই। এখন ঘরটি পরিত্যক্ত। পাশে একটা ইটের বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছে। তবে আঁতুড়ঘরের স্মারক হিসেবে এখনও রেখে দেওয়া হয়েছে ঘরটিকে। নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে আমাদের অতীত ইতিহাসকে।

চিলেকোঠায় যখন উঠলাম তখন আঁশটে আঁশটে গন্ধ নাকে এলো। চারদিক আবছা অন্ধকার। সূর্যের আলো প্রবেশ করে না বললেই চলে। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলাম কোথাও নেই। কোনো সাড়া শব্দও নেই। এবার ঘাড়টা একটু কাত করে ভাঙা চেয়ার টেবিলের স্তূপের দিকে উঁকি দিলাম। চোখের মনি আপনা আপনি স্থির হয়ে এলো। পাশেই ডোরাকাটা বাঘের মতো একজোড়া প্রাণী। সাথে বাচ্চা-কাচ্চাও আছে। কেমন জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে আর একটু এগোলেই দেবে দৌড়। ওদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটালাম না। ধীরে ধীরে নেমে এলাম। কৌতূহলী লোকজন এবার আমাকে বৃত্তাকারে ঘিরে ধরল। ঐ উপজাতি ছেলেটিই প্রথমে সকৌতূহলে জিজ্ঞেস করল, এ্যাই বাবু তুই দেখা পাইছিস না? হামার কথা ঠিক লয়? আমি নিশ্চুপ, কী উত্তর দেবো? যদি বলি নেই, মিথ্যে বলা হবে। যেটা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ। আর যদি বলি আছে, তাহলে ওরা এক্ষুনি হামলে পড়বে হত্যা করবে। অনেক ভেবেচিন্তে বললাম বনবিড়াল আছে, কিন্তু কেউ মারতে পারবে না।

হঠাৎ জমায়েত ফুঁসে উঠল। রীতিমতো চিৎকার শুরু করে দিলো। কে একজন কর্কশ গলায় বলে উঠল, থাকেন তো শহরত। পাড়ার কুন খোঁজখবর রাখেন? গাবড়া আমাদের অনেক ক্ষতি করে, হাঁস-মুরগি ধরে, কবুতর খায়, ছাগলের বাচ্চা লিয়ে যায়, আর আপনে বুলছেন মারতে দেবেন না। এ ক্যামুন কথা! চুপচাপ থাকেন। গাবড়া আমরা মারমুই। কুন কথা শুনবার চাই না।

আমি অপলকে তাকিয়ে থাকলাম। একি বলছে! এখনও কী আগের ধ্যান-ধারণাতেই আছে এরা? হঠাৎ স্তব্ধতা ভেঙে চাপা ক্ষোভে নড়েচড়ে উঠলাম। কিছুটা রূঢ় কণ্ঠে বললাম, আপনারা কি সংবাদপত্র, বই-পুস্তক কিছুই পড়েন না? কিছুই জানেন না। কিছু সময় নীরব থেকে বলতে লাগলাম, কত বন্য প্রাণী, লতা, গাছপালা হারিয়ে গেছে এই দেশ থেকে, এখনও যাচ্ছে। এদের কি রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের ওপর পড়ে না? কেউ কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে আবার বলতে লাগলাম, আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও এই গ্রামে শিয়াল, বেজি, খরগোশের সাথে সাথে বড়ো বড়ো গুই সাপ, সজারু, মেছো বাঘ ছিল। তার আগেও ছিল ডোরাকাটা বাঘ, বুনোশুয়োর। এখন কোথায় সেইগুলো? এদেরকে রক্ষা করার কি দায়িত্ব আমাদের ছিল না? সকলেই নির্বিকার, কারো মুখে কোনো কথা নেই। সকলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। কিন্তু হঠাৎ আজমত চাচা মুখ খুললেন। পান চিবুতে চিবুতে নীরস ভঙ্গিতে বললেন, তুমার কথা সব ঠিক, সত্য। কিন্তুক কুন যুক্তি নাই। ঐ সব জন্তু-জানোয়ার নাই বুলেই আমরা সকলে ভালোই আছি। আগের মতো আর গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি খোয়া যায় না। গাঁয়ের লোকজন এখুন পয়সার মুখ দেখতে পাচ্ছে। দু’বেলা পেট পুরে খাতে পাচ্ছে। এখুন মাথার উপুর আপদ বুলতে গাবড়া, চিল, ঈগল, শিয়াল আর বেজি। ওরকেরে অত্যাচারে হাঁস-মুরগি, কবুতর পালার জো নাই। কাজেই তুমি কুনো বাধা দিও না। গাবড়া মারতে দ্যাও।

- না, আমি অনড় ভঙ্গিতে তাকালাম। বললাম, এরা আমাদের কিছুটা ক্ষতি করলেও শত্রু নয়, বরং বন্ধু। অনেক উপকার করে থাকে। আমার সাফ কথা, বনবিড়াল মারতে পারবেন না। আপনারা দয়া করে আসুন।

জমায়েত এবার কলকলিয়ে উঠল। মাথা গরম এক জোয়ান ছেলে হাতের বর্শাকে ওপরে তুলে উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে লাগল, কুন কথা শুনবার চাই না, গাবড়া মারমুই। আরেকজন আবার হাতের হাঁসুয়া নড়াচড়া করতে করতে বলল, থাকেন তো শহরত। গাঁয়ের দুঃখু বুঝবেন কী করে? গাবড়া মারতে দিবেন না, ভালো কথা! দেখা যাক কতদিন আগলে রাখতে পারেন। এ্যাই সব চল, চল। ঝামেলা করে লাভ নাই। অতঃপর সকলে বিদেয় নিল। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

সেদিন ব্যাংকের কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। হিসেবে টাকা মিলে গেছে, কিন্তু পয়সা মিলছে না। টেবিলে চা দিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। খাবারের অপেক্ষায় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এমন সময় মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল আচমকা। বিরক্তিতে হাতে নিতেই দেখি, ছোটো ভাই রিং করেছে।

- কী হলো? রেগে জিজ্ঞেস করলাম তাকে। সে থতমত খেল? কিছুক্ষণ চুপ থেকে সংকোচের সঙ্গে বলল, এই সময়ে রিং করতে ইচ্ছে ছিল না তবুও করতে হলো আমায়।

- কারণ! আমি উদ্বেগের সাথে জিজ্ঞেস করলাম।

- সে আমতা আমতা করে বলল, সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। পাড়ার লোকজন বদলা নিতে শুরু করেছে।

- তার মানে!

সে এবার খোলাসা করল, সকাল থেকে জনা পঞ্চাশ গ্রামবাসী আর সাঁওতাল মিলেমিশে পাড়া ঘিরে ফেলেছে। শিয়াল, বেজি, গুইসাপ শিকারে মেতে উঠেছে। এমনকি চিল, ঈগল, প্যাঁচাও রক্ষা পাচ্ছে না। ভেঙে ফেলা হচ্ছে ওদের বাসা।

আমি ভুরু কোঁচকালাম। রাগে গজ গজ করতে করতে বললাম, তুমি বাধা দেওনি?

- দিয়েছি, আমার কথা কেউ মানছে না।

- তোমার সমর্থনে কেউ এগিয়ে আসে নি?

- না।

আমি ঝিম মেরে গেলাম। রাগে উদ্বিগ্নে মাথা গুলিয়ে যেতে লাগল। ঘড়ির দিকে তাকালাম। এগারোটা বেজে গেছে। তাহলে কি ওদের নামে থানায় অভিযোগ করব? পুলিশে খবর দেবো? পরক্ষণে ভেবে দেখলাম, এটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বরং হিতে বিপরীত হবে। আত্মীয়তার বাঁধন আলগা হবে। ছোটো ভাইয়ের মাছ চাষ, ক্ষেত-খামারের ফসল মাঠে মারা যাবে। সুতরাং সান্ত¡না খুঁজে পেতে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের বাড়ির বন বিভাগের খবর কী? ওদেরকেও কি মেরে ফেলা হয়েছে?

- না, উত্তর দিলো ছোটো ভাই। ওরা পালিয়ে গেছে।

- তাহলে কাউকেই কিছু বলার দরকার নেই। বিষয়টা পরে ভেবে দেখব। ফোন রেখে দাও।

ছোটো ভাই ফোন রেখে দেবার পরও আমার মনের অস্থিরতা কাটল না। একটা ছটফটে অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে লাগল।

সাপ্তাহিক ছুটির দিনে হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলাম। ঘরে না যেয়ে সোজা গেলাম বাড়ির পেছনে ছোট্ট ডোবার পাড়ে। কাছেই বিশাল শিমুল গাছ। এই সময় গাছের ডালে ঈগল শঙ্খ চিলের দেখা মেলে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলাম না। ওদের বাসাগুলো খুঁজলাম। সেগুলোও নজরে এলো না। এবার ডোবার সাদা বেগুনি শাপলার রাজত্ব ছেড়ে এবার হাঁটা পথে এগোতে লাগলাম। সামনে একটা বড়ো পুকুর। পাড়ে পারিবারিক কবরস্থান। সারা বছর ঝোপ-ঝাড় আর লতাগুল্মে ঢাকা থাকে। কিন্তু অবাক কাণ্ড সেখানকার অবস্থা একবারেই তথৈবচ। মনে হচ্ছে এক জঙ্গল দাঁতাল শুয়োর ঝোপঝাড় মাড়িয়ে দিয়ে গেছে। আমি একটু থামলাম। চোখ ছলছল করে উঠল। একটু দূরে ধান কাটা খাঁখাঁ মাঠে। তারপর আরও চার পাঁচটা ঝোপ জঙ্গল। কাছাকাছি হতেই আমার কপালে ঘাম জমতে শুরু করল। কোথায় সেই লতাগুলো আর বনফুল। সবতো লণ্ডভণ্ড। বন্যপ্রাণী তো দূরে থাকুক, গাছের ডালে শালিক, টিয়ে, কাঠবিড়ালও নেই। মনটা ভীষণ বিষাক্ত হয়ে গেল। বিস্ময় বিমূঢ় চোখে চেয়ে থাকলাম। একসময়ে ঘরে ফিরে এলাম।

এই ঘটনার পর অনেকদিন আর গ্রামে যাওয়া হয়ে উঠল না, প্রায় দুই বছর। প্রথম কারণ অফিসের দায়িত্ব এত বেড়ে গেছে যে যাবার ফুরসত পাইনি। দ্বিতীয়ত দুই বছরের জন্য ঢাকার অফিসে বদলি হয়ে গিয়েছিলাম। গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য মন খুঁতখুঁত করলেও সুযোগ করে উঠতে পারিনি। সেদিন অফিসে দুপুরে খাবারের পর অভ্যাস মতো আরাম কেদারায় একটু গা এলিয়ে দিয়েছিলাম। বন্ধ চেম্বারে এসির শীতল বাতাস চোখের পাতা বুজে আসছিল। হঠাৎ আওয়াজ হলো। কে যেন দরজা টানছে। চোখ মেলে দেখি সামনে সিকিউরিটি গার্ড। ওর চোখে সংকোচ আর ভয়। বললাম, কী ব্যাপার, হঠাৎ এই সময়ে।

ও একটু কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, স্যার আপনার গেস্ট, গ্রাম থেকে এসেছে।

- আমার গেস্ট, আমি অবাক চোখে ওর দিকে তাকালাম।

- জি স্যার, সিকিউরিটি গার্ড শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলো।

- ঠিক আছে, ওনাকে চেম্বারে নিয়ে এসো। দেখি কে এসেছেন।

স্যার, ওরা তো দু-একজন নয়। জনা বিশেক।

- এত লোক, আমার কাছে! কী ব্যাপার বলো তো? আমি হাঁ করে তাকালাম।

গার্ডের মুখে এবার হাসির রেখা ফুটে উঠল। বলল, ভয় নেই স্যার। সব আপনার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী। সাথে প্রধান শিক্ষকও আছেন।

- কিন্তু কেন?

- শিক্ষা সফরে এসেছে ওনারা।

- শিক্ষা সফরে এসেছে। ভালো কথা। কিন্তু আমার কাছে কেন?

- হয়তো এই ফাঁকে ব্যাংকও দেখে নিবে, উত্তর দিলো গার্ড।

এতক্ষণে বিষয়টা মাথায় খেলল। ঢাকায় শিক্ষা সফর মানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখার সুযোগটাও হাতছানি দিয়েছে ওদেরকে। এখন আমি কী করব? গ্রামবাসীর ওপর আমার একটা রাগ অভিমান থাকলেও এইসব কোমলমতি শিশুদের ওপর কোনো বিরক্তি কিংবা অভিযোগ প্রকাশ পেল না। বরং অন্যরকম ভালোবাসায় চোখের পানিতে ঝিলিক দিয়ে উঠল। হাজার হোক জন্মভূমির শিশুর দল। কিন্তু সমস্যা হলো বাংলাদেশ ব্যাংক কেপিআই ভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান। অধিকাংশ এলাকাই সংরক্ষিত ও মহা নিরাপত্তার আওতাধীন। ওদেরকে সবকিছু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখানো সম্ভব নয়। তবুও একটা দায়বদ্ধতা থেকে কেয়ারটেকার হাফিজকে ডেকে পাঠালাম। বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বললাম, নিরাপদ দূরত্ব থেকে ব্যাংক কার্যক্রম দেখানোর পর সকলকে সম্মিলন কক্ষে বসাও। আমি ক্যান্টিনকে বলে দিচ্ছি দুপুরের খাবার দিতে। হাফিজ বলল, কোনো চিন্তা করবেন না স্যার, আমি সব ব্যবস্থা করছি।

দুপুর দুটো নাগাদ সম্মিলন কক্ষে প্রবেশ করলাম। প্রধান শিক্ষক উঠে দাঁড়ালেন, সাথে সাথে অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরাও। বসতে বললাম সকলকে। সামনের চেয়ার ফাঁকা ছিল। মুখোমুখি হলাম। সকলের দৃষ্টি এখন আমার দিকে। তবে কী বলবে, তারা ভেবে রাখেনি। সকলে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল। এমন সময় প্রধান শিক্ষক বলে উঠলেন, স্যার, এরা আমার স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রী। স্কুল ছেড়ে চলে যাচ্ছে। শিক্ষা সফরে নিয়ে এসেছি। আপনার অফিস দেখে ওরা ভীষণ খুশি। আনন্দে ওদের মাথা একরকম গুলিয়ে গেছে। ব্যাংক ভল্ট দেখে ওরা ভীষণ অবাক। ওখানে শুধু টাকা আর টাকা। যেন টাকার খনি। ভাগ্যিস আপনার কথা মনে পড়েছিল, নইলে এই দেখার সুযোগ হাতছাড়া হতো আমাদের।

আমি শুধু শুনেই যাচ্ছি, কোনো মন্তব্য করছি না। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকাণ্ড, এর ইতিবৃত্ত না জানলে যে-কোনো ব্যক্তিই অবাক হতে পারেন অথবা আবেগে অনেক কথাই বলতে পারেন। আমি প্রসঙ্গ পালটাতে যাব এমন সময় প্রধান শিক্ষক প্রসঙ্গ পালটালেন। মৃদু স্বরে বললেন, আমরা বিশ্ববিদালয়, মেডিক্যাল কলেজ, জাদুঘর, চিড়িয়াখানা সব কিছু দেখলাম। ব্যাংকও দেখলাম। কিন্তু আরেকটি কারণেও আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি। যেটা আপনাকে বলব কি না ভাবছি।

- কী কারণ। চোখ তুলে তাকালাম।

- আপনার গ্রামে যাওয়া উচিত, আমরা নিয়ে যেতে চাই।

তার কথায় আমার ভেতর একটা শিহরণ বয়ে গেল। চোখের মনি ছোটো হয়ে এলো। চশমা খুলে ফেললাম। বললাম, হঠাৎ এ চিন্তা কেন আপনার মাথায়। প্রধান শিক্ষক থতমত খেলেন। কিছুক্ষণ ভাবলেন। অতঃপর তিনি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা না বলে সরাসরি বলতে লাগলেন, সেবার গ্রামের লোক আপনাকে বুঝতে পারেনি, ভুল বুঝেছিল। আপনার সাথে যা হয়েছে, তা অন্যায় হয়েছে। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। মাঠে ফসল নেই, গাছে ফল নেই, বাগানে সবজি নেই। ইঁদুর, মাজরা পোকা আর উইপোকা দখল করেছে সব কিছু। কারও মুখে হাসি নেই। সকলের ধারণা, এতে নাকি আপনার অভিশাপ আছে। এখন সকলে শাপমোচন করতে চায়।

আমার ভেতর ঝড় বইতে শুরু করল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলাম। পরক্ষণে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, গ্রামের লোকজন ঠিকই বলেছেন। তবে অভিশাপ আমি দিইনি। অভিশাপ দিয়েছে প্রকৃতি। যেমন একবার হয়েছিল চীন দেশের এক প্রদেশে। ফসল রক্ষা করতে গিয়ে সমস্ত চড়–ই পাখি হত্যা করেছিল। পরের বছর তারা হাতে হাতে ফল পেয়েছিল। পোকামাকড় কীট-পতঙ্গ সাবাড় করল জমির ফসল। দুর্ভিক্ষ নেমে এলো।

আমার কথায় প্রধান শিক্ষকের শীর্ণ মুখের চোখের তারা কাঁপতে লাগল। কিছুটা আবেগে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তাহলে বন্যপ্রাণী হত্যা আর পাখিদের বাসা ভেঙে দেবার কারণে এই কি অভিশাপ! আমি বললাম, ঠিক তাই। কিছু সময় চুপ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের লক্ষ্য করে বললাম, একটা প্যাঁচা কিংবা একটা গুই সাপ ইঁদুর মেরে কত টাকার ফসল রক্ষা করে, তা তোমরা কি জানো?

- না, সমস্বরে উত্তর দিলো সকলে।

- প্রায় কোটি টাকার ফসল, উত্তর দিলাম। সকলে একটু অপ্রতিভ হলো। একজন বিস্মিত কণ্ঠে বলল, এই খবরতো আমরা জানি না। কেউ কোনোদিন বলেওনি।

- আমি তার আহত কণ্ঠকে থামাতে গিয়ে আরো বললাম, চিল, ঈগল, প্যাঁচা, ঘুঘু, চড়–ই, টিয়া প্রভৃতি উপকারী পাখি। সেইসাথে অন্যান্য বন্যপ্রাণীও।

ওরা অমাদের বন্ধু, শত্রু নয়। তাছাড়া ওরা আছে বলেই প্রকৃতি এত সুন্দর এত ভালো। ওদেরকে মেরে ফেলার কারণে গ্রামের এমন বালা মসিবত হাজির হয়েছে। ক্ষেতে ফসল নেই, গাছে ফল নেই, ফুল নেই। আমার কথা শেষ না হতেই একজন ছাত্রী কোনোরকম সংকোচ না করে বলে উঠল, আপনার কথা সত্য, গ্রামে শিয়াল, বেজি, গাবড়া, গুই সাপ মারার পর, আর ফাঁদ পেতে বক, ঘুঘু, ডাহুক মাইরে গোশত খাওয়ার পরই আমাকেরে এই দশা হইছে। আমি তার কথায় ভীষণ আশ্চর্য হলাম। ভালো করে ওর মুখের দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে কুয়াশার চাদর কেটে যাচ্ছে। একটা নতুন সূর্যের উদয় হচ্ছে। মুহূর্তে সোনালি রোদে আমার ভেতরটা ঝলমল করে উঠল। গ্রামের বুড়োরা যেটা উপলব্ধি করতে পারেননি, সেখানে একটি শিশু সমস্যা অনুধাবন করতে পেরেছে।

বললাম, তোমার কথা ঠিক, একদম ঠিক।

প্রধান শিক্ষক হাঁ করে শুনছিলেন। এবার তার ঠোঁট নড়েচড়ে উঠল। আহত কণ্ঠে বললেন, বিষয়টা আমরা অত তলিয়ে দেখিনি। বলতে গেলে গাঁয়ের লোকজন একটা ভুলের মধ্যেই খাবি খাচ্ছে। আবাদ ফসল যদি এইসব সাপ, খোপ, বেজি, প্যাঁচার ওপরই নির্ভর করে তাহলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। এখন এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

উত্তরটা বড়ো কঠিন। এখন কী উত্তর দেবো? ছাত্র-ছাত্রীরা হাঁ করে তাকাল। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটু চুপ করেই থাকতে হলো আমায়। পরক্ষণে আবার চুল ঠিক করতে করতে বললাম, উত্তরটা কঠিন, কাজটাও কঠিন। তবুও উপায় আছে।

- কী উপায়? প্রধান শিক্ষক স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন।

- অতীতকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

- তার মানে, প্রধান শিক্ষক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন।

- আবারও গ্রামে ঝোপ-জঙ্গল আবাদ করতে হবে, পাখপাখালি, জঙ্গলচারী প্রাণীদেরকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

- তা কী করে সম্ভব? অতীত তো পানির স্রোতের মতো। একবার গেলে আর ফিরে আসে না, যুক্তি দেখালেন প্রধান শিক্ষক।

- কথাটা সত্য, তবে ব্যতিক্রমও আছে। আমিও যুক্তি খাড়া করলাম পরিবেশবাদীরা বিপরীত স্রোতে দাঁড়িয়েও অনেক লতাগুল্ম প্রাণীকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন যেগুলো হারিয়ে গিয়েছিল একসময় পৃথিবীর বুক থেকে।

- সেটা উন্নত দেশে সম্ভব। তাই বলে কি আমাদের দেশেও সম্ভব হবে। প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন প্রধান শিক্ষক।

- বললাম, সম্ভব। শুধুমাত্র প্রয়োজন হবে উদ্যম ও উদ্যোগের।

এবার ছাত্রছাত্রীরা চোখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করল। প্রধান শিক্ষক নিরুত্তর থাকলেন। মনে হচ্ছে তিনি পাশ কাটতে চাইছেন। আমি অভয় দিয়ে বললাম, ভয় নেই। উদ্যোগটা কাউকে নিতে হবে না। আমিই নেব। আর মাত্র এক বছর। চাকরি থেকে অবসরে যাচ্ছি। তখন সোজা গিয়ে উঠব গ্রামে। তারপর একটু থেমে বললাম, তখন কী তোমাদেরকে পাশে পাব না? একটু সাহায্য করবে না?

- নিশ্চয়, সমস্বরে উত্তর দিলো তারা। ওদের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। হঠাৎ আমার ভেতরে বৃষ্টি নামতে শুরু করল, ঝমঝমে বৃষ্টি। ভরা নদীর মতো উত্তাল হতে লাগল বুক। এক ফাঁকে হাত ঘড়িটা দেখে নিলাম। তিনটা বেজে গেছে। আর অবস্থান করা যায় না। কাজেই আবেগকে টেনে ধরলাম। মৃদু হেসে বললাম, সময় শেষ হয়ে গেছে, এখন যে আমার উঠতে হবে, অফিসের অনেক কাজ পড়ে আছে। সকলে বিহ্বল চোখে তাকাল। উঠে দাঁড়াল। হাত নাড়ালাম। অতঃপর স্নেহার্দ্র চোখে সকলকে বিদেয় দিলাম, নিজেও বিদায় নিলাম।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ