গুগলে মুন ও জুলির ভাবনা -রফিক মুহাম্মদ

গুগলে মুন ও জুলির ভাবনা -রফিক মুহাম্মদ

গল্প মে ২০২০

মুনকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে জুলিয়া।
জুলিয়াকে এখন এ বাসার সবাই জুলি বলেই ডাকে। প্রায় এক মাস হয় সে ঢাকায় এসেছে। এখানে এসেতো ওর চোখ ছানাবড়া। সাদা দরজার ভেতর ঢুকে বোতামে চাপ দিলেই কী সুন্দর আটতলা বাসায় উঠে যায়। বন্দুকের মতো একটা জিনিস চুলার কাছে ধরতেই আগুন জ্বলে যায়। এরকম আরও কত কিছু দেখে অবাক হয় জুলি।
তবে সব চেয়ে বেশি অবাক হয় মুনকে দেখে। মুন ওর কাছাকাছি বয়সের। কেমন যেন চুপচাপ। বেশি কথা বলে না। সকালে প্রতিদিন বাবা-মায়ের সাথে গাড়িতে করে স্কুলে যায়। এরপর দুপুরে স্কুল থেকে এসেই টেলিভিশনের মতো দেখতে একটা বাক্সের সামনে বসে পড়ে মুন। জুলি প্রথম প্রথম এটাকে টেলিভিশন মনে করতো। তবে একদিন মুনই ওকে বলেছে এটা টেলিভিশন নয়, এটা হলো কম্পিউটার। প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে কম্পিউটারের সামনে বসে একা একাই ক্রিকেট খেলে সে। জুলিতো অবাক! বলে কি একা একা খেলা যায় নাকি?
জুলি গ্রামে ওর বান্ধবীদের নিয়ে কত খেলা খেলেছে। ওদের বাড়ির পাশেই প্রাইমারি স্কুল। ওই স্কুলের সামনে বিশাল মাঠ। প্রতিদিন বিকাল বেলা শেফালি, হাসনা, জমিলা, সাধনা, পূর্ণিমাসহ আরও অনেকে মিলে মাঠের একপাশে বৌচি, হাডুডু, কানামাছি এসব খেলা খেলেছে। মাঠের মাঝখানে ছেলেরা ফুটবল খেলে, কখনোবা দাঁড়িয়াবাঁধা খেলে। সবাই মিলে কত হৈ-চৈ, কত আনন্দ। আর এই ঢাকায় এসে জুলি এসব কী দেখছে? এখানে ঘরে বসে বাক্সের মধ্যে একা একাই খেলা যায়।
মুনের বাবা-মা দু’জনই চাকরি করেন। সকাল বেলা মুনকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে তারা অফিসে চলে যান, এরপর ফিরে আসেন সেই বিকেলে। বাসায় শুধু মুনের দাদু আর জুলি থাকে। মুনের দাদুও অসুস্থ। সারাদিন খাটে শুয়েই তার দিন কাটে। আর মুনও স্কুল থেকে এসেই কম্পিউটারে খেলা নিয়ে বসে। এ বাসায় আসার পর থেকে জুলি বেশ অবাক হয়ে এটি লক্ষ করে। একদিন সাহস করে কাছে গিয়ে মুনকে জিজ্ঞেস করে, ও.. বাইয়া আফনি একলা একলা কী করুইন?
: ওহ জুলি, এই যে দেখ ক্রিকেট খেলছি?
: কইন কি আফনে! একলা একলা খেলন যায় নাহি?
: হ্যাঁ যায়-যায়। তুমি জান না এই কম্পিউটারে সব পারা যায়।
: কই দেহি? জুলি এবার এগিয়ে গিয়ে কম্পিউটারের সামনে দাঁড়ায়।
মুনও খুব আগ্রহের সাথে জুলিকে তার ক্রিকেট খেলা দেখায়। মুন বলে এই যে দেখ, যারা ব্যাট করছে সেটা হলো কম্পিউটারের দল। আর বলিংয়ে আমি, মানে আমার দল। এই যে মাউজ ধরে ক্লিক করলেই বলিং হয়ে গেল..। ইসরে ছক্কা মেরে দিল।
জুলিতো একেবারে হতবাক। সত্যি কী সুন্দর খেলা হচ্ছে। জুলির আগ্রহ এবার বেড়ে যায়। কী তাজ্জব ব্যাপার কম্পিউটার নিজে খেলতে পারে। আইচ্ছা বাইয়া কম্পিউটারে আর কী কী পারে?
: সবই পারে। তুমি যা বলবে, যা করতে চাইবে সবই হবে। এই কম্পিউটারে গুগল আছে। এই গুগলে ঢুকে তুমি যা চাইবে তাই পেয়ে যাবে। আমিতো প্রতিদিনই গুগলে ঢুকে নতুন নতুন গেম বের করে খেলি। গতকাল খুব সুন্দর একটা গাড়ির গেম পেয়েছি। দেখবে সেটা?
জুলি খুব আগ্রহভরে বলে কই কই দেহি..।
মুন গাড়ির গেম বের করতে যাবে এ সময় বাসার কলিং বেল বেজে ওঠে। জুলি বলে, বাইয়া খাল্লাম্মা মনে অয় আইয়া পড়ছুইন। আমি যাই...।
অনেক রাত হয়েছে। বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। জুলির কিছুতেই ঘুম আসছে না। সে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। বাবা-মা আর ছোট ভাই-বোনের কথা মনে পড়ছে। বেশ কিছুদিন হলো ওর বাবা অসুস্থ। ধানের বস্তা মাথায় তুলতে গিয়ে কোমরে ব্যথা পেয়েছে। তাই এখন আর কাজ করতে পারে না। ঘরে শুয়ে বসে দিন কাটাচ্ছে। ভালো ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাবে সে সামর্থ্য নেই। গ্রামের জবেদ ডাক্তারের কাছ থেকে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ এনে খাচ্ছে। এতে খুব একটা ভালো হচ্ছে না। বড় বাড়িতে কাজ করে মা যা পায় তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে ওদের দিন যাচ্ছে। ছোট ভাই জসিম আর বোন আছিয়া হয়তো সারা দিন না খেয়ে থাকে। মা বড় বাড়ির কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় কিছু খাবার নিয়ে বাড়ি ফেরে। তখন হয়তো ওরা খায়। জুলিতো এখানে পেট ভরে তিন বেলা খাচ্ছে। মাছ-গোশত-ফল কত কিছু। যখন মন যা চায় তখনই সে তা খেতে পারছে। অথচ বাড়িতে ভাই-বোন-বাবা না খেয়ে থাকে। আর কয়েক দিন পরে ঈদ। এই ঈদেতো কোন নতুন জামাও ওরা কিনতে পারবে না। এসব ভাবতে ভাবতে জুলির দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রæ বালিশ ভিজিয়ে দেয়।
জুলির হঠাৎ মনে পড়ে গুগলের কথা। মুন বাইয়াতো কইলো গুগলের কাছে যা-ই চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। ও যদি বাবা-মা ভাই-বোনের জন্য কিছু চায় তাহলেই তো পেয়ে যাবে। জুলি এবার পাশ ফিরে শোয়। দু’হাতের তালু দিয়ে অশ্রæভেজা চোখ দুটি মুছে নেয়। কাল সকালে উঠেই সে মুন বাইয়াকে বলে গুগলের কাছে বাড়ির জন্য অনেক কিছু চাইবে। ওদের আর কোন অভাব থাকবে না। ভাই-বোন পেট ভরে খেতে পারবে। ঈদে নতুন জামা কিনতে পারবে। বাবাকে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করাতে পারবে। জুলি আর শেফালি, হাসনা, জমিলা, সাধনা এদের সাথে দলবেঁধে স্কুলে যাবে। ভাবতে ভাবতে ওর দু’চোখের তারা এবার আনন্দে ঝিকিমিকি করে ওঠে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ