খইমুদ্দীন

খইমুদ্দীন

গল্প মাহমুদুল্লাহ রাইহান নভেম্বর ২০২০

মামার হাত ধরে হাঁটছে আইমান। হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে পৌঁছলো। যেখানে বয়ে গেছে চাড়ালকাঁটা ছোট্ট নদীটি। যেতে যেতেই দেখলো গ্রামের সবুজ মেঠোপথ। পথের দু’পাশের আকাশছোঁয়া সারি সারি গাছ। দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ। এসব দেখে বেশ ভালোই লাগলো। সুখের ফুরফুরে আবেশ ছড়িয়ে গেলো মনে। তাছাড়া বিকালের রূপালি পরিবেশটাও মনোরম। চারপাশে আলো-ছায়ার লুকোচুরি আর ঝিরিঝিরি হাওয়ার সঙ্গীত। মামা বললেন, চলো এবার কোথাও গিয়ে বসি। হুমম ভালোই হয়। বললো আইমান। তারপর মামা-ভাগ্নে হিজল গাছের পাশে দূর্বাঘাসের নরম গদিতে বসে পড়লো। ভাগ্নের আবেদনে কবি মামা গল্প শুরু করলো,
সুখিপুরের একটি ছেলে
ছিলো কেমন বোকা
জীবনযাপন দুঃখের ছিল
সবাই দিতো ধোঁকা।
সেই ছেলেটির নাম ছিলো খইম্দ্দুীন। বোকাসোকা লোকের নাম আর কতো ভালো হয়! সুন্দর নাম হলেই বা কী? মানুষ তাকে ডাকতো বোকা খইম। সে এক গরিব চাষির ছেলে। বাবা সেই ওয়াও ওয়াও করে কাঁদার সময়ই মারা যায়। হাঁটি হাঁটি পা পা করে সে বড় হয়। মাকে নিয়ে গড়ে ওঠে তার ছোট্ট সংসার। সে খুবই সরল ও সৎ। সে মাঠে মাঠে গরু চরায়। তার নিজের কোনো গরু নেই। অন্যের গরু নিয়ে মাঠে থাকে। অন্য কাজ টাজও পারতো না।
সারাদিন বাইরে কাটিয়ে বিকেল হলে ঘরে ফিরে। মা যা দেয় তাই খেয়ে নেয়। কোনো কথা বলে না। আজগুবি বায়না ধরে না। খেয়ে দেয়ে চুপচাপ বিছানায় যায়। বাঁশি হাতে নেয়। মনের সুখে কতক্ষণ বাজায়। তবেই হারিয়ে যায় ঘুমের অদ্ভুত রাজ্যে। ঘুমের দেশটা অন্যরকম। ইশ! বাস্তবে যদি তাই হতো। সে স্বপ্ন দেখে,
তার হয়েছে অনেক টাকা
সুনাম বাড়ে খুব
ভাঙা কুটির বদলে গেছে
ঝলমলে হয় রূপ।

একদিন রাখালের মা বলল, বাবা! আর কত দিন অন্যের গরু চরাবি? এবার নিজে দু-একটা গরু কিন। উন্নতি করো।
মায়ের কথা শুনে রাখাল ছেলে খুব খুশি হয়। খুুশি হয়ে রাখাল তার মাকে বলল, বেশ! তুমি যখন গরু কিনতে বলেছ- আমাকে গরু কিনতেই হবে। ছেলের কথায় মা-ও খুশি হল। কিন্তু কিভাবে কিনবে? ঘরে চাল-চুলো নেই। প্রদীপ পর্যন্ত জ্বলে না ঠিকমত।
পরের দিন মাঠের পাশে এক বটগাছের নিচে গিয়ে বসল রাখাল। বসে কী করে একটা গরু কেনা যায় তা ভাবতে লাগলো। ভাবনা যেন অথৈ পানি। কোন কূল-কিনারা নেই। তখনই চিৎকার শোনা গেলো। রাখাল প্রায় লাফিয়ে উঠলো। ছুটলো আওয়াজ বরাবর। একটা ষাঁড়ের দড়ি ছিঁড়ে গেছে। অন্য আরেকটা গরুর সাথে লড়াই করছে। শিং বাগিয়ে আঘাত করতে উদ্যত। আক্রান্ত গাভিটি প্রাণপণে ছুটছে। তাকে ধরতে গিয়ে রাখালও ছুটলো। ছুটতে ছুটতে অনেক দূরে গিয়ে ধরলো। ঘন গরম গরম নিঃশ্বাস ফেলে যখন ফিরছিলো তখন দেখলো একজন বৃদ্ধাকে। লাকড়ি মাথায় নিয়ে অনেক কষ্টে হাঁটছিল। রাখালের মায়া হলো। গরুর দড়ি কোমরে বেঁধে বুড়ির গাঁট্টি মাথায় নিয়ে এগিয়ে দিলো। বুড়ি খুব-ই খুশি হলো। কৃতজ্ঞতা জানাতে বললো-
আল্লাহ তোমার ভালো করুন
হও জীবনে সুখী
ভাগ্য তোমার খুলে যাবে
কাটবে বিপদ ঝুঁকি।

ওর ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছিল। তাই লজ্জা না করে খেতে চাইল। বৃদ্ধা তাকে খেতে দিলো। খেতে খেতে তার পরিচয় জানলো। শুনলো তার ইচ্ছার কথামালা। বুড়ি তাকে পরীক্ষা করতে চাইলো। বললো, তোমার এই গাভিটি আমাকে দিয়ে যাও। আমি বুড়ো মানুষ এর দুধ খেয়ে জীবন পার করে দেবো। আর বিনিময়ে তোমাকে আমার জমানো টাকাগুলো দেবো।
রাখালের সোজাসাপটা জবাব তা হয় কী করে? গরুর মালিক যে আমি নই।
আচ্ছা মামা! চালাক বুড়ির কথার প্যাঁচে রাখাল কি গরুটা শেষ অবধি দিয়ে দিল? গল্পের মাঝে জিজ্ঞেস করলো আইমান। মামা একটানা কথা বলায় একটু বিরতি নিলেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রশ্ন করে সে। মামা বললো দেয়নি সে রাখাল। বোকা হলেও বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছে। এমন সবার হওয়া উচিত। কেননা নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধোঁকা ও প্রতারণাকারী সম্পর্কে কঠোর বাক্য উচ্চারণ করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ধোঁকাবাজ ও প্রতারণাকারী জাহান্নামে যাবে। (বায়হাকি শরীফ)
তাহলে তো খইমুদ্দীন বোকা নয়। বরং সৎ ছেলে। বললো আইমান। হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছ। সে আসলে বোকা নয়। সহজ সরল। এটাকেই সমাজের লোকেরা বোকা ভাবে। মামা আবার গল্পটা আরম্ভ করলো, বুড়ি তাকে লক্ষ্য করে বলল আমি জানি তুমি ভালো ছেলে। বিদ্যা-বুদ্ধি কম হলেও তোমাকে ভালো লেগেছে। সততা এবং পরোপকার গুণে মুগ্ধ হয়েছি। তাই আজ তোমাকে অনেক হীরে-মুক্তা দেবো।
বৃদ্ধার কথা রাখালের কেন যেন বিশ্বাস হলো। তবুও বললো কেন দিবেন এতো কিছু। জবাবে মহিলা বললো, আমার দিন প্রায় শেষ পর্যায়ে এসেছে। কোনদিন মরে যাই ঠিক নাই। এখন সোনাদানা দিয়ে কী করবো। তারচে তুমি নিয়ে যাও। তারপরে মমতাময়ী বৃদ্ধা তাকে রান্নাঘরের মেঝের মাটি খুঁড়তে বললো। সে কোদাল হাতে নিয়ে কাজ শুরু করলো। তিনটি সোনার কলস দেখতে পেলো। কলসগুলো হীরে-মুক্তোয় ভরা।
একে একে সে সবগুলো তুলে আনল।
কলসগুলো পেয়ে রাখাল খুব খুশি হলো। তখন বৃদ্ধা বললো ধনরত্ন ঘরে লুকিয়ে ছিলাম হেফাজতের জন্য। এগুলো অবৈধ নয়। আমার সওদাগর স্বামীর উপার্জিত সম্পদ। বাইরে রাখলে অন্য কারো পাওয়ার সুযোগ ছিল। দেখা যেত এক সময় আমার প্রাণের খতরা শুরু হতো। আমি চাইনি এসব অসৎ লোকদের হাতে যাক। এসব হীরে-মুক্তো ওরা হিসেব করে খরচ করত না। তুমি সহজ-সরল মানুষ। তুমি অন্যের গরু চরিয়ে দিন কাটাও। তোমার ছেঁড়া কাপড়, মলিন চেহারা আমাকে কষ্ট দেয়। তাই তোমাকেই হীরে-মুক্তো দিয়ে দিলাম।
তুমি এসব বাড়িতে নিয়ে যাও। লুকিয়ে লুকিয়ে। ধীরে ধীরে বেচে টাকা জমাও। তোমার মতো অসহায় গরিবদের সাহায্য করবে। অন্যের টাকার লোভ করবে না। কাউকে ঠকাবে না।
তুমি সৎ মানুষ। এগুলো সৎ মানুষের পুরস্কার। রাখাল ছেলে এক কলস উপকারী বৃদ্ধার জন্য রেখে দুই কলস হীরে-মুক্তো নিয়ে বাড়ি গেল। এবং তার কথা মতো কাজ করল। গরিব-দুঃখীরা তার সঙ্গী হলো। ঘরে ঘরে সুখ নেমে এলো। সবাই বন্ধু হয়ে তার পাশে থাকলো। ছায়ার মত। গ্রামের নাম দিলো সুখীপুর। দুষ্টু এবং ধনী লোকেরা হিংসায় মরে যাচ্ছিল। ক্ষতি করতে গিয়েও কিছু করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত তারা ক্ষান্ত হলো। এবার সবাই মিলে খইমুদ্দীনকে হিরো বানিয়ে দিলো।
নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সবাই ছন্দ-সুরে বললো-
কাউকে আমরা বোকা বলে
করবো না আর ভুল
প্রবাদ আছে ঠিক গোবরে
ফুটতে পারে ফুল।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ