ক্ষমা

ক্ষমা

গল্প নাজিব ওয়াদুদ এপ্রিল ২০২৩

-‘আমার রুপার ছুরিটা কে নিয়েছিস রে?’

ছুরিটা মরিয়মের খুব প্রিয়। গত বছর জন্মদিনে তার ছোট খালা তাকে এটা উপহার দিয়েছিল। 

বাড়ির সামনের ছোট্ট প্রাঙ্গণটায় খেলছিল আলী, জাহান, আর লুৎফা। তারা তার কথায় কান দিচ্ছে না দেখে সে চেঁচিয়ে বললো, ‘আমার রুপার ছুরিটা তোরা কেউ দেখেছিস?’

লুডু খেলা নিয়ে ওরা এত বেশি ব্যস্ত যে এবারও তার কথায় ওদের মধ্যে কোনো সাড়া জাগল না। হাত-পা ছুড়তে লাগল মরিয়ম। -‘এই,...এই! তোরা কথা বলছিস না কেন? দেখেছিস আমার ছুরিটা?’

এবার উত্তর দিল আলী, ‘না, না, দেখিনি।’

-‘তোরা দেখেছিস?’

-‘না।’ বলল জাহান। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে লুৎফা বলল, ‘আমিও জানি না।’

ওদের উদাসীনতা দেখে বিশ্বাস হয় না মরিয়মের। 

-‘সত্যিই তোরা নিসনি?’

-‘বললাম তো।’ আলী জবাব দিল। 

তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে জাহান বলল, ‘তোর জিনিস আমরা নিতে যাব কেন? আমাদের কি খেলার জিনিস নেই?’

ওরা সব ভাইবোন। সহোদর এবং জ্ঞাতি। ওদের বয়স সাত থেকে বারো বছরের মধ্যে। যৌথ পরিবারে একসঙ্গে মানুষ ওরা। 

একেবারে ওদের ঘাড়ের ওপর এসে দাঁড়াল মরিয়ম। 

-‘তাহলে খুঁজে পাচ্ছি না কেন?’

-‘ভালো করে খোঁজ।’ আলী বলল।

-‘মনে করে দেখ কোথায় রেখেছিস।’ লুৎফা বলল।

-‘আমি তো ডাইনিং টেবিলে রেখেছিলাম।’ মরিয়ম উত্তর দিল।

-‘ঠিক তো? তোর যা ভুলো মন!’ লুৎফা টিপ্পনী কাটল।

-‘না, না, স্পষ্ট মনে আছে আমার, আমি ওটা ডাইনিং টেবিলেই রেখেছিলাম।’

কথাটা মিথ্যে নয়। স্কুলে যাওয়ার সময় এই ছুরি দিয়ে আপেল কেটেছে মরিয়ম। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে তুলে রাখা হয়নি। ওখানেই ডাইনিং টেবিলে রেখে গিয়েছিল। এখন পেয়ারা কাটতে গিয়ে সেটা আর খুঁজে পাচ্ছে না।

-‘আমি নিশ্চিত।’ জোর দিয়ে বলল সে।

-‘হুম। তুই ওখানে রাখলি। কেউ নিল না। অথচ নেই। তাহলে কি পাখা গজাল ছুরিটার? নিজেই উড়ে গেল কোথাও? উম্?’

জাহানের স্বভাবটাই এ রকম। সব কিছুতে খোঁচা মেরে কথা বলা তার অভ্যাস। তার কথা গায়ে মাখল না মরিয়ম। -‘ইয়ার্কি করিস না ভাই। আমি আমার ছুরিটা সত্যিই খুঁজে পাচ্ছি না।’

গম্ভীর হয়ে গেল জাহান। বলল, ‘দেখ, তোরা অন্য ভাবে নিস না, এই বাড়িতে অনেক বাইরের লোক আসে। আমি আগাগোড়াই এটা পছন্দ করি না। তাদেরই কেউ মেরে দিল কিনা কে জানে!’

-‘তুই কি কাউকে সন্দেহ করছিস?’ আলী বলল।

-‘না, ঠিক তেমনটা নয়, তবে দেখ ওই যে মেয়েটা প্রায় আসে আমাদের বাড়িতে, দুধ নিয়ে আসে। মেয়েটার ভাব-ভঙি আমার ভালো লাগে না। কেমন লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকায় আমাদের বাড়ির জিনিস-পত্রের দিকে।’

জাহান হয়তো আরো কিছু বলত, কিন্তু প্রতিবাদ জানাল লুৎফা- ‘থাম ভাই, থাম, আর বলিস না। কেমন ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটা। কী সুন্দর চোখ দুটো। কত ভদ্র। মেয়েটা আমাদের চেয়েও ছোট। অথচ কত কঠিন কাজ করে। প্রত্যেক দিন কয়েকটা বাড়িতে দুধ দিয়ে বেড়ায়। এই বয়সে ও বাপ-মাকে সাহায্য করছে। আমার তো ওকে খুব ভালো লাগে। ও এ কাজ করতেই পারে না। ওকে অযথা দোষ দিস না।’

-‘তোমার যে কাকে ভালো লাগে না তাই ভাবি।’ কথাগুলো স্বগতোক্তির মতো নিচু স্বরে বলে জাহান। কেউ শুনতে পেল না।

-‘তাহলে কে নিল?’

পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন জাফর সাহেব, লুৎফার পিতা। মরিয়মের চিৎকার শুনে এগিয়ে এলেন তিনি। 

-‘কী ব্যাপার? কী হয়েছে? এত চেঁচামেচি কেন?’

-‘আমার রুপার ছুরিটা পাচ্ছি না, চাচা। মনে হয় কেউ চুরি করে নিয়েছে। কী সুন্দর ছুরিটা।’

-‘সেকি কথা! এমন সুন্দর একটা জিনিস চুরি হয়ে গেল? কে চুরি করল?’

ভেবড়ে কাঁদতে লাগল মরিয়ম।

ভাতিজিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন জাফর সাহেব। -‘কাঁদিস না মা, দেখছি আমি। বাড়ি থেকে এভাবে জিনিস চুরি হয়ে যাবে তা ভাবাই যায় না।’

-‘বাড়িটার যে কী হয়ে গেল!’ বিজ্ঞের মতো হতাশার সুরে বলল আলী।

জাফর সাহেবদের দুই ভাইয়ের সংসার। তার বড় ভাই চাকরি করেন, সপ্তাহের বেশির ভাগ দিন বাইরে থাকতে হয় তাকে। তাই জাফর সাহেবই এ বাড়ির দেখ-ভাল করেন। তিনি ভাবলেন, বাড়িতে চুরি হওয়া ভালো লক্ষ্মণ নয়। এটা তার ব্যর্থতা। অভিভাবক হিসেবে এ সমস্যার সমাধান তাকেই করতে হবে।

-‘তোমরা কি এলিজাকে জিজ্ঞেস করেছ? এমন তো হতে পারে যে সে ডাইনিং টেবিলটা মুছতে গিয়ে তুলে রেখেছে ছুরিটা।’

এলিজা এ বাড়ির কাজের মেয়ে। রান্নাঘরে তার কাছে ছুটে গেল ওরা।

-‘কী বলছ! অমন সুন্দর ছুরিটা হারিয়ে গেল!’ অবাক এলিজা। 

মরিয়ম বলল, ‘আমি আপেল কেটে ডাইনিং টেবিলের ওপর জানালার পাশে রেখেছিলাম।’

-‘হায় আল্লাহ! জানালার পাশে! নিশ্চয়ই ওই মাথা মোটা কাকটার কাজ এটা।’

-‘কাক? কী বলছ?’

-‘হ্যাঁ, আমার মনে হয় ওই কাকটারই কাজ এটা। ঘণ্টাখানেক আগে আমি ডাইনিং টেবিলে বসতে দেখেছি। আমাকে দেখে উড়ে পালিয়ে গেল। তার ঠোঁটে একটা সাদা চকচকে কী যেন ছিল। আমি তখন ভালো মতো খেয়াল করিনি। এখন মনে হচ্ছে ওটা ছুরিই হবে। হ্যাঁ, ওটা ওই রুপার ছুরিটাই! এখন মনে পড়ছে আমার। ঠিক!’

তারা অবাক হলো, কিন্তু কাক যে জিনিস-পত্র চুরি করে তা তো অস্বীকার করার জো নেই। একবার ঝড়ে একটা গাছ পড়ে গিয়েছিল। সেটায় কাকের বাসা ছিল। সে বাসায় কত যে জিনিস-পত্র পাওয়া গিয়েছিল। এমনকি একটা সোনার চেইনও ছিল।

বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুললেও বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল ছেলেমেয়েরা। তারা গাছে উঠে কাকের বাসায় অনুসন্ধান চালাতে বলল। কিন্তু কাকের বাসা বটগাছের মতো বিশাল ফজলি আমগাছের একেবারে মগডালে। সেখানে উঠবে কে?

জাফর সাহেব বললেন, ‘আমরা তো কেউ পারব না। অন্য কেউ রাজি হবে বলেও মনে হয় না। পরের একটা ছোট্ট ছুরি উদ্ধারের জন্য জীবনের ঝুঁকি কেউ নিবে না। বিশেষত ছুরিটা আদৌ সেখানে পাওয়া যাবে কিনা সেটাই যখন নিশ্চিত নয়।’  

-‘তাহলে কী হবে!’

হতাশা নেমে এলো তাদের মধ্যে। লুৎফা বলল, ‘আমার মনে হয় কাকের কাজ নয় এটা।’

আলী পকেটে হাত ঢুকিয়ে গম্ভীর মুখে কী যেন ভাবছিল এতক্ষণ। সেদিকে কারো খেয়ালও ছিল না। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ‘ইউরেকা! ইউরেকা!’

তার চিৎকারে সবার ভিরমি খাবার জোগাড়। চমকে উঠে তার দিকে তাকাল সবাই। -‘কী হলো! চেঁচাচ্ছ কেন?’

-‘আমি কাকের বাসা পরীক্ষা করে দেখার উপায় পেয়ে গেছি!’

বিস্মিত সবাই। 

-‘হলে তো ভালোই। তবে না চেঁচিয়ে বলো তো দেখি কী উপায় তুমি খুঁজে পেয়েছ?’ জাফর সাহেব বললেন।

-‘একটা পোলেমোস্কোপ লাগবে।’ 

-‘সেটা আবার কী? লোহার লম্বা হুক নাকি?’ বলল লুৎফা। তার সঙ্গে মাথা নাড়ল অন্যরাও। 

-‘কী মূর্খ সব! কিচ্ছু জানে না। আরে...’ যন্ত্রের বর্ণনা দিতে যাচ্ছিল আলী, তাকে হাতের ইশারায় নিরস্ত করে জাফর সাহেব বললেন, ‘তার চেয়ে তুমি আগে বলো ওটা দিয়ে তুমি কী করতে চাও।’

আলী বেশ বিজ্ঞজনোচিত কণ্ঠে শুরু করল, ‘যুদ্ধের সময় নিজেদের গোপন রেখে শত্রুসেনাদের গতিবিধি জানার জন্য এই যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।’

-‘যুদ্ধের সময়?’ মরিয়ম কপাল চাপড়ে বলল।

জাফর সাহেব তাকে ইশারায় থামতে বললেন। 

আলী বলে চলল, ‘একটা লম্বা লাঠির আগায় বড়-সড় আয়না বেঁধে সেটা দুর্গের দেয়ালে বা চূড়ায় জুত মতো লটকে দেওয়া হয়। আরেকটা আয়না নিচে রাখা হয়। ওপরের আয়নায় বাইরের দৃশ্য ধরা পড়ে। সেই দৃশ্য ভেতরের আয়নায় প্রতিফলিত হয়। এভাবে বাইরে শত্রুদের আনাগোনা পর্যবেক্ষণ করা হয়।’

-‘আমাদের তো দুটো বড়-বড় আয়না আছে।’ লুৎফা বলল।

-‘এতসবের দরকার কী? আমাদের একটা টেলিস্কোপ আছে না? সেটাকে কাজে লাগালেও তো হয়।’ জাহান বলল। 

-‘বাহ! ভালো আইডিয়া। আব্বা, জাহানের বুদ্ধি আছে বলতে হবে। পোলেমোস্কোপ সংগ্রহ করা বা তৈরি করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমরা বরং একটা লম্বা মই আনি... ওই যে বিদ্যুৎ এবং টেলিফোন বিভাগের লোকেরা ব্যবহার করে সেই রকম মই। ওই মইয়ে উঠে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলে কাকের বাসার মধ্যে কী আছে সব দেখা যাবে।’

চোখ-মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটিয়ে আশপাশে গর্বভরে তাকাল আলী। তার গর্বে অন্যরাও গর্বিত। 

মৃদু হাসলেন জাফর সাহেব। 

-‘তা সম্ভব নয়। কেননা ও-রকম লম্বা মই পাওয়া দুষ্কর। পেলেও সেই মইয়ে ওঠার মতো দক্ষ ও সাহসী লোক পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। তা-ও যদি মেলে তো আরেক মুশকিল হলো, গাছের ডালপালার আড়ালে লুকানো কাকের বাসা টেলিস্কোপের লেন্সে ধরা পড়বে না।’  

হতাশায় ভেঙে পড়ল সবাই।

জাফর সাহেব বললেন, ‘হতাশার কিছু নেই। চলো, আমরা বরং সবাই মিলে ছুরিটা আরেকবার খুঁজি। কী বলো তোমরা?’

সম্মত সবাই। 

-‘মরিয়ম, তুমি তো আপেল বের করেছিলে রান্নাঘরের স্টোর থেকে, তাই না?’

মাথা নাড়ল মরিয়ম।

-‘তাহলে চলো আমরা সেখান থেকেই শুরু করি। চাবি আনো।’ বললেন জাফর সাহেব।

একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ খুঁজে পেল ছেলেমেয়েরা। তারা হইহই করে উঠল। 

জাফর সাহেব বললেন, ‘কোনো জিনিস হারিয়ে গেলে কী দোয়া পড়তে হয়?’

সবাই চেঁচিয়ে উঠল, ‘জানি, জানি- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’

-‘কেউ মারা গেলেও এই দোয়া পড়তে হয়। দুঃসংবাদ শুনলেও।’ আলী বলল।

খালি হাতে ফিরে এলো মরিয়ম। 

-‘চাবি নেই।’

-‘নেই? কেন নেই? চাবিটা যেখানে থাকে সেখানে রাখোনি?’ 

-‘সেখানেই তো রেখেছিলাম। অবশ্যই রেখেছিলাম।’ জোর দিয়ে বলল মরিয়ম।

-‘তাহলে গেল কোথায়?’ লুৎফা বলল।

-‘চাবিরও পাখা গজাল তাহলে?’ জাহান বলল।

-‘অসম্ভব। আমি সত্যি বলছি, আমি চাবিটা যথাস্থানেই রেখেছি।’

ঠোঁটে আঙুল চেপে ভাবছেন জাফর সাহেব। -‘ডালমে তো কুছ কালা হ্যায় দেখছি।’

-‘চাবিটার মনে হয় পাখা গজিয়েছে!’ 

-‘না, না। অসম্ভব। চাবিটা যেখানে ঝোলানো থাকে আমি সেখানেই রেখেছিলাম।’ 

-‘আচ্ছা, ঠিক আছে। দেখা যাক।’ ঠোঁট থেকে আঙুল সরিয়ে বললেন জাফর সাহেব। তার কপালে মৃদু ভাঁজ। -‘চলো, স্টোরে যাই।’

স্টোরটা রান্নাঘরের সঙ্গে লাগানো। রান্নার জিনিস-পত্র ছাড়াও শাক-সবজি এবং ফল-মূলও এখানে রাখা হয়। রান্নাঘর দিয়েই ঢুকতে হয় সেখানে।

-‘হায় আল্লাহ! কী এটা?’ মরিয়ম প্রায় আঁতকে উঠল। রান্নাঘরের কাপবোর্ডের ওপর পড়ে আছে চাবির গোছাটা। গুড়ে-গুড়ে মাখামাখি একেবারে। -‘চাবিটা তো এখানে!’

-‘এখানে কী করে এলো?’ জাহান বলল।

-‘আর এতে গুড় মাখল কী করে?’ লুৎফা বলল।

-‘আমি তো আগেই বলেছিলাম যে চাবিটার পাখা গজিয়েছে। উড়ে গিয়ে গুড় খেয়েছে তারপর ফিরে এসেছে। তবে হাত-মুখ ধোয়ার অবসর পায়নি।’ আলী টিপ্পনী কাটল।

-‘কী আজে-বাজে বকছ ভাইয়া?’ লুৎফা বলল।

-‘ঠিকই বলছি। মরিয়মের খেজুরের গুড় খুব পছন্দ কিনা।’

-‘না, না। অসম্ভব। আমি না।’

-‘ঘটনা তো গুরুতর।’ ভাবলেন জাফর সাহেব। তারপর চাবির গোছাটা বেসিনে ধুয়ে নিলেন। 

-‘আমাদের সামনে মনে হয় আরো সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।’

স্টোরের তালা খুললেন তিনি। ভেতরে ঢুকল সবাই। একটু খুঁজতেই তারা বিস্মিত হয়ে দেখল মরিয়মের রুপার ছুরিটা খেজুর গুড়ের পাটালির ওপর শোভা পাচ্ছে। বেশ বড়সড় পাটালিটা। কদিন আগে গ্রাম থেকে দিয়ে গিয়েছে পাঁচটা পাটালি। একদিন পিঠা বানিয়ে খাওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ গুড়ই অবশিষ্ট রয়েছে। তিনি দেখলেন একটা পাটালির প্রায় অর্ধেকটা কেটে নেওয়া হয়েছে। 

ছুরি পেয়ে ছেলেমেয়েরা আনন্দে হইহই করে উঠল। কিন্তু জাফর সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল।

আলী সবার বড়। তার অনেকটা সামাজিক-সাংসারিক বুদ্ধি হয়েছে। সে তার পিতার কাছে গিয়ে চুপিচুপি বলল, ‘মনে হচ্ছে এটা একটা চুরি।’

ছেলের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তিনিও চুপিচুপি বললেন, ‘কাউকে বোলো না। আমি দেখছি।’ তারপর গলা ঝেড়ে বেশ উচ্চস্বরে বললেন, ‘ছেলেমেয়েরা, পেয়ে গেলে তো তোমাদের রুপার ছুরি? তোমরা এখন খেলো গে, যাও।’

মরিয়ম বলল, ‘তাহলে এলিজা খালা কী করে কাককে ছুরিটা নিয়ে যেতে দেখল?’

জাফর সাহেব বললেন, ‘উত্তেজনার সময় এ রকম ভ্রম হয় মানুষের। ভুল দেখে, ভুল শোনে, বা ভুল ব্যাখ্যা করে। সে রকমই হয়েছে মনে হচ্ছে। যাই হোক, এসব নিয়ে তোমাদের ভাবার দরকার নেই। আল্লাহর শুকরিয়া করো যে সত্যি-সত্যিই কাক ছুরিটা নিয়ে যায়নি। তাহলে সেটা পাওয়াই যেত না। সবাই আল্হাম্দুলিল্লাহ পড়ো।’

সমস্বরে সবাই বলল, ‘আল্হাম্দুলিল্লøাহ।’ 

তারা সবাই আবার বাইরের প্রাঙ্গণে এসে বসল। 

জাফর সাহেব বললেন, ‘চুরি আর প্রতারণা খুব খারাপ কাজ। আল্লাহ ঘৃণা করেন। এ কাজ যারা করে তাদের শাস্তি প্রাপ্য হয়।’

-‘তাহলে তো এলিজা খালাকে শাস্তি পেতে হবে।’ আলী বলল।

-‘ওভাবে বলো না। তার অবস্থায় পড়লে আমরা হয়তো এর চেয়েও বড় অপরাধ করতাম! কে জানে, তাই না? ভেবে দেখ, আল্লাহ কিন্তু ক্ষমা করতেও বলেছেন। আমাদের রাসূল বলেছেন, যে অন্যের দোষ ঢাকে আল্লাহ শেষ বিচারের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন।’

ছেলেমেয়েরা গম্ভীর হয়ে গেল। 

-‘তাহলে তো আমাদের এলিজা খালাকে ক্ষমা করাই উচিত।’ মরিয়ম বলল।

-‘শুধু তা-ই নয়, তার চুরির কথা আমাদের গোপন রাখা উচিত।’ লুৎফা বলল।

-‘আমার মাথায় কিছু খেলছে না।’ জাহান বলল। 

-‘কিন্তু চাবি চুরি ছোট-খাটো ঘটনা নয়, তাই না?’ আলী বলল বড় মানুষের মতো গম্ভীর গলায়।

-‘সেটাই ভাবাচ্ছে আমাকে। এত যে আল্লাহর ভয়ের কথা বলি আমরা তার কথা কী করে ভুলে গেল এলিজা! সেটাই আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। তবে রাসূল (সা) বলেছেন, দারিদ্র্য মানুষকে কুফরের দিকে ঠেলে দেয়। আমাকে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে।’ জাফর সাহেব বললেন। 

-‘তোমরা এ নিয়ে আর কোনো আলোচনা করবে না। এলিজাকে কিছু বলবে না। তোমাদের মায়েরা বাড়ি ফিরলে তাদেরও কিছু বলবে না। যা বলার, যা করার সব আমি করব। ঠিক আছে?’

মাথা নাড়ল ওরা সবাই। ওরা কখনো বড়দের অবাধ্য হয় না। কারণ ওরা জানে, বড়রা অভিজ্ঞ, বড়রা সবকিছু ভালো জানেন, তারা যা করেন তাদের ভালোর জন্যই করেন। ওরা আবার খেলতে লাগল।

জাফর সাহেব এলিজাকে বসার ঘরে ডাকলেন। ঘরে ঢুকেই সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল তার পায়ের ওপর। -‘আমাকে মাফ করেন। আমি ভুল করেছি।’

-‘ওঠো। এমন করলে কেন?’

-‘আমার ছেলেটা খেজুরের গুড় খুব পছন্দ করে। কদিন থেকে খেতে চাচ্ছিল। কিন্তু গুড়ের এত দাম, আমি কিনতে পারছিলাম না।’

কথাটা শেলের মতো বিঁধল জাফর সাহেবের বুকে। 

-‘আহ! আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। কিন্তু তুমি বলে নিতে। আমরা কি দিতাম না?’

-‘সেটাই আমার ভুল। আমাকে মাফ করুন।’ কাঁদতে কাঁদতে বলল এলিজা।

জাফর সাহেব বললেন, ‘তওবা করবে, ক্ষমা চাইবে আল্লাহর কাছে। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ আরো কিছু নসিহত করলেন তিনি। তারপর ছেলেমেয়েদের কাছে গেলেন। তার মন আনন্দে ভরপুর। 

খানিকক্ষণ পর এলিজা তাদের জন্য বিকেলের চা-নাস্তা নিয়ে এলো। 

-‘এলিজা, আমার চায়ে চিনি দাওনি তো?’ জিজ্ঞেস করলেন জাফর সাহেব।

-‘না।’ এলিজা বলল।

-‘আজকে একটু দিতে পারতে।’ বলে হাসলেন তিনি। 

-‘তাহলে আমি চিনি আনছি এখনি।’ এলিজা দৌড় দিল রান্নাঘরের দিকে।

ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্পে মাতলেন জাফর সাহেব।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ