ক্রোধের আগুন    -আহমদ মতিউর রহমান

ক্রোধের আগুন -আহমদ মতিউর রহমান

গল্প জুন ২০১৭

সবেমাত্র ভোর হয়েছে। গাছে গাছে পাখি ডাকছে। কিচির মিচির শব্দে। এখন শান্ত মংডু শহর। শহর বলতে মংডু টাউনশিপ মানে উপশহর। মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম উপকূলের একটি শান্ত শহর। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নাফ নদী। তারপর সমুদ্র, অথৈ সমুদ্র। ১০ অক্টোবর ২০১৬। মংডুর মিউথুগি গ্রামেও স্বাভাবিক নিয়মে ভোর হলো। সূর্য উঠলো। পাখি ডাকলো। সকালের ঝিরি ঝিরি হাওয়ায় মোহাম্মদ হাতেম ওরফে মিন নিহ-দের বাড়ির গাছগুলোও হাওয়ায় দোল খাচ্ছিল। বাবা মা দাদা দুই ভাইবোন এ নিয়ে হাতেমদের পরিবার। হাতেমের আব্বা মোহাম্মদ ইয়াদ হোসেন স্থানীয় একটি স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক। মা ফাতেমা একজন গৃহিণী। আর তার দুই ভাইবোন গুলনাহার আর জাফর হাতেমের চেয়ে বয়সে ছোট। ওরা সবাই স্কুলের ছাত্র। আর ওদের দাদা মোহাম্মদ আবেদ হোসেন বৃদ্ধ হয়েছেন বলে কিছুই করেন না। শরীরে কুলালে সাংসারিক কিছু কাজকর্ম আর বাড়ির চার পাশে ক্ষেতখামার দেখাশোনা করেন। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। বার্মিজ রাখাইনদের চোখ এড়িয়ে সম্ভব হলে কাছের একটি মসজিদে যান। না হলে বাড়িতেই সারেন নামাজ। এই ধর্মীয় পরিচয়টাই তাদের সবাইকে মিয়ানমারের আর সবার শত্রু বানিয়েছে। তা না হলে প্রতিবেশী রাখাইন বা রাখাইন নেতারা ভুলেও বলতে পারবে না তারা অশান্তির কোন কাজ করেছে বা কোনভাবে তাতে জড়িত। কিন্তু তাতে কী। পদে পদে সন্দেহের চোখে তাকায় রাখাইন নেতারা। কাজে-অকাজে বাড়িতে এসে হাজির হয়। এই তো সে দিন এসে গেলেন রাখাইন নেতা খিউ মিন্ট। অনেকক্ষণ বসে থেকে গল্প করলেন আবেদ হোসেনের সাথে। চা খেলেন, মিষ্টি খেলেন, বিস্কুট খেলেন। হাতেম আর হাতেমের আব্বা বাড়ি ছিলেন না। হাতেমের ছোট দুই ভাইবোনকে কাছে বসিয়ে আদর করলেন। তাকে ডাকতে এলো আরো চারজন রাখাইন মাঝারি নেতা। তাদের ডাকে এক সময় চলেও গেলেন খিউ মিন্ট।
খিউ চাচার সাথে পথে দেখা হাতেমের। দেখে সম্মান জানালো সেÑ হাসি মুখে কথা বললো হাতেম।
: ভালো আছেন খিউ চাচা?
: হ্যাঁ, তুমি কেমন?
: ভালো।
: তোমাদের বাড়ি গিয়ে সবার খোঁজ নিয়ে এলাম। মিষ্টি খেলাম, চা খেলাম।
: তাই নাকি? আমি একটু বাজারে গিয়েছিলাম। আজ স্কুল বন্ধ তো।
: ঠিক আছে। বাড়ি যাও। আবার আসবোখন।
খিউ মিন্ট চাচা হেসে হেসে কথা বললেও তার সঙ্গীদের চাহনি আর আচরণ ভালো লাগলো না হাতেমের।
কি আর করা! মংডুতে এরকমভাবেই বাঁচতে হয় রোহিঙ্গা মুসলমানদের। বলতে গেলে ওদের দয়ায় বেঁচে থাকা। এর নাম যে জীবন নয় তা প্রতিটা রোহিঙ্গা নর-নারী আর শিশু জানে। কখন কার উপর বিনা অপরাধে খড়গ নেমে আসবে কেউ জানে না। এই গ্রামে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি হলেও বেশ কিছু রাখাইন বাড়ি আছে। দিন দিন তাদের বাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। হাতেমদের বাড়ি গ্রামের উত্তর প্রান্তে। মাঝামাঝি এলাকায় খিউ মিন্টের বাড়ি। সেখানে পর পর কয়েকটি বাড়ি রাখাইনদের।

দুই.
মিউথুগি গ্রামটার আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য আছে। মংডু শহরের নিকটবর্তী এই গ্রামটাতে আছে একটা প্রাইমারি স্কুল। স্কুলের সাইনবোর্ড বর্মি ভাষার হলেও এ স্কুলে রাখাইন ও মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা পড়ালেখা করতে পারে। এ ছাড়া এ গ্রামে একটা বাংলা স্কুলও আছে। রাখাইন আর মুসলমানরা বলতে গেলে শান্তিপূর্ণভাবেই বসবাস করে আসছে। গ্রামে একটা মসজিদ আছে, যেখানে মুসলিমরা নিয়মিত নামাজ আদায় করতে পারে।
টিনশেড স্কুল ভবনটির সামনে খোলা সবুজ মাঠ। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। কোথাও কোথাও কাঁটাতার উধাও হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে রয়েছে গাছের গুঁড়ি বা খুঁটি দিয়ে বানানো পিলার। দূর থেকে মনে হবে কোন ছাত্র দাঁড়িয়ে আছে। এই স্কুলের ক্লাস ফাইভের ছাত্র মোহাম্মদ হাতেম ওরফে মিন নিহ। মিন নিহ ওর বর্মি নাম। ওর দুই ভাইবোনেরও আছে বর্মি নাম। খিন ইয়াও হচ্ছে জাফরের নাম আর আন তাও নাম গুলনাহারের। এখানে প্রত্যেক মুসলিমের বর্মি নাম আছে। স্কুলে বা মহল্লায় ওটাই তার পরিচয়। মুসলিম নাম শুধু বাড়ির বা নিজেদের জন্য।
অবশ্য বাংলা স্কুলে বা ধর্মীয় স্কুলে এ সমস্যা নেই। সেখানে নিজ নিজ মুসলিম নাম চলতে পারে।
স্কুলে লেখাপড়ার সময়, খেলাধুলার সময় রাখাইন বর্মি আর মুসলিম পরিচয় বলতে কিছু থাকে না। ওরা একের সঙ্গে আরেকজনে মেশে স্বাভাবিক নিয়মেই। নাম পরিচয় মুখ্য হয়ে ওঠে নাÑ মুখ্য হয়ে ওঠে খেলার আনন্দ, পড়ার আনন্দ আর প্রতিযোগিতা।
স্কুলে আসার পথে পড়ে মংডুর একটি প্রধান সড়ক। সেই সড়কের বাম পাশে অবস্থিত মংডু ওয়াচ টাওয়ার। এতে আছে একটি ঘড়ি, যা দূর থেকে সবাইকে সময় জানান দেয়। এই ওয়াচ টাওয়ারটা খুব ভালো লাগে হাতেমের।
একদিন ওয়াচ টাওয়ার অতিক্রম করার সময় হাতেম সেখানে দেখতে পায় একটি মিলিটারি ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। তাতে ছয়-সাতজন উর্দিপরা বর্মি সেনা। এটা দেখেই ছাঁৎ করে ওঠে হাতেমের বুক। একটা ভয়ের অনুভূতি। অবশ্য এটা মংডুর নিত্যকার দৃশ্য। অনেক সময় তারা সাদা পোশাকেও আসে। মিলিটারি ভ্যান কী কাজে আসে আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায় তারাই জানে।
তবে মাঝে মাঝে রোহিঙ্গাদের ধরে নেয় বলে শোনা যায়। যাদের ধরে নেয় তারা আর কোনদিন ফিরে আসে না।
এই ভয় আর আতঙ্কের মাঝেই কাটে তাদের জীবন। দেখতে দেখতে গা সহা হয়ে গেছে।
ভ্যানটা পেরিয়ে এসে হাতের ডান পাশের রাস্তা ধরে খানিকটা এগোলে তবে মিউথুগি গ্রামের পথ। হাতেমদের বাড়ি এই গ্রামেরই উত্তর পাড়ায়। গ্রামের মধ্যখানে বড় এক খাল থাকায় ঘুরে মেইন রোড হয়ে স্কুলে আসতে হয়। বহু দিন ধরে শুনে আসছে এই খালের ওপর সেতু হবে। কিন্তু তা আর হয় না। একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে একটি মিলিটারি ভ্যানে খিউ মিন্ট কাকাকে দেখে থমকে যায় হাতেম। তার সঙ্গে আরেকজন লোক। খিউ মিন্ট সরকারি দলের স্থানীয় নেতা। তাই মিলিটারি বা পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে তার ভাব আছে। হতে পারে সে কারণে মিলিটারি ভ্যানে চড়ে কোথাও যাচ্ছেন। তাকে দেখে দ্রুত পা চালিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়েছে হাতেম। খামাখা বিপদ ডেকে আনা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ওই মিলিটারি আর পুলিশ সে দু’ চোখে দেখতে পারে না। এগুলো সব অত্যাচারীর দল। মানুষ মারা আর নির্যাতন করাই তাদের কাজ। তাদের সাথে কখনো যোগ দেয় স্থানীয় রাজনৈতিক ও বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা। মুসলিম নির্যাতনে সবাই একাট্টা।

তিন.
সে দিন সকালে বাড়ির আঙিনায় পুঁই শাক আর ঢেঁড়স ক্ষেতে নিড়ানির কাজ করছিলেন বৃদ্ধ আবেদ হোসেন। তিনি বরাবরই ভোরে ওঠেন। ফজর নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করেন। এরপর পায়চারি করতে বের হন। তা সেরে গাছগাছালি দেখাশোনা করেন। তাদের টিনশেড বিল্ডিং এর চার পাশটা বাঁশের ঝাঁঝড়ি মতো বেড়া দেয়া। দেয়াল তোলার সাধ্য এখনো হয়নি হাতেমের আব্বার।
সকালের রোদ এসে পড়েছে সেই আঙিনায়। রোদে চকচক করছে পুঁই শাকের ডগাটা। আর সেটা বাতাসে দোল খাচ্ছে। গেটের পাশে ছোট বোগেনভেলিয়ার ঝাড়। বাতাসে দোল খাচ্ছে সেটিও। হালকা বেগুনি আর গোলাপি লালমত থোকা থোকা ফুল ফুটে আছে। রোদ এসে পড়েছে তাতেও। দেখতে বেশ লাগে।
এরই মধ্যে উঠে পড়েছে হাতেম। গুলনাহার আর জাফরকে তাড়া লাগান মা ফাতেমা।
: কী হলো? পড়ে পড়ে আর কত ঘুমাবি। ওঠ, উঠে পড়। তোদের নিয়ে আর পারি না। কেউ যদি কথা শোনে।
: এই তো আম্মা। আমি কখন উঠে পড়েছি। নাস্তা দাও। হাতেম মাকে তাড়া দেয়।
: দিচ্ছিরে বাবা দিচ্ছি। তোর আব্বা কোথায় গেল? তার তো কোন খবর নেই মধ্যরাত থেকে।
: বল কী? কী হয়েছে? দাদা জানে?
: না না তোর দাদাকে কিছু বলিনি। কী যেন খবর পেয়ে রাত দুটায় বেরিয়ে গেল তোর আব্বা।
হাতেম বুঝতে পারলো নির্ঘাত কোন খারাপ খবর।
তা না হলে অত রাতে? ...
ভাবতে গিয়েও কোন থৈ পায় না।
অবশ্য রাতে রাতে গোপনে চলাফেরা খবর আদান প্রদান করা মংডুতে রোহিঙ্গাদের নিয়মিত ব্যাপারই। রাখাইনগুলোর চোখ এড়িয়ে না চললে যে আর রক্ষা নেই।
এসব ভাবতে ভাবতে হুড়মুড় করে এসে ঘরে ঢোকেন হাতেমের আব্বা। তার এই আচরণে অবাক হন ফাতেমা।
: কী হয়েছে? খারাপ কিছু? কোনো দুঃসংবাদ?
: বলছি হাতেমের মা। আব্বা কোথায়?
: ভোরে উঠেছে দেখেছি। বাগানে আছে হয়তো।
তারা এসব কথা বলতে বলতে মোহাম্মদ আবেদ ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে ঘরে ঢোকেন। হাত-পা ধুয়ে গামছা খুঁজে মোছার চেষ্টা করেন।
ছেলে ও বৌমার মুখ থমথমে দেখেই খারাপ কিছু আন্দাজ করেন বুড়ো আবেদ।
হাতেমের আব্বাই মুখ খোলেন:
: আব্বা শুনেছেন কিছু?
: নাতো! কি খবর?
: খুব খারাপ খবর।
ফাতেমা কিছু বলছেন না। হাঁ করে শুনছেন বাবা ও ছেলের কথাবার্তা। মনে মনে ভাবেন রোহিঙ্গাদের জন্য শুধু খারাপ খবরই তিনি শুনে আসছেন। কোন কালে ভালো খবর আসবে কি না আল্লাহই জানেন।
: আহা বলবি তো বাজান! অস্থির হয়ে পড়েন বুড়ো। শরীরে আগের সেই শক্তি আর নেই। খারাপ খবর শুনে সড়কি বল্লম হাতে কত ছুটে গেছেন। লড়াই করেই মংডুতে মুসলমানদের টিকে থাকতে হয়েছে। ইয়া আলী বলে কত লড়াই করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তার শরীরে যোদ্ধা ফরহাদের রক্ত। ছেলে ও নাতিরা তার কিছুই পায়নি।
: বলছি বলছি। বাবাকে শান্ত করেন ইয়াদ হোসেন।
সব শুনে থ হয়ে গেলেন হাতেমের দাদা ও মা। হাতেমও। হাতেম ক্লাস ফাইভের ছাত্র। সে মনে করে তার কব্জিতে খুব জোর। আর ভালো-মন্দ অনেক কিছুই বুঝতে শিখেছে।
ঘটনা খুলে বললেন ইয়াদ হোসেন। গতকাল নাকি রোহিঙ্গা বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা বর্মি সীমান্ত রক্ষীদের উপর হামলা চালিয়ে নয় জনকে মেরে ফেলেছে। এই ঘটনা ঘটেছে মংডুর কাছে সীমান্ত চেকপোস্টে। এই ঘটনার পর ফুঁসে উঠেছে মিয়ানমার বাহিনী। তারা ইতোমধ্যেই ক্র্যাকডাউন শুরু করেছে। কালকের ঘটনার পর তাদের অত্যাচার আরো অনেক গুণ বাড়বে এটা ধরে নেয়াই যায়। আর নয়জন সীমান্তরক্ষী হত্যা একটা বাহানা মাত্র, ভালো করেই জানে সবাই। ঘটনা সত্য-মিথ্যা যাই হোক এর ফল যে ফলবে ভয়ানক সেটা বুঝে গেছে সকল রোহিঙ্গা। তারা সবাই এখন নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে। আর সবাই একথা বিশ্বাসও করছে না।
সব শুনে অবাক হলেন আবেদ হোসেন। কয়েক পুরুষ ধরে তারা মংডুর বাসিন্দা। বর্মি আর রাখাইনদের ভালো করেই চেনা আছে তার।
আবেদ হোসেনের বাবা ফরহাদ হোসেন ছিলেন বার্মার একজন স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা। জেনারেল অং সান বার্মাকে ব্রিটিশের হাত থেকে মুক্ত করতে যে সংগ্রাম করেছেন তাতে সহায়তা করেছেন মুসলমান যোদ্ধারা। জেনারেল অং সান এ জন্য কৃতজ্ঞ ছিলেন রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত বার্মার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে জেনারেল অং সানের মন্ত্রিসভায় মুসলমান সদস্যও ছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র ছয় মাস আগে আততায়ীর হাতে নিহত হন জেনারেল অং সান। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারতো। আর শত শত বছর ধরে আরাকানে বসবাস করে আসছে রোহিঙ্গা মুসলমানরা। এগুলো সবই ইতিহাসের কথা। সেনা সরকার আগের আরাকানের নাম বদলে করেছে রাখাইন স্টেট। আকিয়াবের নাম করেছে সিত্তুই। আগেকার বার্মা নামটাও এখন আর নেই। এর স্থলে হয়েছে মিয়ানমার। ইতিহাস খ্যাত রাজধানী রেঙ্গুন এখন ইয়াঙ্গুন। আর সেটা এখন রাজধানীও নয়। কত পরিবর্তন আর সংস্কার। কিন্তু রোহিঙ্গারা এখনো অধিকারহারা। অন্যের কথা বাদ। জেনারেল অং সানের মেয়ে বর্তমান মিয়ানমারের সর্বময় নেত্রী অং সান সু চি-ই তো আগেকার সব কথা বেমালুম ভুলে বসে আছেন। অথচ রোহিঙ্গারা কত আশায় না বুক বেঁধেছিল সু চি ক্ষমতায় এলে সব ঠিক হয়ে যাবে। রোহিঙ্গারা পাবে তাদের অধিকার। এখন তারা রাষ্ট্রবিহীন লোকÑ স্টেটলেস পিপল। তা আর থাকতে হবে না। পাবে নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার। শান্তিতে থাকতে পারবে মংডু, আকিয়াব, বুচিডংসহ আরাকানের সব জায়গায়। আর এখন। সব ভুলে বসে আছেন সু চি। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে আবেদ হোসেনের বুক থেকে।
: আব্বা! ইয়াদ হোসেনের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলেন যেন আবেদ।
: হ্যাঁ বল বেটা।
: কী ভাবছেন? আর ভাবাভাবির সময় নেই। ওরা মহা খাপ্পা হয়ে আছে। যা করণীয় দ্রুত করতে হবে।
: হ্যাঁ তাই কর বাবা। আমার কিছু ভালো লাগছে না।
ফাতেমা স্বামীর হাবভাবে আগেভাগেই বুঝে গেছেন সব। ছোট ছেলে মেয়ে দুটোকে টেনে ঘুম থেকে উঠিয়ে ব্যাগ আর বোঁচকায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভরে ফেলেছেন। হাতেমও তৈরি হচ্ছে তার ব্যাগ গুছিয়ে। ইতোমধ্যে নাস্তা বানানো শেষ হয়েছিল। বলতে গেলে জোর করে সবাইকে গিলিয়ে বের হওয়ার জন্য তৈরি করেন ফাতেমা। একে নাস্তা খাওয়া বলে না। চায়ের পর্ব তো বাদই থাকলো। ফাতেমার চোখ কোন বাধা মানছে না। অনবরত কেঁদেই চলেছেন ফাতেমা। এই বাড়ি এই সংসার আর সংসারের সব কিছু ফেলে শুধু জীবন বাঁচাতে চলে যেতে হবে! এগুলো যে কত আপন, এসব ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট কে বুঝবে।

চার.
একটু পরেই পাশের বাড়ি থেকে দৌড়ে এলেন সামিনা ভাবী। নূর আলমের স্ত্রী। তাদের দুই ছেলে মেয়ে।
: ভাবী, খবর শুনেছেন তো? সামিনার প্রশ্ন।
: হ্যাঁ ভাবী, আমরা তৈরি হচ্ছি। চোখের পানি মুছতে মুছতে জবাব দিলেন ফাতেমা। লক্ষ করলেন সামিনার চোখও ছল ছল।
: চলেন, বসে থাকার আর সময় নেই।
গ্রামের পর গ্রাম জ্বালাতে জ্বালাতে আসছে শুয়রগুলো। মংডুতে এমন ধ্বংসকান্ড আগে আর কেউ দেখেনি।
হায় আল্লাহ! আমাদের কী হবে। সব রোহিঙ্গা নর-নারীর একই প্রশ্ন। প্রশ্ন ফাতেমারও।
: আপাতত বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে। তার পর দেখা যাবে কী হয়। বললেন সামিনা। ও পাড়ার হাসান আলী পাকা খবর নিয়ে এসেছে, মংডুর দক্ষিণের কয়েকটি গ্রাম একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে মিলিটারি আর সীমান্ত পুলিশ। অনেককে হত্যাও করেছে। আরো জানালেন সামিনা।
: আমরা যাচ্ছি ভাবী। খোদা হাফেজ। সামিনা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
: খোদা হাফেজ। যান। আমরাও আসছি।
হাতেমের আব্বা জানতে চাইলেন সামিনা ভাবী কী বলে গেলেন।
ফাতেমা স্বামীকে সব বুঝিয়ে বললেন। এমন সময় দূরে দেখা যেতে লাগলো কালো ধোঁয়া গলগল করে আকাশে উঠছে। সেই সাথে কামান না কিসের যেন গুড়–ম গুড়–ম শব্দ। নিশ্চয়ই কোন বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে হার্মাদগুলো।
এক সময় বেরিয়ে পড়লো হাতেমদের পরিবার। এমন সময় বেঁকে বসলেন হাতেমের দাদা।
: আমি যাব না। তোমরা যাও। মরতে হয় তো নিজের ভিটেতেই মরবো।
: তা হয় না আব্বা। আপনাকে এভাবে রেখে আমরা যেতে পারি না। বললেন ইয়াদ হোসেন। ডুকরে কেঁদে উঠলো গুলনাহার, জাফর ও হাতেম।
কোন মতেই রাজি হলেন না বৃদ্ধ। তার একই কথাÑ আমি তো কোন অপরাধ করিনি। আমি কেন আমার বাড়ি ছেড়ে যাবো। মরতে হয় তো নিজ ভিটেতেই মরবো। এই গোঁ ধরা বুড়োকে বোঝায় এমন সাধ্য কার।
অগত্যা নারী শিশুদের কথা ভেবে ইয়াদ হোসেনের পরিবারকে বেরিয়ে পড়তেই হলো। এখানে থাকলে বেঘোরে মৃত্যু।
দুই ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে আল বেয়ে হেঁটে চলেছে সবাই। ইয়াদ, হাতেম, ফাতেমা, গুলনাহার ও জাফর। নিরাপদ স্থানের উদ্দেশে। কী জানি কখন হামলে পড়ে রাখাইন আর মিলিটারি। ইয়াদ ঠিক করলেন রাতের কোনো এক প্রহরে বাবাকে দেখে যাবেন।

পাঁচ.
জঙ্গলমতো একটা এলাকায় দুটি রাত পার করে দিয়েছে শত শত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। ঘন বনাঞ্চল বলে এখান পর্যন্ত এসে পৌঁছতে পারেনি মিলিটারি। সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পড়ে মার খাওয়ার ভয়ে রাখাইন বার্মিজদের ছোট ছোট কোন দলও এ পর্যন্ত আসেনি। ফলে এখানে আশ্রয় গ্রহণকারীরা এখনো অক্ষত আছে। এর নাম জীবন রক্ষা, কায় ক্লেশে বেঁচে থাকা। নিঃশ্বাসটুকু থাকুক এখন শুধু এইটুকু চাওয়া। এর নাম জীবন নয়।
একজন রাতে গিয়ে খবর নিয়ে এসেছে খিউ মিন্টের লোকেরা আর মিলিটারি মিলে তাদের দুশো বাড়িতে আগুন দিয়েছে। নিমেষে পুড়ে সব ছাই হয়ে গেছে। পুড়ে গেছে ইয়াদ হোসেনের বাড়িঘর। ধ্বংসের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুধু পোড়া আধপোড়া খুঁটি। আবেদ হোসেনকে বাড়িতে একাকী পেয়ে নিজ হাতে ছুরি চালিয়ে খুন করেছে খিউ মিন্ট। আর যাদেরকে বাড়িতে পেয়েছে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে সবাইকে গুলি করে না হয় ছুরির আঘাতে মেরেছে। এভাবে মরেছে শতাধিক রোহিঙ্গা আর মেয়েদের ধরে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন করেছে বাহিনীর লোকেরা।
এসব শুনে শিউরে উঠেছে বনে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা পরিবারগুলো। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে ফাতেমা। শ্বশুরের প্রতি তার ছিল অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তেমনি কেঁদে চলেছে হাতেম জাফর ও গুলনাহার। ইয়াদ হোসেন বুকে পাথর বেঁধে সব সহ্য করে চলেছেন।
এসবের মানে আর পিছু ফিরে যাওয়া যাবে না। পিছু ফিরলেই মৃত্যু। এখন বাঁচতে চাইলে নৌকায় চড়ে রাতের আঁধারে নাফ নদী পাড়ি দিতে হবে।

ছয়.
রাত দশটা। নাফ নদীর তীরে সারে সারে বাঁধা একে একে সাতটি নৌকা। এর একটিতে অন্য অনেকের সঙ্গে উঠে বসেছেন মোহাম্মদ ইয়াদ ও তার পরিবার। সঙ্গে নেই একজন। সবার চোখেই অশ্রু। নিজ গ্রাম নিজ বাড়ি ছেড়ে যেতে কার ভালো লাগে। কিন্তু জীবন বাঁচাতে তাই করতে হবে। অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছেন ইয়াদ হোসেন। বুকের চাপা পাথর সরানোর জন্য কান্নার চেয়ে ভালো ওষুধ আর নেই। কাঁদছে ফাতেমা, গুলনাহার ও জাফর। অন্য নৌকা থেকেও কান্নার শব্দ আসছে। এ মুহূর্তে কাঁদছে না শুধু হাতেম। বলতে গেলে তার কান্না ফুরিয়ে গেছে। হাতেমের মুষ্টিবদ্ধ হাত প্রতিরোধের কথাই জানান দিচ্ছে। তার চোখে খিউ মিন্টের জন্য ঘৃণা, মিলিটারির জন্য ঘৃণা। ইয়াদ হোসেনও এই মুহূর্তে অনেকটা শান্ত। হাজারো মানুষের কান্না পশুগুলোর বুক এতখানি কাঁপবে না। তার চোখেও ক্রোধের আগুন। দৃষ্টি আসমানের দিকে। ইয়া আল্লাহ তুমি সহায় হও।
রাত এগারটা বাজতেই নৌকাগুলো ভাসানো হলো নাফ নদীর পানিতে। নদীর ওপারে একটা ক্ষুদ্র আলোকবিন্দু দেখা যায়। আপাতত লক্ষ্য ওটাই। এপারে মৃত্যু ওপারে লাঞ্ছনার জীবন। তাও যদি আশ্রয় মিলে। তা না হলে নৌকাতেই ভাসতে হবে। কতকাল কতদিন তা শুধু ভবিতব্যই বলতে পারে। এসব অসহায় মানুষের তা অজানা। সবেমাত্র ভোর হয়েছে। গাছে গাছে পাখি ডাকছে। কিচির মিচির শব্দে। এখন শান্ত মংডু শহর। শহর বলতে মংডু টাউনশিপ মানে উপশহর। মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম উপকূলের একটি শান্ত শহর। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নাফ নদী। তারপর সমুদ্র, অথৈ সমুদ্র। ১০ অক্টোবর ২০১৬। মংডুর মিউথুগি গ্রামেও স্বাভাবিক নিয়মে ভোর হলো। সূর্য উঠলো। পাখি ডাকলো। সকালের ঝিরি ঝিরি হাওয়ায় মোহাম্মদ হাতেম ওরফে মিন নিহ-দের বাড়ির গাছগুলোও হাওয়ায় দোল খাচ্ছিল। বাবা মা দাদা দুই ভাইবোন এ নিয়ে হাতেমদের পরিবার। হাতেমের আব্বা মোহাম্মদ ইয়াদ হোসেন স্থানীয় একটি স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক। মা ফাতেমা একজন গৃহিণী। আর তার দুই ভাইবোন গুলনাহার আর জাফর হাতেমের চেয়ে বয়সে ছোট। ওরা সবাই স্কুলের ছাত্র। আর ওদের দাদা মোহাম্মদ আবেদ হোসেন বৃদ্ধ হয়েছেন বলে কিছুই করেন না। শরীরে কুলালে সাংসারিক কিছু কাজকর্ম আর বাড়ির চার পাশে ক্ষেতখামার দেখাশোনা করেন। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। বার্মিজ রাখাইনদের চোখ এড়িয়ে সম্ভব হলে কাছের একটি মসজিদে যান। না হলে বাড়িতেই সারেন নামাজ। এই ধর্মীয় পরিচয়টাই তাদের সবাইকে মিয়ানমারের আর সবার শত্রু বানিয়েছে। তা না হলে প্রতিবেশী রাখাইন বা রাখাইন নেতারা ভুলেও বলতে পারবে না তারা অশান্তির কোন কাজ করেছে বা কোনভাবে তাতে জড়িত। কিন্তু তাতে কী। পদে পদে সন্দেহের চোখে তাকায় রাখাইন নেতারা। কাজে-অকাজে বাড়িতে এসে হাজির হয়। এই তো সে দিন এসে গেলেন রাখাইন নেতা খিউ মিন্ট। অনেকক্ষণ বসে থেকে গল্প করলেন আবেদ হোসেনের সাথে। চা খেলেন, মিষ্টি খেলেন, বিস্কুট খেলেন। হাতেম আর হাতেমের আব্বা বাড়ি ছিলেন না। হাতেমের ছোট দুই ভাইবোনকে কাছে বসিয়ে আদর করলেন। তাকে ডাকতে এলো আরো চারজন রাখাইন মাঝারি নেতা। তাদের ডাকে এক সময় চলেও গেলেন খিউ মিন্ট।
খিউ চাচার সাথে পথে দেখা হাতেমের। দেখে সম্মান জানালো সে- হাসি মুখে কথা বললো হাতেম।
: ভালো আছেন খিউ চাচা?
: হ্যাঁ, তুমি কেমন?
: ভালো।
: তোমাদের বাড়ি গিয়ে সবার খোঁজ নিয়ে এলাম। মিষ্টি খেলাম, চা খেলাম।
: তাই নাকি? আমি একটু বাজারে গিয়েছিলাম। আজ স্কুল বন্ধ তো।
: ঠিক আছে। বাড়ি যাও। আবার আসবোখন।
খিউ মিন্ট চাচা হেসে হেসে কথা বললেও তার সঙ্গীদের চাহনি আর আচরণ ভালো লাগলো না হাতেমের।
কি আর করা! মংডুতে এরকমভাবেই বাঁচতে হয় রোহিঙ্গা মুসলমানদের। বলতে গেলে ওদের দয়ায় বেঁচে থাকা। এর নাম যে জীবন নয় তা প্রতিটা রোহিঙ্গা নর-নারী আর শিশু জানে। কখন কার উপর বিনা অপরাধে খড়গ নেমে আসবে কেউ জানে না। এই গ্রামে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি হলেও বেশ কিছু রাখাইন বাড়ি আছে। দিন দিন তাদের বাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। হাতেমদের বাড়ি গ্রামের উত্তর প্রান্তে। মাঝামাঝি এলাকায় খিউ মিন্টের বাড়ি। সেখানে পর পর কয়েকটি বাড়ি রাখাইনদের।

দুই.
মিউথুগি গ্রামটার আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য আছে। মংডু শহরের নিকটবর্তী এই গ্রামটাতে আছে একটা প্রাইমারি স্কুল। স্কুলের সাইনবোর্ড বর্মি ভাষার হলেও এ স্কুলে রাখাইন ও মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা পড়ালেখা করতে পারে। এ ছাড়া এ গ্রামে একটা বাংলা স্কুলও আছে। রাখাইন আর মুসলমানরা বলতে গেলে শান্তিপূর্ণভাবেই বসবাস করে আসছে। গ্রামে একটা মসজিদ আছে, যেখানে মুসলিমরা নিয়মিত নামাজ আদায় করতে পারে।
টিনশেড স্কুল ভবনটির সামনে খোলা সবুজ মাঠ। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। কোথাও কোথাও কাঁটাতার উধাও হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে রয়েছে গাছের গুঁড়ি বা খুঁটি দিয়ে বানানো পিলার। দূর থেকে মনে হবে কোন ছাত্র দাঁড়িয়ে আছে। এই স্কুলের ক্লাস ফাইভের ছাত্র মোহাম্মদ হাতেম ওরফে মিন নিহ। মিন নিহ ওর বর্মি নাম। ওর দুই ভাইবোনেরও আছে বর্মি নাম। খিন ইয়াও হচ্ছে জাফরের নাম আর আন তাও নাম গুলনাহারের। এখানে প্রত্যেক মুসলিমের বর্মি নাম আছে। স্কুলে বা মহল্লায় ওটাই তার পরিচয়। মুসলিম নাম শুধু বাড়ির বা নিজেদের জন্য।
অবশ্য বাংলা স্কুলে বা ধর্মীয় স্কুলে এ সমস্যা নেই। সেখানে নিজ নিজ মুসলিম নাম চলতে পারে।
স্কুলে লেখাপড়ার সময়, খেলাধুলার সময় রাখাইন বর্মি আর মুসলিম পরিচয় বলতে কিছু থাকে না। ওরা একের সঙ্গে আরেকজনে মেশে স্বাভাবিক নিয়মেই। নাম পরিচয় মুখ্য হয়ে ওঠে না- মুখ্য হয়ে ওঠে খেলার আনন্দ, পড়ার আনন্দ আর প্রতিযোগিতা।
স্কুলে আসার পথে পড়ে মংডুর একটি প্রধান সড়ক। সেই সড়কের বাম পাশে অবস্থিত মংডু ওয়াচ টাওয়ার। এতে আছে একটি ঘড়ি, যা দূর থেকে সবাইকে সময় জানান দেয়। এই ওয়াচ টাওয়ারটা খুব ভালো লাগে হাতেমের।
একদিন ওয়াচ টাওয়ার অতিক্রম করার সময় হাতেম সেখানে দেখতে পায় একটি মিলিটারি ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। তাতে ছয়-সাতজন উর্দিপরা বর্মি সেনা। এটা দেখেই ছাঁৎ করে ওঠে হাতেমের বুক। একটা ভয়ের অনুভূতি। অবশ্য এটা মংডুর নিত্যকার দৃশ্য। অনেক সময় তারা সাদা পোশাকেও আসে। মিলিটারি ভ্যান কী কাজে আসে আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায় তারাই জানে।
তবে মাঝে মাঝে রোহিঙ্গাদের ধরে নেয় বলে শোনা যায়। যাদের ধরে নেয় তারা আর কোনদিন ফিরে আসে না।
এই ভয় আর আতঙ্কের মাঝেই কাটে তাদের জীবন। দেখতে দেখতে গা সহা হয়ে গেছে।
ভ্যানটা পেরিয়ে এসে হাতের ডান পাশের রাস্তা ধরে খানিকটা এগোলে তবে মিউথুগি গ্রামের পথ। হাতেমদের বাড়ি এই গ্রামেরই উত্তর পাড়ায়। গ্রামের মধ্যখানে বড় এক খাল থাকায় ঘুরে মেইন রোড হয়ে স্কুলে আসতে হয়। বহু দিন ধরে শুনে আসছে এই খালের ওপর সেতু হবে। কিন্তু তা আর হয় না। একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে একটি মিলিটারি ভ্যানে খিউ মিন্ট কাকাকে দেখে থমকে যায় হাতেম। তার সঙ্গে আরেকজন লোক। খিউ মিন্ট সরকারি দলের স্থানীয় নেতা। তাই মিলিটারি বা পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে তার ভাব আছে। হতে পারে সে কারণে মিলিটারি ভ্যানে চড়ে কোথাও যাচ্ছেন। তাকে দেখে দ্রুত পা চালিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়েছে হাতেম। খামাখা বিপদ ডেকে আনা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ওই মিলিটারি আর পুলিশ সে দু’ চোখে দেখতে পারে না। এগুলো সব অত্যাচারীর দল। মানুষ মারা আর নির্যাতন করাই তাদের কাজ। তাদের সাথে কখনো যোগ দেয় স্থানীয় রাজনৈতিক ও বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা। মুসলিম নির্যাতনে সবাই একাট্টা।

তিন.
সে দিন সকালে বাড়ির আঙিনায় পুঁই শাক আর ঢেঁড়স ক্ষেতে নিড়ানির কাজ করছিলেন বৃদ্ধ আবেদ হোসেন। তিনি বরাবরই ভোরে ওঠেন। ফজর নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করেন। এরপর পায়চারি করতে বের হন। তা সেরে গাছগাছালি দেখাশোনা করেন। তাদের টিনশেড বিল্ডিং এর চার পাশটা বাঁশের ঝাঁঝড়ি মতো বেড়া দেয়া। দেয়াল তোলার সাধ্য এখনো হয়নি হাতেমের আব্বার।
সকালের রোদ এসে পড়েছে সেই আঙিনায়। রোদে চকচক করছে পুঁই শাকের ডগাটা। আর সেটা বাতাসে দোল খাচ্ছে। গেটের পাশে ছোট বোগেনভেলিয়ার ঝাড়। বাতাসে দোল খাচ্ছে সেটিও। হালকা বেগুনি আর গোলাপি লালমত থোকা থোকা ফুল ফুটে আছে। রোদ এসে পড়েছে তাতেও। দেখতে বেশ লাগে।
এরই মধ্যে উঠে পড়েছে হাতেম। গুলনাহার আর জাফরকে তাড়া লাগান মা ফাতেমা।
: কী হলো? পড়ে পড়ে আর কত ঘুমাবি। ওঠ, উঠে পড়। তোদের নিয়ে আর পারি না। কেউ যদি কথা শোনে।
: এই তো আম্মা। আমি কখন উঠে পড়েছি। নাস্তা দাও। হাতেম মাকে তাড়া দেয়।
: দিচ্ছিরে বাবা দিচ্ছি। তোর আব্বা কোথায় গেল? তার তো কোন খবর নেই মধ্যরাত থেকে।
: বল কী? কী হয়েছে? দাদা জানে?
: না না তোর দাদাকে কিছু বলিনি। কী যেন খবর পেয়ে রাত দুটায় বেরিয়ে গেল তোর আব্বা।
হাতেম বুঝতে পারলো নির্ঘাত কোন খারাপ খবর।
তা না হলে অত রাতে? ...
ভাবতে গিয়েও কোন থৈ পায় না।
অবশ্য রাতে রাতে গোপনে চলাফেরা খবর আদান প্রদান করা মংডুতে রোহিঙ্গাদের নিয়মিত ব্যাপারই। রাখাইনগুলোর চোখ এড়িয়ে না চললে যে আর রক্ষা নেই।
এসব ভাবতে ভাবতে হুড়মুড় করে এসে ঘরে ঢোকেন হাতেমের আব্বা। তার এই আচরণে অবাক হন ফাতেমা।
: কী হয়েছে? খারাপ কিছু? কোনো দুঃসংবাদ?
: বলছি হাতেমের মা। আব্বা কোথায়?
: ভোরে উঠেছে দেখেছি। বাগানে আছে হয়তো।
তারা এসব কথা বলতে বলতে মোহাম্মদ আবেদ ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে ঘরে ঢোকেন। হাত-পা ধুয়ে গামছা খুঁজে মোছার চেষ্টা করেন।
ছেলে ও বৌমার মুখ থমথমে দেখেই খারাপ কিছু আন্দাজ করেন বুড়ো আবেদ।
হাতেমের আব্বাই মুখ খোলেন:
: আব্বা শুনেছেন কিছু?
: নাতো! কি খবর?
: খুব খারাপ খবর।
ফাতেমা কিছু বলছেন না। হাঁ করে শুনছেন বাবা ও ছেলের কথাবার্তা। মনে মনে ভাবেন রোহিঙ্গাদের জন্য শুধু খারাপ খবরই তিনি শুনে আসছেন। কোন কালে ভালো খবর আসবে কি না আল্লাহই জানেন।
: আহা বলবি তো বাজান! অস্থির হয়ে পড়েন বুড়ো। শরীরে আগের সেই শক্তি আর নেই। খারাপ খবর শুনে সড়কি বল্লম হাতে কত ছুটে গেছেন। লড়াই করেই মংডুতে মুসলমানদের টিকে থাকতে হয়েছে। ইয়া আলী বলে কত লড়াই করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তার শরীরে যোদ্ধা ফরহাদের রক্ত। ছেলে ও নাতিরা তার কিছুই পায়নি।
: বলছি বলছি। বাবাকে শান্ত করেন ইয়াদ হোসেন।
সব শুনে থ হয়ে গেলেন হাতেমের দাদা ও মা। হাতেমও। হাতেম ক্লাস ফাইভের ছাত্র। সে মনে করে তার কব্জিতে খুব জোর। আর ভালো-মন্দ অনেক কিছুই বুঝতে শিখেছে।
ঘটনা খুলে বললেন ইয়াদ হোসেন। গতকাল নাকি রোহিঙ্গা বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা বর্মি সীমান্ত রক্ষীদের উপর হামলা চালিয়ে নয় জনকে মেরে ফেলেছে। এই ঘটনা ঘটেছে মংডুর কাছে সীমান্ত চেকপোস্টে। এই ঘটনার পর ফুঁসে উঠেছে মিয়ানমার বাহিনী। তারা ইতোমধ্যেই ক্র্যাকডাউন শুরু করেছে। কালকের ঘটনার পর তাদের অত্যাচার আরো অনেক গুণ বাড়বে এটা ধরে নেয়াই যায়। আর নয়জন সীমান্তরক্ষী হত্যা একটা বাহানা মাত্র, ভালো করেই জানে সবাই। ঘটনা সত্য-মিথ্যা যাই হোক এর ফল যে ফলবে ভয়ানক সেটা বুঝে গেছে সকল রোহিঙ্গা। তারা সবাই এখন নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে। আর সবাই একথা বিশ্বাসও করছে না।
সব শুনে অবাক হলেন আবেদ হোসেন। কয়েক পুরুষ ধরে তারা মংডুর বাসিন্দা। বর্মি আর রাখাইনদের ভালো করেই চেনা আছে তার।
আবেদ হোসেনের বাবা ফরহাদ হোসেন ছিলেন বার্মার একজন স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা। জেনারেল অং সান বার্মাকে ব্রিটিশের হাত থেকে মুক্ত করতে যে সংগ্রাম করেছেন তাতে সহায়তা করেছেন মুসলমান যোদ্ধারা। জেনারেল অং সান এ জন্য কৃতজ্ঞ ছিলেন রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত বার্মার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে জেনারেল অং সানের মন্ত্রিসভায় মুসলমান সদস্যও ছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র ছয় মাস আগে আততায়ীর হাতে নিহত হন জেনারেল অং সান। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারতো। আর শত শত বছর ধরে আরাকানে বসবাস করে আসছে রোহিঙ্গা মুসলমানরা। এগুলো সবই ইতিহাসের কথা। সেনা সরকার আগের আরাকানের নাম বদলে করেছে রাখাইন স্টেট। আকিয়াবের নাম করেছে সিত্তুই। আগেকার বার্মা নামটাও এখন আর নেই। এর স্থলে হয়েছে মিয়ানমার। ইতিহাস খ্যাত রাজধানী রেঙ্গুন এখন ইয়াঙ্গুন। আর সেটা এখন রাজধানীও নয়। কত পরিবর্তন আর সংস্কার। কিন্তু রোহিঙ্গারা এখনো অধিকারহারা। অন্যের কথা বাদ। জেনারেল অং সানের মেয়ে বর্তমান মিয়ানমারের সর্বময় নেত্রী অং সান সু চি-ই তো আগেকার সব কথা বেমালুম ভুলে বসে আছেন। অথচ রোহিঙ্গারা কত আশায় না বুক বেঁধেছিল সু চি ক্ষমতায় এলে সব ঠিক হয়ে যাবে। রোহিঙ্গারা পাবে তাদের অধিকার। এখন তারা রাষ্ট্রবিহীন লোক- স্টেটলেস পিপল। তা আর থাকতে হবে না। পাবে নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার। শান্তিতে থাকতে পারবে মংডু, আকিয়াব, বুচিডংসহ আরাকানের সব জায়গায়। আর এখন। সব ভুলে বসে আছেন সু চি। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে আবেদ হোসেনের বুক থেকে।
: আব্বা! ইয়াদ হোসেনের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলেন যেন আবেদ।
: হ্যাঁ বল বেটা।
: কী ভাবছেন? আর ভাবাভাবির সময় নেই। ওরা মহা খাপ্পা হয়ে আছে। যা করণীয় দ্রুত করতে হবে।
: হ্যাঁ তাই কর বাবা। আমার কিছু ভালো লাগছে না।
ফাতেমা স্বামীর হাবভাবে আগেভাগেই বুঝে গেছেন সব। ছোট ছেলে মেয়ে দুটোকে টেনে ঘুম থেকে উঠিয়ে ব্যাগ আর বোঁচকায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভরে ফেলেছেন। হাতেমও তৈরি হচ্ছে তার ব্যাগ গুছিয়ে। ইতোমধ্যে নাস্তা বানানো শেষ হয়েছিল। বলতে গেলে জোর করে সবাইকে গিলিয়ে বের হওয়ার জন্য তৈরি করেন ফাতেমা। একে নাস্তা খাওয়া বলে না। চায়ের পর্ব তো বাদই থাকলো। ফাতেমার চোখ কোন বাধা মানছে না। অনবরত কেঁদেই চলেছেন ফাতেমা। এই বাড়ি এই সংসার আর সংসারের সব কিছু ফেলে শুধু জীবন বাঁচাতে চলে যেতে হবে! এগুলো যে কত আপন, এসব ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট কে বুঝবে।

চার.
একটু পরেই পাশের বাড়ি থেকে দৌড়ে এলেন সামিনা ভাবী। নূর আলমের স্ত্রী। তাদের দুই ছেলে মেয়ে।
: ভাবী, খবর শুনেছেন তো? সামিনার প্রশ্ন।
: হ্যাঁ ভাবী, আমরা তৈরি হচ্ছি। চোখের পানি মুছতে মুছতে জবাব দিলেন ফাতেমা। লক্ষ করলেন সামিনার চোখও ছল ছল।
: চলেন, বসে থাকার আর সময় নেই।
গ্রামের পর গ্রাম জ্বালাতে জ্বালাতে আসছে শুয়রগুলো। মংডুতে এমন ধ্বংসকান্ড আগে আর কেউ দেখেনি।
হায় আল্লাহ! আমাদের কী হবে। সব রোহিঙ্গা নর-নারীর একই প্রশ্ন। প্রশ্ন ফাতেমারও।
: আপাতত বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে। তার পর দেখা যাবে কী হয়। বললেন সামিনা। ও পাড়ার হাসান আলী পাকা খবর নিয়ে এসেছে, মংডুর দক্ষিণের কয়েকটি গ্রাম একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে মিলিটারি আর সীমান্ত পুলিশ। অনেককে হত্যাও করেছে। আরো জানালেন সামিনা।
: আমরা যাচ্ছি ভাবী। খোদা হাফেজ। সামিনা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
: খোদা হাফেজ। যান। আমরাও আসছি।
হাতেমের আব্বা জানতে চাইলেন সামিনা ভাবী কী বলে গেলেন।
ফাতেমা স্বামীকে সব বুঝিয়ে বললেন। এমন সময় দূরে দেখা যেতে লাগলো কালো ধোঁয়া গলগল করে আকাশে উঠছে। সেই সাথে কামান না কিসের যেন গুড়–ম গুড়–ম শব্দ। নিশ্চয়ই কোন বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে হার্মাদগুলো।
এক সময় বেরিয়ে পড়লো হাতেমদের পরিবার। এমন সময় বেঁকে বসলেন হাতেমের দাদা।
: আমি যাব না। তোমরা যাও। মরতে হয় তো নিজের ভিটেতেই মরবো।
: তা হয় না আব্বা। আপনাকে এভাবে রেখে আমরা যেতে পারি না। বললেন ইয়াদ হোসেন। ডুকরে কেঁদে উঠলো গুলনাহার, জাফর ও হাতেম।
কোন মতেই রাজি হলেন না বৃদ্ধ। তার একই কথা- আমি তো কোন অপরাধ করিনি। আমি কেন আমার বাড়ি ছেড়ে যাবো। মরতে হয় তো নিজ ভিটেতেই মরবো। এই গোঁ ধরা বুড়োকে বোঝায় এমন সাধ্য কার।
অগত্যা নারী শিশুদের কথা ভেবে ইয়াদ হোসেনের পরিবারকে বেরিয়ে পড়তেই হলো। এখানে থাকলে বেঘোরে মৃত্যু।
দুই ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে আল বেয়ে হেঁটে চলেছে সবাই। ইয়াদ, হাতেম, ফাতেমা, গুলনাহার ও জাফর। নিরাপদ স্থানের উদ্দেশে। কী জানি কখন হামলে পড়ে রাখাইন আর মিলিটারি। ইয়াদ ঠিক করলেন রাতের কোনো এক প্রহরে বাবাকে দেখে যাবেন।

পাঁচ.
জঙ্গলমতো একটা এলাকায় দুটি রাত পার করে দিয়েছে শত শত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। ঘন বনাঞ্চল বলে এখান পর্যন্ত এসে পৌঁছতে পারেনি মিলিটারি। সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পড়ে মার খাওয়ার ভয়ে রাখাইন বার্মিজদের ছোট ছোট কোন দলও এ পর্যন্ত আসেনি। ফলে এখানে আশ্রয় গ্রহণকারীরা এখনো অক্ষত আছে। এর নাম জীবন রক্ষা, কায় ক্লেশে বেঁচে থাকা। নিঃশ্বাসটুকু থাকুক এখন শুধু এইটুকু চাওয়া। এর নাম জীবন নয়।
একজন রাতে গিয়ে খবর নিয়ে এসেছে খিউ মিন্টের লোকেরা আর মিলিটারি মিলে তাদের দুশো বাড়িতে আগুন দিয়েছে। নিমেষে পুড়ে সব ছাই হয়ে গেছে। পুড়ে গেছে ইয়াদ হোসেনের বাড়িঘর। ধ্বংসের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুধু পোড়া আধপোড়া খুঁটি। আবেদ হোসেনকে বাড়িতে একাকী পেয়ে নিজ হাতে ছুরি চালিয়ে খুন করেছে খিউ মিন্ট। আর যাদেরকে বাড়িতে পেয়েছে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে সবাইকে গুলি করে না হয় ছুরির আঘাতে মেরেছে। এভাবে মরেছে শতাধিক রোহিঙ্গা আর মেয়েদের ধরে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন করেছে বাহিনীর লোকেরা।
এসব শুনে শিউরে উঠেছে বনে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা পরিবারগুলো। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে ফাতেমা। শ্বশুরের প্রতি তার ছিল অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তেমনি কেঁদে চলেছে হাতেম জাফর ও গুলনাহার। ইয়াদ হোসেন বুকে পাথর বেঁধে সব সহ্য করে চলেছেন।
এসবের মানে আর পিছু ফিরে যাওয়া যাবে না। পিছু ফিরলেই মৃত্যু। এখন বাঁচতে চাইলে নৌকায় চড়ে রাতের আঁধারে নাফ নদী পাড়ি দিতে হবে।

ছয়.
রাত দশটা। নাফ নদীর তীরে সারে সারে বাঁধা একে একে সাতটি নৌকা। এর একটিতে অন্য অনেকের সঙ্গে উঠে বসেছেন মোহাম্মদ ইয়াদ ও তার পরিবার। সঙ্গে নেই একজন। সবার চোখেই অশ্রু। নিজ গ্রাম নিজ বাড়ি ছেড়ে যেতে কার ভালো লাগে। কিন্তু জীবন বাঁচাতে তাই করতে হবে। অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছেন ইয়াদ হোসেন। বুকের চাপা পাথর সরানোর জন্য কান্নার চেয়ে ভালো ওষুধ আর নেই। কাঁদছে ফাতেমা, গুলনাহার ও জাফর। অন্য নৌকা থেকেও কান্নার শব্দ আসছে। এ মুহূর্তে কাঁদছে না শুধু হাতেম। বলতে গেলে তার কান্না ফুরিয়ে গেছে। হাতেমের মুষ্টিবদ্ধ হাত প্রতিরোধের কথাই জানান দিচ্ছে। তার চোখে খিউ মিন্টের জন্য ঘৃণা, মিলিটারির জন্য ঘৃণা। ইয়াদ হোসেনও এই মুহূর্তে অনেকটা শান্ত। হাজারো মানুষের কান্না পশুগুলোর বুক এতখানি কাঁপবে না। তার চোখেও ক্রোধের আগুন। দৃষ্টি আসমানের দিকে। ইয়া আল্লাহ তুমি সহায় হও।
রাত এগারটা বাজতেই নৌকাগুলো ভাসানো হলো নাফ নদীর পানিতে। নদীর ওপারে একটা ক্ষুদ্র আলোকবিন্দু দেখা যায়। আপাতত লক্ষ্য ওটাই। এপারে মৃত্যু ওপারে লাঞ্ছনার জীবন। তাও যদি আশ্রয় মিলে। তা না হলে নৌকাতেই ভাসতে হবে। কতকাল কতদিন তা শুধু ভবিতব্যই বলতে পারে। এসব অসহায় মানুষের তা অজানা।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ