কুয়াশার চাদরে শীত এলোরে

কুয়াশার চাদরে শীত এলোরে

ফিচার মুহাম্মদ রবিউল ইসলাম জানুয়ারি ২০২৪

বছর ঘুরে আবার এলো শীতকাল। কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে শীতকে বরণ করে নিয়েছে প্রকৃতি। বাংলা ক্যালেন্ডারের পৌষ ও মাঘ এই দু’মাস শীতকাল। শীতের আগমনে গাছপালার সবুজ পাতা ঝরে যায়। শুকনো পাতার মর্মর শব্দ শীতের আরেক রূপ। এ সময় উত্তরের হিমেল হাওয়া শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। শীত একটি বৈচিত্র্যময় ঋতু। স্রষ্টা এই পৃথিবীকে কত সুন্দর করে সাজিয়েছেন, তারই প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে শীতে।

শীতের সৌন্দর্য শহরের চার দেওয়ালে বসে উপভোগের সুযোগ কম। শীতের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় গ্রামাঞ্চলে। গ্রামের মাঠঘাটে নানারকম শীতের সবজির চাষ হয়। এ সময় গ্রামের মাঠে, বাড়ির আঙিনায়, রাস্তার আশপাশে লালশাক, সরিষা, বেগুন, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বিভিন্ন জাতের লাউ, বিভিন্ন জাতের শিম, ধনেপাতার ব্যাপক চাষ করা হয়। মাঠে মাঠে বিচিত্র ফসল মুগ্ধ করে সবাইকে। গ্রামের এসব ফসল প্রতিদিন গাড়ি ভর্তি করে শহরে বিক্রির জন্য পাঠানো হয়। শীতের এসব ফসলের পুষ্টিগুণ বলে শেষ করা যাবে না। শীতের এই সবজি নিশ্চয়ই আল্লাহর বড় নেয়ামত। তাই স্রষ্টার কাছে আমাদের এজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত।

শীতে গ্রামের মানুষের জীবনচিত্রটা সত্যি অন্যরকম। বাড়ির উঠানে, পুকুর ঘাটে, বাজারে, রাস্তার পাশে খড়-কুটো জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে শরীরটাকে উষ্ণ করার চেষ্টা করে। আবার সকালে ঘন কুয়াশা ভেদ করে সূর্যি মামা উত্তাপ ছড়ালেই শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই বাড়ির উঠানে কিংবা পুকুরঘাটে রোদ পোহানোর প্রতিযোগিতায় নামে। গ্রামে গ্রামে ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করা হয়। সবাই দল বেঁধে সেই মাহফিলে যান। সেখানে উৎসবের পরিবেশ বিরাজ করে। শীতের রাতে ওয়াজ শোনার মধ্যে অন্য রকমের আনন্দ আছে।

এ সময় পুকুর-ডোবা, নদ-নদী ও বিলের পানি শুকিয়ে যায়। গ্রামের শিশু-কিশোররা মাছ শিকারে নেমে যায়। নানা ধরনের ছোট মাছ যেমন- পুঁটি, মলা ঢেলা, ট্যাংরা, কাচকি, চিংড়ি, তেলাপিয়া ইত্যাদি মাছ পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে বোয়াল, শোল, আইড়, চিতল, রুই, পাঙ্গাশ, বাইন, বাঘাসহ নানা ধরনের বড় বড় ভিন্ন স্বাদের প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। এছাড়া পুকুরে বিলে লাল শাপলা দেখা যায়। লাল শাপলা গ্রামের প্রকৃতিকে আরও নান্দনিক করে তোলে। ঘরে ঘরে থাকে পাকা ধান। খেজুর রস দিয়ে তৈরি করা হয় খেজুরের গুড়, মইরছা গুড়, পাটালি গুড় ইত্যাদি।

পরিযায়ী পাখি

প্রতিবছর শীতের সময় আমাদের দেশে পরিযায়ী পাখি আসে। দূর দেশ থেকে এই পাখিগুলো একটু আশ্রয় ও খাদ্যের আশায় আসে। কারণ এই পাখিগুলো যে দেশে থাকে সেখানে শীতের তীব্রতা বেশি। তাই সেখানে তাদের বেঁচে থাকা খুব কঠিন হয়ে ওঠে। এজন্য এই পাখিগুলো আমাদের দেশে উড়ে আসে। কোনো কোনো পাখি হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আসে। ভাবতে পারো, কতটা দিন ও মাস তাদের উড়তে হয়। কোনো কোনো দেশ থেকে এসব পাখির আসতে প্রায় তিন মাস সময় লেগে যায়। ওরা কিন্তু এখানে থাকতে আসে না, কিছুদিন থেকে আবার নিজের দেশে ফিরে যায়। ফিরে যেতেও আবার তিন মাস উড়তে হয়। অর্থাৎ কোনো কোনো পাখির বছরে ছয় মাস শুধু উড়তে উড়তেই জীবন চলে যায়।

পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখি আছে। গবেষকরা এদের মধ্যে এক হাজার ৮৫৫টি প্রজাতির পাখিকে পরিযায়ী পাখি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বাংলাদেশে মোট ৩১৬ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসে, যার মধ্যে ২৯০ প্রজাতির পাখি আসে শীতে। অক্টোবরের শেষ বা নভেম্বর থেকে ওদের আসা শুরু হয় আর চলে যায় মার্চে। অর্থাৎ ওরা শীতে আসে এবং বসন্তে চলে যায়। পরিযায়ী পাখিগুলো প্রধানত উত্তরের দেশ থেকে আসে। বিশেষ করে হিমালয়, নেপাল, সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, চীনের জিনজিয়ান, ইউরোপ ইত্যাদি অঞ্চল থেকে।

মজার বিষয় কী জানো, আসার আগে ওরা পাখার নিচে বেশি চর্বি জমা করে রাখে। মাইলের পর মাইল ওড়ে  সেই সঞ্চিত চর্বির শক্তিতে। সাধারণত ওরা দলবেঁধে চলে। যেখানে একবার আসে, সাধারণত পরের বছরগুলোতেও সেখানে আসার চেষ্টা করে। ওদের দেহে অসাধারণ এক সংবেদ ও সাড়া প্রদান কৌশল আছে। যা দিয়ে ওরা শত শত এমনকি হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ঠিকই আগের জায়গায় ফিরে আসতে পারে। চিন্তা করতে পারো, মহান আল্লাহর সৃষ্টি কতটা রহস্যময়। তিনি পাখিকেও কত চমৎকার গুণ দিয়েছেন।

কিন্তু, তোমরা জানলে অবাক হবে- আমাদের দেশে কিছু দুষ্টু মানুষ আছে যারা এই পাখিগুলোর ক্ষতি করার চেষ্টা করে। যে পাখিগুলো আশ্রয় ও খাদ্যের আশায় হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এখানে আসে, কিছু দুষ্টু লোক সেই পাখিগুলোকে শিকার করার চেষ্টা করে। তারা নিরীহ পাখিগুলোকে হত্যা করে। আমি জানি তোমরা কেউ এমন নও, তাই তোমাদের সামনে যদি কোনো দুষ্টু লোক পাখি শিকারের চেষ্টা করে তোমরা প্রতিবাদ করবে। দরকার হলে বড়দের জানিয়ে দেবে। দেখবে বড়রা তোমাদের সাহায্য করবে।


শীতের পিঠাপুলি

পিঠাপুলি আমাদের ঐতিহ্য। শীত এলেই পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায়। সকাল বা সন্ধ্যায় রাস্তার ধার বা গৃহস্থালি সব জায়গা উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। সেই উৎসবের প্রধান আকর্ষণই হলো শীতের পিঠা। এ সময় বানানো হয় নানারকম পিঠা। নতুন চাল গুঁড়া করে দেওয়া হয় পিঠার রেসিপিতে। সঙ্গে যোগ করা হয় গুড়, দুধ, চিনিসহ অনেক কিছু। আগে গ্রামেই শীতের পিঠা বেশি পাওয়া যেত। কিন্তু এখন শহরাঞ্চলেও শীতের পিঠার জনপ্রিয়তা অনেক। শীতের সন্ধ্যায় ঢাকা শহরের রাস্তায় বের হলেই দেখা যায় ভ্যানের ওপর চুলা বসিয়ে বানাচ্ছে নানারকমের পিঠা, এর সঙ্গে থাকে বাহারি রংবেরঙের ভর্তা। পার্থক্য হলো শহরের পিঠা হলো বাণিজ্যিক। আর গ্রামের পিঠাতে মিশে থাকে পরিবারের ভালোবাসা।

শীতের সবচেয়ে জনপ্রিয় পিঠা হলো ভাপা পিঠা। সকাল বা সন্ধ্যার নাস্তা হিসেবে অনেকের প্রিয় এই পিঠা। এই পিঠা গুড় আর চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি বলে এমনিতেই খুব মিষ্টি। যারা মিষ্টিপ্রিয় মানুষ তাদের খুব পছন্দ। এরপরই আছে চিতই পিঠা। গরম গরম চিতই পিঠার সঙ্গে থাকে নানারকমের ভর্তা। এই পিঠা পছন্দ করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া হয়তো অসম্ভব। তবে, গ্রামের মানুষ খেজুর রসে ভিজিয়ে কিংবা দুধে ভিজিয়ে চিতই পিঠা খেয়ে থাকেন। শীতের আরেকটি পিঠা হলো পুলি পিঠা। এই পিঠা সাত ধরনের হয়। তেলে ভেজে, সেদ্ধ করে বা দুধের মিশ্রণে ভিজিয়ে তা তৈরি করা হয়। কখনো কখনো এ পিঠা ঝাল করেও তৈরি করা হয়। এ সময়ের আরও একটি পিঠা হলো পাটিসাপটা। এই পিঠা এতোটাই সুস্বাদু যে, একটা খেলে মনে হবে আরও কয়েকটা খাই। এর ভেতরে দুধ, চিনির মিশ্রণে ক্ষীর করে মুড়ানো থাকে।

ওপরের পিঠাগুলো ছাড়াও শীতকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হরেক নামের বাহারি সব পিঠা দেখা যায়। যেমন- কলা পিঠা, নকশি পিঠা (ঝাল), নকশি পিঠা (মিষ্টি), পাকান পিঠা, তেলে ভাজা পিঠা, পায়েস পিঠা, সেমাই কুলি পিঠা, শামুক পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, পাকড়া পিঠা, ডিমের ঝাল পিঠা, মালাই পিঠা।

শীতের ফল

বাহারি শাকসবজি, খেজুরের রস, পিঠা-পায়েস যেমন শীতকে মিষ্টি করে তোলে। একইভাবে এ সময়ের নানান ফল শীতকে আরও মিষ্টি করে তোলে। এ সময় কমলা, কুল, সফেদা, জলপাই ইত্যাদি ফল মুখের স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। এসব ফলে ভিটামিন, মিনারেল, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও নানা ফাইটো নিউট্রিয়েন্টে ভরপুর থাকে।

শীতের জনপ্রিয় ফলগুলোর একটি ডালিম। ফলটি কারও কাছে বেদানা, কারও কাছে আনার নামে পরিচিত। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে তিন ধরনের ডালিমের উল্লেখ পাওয়া যায়- মধুর ডালিম, কষায় ডালিম ও টক ডালিম। মধুর ডালিমের দানা বেশি লাল, রসালো ও উপকারী। এরপর আছে সফেদা। এই ফল দেখতে সুন্দর না হলেও নানা গুণে সমৃদ্ধ। সুগন্ধ আর মিষ্টতার দিক দিয়ে ফলটি অনেক এগিয়ে। অপুষ্টি, পরিশ্রমজনিত ক্লান্তি, হার্টের দুর্বলতা ইত্যাদি রোগে পাকা সফেদা উপকারী। শীতের ফলের রাজা বলা হয় কমলাকে। বর্তমানে আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলে কিছু কিছু কমলার চাষ হচ্ছে। কমলাতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি আছে। শীতের জনপ্রিয় আরেকটি ফল হলো কুল। সচরাচর দেশের সব জায়গাতেই কুল পাওয়া যায়। অনেক অঞ্চলে ফলটিকে বরই নামে ডাকা হয়। কুল নানা জাতের হয়। যেমন- নারকেল কুল, আপেল কুল, বাউ কুল ইত্যাদি। শীত ঋতুর জনপ্রিয় ফল জলপাই। জলপাইয়ের পাতা ও ফল দুটোই উপকারী। ফলের রস থেকে তৈরি হয় তেল যার অনেক পুষ্টিগুণ আছে। শীতের সুস্বাদু ও উপকারী ফল আমলকী। আমলকীকে বলা হয় ভিটামিন ‘সি’-এর রাজা।


শীতের ফুল

শীতকাল যেন ফুলের বাহার। শীতের রুক্ষতার মাঝেও মানবজীবনে আশ্চর্য এক সজীবতার পরশ বুলিয়ে দেয় শিশিরভেজা ফুলের মঞ্জুরি। শীতকালে বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিচিত ফুল বললেই নাম আসে গাঁদা ফুলের। সাধারণত হলুদাভ কমলা রঙের হলেও খয়েরি রঙের গাঁদাও পাওয়া যায় শীতকালে। গাঁদার প্রজাতিগুলোর মধ্যে সাধারণত দেশি গাঁদা, রক্ত গাঁদা, বড় ইনকা গাঁদা, জাম্বো গাঁদা, ছোট চায়না গাঁদা বেশি দেখা যায় বাংলাদেশে। শীতকালে গাঁদার পরের স্থানটা হয়তো ছেড়ে দিতে হবে ডালিয়ার জন্য। সাদা, লাল, হলুদ, গোলাপি, চকোলেট রঙের এই ফুলটি বাহারি পাপড়ির কারণে সহজেই মানুষের মন ছুঁয়ে যেতে পারে। শীতের আরেকটি ফুল হলো চন্দ্রমল্লিকা। আমাদের দেশের প্রকৃতিপ্রেমীদের আকৃষ্ট করে রেখেছে শতাধিক প্রজাতির চন্দ্রমল্লিকা। বাহারি ও বিভিন্ন রঙের এই ফুলের ইংরেজি নাম ক্রিসেস্থিমাম। শীতের আরেকটি ফুল সন্ধ্যামালতি। ছোট গাছের সাদা আর গোলাপি রঙের এই ফুল এদেশের শীতের পরিচয় আলাদাভাবেই বহন করে। এর মায়াবী সৌন্দর্যে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। শীতকালে ফোটা ফুলগুলোর মধ্যে আরও আছে গ্যাজানিয়া। সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বাংলাদেশে আসা এই ফুলটিকে সূর্যমুখীর প্রতিরূপই বলা যায়। সাদা, হলুদ, লাল, কমলা রঙের এই ফুলটি সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলে সৌন্দর্য বিলিয়ে থাকে।

এগুলো ছাড়া আরও নানারকম বাহারি ফুলের পসরা সাজিয়ে আসে শীতকাল। যেমন- কসমস, জিনিয়া, ডেইজি, সিলভিয়া, জারবেরা, অ্যাজেলিয়া।


শীতের খেলা

আগেই বলেছি শীত একটি বৈচিত্র্যময় ঋতু। এ সময় নানাধরনের খেলাধুলায় মেতে ওঠে মানুষ। শীতের খেলার কথা বললে সবার আগে আসে ব্যাডমিন্টন। ক্রিকেট অথবা ফুটবলের মতো সারা বছর এর জনপ্রিয়তা না থাকলেও শীতের সময়ে এটিই হয়ে ওঠে প্রধান খেলা। শীতের সোনালি বিকেলে কিংবা কুয়াশামাখা সন্ধ্যায় বসে যায় এই খেলার আয়োজন। এরপর আছে ভলিবল। শীতের বিকেলে গ্রামের মাঠে মাঠে ভলিবলের আসর বসে। এ পাড়া ও পাড়া প্রতিযোগিতা হয়। শীতকালে ক্রিকেট খেলাতেও মেতে ওঠে সবাই। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে শীতের সময় হাডুডু, গোল্লাছুট খেলায় মেতে ওঠে বিভিন্ন বয়সিরা।

বন্ধুরা সব মিলিয়ে শীতকালে খুবই চমৎকার একটি ঋতু।  মহান  আল্লাহ আমাদের এই প্রকৃতিকে নানা রূপে সাজিয়েছেন। তিনি সবকিছু এমনভাবে সাজিয়েছেন, যেন তাতে মানুষের উপকার হয়।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ