কুরবানির মর্মবাণী

কুরবানির মর্মবাণী

প্রচ্ছদ রচনা আবু মিনহাল জাদীদ জুন ২০২৩

জিলহজ মাসের নতুন চাঁদ আকাশে উঠলেই আমাদের হৃদয়টা খুশির আগাম আমেজে মুখরিত হয়ে ওঠে। জিলহজ মাসের দশ তারিখেই তো ঈদুল আজহা। কুরবানির ঈদ। এ ঈদ যেন ফেরদাউস থেকে নেমে আসা এক অবারিত নদী! তার অনাবিল ঢেউয়ের কল-কল্লোলে গুঞ্জরিত হয় মহান আল্লাহর প্রতি নবী ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ)-এর ভালোবাসার অমলিন গল্প। এ এমন এক ভালোবাসা, যার কোনো উপমা নেই। উদাহরণ নেই।

পৃথিবীর প্রথম কুরবানি ছিল হাবিল-কাবিলের কুরবানি। প্রথম মানুষ আদম (আ)-এর ছেলে ছিলেন তারা। হাবিলের কুরবানি আল্লাহ কবুল করেছিলেন। কাবিল তাকওয়ার পরিচয় দিতে পারেনি। তাই সে পৌঁছুতে পারেনি কবুলের দরজায়। এরপর সকল যুগেই কুরবানির বিধান ছিল। আমাদের কুরবানির সাথে জড়িয়ে আছে পিতা-পুত্রের নজরানা। জড়িয়ে আছে ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ), পবিত্র দু’টি নাম!

কুরবানি মানে আল্লাহর নৈকট্যলাভ। ত্যাগ। সমর্পণ। কুরবানি মানেই নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার আয়োজন। এখন এসো, ঘুরে আসি ইতিহাসের বাঁকে! খুলে দেখি রহস্যের কপাট!


অবাক করা স্বপ্ন

ইবরাহিম (আ) আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন, ‘প্রভু! আমাকে একটি সু-সন্তান দাও!’ আল্লাহ সে ডাকে সাড়া দিলেন। পাঠালেন এক ধৈর্যশীল ছেলের সুসংবাদ। তারপর ইসমাইল নামের এক বেহেশতি চাঁদ নেমে এলো তাঁর কাছে। 


এ যে অমাবস্যার চাঁদ

এ চাঁদের অপেক্ষায় কত বসন্ত পার করে দিয়েছেন তিনি! ছিয়াশি বছর বয়সে অবশেষে তাকে পেলেন! পেলেন তাঁর কলিজার টুকরোকে, দু’চোখের শীতল দৃষ্টিকে!

আলহামদুলিল্লাহ।

ধীরে ধীরে বড়ো হতে লাগল ইসমাইল। পিতার সাথে চলা-ফেরার বয়সে উপনীত হলো সে। তখনই এক অবাক করা স্বপ্ন দেখলেন ইবরাহিম (আ)। সেই স্বপ্নের কথা পরম আদরের ছেলের কাছে পেশ করলেন, এভাবে- ‘হে আমার প্রিয় ছেলে! স্বপ্নে দেখেছি- আমি তোমাকে জবাই করছি! এখন তোমার অভিমত কী? বলো!’


কী কঠিন কথা

এ কথার জবাবে কী বলেছিল কিশোর ইসমাইল? তা আরও বিস্ময়কর! অভাবনীয়!- ‘হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তা-ই করুন! আল্লাহ চাহে তো, আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যেই পাবেন।’ 

যেমন পিতা, তেমনি ছেলে!

নবীদের স্বপ্নও ওহি। ইসমাইলও তা বুঝতে পেরেছিলেন- এটা নিছক স্বপ্ন নয়, আল্লাহর আদেশ। কবির ভাষায়-

‘ইসমাইলের বুকেও ছিল আল্লাহপ্রেমের সুর-বাণী-

তাই সহজেই রাজি হলো হতে নিজেই কুরবানি!’

তারপর?

তারপরের দৃশ্য তো বড়োই হৃদয়বিদারক! জানি না, আকাশে-বাতাসে কী গভীর বেদনার রব উঠেছিল সেদিন! ইবরাহিম (আ) ছেলেকে শুইয়ে দিলেন, কুরবানি করবেন বলে! আহা, আল্লাহর আদেশকে কীভাবে মেনে নিলেন পিতা-পুত্র দু’জনই! আল্লাহ শুধু এ দৃশ্যটুকুই দেখতে চেয়েছিলেন। এরপর ডেকে বললেন-

‘হে ইবরাহিম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্যি করেই ছাড়লে! এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কার দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক প্রকাশ্য পরীক্ষা।’

ইসমাইল জবাই হলো না! তার পরিবর্তে আল্লাহ পাঠালেন ‘এক বিরাট জবাইয়ের পশু’- বেহেশতি দুম্বা! (সূরা আস-সাফফাত : ১০০-১০৭)

তাকওয়ার জাফরান

পিতা-পুত্রের অমর কাহিনি চির-স্মরণীয় হয়ে রইল পৃথিবীর বুকে। এ কাহিনির সৌরভ মেখেই আমরা আল্লাহর ভালোবাসায় রঙিন হয়ে উঠি। ভোগ-বিলাসের পথ ছেড়ে পা রাখি কাঁটাবনে। আল্লাহ কী চান আমাদের কাছে? চান ইবরাহিমের মতো ঈমান। ইসমাইলের মতো আত্মসমর্পণ। আর কিছু চান না তিনি, কিছুই না! শুধু হৃদয়ের ভালোবাসাটুকুই পৌঁছে যায় তাঁর কাছে। 

কুরবানির পশুর ‘গোশত ও রক্ত কিছুই পৌঁছে না আল্লাহর কাছে। বরং তার কাছে পৌঁছে যায় তোমাদের তাকওয়া!’ (সূরা আল-হজ্জ: ৩৭) ঈদুল আজহা শুধু ঈদ নয়, তাকওয়ার অনন্য মাপকাঠি-

‘বুকের বাগানে ফুটল কতটা তাকওয়ার জাফরান-

সে খবর নিতে কুরবানি আসে, ছড়ায় নতুন ঘ্রাণ!’


পৃথিবীর সেরা দিন

মহানবী (সা) মদিনায় এসে দেখলেন- সেখানে নওরোজ ও মেহেরজান উৎসব হচ্ছে। জাহেলি যুগে সে দিনগুলোতে খেলাধুলা করতেন সাহাবিরাও। মহানবী (সা) বললেন- এগুলোর পরিবর্তে আল্লাহ তোমাদের আরও উত্তম দু’টি দিন দিয়েছেন। ঈদুল আজহার দিন ও ঈদুল ফিতরের দিন। (আবু দাউদ)

কুরবানির দিন এক মহান দিন। পবিত্র দিন। এ দিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মর্যাদার। (আবু দাউদ) এ দিনের কসমও করেছেন তিনি- ‘শপথ জোড় ও বেজোড়ের’। (সূরা আল-ফজর : ৩) এখানে জোড় বলতে কুরবানির দিন। জিলহজ মাসের দশ তারিখ। (মুসনাদ আহমদ) ১০ জিলহজ মুসলমানদের মহামিলনের মহোৎসব- হজের দিন।


সালাতের পরে

ঈদের দিনের প্রথম কাজ সালাত আদায় করা। ঈদের সালাত। তারপর কুরবানি করা। কেউ যদি আগেই করে ফেলে?

‘যে সালাতের আগেই কুরবানি করে, সে তা নিজের জন্যই করে।’ গোশত খাওয়া ছাড়া এতে আর কোনো সৌন্দর্য নেই। মর্যাদা নেই। উপকার নেই। আর যে কুরবানি করে সালাতের পর, সে তার কুরবানিকে পূর্ণ করে। অনুসরণ করে মুসলমানদের রীতিনীতি।’ (বুখারি)

ছয় ধরনের পশু কুরবানি করা যাবে। উট, গরু, মহিষ, ভেড়া, দুম্বা ও ছাগল। এগুলো হতে হবে সুস্থ, সবল ও নিখুঁত। উট-গরু-মহিষ যেকোনো একটিতে সাতজন শরিক মিলে কুরবানি দিতে পারবে। 


সবার জন্য কুরবানি

কুরবানি সবাই করতে পারে না। সবার জন্য তা জরুরিও নয়। আল্লাহ যাদের তাওফিক দিয়েছেন, কেবল তারাই করে। তবে ঈদের খুশি পৌঁছে যায় সবার ঘরে। সবার মুখেই ফোটে অমলিন হাসি। সবার উনুনেই রান্না হয় কুরবানির গোশত। আল্লাহ বলেছেন-

‘...(জবাই করার সময়) তোমরা আল্লাহর নাম নাও। এরপর তারা যখন কাত হয়ে পড়ে যায়, তোমরা তা থেকে আহার করো। এবং আহার করাও তাকে- যে চায় না এবং যে চায়। (সূরা আল-হাজ : ৩৬)

অনেক আলেমই মনে করেন, উত্তম হচ্ছে কুরবানির গোশত তিন ভাগ করা। একভাগ নিজের জন্য। একভাগ আত্মীয়-স্বজনকে উপহার দেওয়ার জন্য। একভাগ গরিবকে দান করার জন্য। তাহলে ঈদ আর কারও একার থাকে না। ঈদ হয়ে যায় সবার। সব মুসলিমের। এমন সাম্য আর কোথায় আছে? কোথায় আছে সম্প্রীতির এমন সরোবর? 


ঈদ মুবারক

ঈদ মুবারক না বললে যেন আমাদের ঈদই হয় না। এ কথাটিকে আমরা খুব আপন করে নিয়েছি। যেন একসমুদ্র ভালোবাসা উপচে পড়ে এ কথায়। একপাহাড় সবুজ অনুভূতি জমা হয় বুকের আঙিনায়! সাহাবিরা ঈদগাহ থেকে ফেরার পথে একে অপরকে বলতেন- ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া-মিনকুম!’- ‘আল্লাহ কবুল করুন আমাদের কাছ থেকে এবং আপনাদের কাছ থেকেও।’ কবুল করুন- আমাদের ইবাদাত। আমাদের ভালোবাসা। আমাদের ঈদ। আমাদের সবকিছু। কী চমৎকার শুভেচ্ছা! কী মনোহর উচ্চারণ। 


শেষের কথা

ঈদুল আজহা আমাদের হৃদয় কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। আমাদের শেখায়, মালিকের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দাও! মাথা নত করে দাও! কুরবান করে দাও সব সাধ-আহলাদ! নিজের সুখগুলো ভাগ করে দিয়ে দাও মানুষের হাতে! তারপর দেখো, তোমার জন্য কী অপেক্ষা করছে! কী অপেক্ষা করছে? আল্লাহর ভালেবাসা! তাঁর ভালোবাসা পেলে আর কিছুই চাই না। কিছুই না।

ঈদুল আজহার প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে আমাদের। সেই শিক্ষার আলোকে জীবনকে পরিচালিত করতে হবে।


ঈদুল আজহার আনন্দ ছড়িয়ে পড়–ক সবখানে। সবার মনে। সবার ঘরে। 

ঈদ মুবারক!

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ