কিশোরকণ্ঠ, পাহাড়ি এক লড়াকু এবং মতিউর রহমান মল্লিক

কিশোরকণ্ঠ, পাহাড়ি এক লড়াকু এবং মতিউর রহমান মল্লিক

স্মরণ আমিনুল ইসলাম আগস্ট ২০২৩

শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, সংগঠন ও আন্দোলনে অবদানের ক্ষেত্রে যে মানুষটির তৎপরতা পরিমাপ করা যায় না, তিনি ছিলেন আমাদের প্রিয় ও কাছের মানুষ কবি মতিউর রহমান মল্লিক। ১৯৫৬ সালের ১ মার্চ বাগেরহাট জেলার অন্তর্গত রায়পাড়া উপজেলার বারোইপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার জীবন থেকে কিছু কথা অতি সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো। 

পড়ালেখার শুরুটা বাড়িতে হলেও মাদ্রাসায় ফাজিল পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে ঢাকায় এসে তিনি জগন্নাথ কলেজে বাংলায় অধ্যয়ন করেন। ঢাকায় আসার পর কবি মতিউর রহমান মল্লিক নতুন করে আলো ছড়াতে শুরু করেন। পূর্ণোদ্যম নিয়ে তিনি লিখতে থাকেন গান, কবিতা, ছড়া। তার লেখা ভিন্ন ধারার গানে আন্দোলিত হতে থাকে তরুণ ও যুবসমাজ। কবি মল্লিক এসময় সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে দেশজুড়ে সফর তৎপরতা আরম্ভ করেন। প্রথমেই রাজধানী ঢাকায় সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রামে পাঞ্জেরী শিল্পীগোষ্ঠী, খুলনায় টাইফুন শিল্পীগোষ্ঠী, সিলেটে দিশারী শিল্পীগোষ্ঠী, বরিশালে হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠী এবং নিজ জেলা বাগেরহাটে খানজাহান আলী শিল্পীগোষ্ঠীসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে বিভিন্ন নামে আরো বেশকিছু শিল্পীগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন।আনন্দের বিষয় হলো, কবির প্রতিষ্ঠিত শিল্পীগোষ্ঠীগুলো ধীরে ধীরে শিল্প সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রেও নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে সক্ষম হয়।

পেশার দিক থেকে কবি মতিউর রহমান মল্লিক কিছুদিন সাংবাদিকতা করেন। তবে, পরবর্তী দীর্ঘ সময় তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন।

কবি মল্লিক এক বহুমুখী প্রতিভার নাম। তিনি ছিলেন একজন কবি, গীতিকার, সুরকার, শিল্পী, সাংস্কৃতিক সংগঠক, সম্পাদক, প্রাবন্ধিক এবং সুবক্তা। তার মানবিক বোধ ছিল অসাধারণ। তার সহজ সরল স্নিগ্ধ হাসি সহজেই মানুষকে স্পর্শ করতো। অল্প সময়ের জন্য হলেও কবি মতিউর রহমান মল্লিকের সান্নিধ্য পেয়ে তাকে ভুলে গেছেন, এমনটি একজনও পাওয়া যাবে না। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমাদের চলনে বলনে অবশ্যই ইসলামী সংস্কৃতির ছাপ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, শুধু মঞ্চে উঠে সুন্দর করে গাইলে বা অভিনয় করলেই হবে না।’

৭০ দশকের দিকে কবি মতিউর রহমান মল্লিকের সাথে আমি পরিচিত হই। তার বিনয় ও আবেগ আমাকে মুগ্ধ করে। পরবর্তী সময়ে গানের কারণে আরো আকৃষ্ট হই তার প্রতি। মল্লিক ভাইয়ের উৎসাহে একসময়ে নিজের নামটিও দেখতে পাই গীতিকারদের তালিকায়। কবি মতিউর রহমান মল্লিক ছিলেন পরশ পাথরের মতো। তার সংস্পর্শে এসে অনেকেই গীতিকার হয়েছেন, কবি হয়েছেন, শিল্পী হয়েছেন। তিনি উৎসাহ দিতেন ছোটো বড়ো সবাইকে আর নিজে থাকতেন নেপথ্যে।

একটি মজার বিষয় হলো, আপনজনদের মধ্য থেকে অনেকের নামের ওপরই তিনি গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়েছেন, অর্থাৎ কিছুটা পরিমার্জন করে সুন্দর একটি আধুনিক নাম উপহার দিয়েছেন।

খুবই আনন্দের কথা হলো, আমাদের এই প্রিয় পত্রিকা, সর্বাধিক প্রচারিত এই পত্রিকা, পাঠক নন্দিত এই  কিশোর পত্রিকাটির নামও কিন্তু মল্লিক ভাই দিয়েছিলেন ‘কিশোরকণ্ঠ’। অবশ্যই কিশোরদের জন্য এটি ছিল কবির পক্ষ থেকে এক অনন্য উপহার। তিনি শিশু-কিশোরদের ভালোবাসতেন হৃদয় দিয়ে। তার অসংখ্য গান কবিতা ও ছড়ায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। শুধু কিশোরকণ্ঠের নাম উপহার দিয়েই তিনি দায়িত্ব পালন শেষ করেননি, তিনি পত্রিকাটিকে ধারণ করতেন। সুযোগ পেলেই কিশোরকণ্ঠের কলাকুশলী ও লেখকদের সাথে অন্তরঙ্গ আড্ডায় হারিয়ে যেতেন এবং অনেক সুন্দর সুন্দর বাস্তবধর্মী পরামর্শ দিতেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আজও সেসব স্মৃতি স্মরণ করে আবেগ আপ্লুত হয়ে যান। 

কবি মতিউর রহমান মল্লিক কিন্তু উপন্যাস লেখায়ও হাত দিয়েছিলেন। তার অনূদিত ‘পাহাড়ি এক লড়াকু’ শিরোনামের কিশোর উপন্যাসটি এর প্রমাণ। অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় কিশোর পাঠকদের উপযোগী করে লেখা এটি একটি অনবদ্য সৃষ্টি। কিশোরকণ্ঠে ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি পর্ব ছাপা হয়। সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের সাথে মিল রেখে লেখা এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি পাঠকদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় এবং অনেকটা মৌলিকতা পায়।


কবি মল্লিকের মূল কর্মব্যস্ততা সংগীতকেন্দ্রিক হলেও তিনি বহুমাত্রিক একজন লেখক ছিলেন নিঃসন্দেহে। তার প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থের সংখ্যা ৫টি-

১. আবর্তিত তৃণলতা

২. অনবরত বৃক্ষের গান

৩. তোমার ভাষায় তীক্ষ্ণ ছোরা

৪. চিত্রল প্রজাপতি 

৫. নিষণ্ন পাখির নীড়ে


কবি মল্লিকের প্রকাশিত গানের বইয়ের মধ্যে ‘ঝংকার’ ও ‘যত গান গেয়েছি’ উল্লেখযোগ্য। কিশোরদের জন্য কবিতাগ্রন্থ ‘রঙিন মেঘের পালকি’ ও ‘নতুন চাঁদের আলো’ কবির অসামান্য অবদান। তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন, নির্বাচিত প্রবন্ধ সম্পাদনা করেছেন। উপন্যাস লিখেছেন এবং অনুবাদ করেছেন। তার অনেক লেখা এখনো অগ্রন্থিত অবস্থায় রয়েছে।

কবি মতিউর রহমান মল্লিক ছিলেন ইসলামী আদর্শে উজ্জীবিত। তার লেখনীর ভাঁজে ভাঁজে ছিল আল্লাহ প্রেম, রাসূলের প্রতি ভালোবাসা। প্রকৃতির বিশালতায় তিনি স্রষ্টাকে খুঁজে পেয়েছেন। পার্থিব লোভ আর মোহে আকৃষ্ট হননি তিনি কখনোই। মল্লিক ছিলেন একজন মানবদরদি বিশ্বাসী কবি।


কবি মতিউর রহমান মল্লিক তার সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে বেশ কিছু সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন, একঝলক দৃষ্টি দেওয়া যাক সেদিকে-

১. জাতীয় সাহিত্য সংসদ স্বর্ণপদক

২. সবুজ মিতালী সংঘ পুরস্কার 

৩. কলমসেনা সাহিত্য পদক

৪. লক্ষ্মীপুর সংসদ সাহিত্য পদক

৫. রাঙ্গামাটি সংসদ সাহিত্য পদক

৬. খানজাহান আলী শিল্পীগোষ্ঠী সাহিত্য পদক

৭. সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদ সাহিত্য পুরস্কার 

৮. বায়তুশ শরফ সাহিত্য পুরস্কার (চট্টগ্রাম)

৯. বাংলাদেশ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ পুরস্কার 

১০. কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার 

১১. আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সাহিত্য পুরস্কার (বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ, প্যারিস, ফ্রান্স)


মতিউর রহমান মল্লিক আল্লাহর ইচ্ছায় পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ২০১০ সালে, রেখে গেছেন অসংখ্য সাংস্কৃতিক সহযোদ্ধা এবং ইসলামী সংস্কৃতি আন্দোলনে অসামান্য অবদানের ছোঁয়া। পৃথিবীর দেশে দেশে ছড়িয়ে রয়েছে এর প্রমাণ।

দোয়া করি, মহান মালিকের পক্ষ থেকে যেন কবি মল্লিক পেয়ে যান তার যাবতীয় কাজের উত্তম বিনিময়। আমিন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ