কর্মফল

কর্মফল

গল্প ফেব্রুয়ারি ২০১৪

আবদুল ওহাব আজাদ..

Golpoবাড়িময় থমথমে ভাব, মনে হচ্ছে যেনন একটা ভুতুড়ে বাড়ি। আসিফ সাহেব বাড়িতে পা দিয়ে কাউকে দেখলেন না, অন্য দিন স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা ছুটে আসতো। আজ তাকে দেখে যেন ভয়ে পালাচ্ছে। রাগ-ক্রোধ আর অভিমানে ফুঁসে উঠেছেন আসিফ সাহেব, বিমর্ষ ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকলেন তিনি। স্ত্রী আমেনা বিবি পাশে এসে চুপচাপ দাঁড়ালো, তারপর তাকালো স্বামীর দিকে, ভয়ভয় কণ্ঠে আমেনা বিবি বললো, তোমাকে অমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর টরীর খারাপ করেনি তো? আসিফ সাহেব কোনো জবাব না দিয়ে জামা-প্যান্ট ছাড়তে লাগলেন। আমেনা বিবি স্বামীর আরো কাছে বসলো। আবার জিজ্ঞেস করলো, আজ না আরিফের রেজাল্ট বের হওয়ার কথা? আসিফ সাহেব ছোট্ট করে বললেন, হ্যাঁ। আরিফের রেজাল্ট জেনে এসেছো? রেজাল্ট জেনে আর কী হবে? অমন করে বলছো কেন? কী হয়েছে আমার আরিফের রেজাল্ট? যা হবার তাই হয়েছে। তার মানে? তার মানে আর কী? আরিফ ফেল করেছে। না, আমার আরিফ ফেল করতে পারে না। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে আমেনা বিবি। আসিফ সাহেব বড় একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললেন, জানো আমেনা, আমার কি কম খারাপ লাগছে, আমাদের স্কুল থেকে কত ছেলেমেয়ে তো এ, এ-প্লাস পেয়ে বাবা-মা’র মুখ উজ্জ্বল করলো। কিন্তু আমাদের আরিফ? সেতো বি, সি গ্রেডেও এসএসসি পাস করতে পারতো? আমি তো তার জন্য কোন ত্রুটি রাখিনি। প্রাইভেট দিয়েছি, বই-পত্তরের অভাব রাখিনি, পোশাক পরিচ্ছদ খাতা-কলমের কষ্ট দেইনি। আমেনা বিবি বলল, তাহলে কেন এমন হলো? আসিফ সাহেব রেগে রূঢ়কণ্ঠে বললেন, সব কিছু হয়েছে তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য। তুমি ওকে অতিরিক্ত আদর দিয়ে ওর ভবিষ্যৎ ঝরঝরে করে দিয়েছ। কেন তুমি ওকে শাসনে শাসনে মানুষ করতে পারোনি, বল কেন? এ কেনর উত্তর আমেনা বিবি দিতে পারল না। শুধু কাঁদলো অনেকক্ষণ। আসিফ সাহেব বললেন, আরিফ কোথায়? আমি ওর সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। আমেনা বিবি বলল, তাকে তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যেখানে থেকে হোক ওকে খুঁজে বের করো। ওর সঙ্গে আমার অনেক জরুরি কথা আছে।

আরিফ, সোহাগ, সবুজ, রমেন একই ক্লাসের সহপাঠী, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে হৈ-হুল্লোড় করে বেড়ানোর ওস্তাদ সব। ক্লাসে যেন মন বসে না ওদের, তা ছাড়া ইংরেজি শিক্ষক তমেজ স্যারকে যমের মত ভয় পায় সবাই। ইংরেজি ক্লাসে পড়া করেই তবে উপস্থিত হতে হবে, নইলে রক্ষে নেই, বেত্রাঘাতে দেহ রক্তাক্তের বহু নজির আছে। নির্বাচনী পরীক্ষার মাত্র এক সপ্তাহ বাকি, আরিফের বন্ধুরা মিলে ঠিক করলো তারা স্কুল ফাঁকি দিয়ে মৌমাছির মধু ভাঙতে যাবে। এর পরে দিঘির জলে মাছ মারতে যাবে। প্রস্তাব শুনে সোহাগ বলল, টেস্ট পরীক্ষার মাত্র এক সপ্তাহ বাকি, এখন কি স্কুল ফাঁকি দেয়া ঠিক হবে? আরিফ বলল, বাদ দে টেস্ট পরীক্ষা। আগে হবে চাকের মধু ভাঙার কাজ, তারপর হবে দিঘিতে মাছ মারা, এরপর বিকেলে ক্রিকেট খেলা, ব্যস। রমেন আরিফের কথায় জোর সমর্থন করে বলল, আরিফ ঠিকই বলেছে, আরে আগে হবে ইনজয় তারপর হবে লেখাপড়া। সবুজ আরিফের কথা শুনে গেয়ে উঠলো, খাও দাও ফুর্তি করো- আগামী কাল বাঁচবে কি না বলতে পারো। সবুজের সাথে সবাই কণ্ঠ মেলালো। পরিকল্পনা মোতাবেক সবাই চললো, ঘোষদের আমবাগানে বিশাল চাকের মধু ভাঙতে। অভ্যস্ত না হলে যা হয় তাই হলো। টিম লিডার আরিফ ভাবলো, বাঁশের খোঁচা মেরে পুরো চাকটা মাটিতে নামিয়ে আনবে। কিন্তু ফল হলো উল্টো, আরিফের বাঁশের খোঁচা চাক ভেদ করতে পারলো না, কেবল মাত্র মৌমাছিগুলো বিদ্রোহী হয়ে উঠলো, একপর্যায়ে তাড়া করলো ওদের। সমস্ত রাগ যেন আরিফের ওপর, চারিদিকে মৌমাছির ভিড়, বিষাক্ত হুলের জ্বালায় ছটফট করতে লাগলো আরিফ। সহপাঠীরাও সে যন্ত্রণা থেকে বাদ গেল না। আরিফের চোখ মুখ মুহূর্তের মধ্যে বোম ভোলানাথের মতো ফুলে গেল। সমস্ত প্লান-প্রোগ্রাম মৌমাছির হুলের জ্বালায় অকস্মাৎ ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তমেজ স্যারের মাধ্যমে এ সংবাদ আসিফ সাহেবের কানে গেল। আসিফ সাহেব রাতে অফিস থেকে বাসায় ফিরে আমেনা বিবিকে তলব করলেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমেনা বিবির জবাবে আসিফ সাহেব সন্তুষ্ট হলেন না। আসিফ সাহেব রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, আরিফ যে স্কুল ফাঁকি দিয়ে টু টু করে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে হইচই করে ঘুরে বেড়ায় সে সংবাদ কি কিছু রাখো? আমিনা বিবি বলল, এ সংবাদ, আমি কিছুই জানি না। আরিফকে ডাকো, তাকে পড়ার টেবিলে দেখছি না কেন? ওর ভয়ানক জ্বর। জ্বর হবে না? ও সব মৌমাছি কামড়ের জন্য জ্বর, তোমার ছেলে ঘোষদের আমবাগানের মৌচাক ভাঙতে যেয়ে মৌমাছির কামড় খেয়েছে। ও তো আমাকে কিছুই বলেনি। আমেনা, তুমি ওকে আদর দিয়ে দিয়ে মাথাটা খেয়েছো। ছেলেকে শুধু আদর দিতে নেই শাসনও করতে হয় বুঝলে। আমিনা বিবি কোনো কথার উত্তর না দিয়ে চুপচাপ থাকলো। এসএসসি পরীক্ষার আর বাকি নেই। আরিফের কাছে সমস্ত বই নতুন মনে হতে লাগলো, ইংরেজি প্রশ্নগুলো দেখতে দেখতে মাথা ঘুরে গেল। অঙ্ক এতই জটিল মনে হলো যে কোনটিরও যেন উত্তর মিলতে চাইছে না। এ ছাড়া অন্যান্য বিষয়গুলো তাকে বড্ড পীড়া দিতে লাগলো। প্রাইভেটে যাওয়ার পথে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে প্রাইভেট ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখার মজাটা বেশ অনুভব করতে পারলো আরিফ। খুব জোরে কাঁদতে ইচ্ছে করলো তার। রঙিন পৃথিবী মুহূর্তের মধ্যে বিবর্ণ মনে হল আরিফের কাছে। এসএসসি পরীক্ষা সঙ্গত কারণেই ভালো হয়নি আরিফের। আগামীকাল এসএসসির রেজাল্ট বের হবে। অজানা আতঙ্কে আরিফের বুক দুরু দুরু করে কেঁপে উঠলো। সোহাগ, সবুজ, রমেন এসে ভিড় করলো আরিফের বাড়ি। সবার একই রকম পরীক্ষা হয়েছে। সবুজ বলল, কালতো রেজাল্ট বের হবে? সোহাগ বলল, হ্যাঁ তাইতো ভাবছি। রমেন বলল, কী ডাল যে আছে কপালে! সবুজ বলল, আল্লাহ আল্লাহ কর। আরিফ এবার মুখ খুলল, আমরা যদি খাতায় না লিখি তাহলে আল্লাহ কি আমাদের খাতায় লিখে পাস করিয়ে দেবেন? আসলে তোরা যে যাই বলিস, ভুলটা আমাদের, আর সে ভুলের খেসারত আমাদের সারা জীবন দিয়ে যেতে হবে। রমেন বলল, এ যে আমাদের কর্মফল। তানভীর, আসাদ, রিয়াদ, নীলা, মাধবী, অন্তরা ওরা নির্ঘাৎ এ, এ-প্লাস পাবে, আর আমরা, আমাদের ভাগ্যে কী আছে, আল্লাহ পাকই জানেন। সম্মিলিত দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী হয়ে উঠলো।
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ