কবির গভীর মর্মলোকে, যেমন চিনেছি
স্মরণ মার্চ ২০১২
জুবাইদা গুলশান আরা.. কবি মতিউর রহমান মল্লিক আমাদের দেশের একটি প্রিয় নাম। তবে ভাবলে অবাক হতে হয়, মৃদুভাষী, নম্র, চুপচাপ একজন কবি ছিলেন তিনি। কখনও হইচই করে নিজেকে জাহির করেননি। কিন্তু আসলে মানুষটির মনটি ছিলো আগাগোড়া কবিতার রঙে ডোবানো। বাংলার প্রকৃতির মধ্যে ছুটে বেড়ানো এক কিশোর তার কবিতার মধ্যে লুকিয়ে আছে। প্রাণভরা চঞ্চল দৃষ্টি আর মুঠোভরা স্নেহের অজস্র ফুল নিয়ে আমাদের সাহিত্যের বাগানে এই মানুষটি জায়গা করে নিয়েছিলেন। কবিরা কিন্তু সাধারণ মানুষ হন না। কবিদের মনের চোখ অনেক কিছু দেখতে পায়, যা সাধারণভাবে আমরা বুঝতে পারি না। যেমন ধরা যাক, কবির কবিতার বই ‘অনবরত বৃক্ষের গান’। গাছপালা, বৃক্ষ-লতা সব কিছুর মধ্যেই তো আমরা বেড়ে উঠি। কিন্তু ব্যাপারটা একেবারে বদলে যায় যখন কবি বলেনÑ শহীদেরা আকাশের ধ্রুবতারা সীমাহীন মউজ... শহীদেরা যেন বুকের দীঘিতে সাহসের নীল দীপ্র পদ্ম, অমর ঠিকানা শুধু শয্যার চেয়ে অবিরাম ভেসে আসা মিছিলের ডাক ভালবাসার চিঠি। (শহীদেরা) এই সময়টা শহীদদের সময়। রাস্তার ধুলোর রক্তধারায় লেখা যে অগণিত নাম, তাদের স্মৃতি যে কবির হৃদয়ে কত গভীর ভালোবাসায় ধরে রেখেছেন, এই কবিতা পড়লেই মন তার সঙ্গে মিছিলে যেতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। প্রকৃতির সঙ্গে কবির বন্ধুতা গভীর। সে শুধু গাছের কথা, ফুলের কথা বলে না। দুর্গম অঞ্চলে যখন প্রচণ্ড প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাবা দেয়, তখন কবি বেদনায় উচ্চারণ করেন তার কবিতায়Ñ মৃত্যু এবং লাশ দিয়ে ঢেকে ফেলে গোটা বাংলাদেশ দেখো প্রতি ইঞ্চি জমিতে এখন মৃত্যুদণ্ড ওঁৎ পাতা রয়েছে বলে সমগ্র বাংলাদেশ যেন শেষতক রুদ্ধশ্বাস আতঙ্কের মধ্যেই বেঁচে রইল। (ভয়াবহতম আর্তনাদের মধ্যে) আমরা যারা লড়াই করে বেঁচে আছি, পৃথিবীর কঠিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাঝখানে আমাদের চেষ্টা হল আণবিক শক্তির ঝুঁকির মধ্যে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা। আরও বড় পরীক্ষার সামনে আমরা ব্যথিত, পীড়িত, মর্মাহত হই। কেন এমন হয়, তা বোঝা কঠিন। একদিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসী মনোভাব, অন্য দিকে ধর্ম নিয়ে অমানবিক আক্রমণ, প্রতিবেশীকে দুর্বল পেলে সবলের আস্ফালন, আর নিরন্ন দরিদ্র মানুষের হাহাকার। এই সব নিয়েই মানুষ চলেছে। প্রাচীন যুগে মানুষ সাধনা করতেন। তপস্যার মধ্য দিয়ে তারা রোগ, শোক ও দুঃখকে জয় করতেন। মানুষ তার মনের এসব কথা লিখে রেখে যায় প্রবচন, ছড়া কবিতা ও সাহিত্যে। তাদের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয় এসব লেখার মধ্য দিয়ে। কবিরাও তো তেমনই জীবনের সাধক। জীবন ক্ষয় করে তারা সত্যকে খুঁজে পাবার চেষ্টা করেন। দুঃখের মধ্য থেকে তুলে আনেন মহামূল্য নুড়ি পাথর, ঝিনুক আর চিত্রমালা। কবিদের দেখার চোখ বাস্তব পৃথিবীকে নতুন করে চিনিয়ে দেয়। কবি যেমন তার চিত্রল হরিণের মতো চিত্রল প্রজাপতির মধ্যে তুলে আনেন সাদা সাপটা রোজকার চেনাপথ, আমরা তো বাস্তবতার জটিল দৌড়ে ব্যস্ত, কবি তখন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকেন। বলেনÑ তোমার ছোটবেলার মত এত বাবলা বৃক্ষ তুমি কোথাও পাবে না তোমার কিশোর কালের মত এত পুকুরও তুমি কোথাও পাবে না। (বিলের দিকে) এভাবেই কবি সহজেই আমাদের ছেলেবেলার প্রিয় বেলাল ভাইদের গাঁয়ের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন। কবির মধ্যে লুকোনো থাকে আগুন। দেশকে, জাতিকে, মানুষ ও মানবতাকে ভালোবাসতে জানতে তার মধ্য থেকে জ্বলে ওঠে আগুনের তেজ, শক্তির উত্তাপ। কবি নজরুল ইসলাম যেমন গোটা পরাধীনতার যুগে জাতির বুকে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার আগুন। কবি মতিউর রহমান মল্লিকও বর্তমান সময়ের জ্বালা যন্ত্রণাকে প্রকাশ করেন এভাবেÑ গণতন্ত্রের কুরাশ ছাড়া বুশের আর কি নাম হতে পারে? গণতন্ত্রের আর এক হায়েনার নাম রামসফেল্ড, এবং শ্যারনরা একেকজন রাক্ষস ছাড়া আর কি হতে পারে? (পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রের ভেতরে) কারণ কবি তেজোদীপ্ত কণ্ঠে মনে করিয়ে দেন Ñ‘‘পেন্টাগনের ভূগোল থেকে জঠর থেকে বেরিয়ে আসে ইরাকের কঙ্কাল ফিলিস্তিনের খুলি আর হাড়গোড়।” (পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রের ভেতরে) কবি অস্ত্রের ভাষাকে কখনও মূল্যবান মনে করেননি। অস্ত্রের প্রতি ছিলো তার বিতৃষ্ণা, তাই মনে করিয়ে দেনÑ একটা অস্ত্র শেষাবধি একটাই থাকে তার শরীরের সর্বত্র একটা অস্ত্রেরই স্বভাব। (অস্ত্রের ভাষা) আজ লিখতে বসে মনে হচ্ছে, আমরা বড়রা কেন যেন কঠিন ভাষায় কথা সাজাতে সাজাতে ছোটাদেরকেও কঠিন করে তুলছি। এসব কথা মনে করেই এই কবি একগুচ্ছ শিশু-কিশোরকে সামনে রেখে তাদের জন্য গড়ে দিয়েছেন ‘রঙীন মেঘের পালকী’। এই ছড়ার মধুমেলায় এসে আমরাও দু’ ছত্র কাব্য কথা সাজিয়ে দিতে চাইÑ ছোটদের হৃদয়ের ফুলবাগানে অথৈ প্রাণের ঢেউ ছড়ায়, গানে লিখেছেন কবি যেন স্বপ্ন এঁকে তোমাদের জীবনের শপথ দেখে। এই কাব্য কথায় আছে চড়–ই পাখির দুরন্ত ছুটন্ত ছবি, সেই সঙ্গে খুদে মরিচের ঝালের কাহিনী। কবি লিখেছেনÑ নামবে আঁধার তাই বলে কি আলোর আশা করবো না, বিপদ বাধায় পড়বো বলে ন্যায়ের পথে লড়বো না? (আলোর আশা) এটি তরুণদের কণ্ঠের একটি প্রিয় গান হয়ে তাদের গাইতে শুনেছি। মন কেড়ে নেয়া গান। এ ছাড়া কবি ছোটোদের মনে করিয়ে দিয়েছেনÑ ভাল নয় বাড়াবাড়ি আড়াআড়ি কাড়াকাড়ি মারামারি করাটা! তাছাড়া, আমারই এখন একটি প্রচণ্ড বৈশাখের ঝড় বেশি প্রয়োজন। এ ছাড়া বোশেখের কবিতা, বিভিন্ন ঋতু আর ফুলের নামে ছড়া, ঈদ আর রমজানের ভাবনা নিয়ে। প্রিয় রাসূলকে (সা) স্মরণ করেছেন ভালোবাসা আর ভক্তি দিয়ে। অনেক কবি সাহিত্যিককে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তার কবিতার মধ্য দিয়ে। আমার পাঠক বন্ধুরা, সত্যি বলছি, এই কবির প্রায় সব কবিতাই উল্লেখ করতে ইচ্ছে হয়। এত উদার মনের এই কবি, সারা পৃথিবীতে বিছিয়ে গেছেন মায়া ও মমতা। শেষ করবার আগে বলার খুব তাগিদ বোধ করছি যে, তার পরিচয় যেন মানুষ মাত্রই গ্রহণ করতে পারে। রুক্ষ বালুবেলায় দুলতে থাকা কাশবনের মতোই কবির দু’হাতে অনেক সম্পদ। কলম যা বলেছে তার চেয়েও অনেক বেশি। তিনি যা রেখে গেছেন, তার মধ্যে দুঃখ আছে, ক্রোধ আছে কিন্তু তারও চেয়ে বেশি আছেÑ কাশ শিউলির সময়... আকাশ নড়ে অথবা পৃথিবী শিশিরের প্রার্থনা যেখানে হাঁটছে শান্ত নদীরা আজ খেজুর গাছের নতুন নলির লোভে টপ টপ করে ছন্নছাড়ার চোখ... কালের ভেতরে আমার জন্মভূমি শরতের মত প্রথম প্রেমের গান (কাশ শিউলির সময়) কবির একটি অসাধারণ অনুবাদ বা ভাবানুবাদ আছে ‘হপ্তানামা’ নামের কবিতায় (হযরত আলী রা:-এর রচিত কবিতা)। তার তুল্য হপ্তানামা হাতে পাওয়া খুবই সৌভাগ্যের ব্যাপার। কবির সঙ্গে এভাবেই আমার সাক্ষাৎ। এবং যাত্রা পথে বিস্ময় আনন্দ এবং অশ্রুর ক্ষীণ রেখা ছুঁয়ে দেখা হলো অলৌকিক আলোর গম্বুজ- “সমস্ত পৃথিবী তাকে বেঁচে থাকার সর্বশেষ অবলম্বন বলে আহ্বান জানালো। (আর এক সূর্যের গান) কবির সাথে দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে আমি মুগ্ধ বিস্মিত, অভিভূত। এখন কবি আমাকে অনুমতি দিলেনÑ ‘এবং অনেকক্ষণ লেখাপড়া করার পর এইবার তুমি ঘাসের উদ্দীপনার মধ্যে পা ডুবিয়ে শিশির ভেজা পানির প্রশস্ততায় ওজু করে নিতে পারো।’ সত্যি, ভাবনার এমন প্রশান্তি ক’জন দিতে পারে বলো? তাঁর প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।
আরও পড়ুন...