কবি কাজী নজরুল ইসলাম

কবি কাজী নজরুল ইসলাম

বিশেষ রচনা মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন মে ২০২৩

কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। সবাই তাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবেসে ‘বিদ্রোহী কবি’ বলে ডাকেন। তিনি সব মানুষের কবি। দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন কবিতায়, নাটকে, উপন্যাসে, সংবাদপত্রের মাধ্যমে এবং রাজনীতির মাঠে। নজরুল শিশু-কিশোরদের জন্য কাজ করেছেন অনেক। তিনি জানতেন আজকের শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। 

সুন্দর রূপের লীলাভূমি আমার এই দেশ। এই দেশ ধানের দেশ, গানের দেশ, কবির দেশ। সবুজ শ্যামল বাংলার রূপ প্রত্যেক কবিকেই হাতছানি দিয়ে ডেকেছে বারবার। তেমনি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, ছোটোদের কবি। তিনি ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ, ইংরেজি ১৮৯৯ সালের ২৪ মে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর থেকেই নানা দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে বড়ো হয়েছেন। কখনো রুটির দোকানে কাজ করেছেন, কখনো বা লেটোর (যাত্রা গান) দলে কাজ করেছেন। বিচিত্র এই জীবনে কবি প্রতিভার যে উন্মেষ ঘটেছে তা আমরা তার রচনাবলিতেই দেখতে পাই। সবার জন্য সমানভাবে দু’হাত ভরে লিখেছেন। 

নজরুলের সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এতো বিশাল ভান্ডার তিনি সৃষ্টি করেছেন যার মাঝে শিশু-কিশোর সৃষ্টি আলাদা করলে আরেকটি সাগরে পরিণত হয়। শিশু-কিশোররা যেন নিজেদের মতো করে নিজেদের কথাগুলো পড়তে পারে এবং অন্যের সাথে আলাপ করতে পারে সেভাবেই নজরুল তাদের জন্য লিখেছেন। ফলে তার কিশোর রচনা মনভোলানো অসামান্য সম্ভারে পরিণত হয়েছে।

চারপাশ সম্পর্কে শিশু-কিশোরদের অপার কৌতূহল, তাদের অবাধ কল্পনার বিস্তার ও কাল্পনিক জগতে বিচরণ করার অপরিমেয় ক্ষমতা, অদ্ভুতের প্রতি, উদ্ভটের প্রতি আকর্ষণ, তাদের অভিমান-প্রিয়তা, প্রখর ছন্দদোলার প্রতি আকর্ষণ-এসবই অবলীলাক্রমে নজরুলের কিশোর সাহিত্যে উঠে এসেছে। কাজী নজরুল ইসলাম শিশু-কিশোরদের জন্য যেসব গদ্য-কবিতা, গান ও নাটক রচনা করেছেন তা একটু দেখে নেওয়া যাক।

কাজী নজরুল ইসলাম কিশোরদের জন্য যেসব কবিতা লিখেছেন তার মধ্যে বেশি আলোচিত ‘সঙ্কল্প’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘প্রভাতী’, ‘চড়–ই পাখির ডানা’, ‘ঝিঙে ফুল’, ‘খুকি ও কাড়বিড়ালী’, ‘খাঁদু দাদু’, ‘দিদির বে’তে খোকা’, ‘মা’, ‘খোকার বুদ্ধি’, ‘খোকার গপ্পো বলা’, ‘চিঠি’, ‘লিচু চোর’, ‘হোঁদল কুঁৎকুঁতের বিজ্ঞাপন’, ‘ঠ্যাং-ফুলী’, ‘পিলে ফটকা’, ‘কালো জাম রে ভাই’, ‘শিশু জাদুকর’, ‘চলব আমি হালকা চালে’, ‘কিশোরের স্বপ্ন’, ‘জিজ্ঞাসা’, ‘সারস পাখি’, ‘সাঙ্গলিক’, ‘লক্ষ্মীছেলে তাই তোলে’, ‘ছোট হিটলার’, ‘নতুন খাবার’, ‘শিশু সওগাত’, ‘ঈদের চাঁদ’, ‘কোথায় ছিলাম আমি’, ‘বগ দেখেছ?’, ‘ফ্যাসাদ’, ‘আগুনের ফুলকি ছুটে’, ‘মায়া-মুকুর’ উল্লেখযোগ্য। 

তিনি কিশোরদের জন্য ‘পদ্ম গোখরো’ নামক একটি গল্পের বইও লিখেছেন। কিন্তু গল্পের চেয়ে নাটিকা লিখেছেন বেশি যার প্রতিটি খুব চমৎকার। ‘পুতুলের বিয়ে’, ‘জুজুবুড়ির ভয়’, ‘কানামাছি’, ‘নবার নামতা পাঠ’, ‘জাগো সুন্দর চিরকিশোর’ বেশ উল্লেখযোগ্য। 

কাজী নজরুল ইসলাম সবার জন্য গান লিখেছেন অসংখ্য। নতুন নতুন সুর ও তাল সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন অনন্য। ‘প্রজাপতি প্রজাপতি’, ‘চমকে চমকে’, ‘মোমের পুতুল’, ‘শুকনো পাতার’, ‘পউষ এলো’, ‘শিকল পরার গান’, ‘ভাঙার গান’, ‘পাহাড়ি গান’, ‘ছাত্রদলের গান’, ‘কাণ্ডারি হুঁশিয়ার’, ‘অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত’, ‘চল চল চল’, ‘ভোরের সানাই’, ‘সমর-সঙ্গীত’, ‘দিকে দিকে পুন’, ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায়’, ‘আমার দেশের মাটি’, ‘আমার শ্যামল বরণ বাঙলা’, ‘মেঘ-বিহীন খর-বৈশাখে’, ‘তৃষিত আকাশ কাঁপে’, ‘মেঘের ডমরু ঘন বাজে’, ‘হে সজল শ্যাম’, ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক’, ‘হৈমন্তিকা’, ‘বসন্ত মুখর আজি’, ‘আসে বসন্ত ফুলবনে’, ‘খেলিছে জলদেবী’, ও ‘মারা একবৃন্তে দুটি কুসুম’ বেশ আলোড়িত গান। 

কাজী নজরুল ইসলাম হামদ ও না’ত রচনায় কিশোরদের কথা ভেবেছেন এবং লিখেছেন অনেক ইসলামী সঙ্গীত। ‘এই সুন্দর ফুল’, ‘খোদার প্রেমের শরাব’, ‘রোজ হাশরে আল্লাহ’, ‘শোনো শোনো ইয়া এলাহী’, ‘খোদা এই গরীবের’ ইত্যাদি হামদ ও ‘তোরা দেখে যা’, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ’, ‘ইসলামের ঐ সওদা’, ‘এ কোন মধুর সরাব’, ‘তৌহিদের মুর্শিদ আমার’, ‘মোহাম্মদ নাম যতই জপি’, ‘ইয়া মোহাম্মদ’ না’ত লিখেছেন। 

শিশুদের চঞ্চল মন কী চায় তার একটি পরিষ্কার ছবি বিদ্যমান কবির কবিতায়। কাব্যিক শৈলীতে কবির শিশুতোষ কবিতাগুলো ছোটো-বড়ো সবারই মন কাড়ে। এ যেমন সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠা একটি ভালো অভ্যাস। সেই সকাল বেলা ওঠা নিয়ে কবি লিখেছেন ‘প্রভাতি’ নামক কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমে কিশোরদের কথা বলার চেষ্টা করেছেন। কিশোরদের ভাষায় তিনি বললেন, 

ভোর হোলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠ রে!

ঐ ডাকে জুঁই শাখে ফুল-খুকি ছোট রে!

খুলি হাল তুলি পাল ঐ তরি চলল

এই বার এই বার খুকু চোখ খুলল।

খোকা সকাল বেলা পাখি হতে চায়, কিন্তু সেখানে বাদ সাধে তার মা। তার মা সকালে খোকাকে উঠতে দিতে চায় না, মা বলে এখনো সকাল হয়নি। তাই খোকার আরো ঘুমিয়ে থাকা প্রয়োজন। তাই খোকা মাকে আলসে মেয়ে বলেছে। খোকা তার মাকে এও বোঝানোর চেষ্টা করেছে আমরা জাগলেই তবে সকাল হবে। তাই কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন: 

আমি হব সকাল বেলার পাখি

সবার আগে কুসুম-বাগে উঠব আমি ডাকি। 

সূয্যিমামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে,

‘হয়নি সকাল, ঘুমো এখন’ মা বলবেন রেগে।

বলব আমি, ‘আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাক

হয়নি সকাল-তাই বলে কি সকাল হবে না ক?

আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?

তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!

কিশোর মনে নানা কিছুর ভাবনা আসে। কিশোর মনে নানা ভাবের জন্ম নেয়। শিশুদের অদম্য ইচ্ছাকে সুন্দররূপে ফুটিয়ে তুলেছেন সঙ্কল্প কবিতায়। তিনি বলেছেন, 

থাকব না কো বদ্ধ ঘরে দেখব এবার জগৎটাকে,

কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।

দেশ হতে দেশান্তরে ছুটছে তারা কেমন করে,

কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে,

কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণাকে। 

‘খুকি ও কাঠবিড়ালি’ কবিতায় ছোটোদের মান অভিমানের একটি চমৎকার চিত্র পাওয়া যায়। তিনি এখানে বলেছেন,

কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?

গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি লেবু? লাউ? 

বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর ছানা? তাও?

ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,

খাও একা পাও যেথায় যেটুকু!

বাতাবি-নেবু সকলগুলো একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!

তবে যে ভারী লেজ উঁচিয়ে পটুস পাটুস চাও?

ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!

কাজী নজরুল ইসলাম কিশোরদের ভাষায় কিশোরদের মতো করে লিখেছেন। তিনি তাদেরকে ছোটবেলাতেই স্বাধীন চেতনাসম্পন্ন মানুষ হতে আহ্বান করেছেন। তার উল্লিখিত লেখাগুলোর মাঝে তাকে কিশোর কবি বলা যায়। কেননা কিশোরদের আশা ও চাওয়া-পাওয়াকে তাদের মতো করেই লিখেছেন। তাই আমাদের সকলেরই প্রয়োজন কাজী নজরুল ইসলামকে আরো বেশি করে জানা এবং চর্চা করা।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ