কথা বলার সাথী

কথা বলার সাথী

তোমাদের গল্প সেপ্টেম্বর ২০১৩

এম ইমন ইসলাম

ক্লাস ছুটির পর বন্ধু রবির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। দেখছিলাম চার পাশের সবুজ বৃক্ষ। হঠাৎ চোখ আটকে গেল একটি কদম ফুলগাছ দেখে। কত সুন্দর; ফুল থেকে যেন আলো ছুটছে! গাছগুলো দুলে দুলে একে অপরের সাথে কী যেন বলছে। আপনাতেই মুখ থেকে এমনিতেই বেরিয়ে এলো আল- হামদুলিল্লাহ। এমন সময় শুনতে পেলাম ‘ভাইয়া’ ডাক। একটি কচি কণ্ঠ। পেছন ফিরে দেখি ছোট একটি ছেলে। কত সুন্দর চেহারা। টানাটানা চোখ, মায়াভরা মুখ। চেহারা দেখলেই যে কারো মন কাড়বে। বয়স ৮/৯ বছর, তার বেশি নয়। পরনে ময়লা হাফ প্যান্ট, গায়ে কিছুই না। জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে ডাকছো? বলল, হ্যাঁ। বললাম, কী বলবে বল। করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে কাতর কণ্ঠে বলল, পাঁচটি টাকা দেবেন, খাবার খেতাম। খুব ক্ষিধে পেয়েছে। একথা বলে সে থেমে গেল। আর যেন কথা বের করতে পারছে না। চোখ ফেটে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার । জীবনে অনেককে অবিশ্বাস করেছি; কিন্তু তার কথা কেন যেন অবিশ্বাস করতে কষ্ট হল আমার। বুকের ভিতরটা ভীষণভাবে কেঁপে উঠলো। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলো। পাশের একটি দোকানে নিয়ে কিছু খাবার কিনে দিলাম। সে খাচ্ছিল আর আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিল। আমি শুধু মুখ নেড়ে বললাম, খাও। খাওয়া শেষে পাশে ডেকে বললাম, কোথায় থাকো তুমি? বলল, রাস্তায় রাস্তায়। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন! তোমার বাবা- মা কোথায় থাকে? একথা শোনামাত্র ওর চোখ দিয়ে এবার দরদর করে অশ্রু বেরিয়ে এলো। আমি বললাম, কী হল তোমার, কথা না বলে কাঁদছো কেন? একটু পরে বলল সে, জন্মের পূর্বেই বাবা মারা গেছেন। আর মা, বোন কোথায় আছে তা বলতে পারি না। আমরা তখন বস্তিতে থাকতাম। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি একা; মা-বোন কেউ নেই। এরপর আর কোনদিন মায়ের সাথে দেখা হয়নি আমার। আজও খুঁজি তাদের। একটানা কথাগুলি বলে থেমে গেল সে। তখনও চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল তার। ওর প্রতি আমার মনে খুব মায়া জাগলো। তাকে ছেড়ে আসতে মন বাঁধা দিল। জিজ্ঞাসা করলাম, আমার সাথে যাবে? সে বলল, কোথায়? বললাম, আমি যেখানে থাকি। কী যেন ভেবে নিল, বলল, হ্যাঁ যাবো। সাথে করে নিয়ে এলাম রুমে। নাম জিজ্ঞাসা করলাম। বলল, সাজু। মুখে হাসি টেনে বললাম, খুব সুন্দর নাম তো! তুমি কি স্কুলে পড়তে? সে বলল, না, কেউ আমাকে কোনদিন স্কুলে নিয়ে যায়নি। আমি বললাম, তোমাকে স্কুলে যেতে হবে। পড়ালেখা শিখে অনেক বড় হতে হবে। কি, যাবে? সে বলল, হ্যাঁ, যেতে তো মন চায়, কিন্তু...। তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, তাহলে আর কিন্তু কেন, যত খরচ লাগে আমি দেব, সব ব্যবস্থা করব। রুমে ওর সাথে কথা বলে সময় কাটাতাম। আমি ছোট বেলা থেকেই নিয়মিত নামাজ পড়ি। কয়েক দিন পরে দেখি সেও নামাজ পড়া শুরু করেছে। আমি দূর থেকে ওর নামাজ পড়া দেখতাম আর হাসতাম। খুব ভাল লাগতো। এভাবে কেটে গেল প্রায় তিন মাস। জানুয়ারি মাসে সাজুকে একটি এতিমখানায় ভর্তি করিয়ে দিলাম। কয়েক দিন পর সবকিছু গুছিয়ে সেখানে রাখতে নিয়ে গেলাম। বললাম, তুমি আজ থেকে এখানে থাকবে, ভালো করে লেখাপড়া করবে। আমি মাঝে মাঝে এসে দেখে যাবো। আমার কথা শুনে তার চোখে অশ্রু চলে এলো। বলল, ভাইয়া আপনাকে ছাড়া আমার খুবই কষ্ট হবে।  বললাম, কেঁদো না। লেখাপড়া করে তোমাকে অনেক বড় হতে হবে। এখানে তোমার মত অনেকেই আছে। তাদের সাথে খেলাধুলা করবে। তাছাড়া আমি তো মাঝে মাঝে আসছি। সে অশ্রু মুছলো। এতদিন একসাথে থাকাই দু’জনের মধ্যে বেশ ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছিল। আর তাই আমারও কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু কষ্টে তা চেপে রাখলাম। পাঁচ মাস গত হয়েছে। আমি মাঝে মাঝে সাজুর কাছে যাই। শিক্ষকদের কাছে ওর খবর নেই। সবাই ওকে খুব ভালো বলে। সে নাকি ক্লাসে সবচেয়ে ভালো পারে। এসব শুনে তার প্রতি আমার ভালোবাসা দ্বিগুণ হল। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। অনেক বড় করার স্বপ্ন। সাজুর সাথে কথা বলে গোপনে চোখ মুছতে মুছতে বাসায় ফিরতাম। আমার প্রথম বর্ষের পরীক্ষা চলে আসায় পড়ালেখা নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তাই অনেক দিন তার সাথে দেখা করতে পারিনি। শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাসায় না গিয়ে রিকশা নিয়ে সাজুর দিকে রওনা দিলাম। কিছু ফল ও বিস্কুট কিনলাম। ভাবছিলাম আমাকে দেখে আজ সে অনেক কাঁদবে। ওদের গেটে পৌছে গেলাম। এমন সময় একটি ট্রাক দ্রুত ওপাশ দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ ‘ভাইয়া’ চিৎকার শুনতে পেলাম। ট্রাক ডেট ব্রেক করে দাঁড়িয়ে গেল, তাতে কোন কাজ হল না। চাকার নিচে পিশে গেছে ছোট একটি শিশু। চারিদিক থেকে অনেক লোক এলো। সবাই আফসোস করে বললÑ ওহ! কী সুন্দর ছেলেটি। রিকশা থেকে দ্রুত নেমে এলাম। তাকিয়ে দেখি আমার সাজু। আমার বুকের মধ্যে কঠিন ব্যথা অনুভব করলাম। রক্ত মাখা লাশ জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। বললাম, কথা বল সাজ্ ু। কিন্তু সে কথা বলল না। চলে গেছে না ফেরার দেশে; যেখান থেকে কেউ কখনো ফেরে না। সে আর কখনো আমাকে ভাইয়া বলে ডাকবে না। আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। হারিয়ে গেল কথা বলার সাথী। ওর জন্য আমার ভিশন কষ্ট হয়।  আজও সেই ভাইয়া ডাক আমার হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয়।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ