একমুঠো সুখ  -শরিফ আহমাদ

একমুঠো সুখ -শরিফ আহমাদ

গল্প আগস্ট ২০১৬

আজ হুমায়রা খুব খুশি। মা তার মনের কথা বাবাকে বলেছেন। বাবা রাজি হয়েছেন গ্রামে যেতে। অ-নে-ক দিন হলো গ্রামে যাওয়া হয় না। নানু বাড়িতে ওঠা হয় না। কারো সুযোগ হয়ে ওঠে না। বাবা-মা অফিস নিয়ে ব্যস্ত। আর সে পড়া নিয়ে।
হুমায়রা ৫ম শ্রেণীতে পড়ে। আজিমপুর গার্লস স্কুলে। প্রতিবারই ক্লাসে প্রথম হয়। লেখা পড়ায় খুব মনোযোগী। খেলার সময় খেলে আর পড়ার সময় পড়ে। নিয়মিত স্কুলে যায়। ক্লাস করে। ফাঁকে ফাঁকে গল্পের বই পড়ে। ছড়ার ছন্দে নেচে ওঠে। ছবিও ভালো আঁকে। কারো সাথে ঝগরা করে না। সবার সাথে মিলে-মিশে চলে। অনেক গুণের কারণে ম্যাডামরা তাকে আদর করেন। স্যাররা পছন্দ করেন। আর মা-বাবাতো এমন মেয়ে পেয়ে খুশিতে আটখানা। তাই তার গ্রামে যাবার আবদার শুনে তারা রাজি হন। স্কুল যে কয়দিন বন্ধ সে কয়দিন থাকতে বলেছেন বাবা। তিনি অফিসের কাজে ব্যস্ত। সময় করে একদিন গিয়ে তাদের নিয়ে আসবেন। কথা দিয়েছেন তিনি।
হুমায়রার নানু বাড়ি ঠাকুরগাঁও। সালসা পেয়ালা গ্রামে। নানু বাড়িটা অনেক বড়। সুন্দর। যেন দক্ষ কোন শিল্পীর আঁকা। মায়ের সাথে গাড়িতে ওঠে এমন কল্পনায় দেখছে ও নানুবাড়ি। হঠাৎ আইসক্রিম ওয়ালার হাঁক শুনে বাস্তবতায় আসে। তাকিয়ে থাকে পলকহীন। আইসক্রিম খেতে না চাইলেও মা কিনে দেন একটা। অন্য সময় হলে মা কিনে দিতেন না। বাইরের খোলামেলা জিনিস তিনি পছন্দ করেন না। খান না কখনো। তাকেও খেতে দেন না। আজ কেন যে কিনে দিলেন আল্লাহতায়ালাই জানেন। খেতে খেতে ও চারপাশে নজর বুলালো। দোকানপাট, ঘরবাড়ি সব ছাড়িয়ে যাচ্ছে গাড়ি। আলাদিনের প্রদীপের দৈত্য যেন সব কিছুকে দূরে ভাগিয়ে দিচ্ছে। দ্রুতগতিতে গাড়ি ছুটছে। অ-নে-ক দূরের পথ! ৪৫৯ কিলোমিটার।
মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙলো হুমায়রার। ঠাকুরগাঁও স্টেশনে পৌঁছেছে গাড়ি। সবাই নামছে। মায়ের কোলে সারা পথ ঘুমিয়ে এসেছে। শুধু যমুনা পার হবার সময় জেগেছিলো। আর মাঝে একবার গাড়ি বিরতির সময় নেমেছিল। তড়িঘড়ি করে নামলো তারা। অটোয় চড়ে বোর্ড অফিস পৌঁছলো। সেখান থেকে রিকশা নিলো। আড়াই মাইল পথ। মেঠোপথে রিকশা চলছে। বিকেলের সোনালি রোদ পরশ বুলাচ্ছে মাঠে। চমৎকার বাতাস আসছে। রাস্তার দু’ধারে গাছের মাথা দুলছে। পাশে বয়ে চলেছে ছোট একটা নদী। নদীতে দু’ একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে। দূরে দেখা যাচ্ছে ঘন বন। মাঝে মাঝে বাড়ি। আর অধিকাংশ ফসলের মাঠ। গ্রামের মুগ্ধ করা রূপ দেখতে দেখতে তারা গন্তব্যে পৌঁছলো। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। নানা-নানু, মামা-মামি সবার সাথে কথা বললো হুমায়রা আগেই। মা বড়দের সাথে আর সে ছোট খালার সাথে মেতে উঠলো।
পরদিন কাকডাকা ভোরে ঘুম ছুটলো হুমায়রার। চোখ ডলতে ডলতে বাইরে বেরুলো। মৃদু বাতাস আসছে। সূর্য এখনো পুরো ওঠেনি। ডিমের কুসুমের মতো আলো ছড়াচ্ছে। প্রকৃতিটা বেশ ভালো লাগছে। অনেক দিন পর আসায় পুরো বাড়িটা অন্য রকম লাগছে। আঙিনায় পুই গাছগুলো বড় হয়েছে। লকলকে ডাঁটাওয়ালা পুই লতাগুলো দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। কলের পাড়ে হাসনাহেনা গাছে ফুল ভরা। ডালিম গাছ কচি পাতায় ছেয়ে গেছে। অনেক পাখির আনাগোনা আশপাশ গাছে। ডালিম গাছে টুনটুনিরা লুকোচুরি খেলছে। ও মুগ্ধ হয়ে দেখছে সব। টের পায়নি কখন ছোট খালা সানজিদা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। পেছন ফিরতেই চোখাচোখি হলো। তিনি হাসি মুখে বললেন, খুব ভালো লাগছে না? হুম। মাথা দোলালো হুমায়রা। আমরা এসব দৈনিক দেখি। খু-উ-ব ভালো লাগে। চল গ্রামটা একটু ঘুরে আসি। আরো অনেক ভালো লাগবে তোমার। বেশ মজা পাবে। খালা তার একটা হাত ধরে চলতে লাগলেন। প্রথমে গেলেন দিঘির পাড়ে। অনেক বড় দিঘিটা। দিঘির পাড়ে নারিকেল, সুপারি আর হিজল গাছে ভরা। নানা দিঘিতে মাছ ধরছেন। জাল দিয়ে। মাছ একটা ছোট ডেকচিতে রাখছে মামাতো বোন শাহানা। নানা তাকে দেখে মুচকি হাসলেন। বললেন, ঘুম কেমন হলো তোমার ছোটমণি? জি! ভালো হয়েছে। অনেক ভালো। তোমার মাছ ধরা আরো ভালো লাগছে। এসো মাছ ধরো আমার সাথে। দুষ্টুমিভরা ঠোঁটে বললেন নানা। আমি তো সাঁতার জানি না। মাছ ধরবো কেমনে? তার কথায় হেসে উঠলো সবাই। খালা হাসতে হাসতে বললেন চিন্তা করো না। তোমাকে সাঁতার শিখিয়ে দেবো। তোমার ইচ্ছা থাকলে মাছ ধরাও শিখতে পারবে। এসেছি যখন অনেক কিছু শিখে যাবো। ইনশাআল্লাহ! খালার সাথে চলতে চলতে বললো হুমায়রা।
কথার খৈ ফুটিয়ে চলছে ও। অধিকাংশ প্রশ্ন। খালা যথাসম্ভব জবাব দিচ্ছেন। উত্তর দিকে যাচ্ছে ওরা। বটগাছের কাছে। বিশাল বড় ওটা। প্রাচীন আমলের। অনেকের ধারণা সেখানে ভূত-প্রেত থাকে। কেউ কেউ ভূতের পা দেখেছে। তালগাছের মত লম্বা। কেউ ভূতের মাথা দেখেছে। আকাশের মতো বড়। চোখ নেই। দুই কোটর থেকে আগুন বেরোয়। কেউ কথা শুনেছে। বজ্রের মতো আওয়াজ। এ রকম আরো কত কী গল্প আছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সবই মুরব্বিদের মুখে শোনা যায়। খালার মুখে এমনিই একটা ভয়ঙ্কর গল্প শুনতে শুনতে হাঁটছে ও। ভূত বিশ্বাস না করলেও খালার বলার ভঙ্গিমাতে একট একটু ভয় লাগছিলো। ভয় আরো বাড়িয়ে দিলো একটা বিড়াল এসে। কোত্থেকে যে এলো! পায়ের কাছে একটানা মিউ মিউ করছে। কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো হুমায়রা। বিড়ালটা যদি খামচি দেয়। কতক্ষণ লেজ নাড়িয়ে বিড়ালটা চলে গেলো অন্য দিকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সামনে চললো ওরা। বটগাছের নিচে অনেক ঝরাপাতা। ঘাসের গায়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ঢাকায় শুধু কাকের দেখা পাওয়া যায়। কা-কা শব্দের মিছিল করে যেন। আর এখানে, শালিক, দোয়েল, ময়না, বুলবুলি, ঘুঘু, টিয়ে সবই আছে। ভীষণ ভালো লাগছে টিয়ার টিয়াক টিয়াক ডাক। নাম না জানা ছোট পাখির কিচির-মিচির ডাকে পরিবেশ মুখরিত। সব কিছু দেখছে আর মুঠো মুঠো সুখ জমা করছে মনের ঘরে। এতক্ষণে হুমায়রার বুঝে এলো কেন এই স্থান ভয়ঙ্কর হওয়ার পরও মানুষ আসে। দীর্ঘক্ষণ দূর্বাঘাসে বসে থেকে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো ওরা। রাস্তার ধারে সবুজ ধানক্ষেত। মুদু হাওয়ায় নেচে উঠছে। বাঁশ বাগানে দু’ চারটা বকেরও দেখা মিলছে। অন্য রকম অনুভূতি নিয়ে বাড়িতে পৌঁছলো ওরা। বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে ক্লান্ত হয়ে পড়লো হুমায়রা। হঠাৎ ইচ্ছে হলো ডাব খাওয়ার। শুভ মামাকে বলতেই ক’টা পেড়ে কেটে দিলেন। আহ কী সুন্দর ফ্রেশ পানি। প্রাণ জুড়িয়ে গেলো নিমিষেই।
বিকেলে হুমায়রা খালার সাথে নদীর পাড়ে যাচ্ছিলো। মা এবং শাহানা সঙ্গী হলেন। হাঁটতে হাঁটতে মুবাশ্বিরা বেগম ছোটকালের কথা বলছেন। কিভাবে কোথায় খেলেছে? কোথায় কোথায় বসে গল্প শুনেছে। কোন স্কুলে পড়েছে? এইগুলো মন দিয়ে শুনছিলো হুমায়রা। মাঝে মাঝে মায়ের চোখের দিকে তাকাচ্ছিলো। সেখানে দস্যি কিশোরীর ভাব দেখতে পাচ্ছিলো। নদীর পাড়ে পৌঁছে একটা নৌকা ভাড়া নিলেন মা। গ্রামের মাঝি। তেমন কিছু বলতে হলো না। তাদের নিয়ে বাইতে শুরু করলো। কিছু দূর এগোতেই কচুরিপানার স্তূপ এলো। বৃদ্ধ মাঝি পাশ কাটাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই সাদা কচুরি ফুল ছিঁড়তে হাত বাড়াচ্ছিলো হুমায়রা। মা নিষেধ করলেন।
তাই আর ছিঁড়া হলো না। আরো একটু সামনে যেতেই শাপলা ফুল দেখা গেলো। সাদা শাপলা। হুমায়রা এবার মায়ের দিকে তাকালেন। মায়ের নীরব সম্মতি দেখে কয়েকটা তুললো। শাহানাও তুললো। খালা জলে হাত ছোঁয়ালো। দেখে সেও ছোঁয়ালো। খালার হাতে একটা জোঁক ধরেছে। এতে তিনি একটুও বিচলিত হলেন না। হাত থেকে নামিয়ে কাঠের ওপর রাখলেন। তারপর হিলের আঘাতে মেরে ফেললেন। তাজা রক্ত ছিটকে পড়লো চার পাশে। খালার সাহস দেখে হুমায়রা অবাক। কৌতূহলে বললো, খালা তোমার ভয় করেনি? না। ভয় করবে কেন? কত জোঁক মেরেছি তার কোন হিসাব আছে! এবার মাও খালার পক্ষে বললেন, আমরাও তো কম মারিনি। আসলে গ্রামের মেয়েরা অনেক সাহসী। এমনি নানা গল্পগুজবে তারা ঘাটে ভিড়লো। ভাড়া মিটিয়ে তারা বাড়ি পৌঁছলো।
হুমায়রারা মালা গাঁথতে বসলো। আর তার মা ঢেঁকিতে পিঠার চাল ভাঙতে যোগ দিলেন অন্যদের সাথে। রাতে তেল পিঠা, গোশতের পিঠাসহ আরো অনেক পিঠা বানানো হলো। পেট পুরে পিঠা খেলো হুমায়রা। তার পর ভাত না খেয়েই দিলো এক ঘুম। নানা বাড়িতে আনন্দের সাথে কেটে গেলো চার দিন। কিভাবে চার দিন গেলো বুঝতেই পারলো না। আসলে আনন্দের সময়গুলো দ্রুত চলে যায়। ৫ম দিনে তার বাবা ঢাকা থেকে এলেন। একদিন থেকে পরদিন রওয়ানা হলেন ঢাকা পানে। অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায়কালে মুঠো মুঠো সুখ নিয়ে হুমায়রারা গ্রাম ছাড়লেও গ্রামেই পড়ে থাকলো তাদের মনপ্রাণ।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ