এক ঈগলের গল্প   -আলতাফ হোসাইন রানা

এক ঈগলের গল্প -আলতাফ হোসাইন রানা

গল্প জুন ২০১৮

আলভীদের পুরনো বাড়ির পিঠ ঘেঁষে চতুর্পাশে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরনো বুড়ো বটগাছটি। কোন ডাল পুবে, কোনোটা পশ্চিমে, উত্তরে-দক্ষিণে মেলে দিয়েছে। কোথাও কোথাও আবার ঝুলে পড়েছে সাপের মতো লতা। নিচ থেকে উপরে তাকালে পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে কিছুটা আকাশ চোখে পড়ে।
এমন সুন্দর বুড়ো বাটগাছটা চোখে পড়তেই এক ঈগল গাছটাকে ভালোবেসে ফেললো। ধীরে ধীরে মনের মতো করে ঈগল বাসা বাঁধলো এক ডালে। ঈগলের বন্ধু-বান্ধব বলতে তেমন ঘনিষ্ঠ কেউ ছিল না। বেশির ভাগ সময়ই পাখা দুটো দু’দিকে দিয়ে ছড়িয়ে ঈগল আকাশে চরে বেড়ায়। ক্ষিধে পেলে নিচে খাল-বিল থেকে মাছ ধরে খায়। নতুন পরিবেশে ঈগল বেশ হৃষ্ট পুষ্ট হয়ে উঠলো।
কিছুদিন পর।
পর পর দু’দিনে ঈগল দুটো ডিম পাড়লো।
গাঁয়ের মাঝখান দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে জরাজীর্ণ পায়ে চলা পথ। মেঠোপথ ফেলে বড় রাস্তার তেমাথায় এলেই বুড়ো বটগাছ। ছাতার মতো এর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে অকৃত্রিমভাবে ছায়া দান করাতে অনেকে এটাকে ছাতিম তলা বলেও চেনে। গাঁয়ের ছেলারা খেলা-ধুলার জন্য ছাতিম তলাকে লোভনীয় মনে করে। ছাতিম তলার দক্ষিণাংশের পুরো গ্রামটি চাঁদশী। পূর্বে বাদামতলা।
দূরে। একটু দূরেই ছোট নদী টরকী ফুর্তিতে গড়িয়ে গড়িয়ে ছুটে চলছে গৈলার দিকে। কী শীতে কী গ্রীষ্মে নদীটি সকলকে জুগিয়ে চলে বরফের কুচির মতো টলটলে ঠাণ্ডা পানীয় জল।
বিকেলে হিমেল হাওয়ায় নদীর জল ভেঙে বিরাট ঢেউ তুলে গৈলার দিকে ছুটে আসতো ছোট ছোট লঞ্চ, টলার। টলার হিস হিস ভেঁপু বাজার শব্দে ছাতিম তলার খেলা ফেলে ছুটে আসতো আলম, রাজু, রানা, টনি অনেকেই। নদীর দু’কূলে কাশবনের ওপর বিকেলের মিষ্টি হাওয়া তখন আছড়ে পড়তো। বালিহাঁসের পাল কিচির মিচির রব তুলে ছুটে যেতো নীড় পানে। জলের ঢেউয়ের টানে আনন্দে সকলেই ঢেউ ধরতে ছুটে যেতো নদীর তীর ঘেঁষা চরে।
সোমবার লঞ্চের ভেঁপু বাজার শব্দ শোনা যায় না। গৌরনদী বন্দরে হাটবার হলে সেদিন আর টরকী ঘাটে স্টিমার ভেড়ে না। আজ ছাতিম তলার বুড়ো গাছাটির নিচেই খেলা জুড়ে দিয়েছে গাঁয়ের ছেলেরা। ঝুলে পড়া সাপের মতো লতা দিয়ে দোল খেতে গিয়ে আলমের চোখ পড়ে ঈগলের বাসার দিতে। আলমের দুষ্ট মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। সবাইকে নিয়ে জড়ো হয় গাছটির নিচে। কিভাবে বাসাটি ভাঙা যায় বলাবলি করে। এমন সময় বন্ধুদের মাঝে গেছোপণ্ডিত বলে পরিচিত লিকলিকে শরীর নিয়ে আলম গাছ বেয়ে মগডালে ঠিক বাসাটির কাছে উঠে গেলো। ঈগল তখনো বাসায় ফেরেনি। বাসাটি ভেঙে ফেলে ডিম দুটো নিচে নামিয়ে নিয়ে এলো। ডিম নিয়ে নানা গবেষণা চললো চারজনের মধ্যে। শেষে খেলতে গিয়ে ডিম দুটো ভেঙে ফেলল। তখন সূর্যের লাল আভাটা আস্তে আস্তে নদীর পশ্চিমের শেষ প্রান্তে ডুবতে থাকে। চারদিকে অন্ধকার নেমে এলে ছেলেরা ছাতিম তলার বুড়ো বটগাছটির সাথে আড়ি করে পথ ধরে বাড়ির দিকে।
সন্ধ্যায় ঈগল আপন নীড়ে ফিরে এলো। বাসার ধারেই বসে দেখলো কয়েকটি খড় কুটো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গাছের ডাল-পালার ওপর। ঈগলটি এ-ডালে ও-ডালে ছুটোছুটি করে। ডানা ঝাপটিয়ে ক’বার গাছের ওপর থেকে নিচে চক্কর দেয়। কিন্তু বাসাটি আর খুঁজে পায় না। চোখে পড়ে না তার ডিম দুটো। একটি পাখি মারার গুলতি ঝুলে রয়েছে ঠিক বাসাটির কাছে। ঈগল ডানা ঝাপটা দিয়ে করুণ কণ্ঠে ডেকে উঠলো। তার ডাকগুলো মনে হলো অভিশাপের বাণীর মতো। সাঁঝের বেলা একটা প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ, বাঁধন ছেঁড়া গর্জনে ছেয়ে গেলো গোটা গ্রাম। তার প্রতিধ্বনি উঠলো গাঁয়ের সমস্ত প্রান্ত জুড়ে। সে গর্জনে উচ্ছ্বসিত ভক্তি ভালোবাসার সঙ্গে মেশানো ছিল যেমন অনুযোগ তেমনি ক্রোধ আর দৈহিক যন্ত্রণার অনুভূতি। আজকের মতো অসহায়তা, অবহেলা ও নিঃসঙ্গতায় পরিপূর্ণ এমন যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি জীবনে আর কখনো তার হয়নি। মনে হলো পুরো গ্রামটা যেনো নির্মম শত্রুতে গিজ গিজ করছে।
এ গাঁয়ে আর থাকবে না ঈগল। উড়ে চলে যায় নদী থেকে কিছুটা দূরে। বড় রাস্তার পাশে বিশাল রেনট্রি গাছে আবার বাসা বাঁধে ঈগল। ভালোই কাটছিল তার দিনগুলো। এখন দুটো বাচ্চা তার। খাবারের সন্ধানে ঈগল বেরিয়ে পড়ে। রাস্তার পাশে রেনট্রি গাছের পাশে জমিতে কাজ করছিলো কিছু লোক। ঈগল নখে করে বড় এক মাছ ধরে নিয়ে এলো। ঈগলের নখে বড় মাছ দেখে জমিতে কাজ করা ক’জন লোক, গাছটির চারদিক থেকে ঢিল ছুড়তে থাকে। ঈগল প্রাণপণে নখ দিয়ে মাছ আঁকড়ে ধরে থাকলো। অবশেষে ঈগল হয়রান হয়ে পড়লো। ভয়ঙ্কর আতঙ্ক ভেদ করে একটা ঠাণ্ডা মৃদু মন কেমন করা ভাব সমস্ত রকম বিপদের প্রতি এক নিদারুণ উদাসীন্য তাকে পেয়ে বসলো।
পর পর ঢিল ছোড়া দেখে ঈগল ভয়ে মাছ ফেলে দিলে লোকেরা মাছ নিয়ে চলে যায়। ঈগলটি গাছের মগডালে বসে রইলো। তার ক্লান্ত শরীর গাছের গুঁড়িতে ঠেকিয়ে চোখ কচলালো।
ঈগল ছানার বাসা থেকে মাথা তুলে চিঁ চিঁ করে ডাকতে লাগলো খাবারের জন্য। ঈগল ডানা দিয়ে তাদের ঢেকে রাখলো। আদর করে বললো-
একটু ধৈর্য ধরো। পরে খাবার দেবো।
কিন্তু বাচ্চাগুলো তখনো একে অন্যের সাথে মিশে মৃদুস্বরে কিউ কিউ করছে- খাবার দাও, খাবার দাও। প্রখর রোদে উড়ে উড়ে ঈগল ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ফের খাবার আনতে যাওয়ার মতো শক্তি তার ছিল না। এদিকে ক্ষিধেয় ছানাদের ডানাগুলো নেতিয়ে পড়েছে। ঠোঁট দুটো হাঁ করা। চোখগুলো খোলা। আরো করুণ হয়ে উঠলো ছানাদের কিচির মিচির কিউ মিউ শব্দ। ঈগল মনের কষ্টে তীক্ষè একটা চিৎকার দিয়ে উড়ে গেলো আবার নদীতে মাছের সন্ধানে।
তখন সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশের এক কোণায় চাঁদ হাসছে। ঈগল অনেক কষ্টে লোকচক্ষুর দৃষ্টি এড়িয়ে ঠোঁটে মাছ গেঁথে ঘরে ফিরলো। আজ সারাটা দিন ঈগলকে বেশ ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। বিলের মাছগুলোর বেশ বুদ্ধি বেড়েছে। পিঠ ভাসিয়ে নির্বিঘেœ আগের মতো চলা ফেরা করা ছেড়ে দিয়েছে। ভেসে উঠেই চারদিকে চোখ মেলে তাকায়। তারপর ভাসবে নাকি ডুবে থাকবে সিদ্ধান্ত নেয়। তাই আজ মাছ পেতে ঈগলকে বকের মতো অপেক্ষা করতে হয়েছে।
মাছসহ মা ঈগলকে দেখেই বাচ্চা দুটো ঠোঁট দুটো ওপরে তুলে আনন্দ প্রকাশ করে। ঈগলের মনে তখনো শঙ্কা। এই বুঝি তার মাছ, বাচ্চা দুুটোই যায়। ঈগল মাছ রেখে বাচ্চা দুটোকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। বাচ্চাগুলো চিঁ চিঁ করে মায়ের কাছে খাবার চায়।
ঈগল মাছ ছিঁড়ে ছিঁড়ে বাচ্চাদের মুখে তুলে দেয়। অল্পতেই বাচ্চাদের পেট ভয়ে যায়। বেঁচে যাওয়া অংশটুকু মা ঈগল খায়। বাচ্চা দুটো আবার চিঁ চিঁ করে। এবার ওদের মায়ের সান্নিধ্য প্রয়োজন। তখন ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করছে। মা ঈগল টের পেয়ে বাচ্চা দুটোকে জড়িয়ে ধরে ওম্ দেয়। অন্ধকার গাঢ় হতে হতে বাচ্চাগুলো এবং মা ঈগল পরম উষ্ণতায় জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে পড়ে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ