এক অনন্য উচ্চতার নাম  সাকিব আল হাসান

এক অনন্য উচ্চতার নাম সাকিব আল হাসান

খেলার চমক মে ২০১২

মিজানুর রহমান মিজান..

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিব আল হাসানের অভিষেক হয় এখন থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর আগে। তখন ব্যতিক্রমধর্মী কিছুই মনে হয়নি।  কিন্তু মাঠের ভেতরে তার শান্ত সৌম্য চেহারা আর যেকোন অবস্থাতেই মুখে হাসি ধরে রাখাটা কেমন যেন ব্যতিক্রমধর্মী মনে হয়েছিল। সাকিব আল হাসান কী জিনিস- তা বাংলাদেশ ক্রিকেট টের পেল কিছুদিন পরই। সবারই যেখানে ধারাবাহিকতার চরম অভাব, সেখানে তার ধারাবাহিকতা ছিল চোখে পড়ার মতো। অভিষেকের আড়াই বছর পরই আইসিসি র‌্যাংকিং-এ এক নম্বর অলরাউন্ডার হওয়ার মাধ্যমে সাকিব আল হাসান তার জাত চিনিয়ে দিলেন পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে। বাঁকা হাসি দিয়েছিলেন তখন অনেকেই। কিন্তু মাঝখানে কিছু দিন বাদ দিয়ে যখন ওয়ানডেতে এক নম্বরের এ অবস্থানটা তিনি নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছেন তখন বোঝা গেল আসলেই সাকিব স্পেশাল একজন।
অস্ট্রেলিয়ার সহ-অধিনায়ক শেন ওয়াটসনের সাথে তার ওডিআইতে নাম্বার ওয়ান জায়গাটি নিয়ে ইঁদুর দৌড় খেলা চলছিল বেশ কিছুদিন  ধরেই।  ওয়াটসন মাঝখানে কিছুদিন জায়গাটি নিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু সাকিব আল হাসান এশিয়া কাপে অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স দেখিয়ে আবারো মুঠোবন্দি করেছেন ওয়ানডের এক নম্বর সেরা অলরাউন্ডারের জায়গাটি। আইসিসি থেকেও মোটামুটি একটা স্বীকৃতি পেয়েছেন গত দু’বছর  আগে, বিশ্বসেরা টেস্ট দলে যখন  তার নাম অন্তর্ভুক্ত হলো।  সেই বছর উইজডেনও তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে টেস্ট ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার করে। ছোট দেশের বড় তারকা খেলোয়াড় এতসব অর্জনের ভিড়ে তো হারিয়ে যাওয়ার কথা এ বয়সেই।  কিন্তু সাকিবতো  অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি সাফল্যের পেছনে যেন ছোটেননি, বরং সাফল্যই  তার পেছনে ছুটেছে। তাইতো ওখানেই থেমে থাকেননি।
টেস্টে বাংলাদেশ যখন নিজেদের অবস্থান জানান দিতেই রীতিমত সংগ্রাম করছে তখন বাংলাদেশের প্রথম  খেলোয়াড় হিসেবে টেস্টে সেরা অলরাউন্ডারের  পদটি ছিনিয়ে নিলেন সাকিব আল হাসান। কেউ কখনো কি  ভেবেছিল কোনো বাংলাদেশী খেলোয়াড় ওয়ানডে ও টেস্টের সর্বোচ্চ দুটি স্থানই একসাথে দখল করে রাখতে পারবেন? নিজেকে আরো উচ্চতায় তুলে নেওয়াই যেন তার নেশা। আর সাফল্য যেন তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে।
২৫তম  জন্মবার্ষিকী আশীর্বাদ হয়ে এসছে সাকিবের জন্য, জন্মদিন পেরিয়ে যাওয়ার  দু’দিনের  মাথায়ই পুনরুদ্ধার করলেন ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ের সেরা অলরাউন্ডারের স্বীকৃতি। স্বীকৃতিটি তিনি পেয়েছেন বিশ্বক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থার  কাছ থেকেই। এশিয়াকাপ এবং  ওয়েস্টইন্ডিজে সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার ভেতর ৫ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ শেষে নতুন করে গত ২৭ মার্চ র‌্যাঙ্কিং পুনঃনির্ধারণ করে আইসিসি। আর সেখানে আবারও অসি অলরাউন্ডার শেন ওয়াটসনকে টপকে শীর্ষে উঠেছেন সাকিব আল হাসান। সাকিব এগিয়ে গেছেন বেশ খানিকটা। তার রেটিং পয়েন্ট ৪৪৭ হলেও ওয়াটসনের ৪৩৩। ব্যাটিং-এ তিনি এসেছেন ১২ নম্বরে। ব্যাটিং-এ ওডিআইতে  এখনো কোনো বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান সেরা দশে ঢুকতে পারেননি। সেটিও  হাতছানি দিচ্ছে সাকিবকে। এশিয়াকাপ শুরুর  সময়ই দুঃসংবাদটি পেয়েছিলেন সাকিব। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অনুষ্ঠিত হওয়া কমনওয়েলথ ব্যাংক সিরিজে ভাল করার সুবাদে তাকে টপকে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বসেরা  অলরাউন্ডার হয়েছিলেন ওয়াটসন। ওই সময় ওয়াটসনের রেটিং ছিল ৪২৩ আর সাকিবের রেটিং ছিল ৪২০। কিন্তু দু’সপ্তাহ পেরোতেই পারলো না, তার আগেই  নিজের হারানো আসন পুনরুদ্ধার করলেন সাকিব। এগিয়ে গেলেন বেশ খানিকটা। এশিয়া কাপে ৪ ম্যাচ খেলে ৩টি অর্ধশতক হাঁকিয়ে  সাকিব করেছেন ৫৯.২৫ গড়ে ২৩৭ রান। আর বল হাতে নিয়েছেন ৩৩.১৬ গড়ে ৬ উইকেট। এ কারণেই ওয়ানডে ক্যারিয়ারে পঞ্চমবারের মতো সিরিজ সেরার পুরস্কার হাতে তোলেন তিনি। সে কারণেই সাকিবের রেটিং পয়েন্ট বেড়েছে ২৭।
২০০৯ সালের ২৩ জানুয়ারি  প্রথমবারের মতো আইসিসি র‌্যাংকিংয়ের ওয়ানডে অলরাউন্ডারের শীর্ষস্থান দখল করেন সাকিব। দু’বছর  পর ২০১১ সালের এপ্রিলে অস্ট্রেলিয়ার এই ওয়াটসনের কাছে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব হারান তিনি। ৬ মাস পরই শীর্ষস্থান পুনর্দখল করেন সাকিব।  ছয় মাস পরই গত ৯ মার্চ সেখানে হস্তক্ষেপ করেছিলেন ওয়াটসন। কিন্তু এবার সাকিবের ধোপে টিকতে পারলেন না ওয়াটসন ১৪ দিনের বেশি। মোহাম্মদ হাফিজ ৩৯২ রেটিং নিয়ে আছেন তিন নাম্বারে। টেস্ট ক্রিকেটের সেরা এখনও আছেন সাকিবই।
ওয়ানডেতে বাংলাদেশ যেমন নিয়মিত বিরতিতে সাফল্য পেয়ে আসছে, টেস্টে ব্যাপারটা ঠিক সে রকম না। টেস্টে অভিষেকের ১১ বছর পরও বাংলাদেশকে ধুঁকতে হচ্ছে প্রতিটি পদক্ষেপে। এ অবস্থায় টেস্টে কোনো বাংলাদেশীর সর্বোচ্চ শিখরে চলে যাবেন তা ভাবাটাই ছিল বোধকরি অন্যায়। গত বছর তামিম ইকবাল ইংল্যান্ডের মাটিতে  ইংল্যান্ডের তুখোড় বোলিং আক্রমণকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলে একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন টেস্টেও বাংলাদেশের কেউ পারে। সাকিব অবশ্য অলরাউন্ডার হিসেবে ওয়ানডের মত টেস্টেও তার প্রতিভার ছাপ রেখে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার সে প্রচেষ্টাগুলো জয়ে পরিণত না হওয়ায় মানুষ খুব একটা মনে রাখেনি। তারপরও একা হাতে যতটুকু করা সম্ভব তিনি করে যাচ্ছিলেন। তারই স্বীকৃতি হিসেবে টেস্টে প্রথম পাঁচ অলরাউন্ডারের মধ্যে তিনি ছিলেন বেশ কিছুদিন ধরেই।
ওয়ানডেতে যেমন সাকিব  টেস্টে সেরা অলরাউন্ডারের তকমাটা ছিল জ্যাক ক্যালিসের সম্পত্তি। সবাই নিশ্চয়ই  একবাক্যে মেনে নেবেন ক্যালিস সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের মধ্যে একজন। সেই কালিসকে হটানোটা যা-তা ব্যাপার নয়। কিন্তু তার ওপর টেস্টে সাকিবের ব্যাটিংটা  ঠিক সেভাবে ফুটে উঠছিল না। তবে উইকেট নেয়া থেকে শুরু করে ৭০-৮০ এর ঘরে রান করে যাচ্ছিলেন নিয়মিত। সাফল্য কোনো না কোনো সময় ধরা দেয়ই যদি কেউ তার কাজ ঠিকমত করে যায়। তাইতো ক্যালিস যখন শ্রীলংকার সাথে একটা বাজে সিরিজ কাটাচ্ছেন, সাকিব তখন পাকিস্তানের সাথে পুরো বাংলাদেশ দলের ভরাডুবির মাঝখানে স্বীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে ক্যালিসের সম্পত্তিটা ছিনিয়ে নিলেন।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে শুধু ব্যাট হাতেই উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছেন কিছুদিন। তবে বল হাতেও নিজেকে মেলে ধরতে সময় লাগেনি তার। ওয়ানডে কিংবা টেস্ট কোন ফরমেটের ক্রিকেটেই তার চৌকস নৈপুণ্যের ঘাটতি হয়নি। এ কারণেই মাঝখানে ৪ মাসের বিরতি বাদ দিলে ওয়ানডে  ক্রিকেটে বিশ্বের সেরা  অলরাউন্ডার হিসেবে দেড় বছর ধরে সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে রাজত্ব করছেন তিনি।
২৫ টেস্টের ক্যারিয়ারে ইনিংসে ৫ বার ৯ উইকেট পাওয়ার পাশাপাশি দ’ুটি শতরানও আছে তার। তাকে তো সমীহ করবেনই প্রতিপক্ষরা। বাংলাদেশের মানুষ আগেই তাকে সেরা বলে মেনে নিয়েছে। এখন আর বাংলাদেশের মানুষের গর্ব করে বলতে হবে না যে সাকিব সেরা। বিশ্ববাসীকে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (আইসিসি) তাদের নতুন করে ঘোষিত সর্বশেষ প্লেয়ার র‌্যাংকিং-এ সেরা বলে প্রকাশ করেছে সাকিবকে।
এতদিন শুধু ওয়ানডেরই সেরা অলরাউন্ডার হিসাবে নিজের আসন পাকাপোক্তভাবে ধরে রেখেছিলেন  আর এবার টেস্টেরও সেরার আসন দখল করে ক্রিকেটের দুটি ফরমেটেই শীর্ষ স্থানের একক অধিপতি হলেন সাকিবÑ ৪৪৭ রেটিং নিয়ে ওয়ানডের আর ৪০৪ রেটিং নিয়ে টেস্টেও সেরা এখন তিনি।
বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যখন ধারাবাহিক সমস্যায় দুষ্ট তখন সাকিবই আছেন একমাত্র ব্যতিক্রম হিসাবে। বাংলাদেশের অন্যান্য ক্রিকেটার এমনকি দলের পারফরম্যান্স বিবেচনা করলে এক পাল্লায় সবাইকে তুলে অন্য পাল্লায় তুলতে হবে তাকে, এরপরও ঘোর তারতম্য যে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। পাকদের বিপক্ষে হোম সিরিজে ব্যাটে বলে সমানতালে চৌকস ছিলেন সাকিব।
২০০৯ সালের ২৩ জানুয়ারি সেই যে  ওয়ানডে অলরাউরন্ডার র‌্যাংকিং-এ শীর্ষস্থানে উঠেছিলেন তাকে আর কোনোভাবেই নামাতে পারছিলেন না বিশ্বের কোনো ক্রিকেটারই। তবে গত বছরের এপ্রিলে তাকে হটিয়ে দেন অস্ট্রেলিয়ার অলরাউন্ডার শেন ওয়াটসন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজ খেলতে এসে। তবে গত অক্টেবরেই সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজে নিজের অসামান্য নৈপুণ্য দেখিয়ে পূনরুদ্ধার করেন ওয়ানডে সেরার মুকুটটি। এখনও যেহেতু এই আসন অটুট রেখেছেন, তাই টেস্ট নিয়েই বরং বলা যাক।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্ট শুরুর আগে শীর্ষ টেস্ট অলরাউন্ডার হওয়ার ধারে কাছেও ছিলেন না সাকিব। তার অবস্থান ছিলো পাঁচ নম্বরে। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুই টেস্টে দু’টি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৩ ইনিংসে ১৬৮ রান এবং ১০ উইকেট লাভ করে দুই ধাপ এগিয়ে সাত থেকে আসেন পাঁচে। আর পাকদের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে এক ইনিংস বোলিং করে কোনো উইকেট না পেলেও দুই ইনিংসে করেন ৮ ও ৫১ রান। দ্বিতীয় টেস্টে তো আর তার কাছে পাত্তাই পায়নি পাক ক্রিকেটাররা। প্রথম ইনিংসেই ১৪৪ রান ও ৮২ রানে ৬ উইকেট নিয়ে রেকর্ড বুকে নাম লেখালেন। এরপর স্বীকৃতিটি ধরা দিলো তার হাতে। টেস্ট এবং ওয়ানডে বোলারের তালিকায় বাংলাদেশের এই ক্রিকেটারের অবস্থান সপ্তম। উভয় ধরনের ক্রিকেটে ব্যাটসম্যান হিসাবে শীর্ষ ১০ জনের তালিকায় এখনও জায়গা করে নিতে পারেননি তিনি। ২৬ টেস্টে ৯ হাফ সেঞ্চুরি ও দু’টি সেঞ্চুরিসহ ৩৪.৬৮ গড়ে ২৭৯০ রান এবং ৩১.৩৬ গড়ে ৯৬ উইকেট নিয়েছেন ২৪ বছর বয়সী সাবেক এই অধিনায়ক।
তবে ক্রিকেটের ইতিহাসে একই সঙ্গে ওয়ানডে এবং টেস্ট ক্রিকেটের সেরা অলরাউন্ডার হওয়ার অভূতপূর্ব নজির তিনি সৃষ্টি করেছেন। আর শীর্ষস্থান খোয়ানোর পর তা আবার পুনরুদ্ধারের রেকর্ড তো সাকিবের নিজেরই আছে। যেভাবে তিনি এগুচ্ছেন তাতে করে টেস্ট ক্রিকেটের শীর্ষস্থান হারালেও সেটা পুনরুদ্ধার করবেন  সেটাই স্বাভাবিক।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ