এ কোন সভ্যতায় আমাদের ঈদ

এ কোন সভ্যতায় আমাদের ঈদ

স্মৃতিকথা জয়নুল আবেদীন আজাদ এপ্রিল ২০২৪

রং শুধু কাপড় বা প্রকৃতির বিষয় নয়, দিনেরও বিষয়। তাই তো আমরা বলি, নানা রঙের দিনগুলো। একটু ভাবতে বসলে উপলব্ধি করবো, আমাদের অতীতের দিনগুলো একরকম ছিল না, এখনকার দিনগুলোও নানা রঙের। আসলে রঙেরও ভাষা আছে। একেক রং একেক ভাষায় কথা বলে। রঙের সাথে সময়েরও একটা সম্পর্ক আছে। সময়কে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়ে যায় ঋতু। সব ঋতুতে প্রকৃতির রং কি একরকম থাকে? সময়ের কথা বলছিলাম, রমজানের সময়টা কেমন? সাহরি, ইফতার, সিয়াম-সাধনা, কুরআন তেলাওয়াত এ মাসটায় যোগ করে নতুন মাত্রা। রমজান শেষে শাওয়ালের চিকন চাঁদ আমাদের দেয় ঈদের বার্তা। এখন যদি ঈদের বার্তাকে আমরা কোনো রং দিয়ে সাজাতে চাই, তাহলে কোন রং ভালো হবে? লাল হলে কেমন হয়?

উৎসবের রং লাল, রক্তের রংও লাল। ফিলিস্তিনতো আমাদের প্রিয় এই পৃথিবীরই একটি জনপদ। সেখানে রক্তের হোলি খেলছে অসুর ইসরাইল। ফিলিস্তিনের একটি উপত্যকা গাজা। ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় ২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি সেখানে নিহত হয়েছেন ২৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি, যার প্রায় সাড়ে ১০ হাজারই শিশু। গাজার বেশির ভাগ বাড়ি-ঘর ও স্থাপনা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আর ৮৫ শতাংশ বাসিন্দাই হয়েছেন বাস্তুচ্যূত। ফিলিস্তিনিদের জন্য এবার রমজানটা কেমন হবে, ঈদের রূপটাইবা হবে কেমন? তবে চ্যালেঞ্জের উচ্চমাত্রা মুসলমানদের জন্য নতুন কোনো বিষয় নয়। আমাদের নবী (সা) তো রমজান মাসেই বদর যুদ্ধ করেছিলেন এবং বিজয়ী হয়েছিলেন। ন্যায়-অন্যায়ের বিরোধ, জালেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চিরন্তন বিষয়।  এই ইতিহাসটা ফিলিস্তিনিদের জানা আছে। ফলে অসম-যুদ্ধেও বীরত্বের সাথে লড়ে যাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। ওদের বিজয় আমাদের কাম্য। সাথে জানাই ঈদ মোবারক। 

একটু অনুসন্ধানী হয়ে ভাবলে আমরা ঈদ-উৎসবে পেয়ে যাবো আনন্দের সাথে অনেক মানবিক বার্তা। ঈদ আসলেই অনন্য। আর একটি মজার বিষয় না বললেই নয়, সেটা হলো- ঈদ এমন একটা উৎসব, যাতে একই সাথে রয়েছে আনন্দ ও ইবাদতের মহিমা। বিষয়টি আসলেই উপলব্ধি করার মতো। আনন্দ ও সওয়াব একই সাথে, ভাবা যায়!

জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি। শৈশব-কৈশোর, যৌবন শেষে এখন প্রবীণের চোখে জীবনকে দেখছি। এই দেখায় যেমন জ্ঞান-অভিজ্ঞান আছে, তেমনি আছে স্মৃতিময় অনেক সকাল-সন্ধ্যা। এই দেখায় আছে ঈদ-উৎসবও। আজকে শুধু রোজার ঈদের কথাই বলবো। রোজার ঈদতো একটাই, কিন্তু  শৈশব-কৈশোরের ঈদ এবং এই প্রবীণ বয়সের ঈদ কি একরকম? জ্ঞান, উপলব্ধি, আশা-আকাক্সক্ষা এবং দায়িত্বের তারতম্যের কারণে ঈদের রঙে-রূপেও ঘটে গেছে কিছু পার্থক্য। শৈশবের ঈদে চাঁদ দেখার বিষয়টা আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আকাশের নতুন চাঁদ আমাদের ঈদের বার্তা দিতো। তাই সন্ধ্যায় সবার চোখ থাকতো পশ্চিম আকাশের দিকে। কেউ চলে যেত নদীর পাড়ে, কেউ খোলা মাঠে, কেউবা বাড়ির ছাদে। শাওয়ালের চিকন চাঁদটা দেখতে পেলে সে কী আনন্দ! একসাথে অনেকেই বলে উঠতাম ঈদ-মোবারক, ঈদ-মোবারক। তখনতো রেডিওর যুগ। কান পেতে আমরা রেডিওর ঈদ-ঘোষণা শুনতাম, ঈদ জামায়াতের সময় জানতাম, আর মুগ্ধ হয়ে শুনতাম ঈদের গান। তবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গানটাই সবচাইতে প্রিয় ছিল আমাদের কাছে-

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে

এলো খুশির ঈদ।

তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে

শোন আসমানী তাকিদ।

এত বছর পরে এই প্রবীণ বয়সেও নজরুলের ঈদের গানটাই আমাদের কাছে সবচাইতে প্রিয় গান। এই গানটি বাজালেই মনে হয় ঈদ এসেছে। ঈদ-আনন্দের আর একটি বিষয় ছিল নতুন জামা-কাপড়। তবে আমাদের শৈশবে আমরা অল্পেই তুষ্ট থাকতাম। একটা জামা পেলেই বেশ খুশি হতাম। এখানে অবশ্য একটা বিষয় ছিল- ঈদের আগে জামাটা যেন কেউ দেখে না ফেলে। দুষ্টু ছেলেরা জামা দেখার চেষ্টা চালিয়ে যেত। সবাই নতুন জামা লুকিয়ে রাখতো, যেন কেউ দেখে না ফেলে। তবে দেখার কাজে কেউ সফল হলে জামার বর্ণনা দিয়ে চিৎকার করে বলতো, তোমার জামা পুরোনো হয়ে গেছে। বেচারার তখন সে কি কান্না। মা কত করে বোঝান, কেউ দেখলে জামা পুরোনো হয় না, পরলে পুরোনো হয়। কিন্তু যুক্তির কথা কে শোনে। 

শৈশবে আতর মেখে নতুন জামা পরে ঈদের মাঠে নামাজ পড়তে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের কাছে ছিল মহা আনন্দের। ইমাম সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে আরবিতে খুতবা পড়তেন। কিছু না বুঝলেও মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। বিশ^াস করতাম অনেক ভালো কথা বলা হচ্ছে, না বুঝলেও সওয়াবতো পাবো। আর আল্লাহ তো সব দেখছেন। নামাজ ও খুতবা শেষে চলতো কোলাকুলির পালা। কত যে কোলাকুলি, কত যে আনন্দ। কোলাকুলির আতিশয্যে অনেক সময় মাথার টুপি পড়ে যেত মাটিতে। তাতে কী, টুপি পরে আবার কোলাকুলি। এরপর বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঈদের দাওয়াত খাওয়া। সবার মুখে হাসি, কণ্ঠে আমন্ত্রণ। কবি নজরুল কি সুন্দর করে বিষয়টা লিখে গেছেন- 

আজ ভুলে গিয়ে দোস্ত-দুশমন

হাত মিলাও হাতে,

তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ^ নিখিল

ইসলামে মুরীদ।

ঈদ মানুষে-মানুষে ভালোবাসার শিক্ষা দেয়, আনন্দকে ভাগ করে নেওয়ার দীক্ষা দেয়। শৈশবে তত্ত্বকথা আমরা তেমন বুঝতাম না, তবে ঈদের পরিবেশ আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। ধনী-গরিব সবাইকে আপন করে নিতে হয়, মনোমালিন্য ভুলে যেতে হয়, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের খোঁজ নিতে হয়, অভাবীর অভাব দূর করতে হয়, দান-সাদকা করতে হয়, মিলে-মিশে থাকতে হয, ¯্রষ্টার আদেশ মানতে হয়। ঈদের পরিবেশ থেকে এই বিষয়গুলো আমরা জানতে পেরেছি শৈশবেই। পরিবেশ যে কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, একটি উদাহরণ থেকে তা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যাবে। রোজার কারণেইতো ঈদ। পুরো মাস সিয়াম সাধনার উপহার ঈদ। এই তত্ত্বকথা তো ছোট্ট শিশুর বোঝার কথা নয়। কিন্তু সে দেখছে, রমজান মাসটা আসার পর বাসার সবকিছু কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। সারাদিন কেউ কিছু খাচ্ছে না, আবার যখন খাওয়ার কথা নয়, সেই শেষ রাতে টুংটাং আওয়াজ তুলে সবাই খাচ্ছে। সবাই কথা বলছে ফিসফিস করে, যেন ছোটোরা উঠে না যায়। অন্য সময়ের চাইতে এ মাসে সবাই কুরআন বেশি পড়ছে, তারাবি পড়ছে, ইবাদত বেশি করছে। কিন্তু কেন? অবাক চোখে শিশুরা দেখছে আর ভাবছে। ভাবতে গিয়ে তারা বুঝলো, বড়োদের এই বিষয়গুলো থেকে তাদের দূরে রাখা হচ্ছে। মনে প্রশ্ন জাগলো, তাহলে আমরা কি ওদের আপন নই? এমন দুঃখবোধ থেকে শিশুমনে দেখা দিলো ক্ষোভ। বললো, আমিও রোজা রাখবো, শেষ রাতে ডেকে দিও। ইতোমধ্যে ওরা জেনে গেছে, রোজা রাখতে হলে শেষরাতে উঠে সাহরি খেতে হবে। মা কত করে বোঝান, শিশুদের জন্য রোজা নয়, বড়ো হয়ে রেখো। শিশুর জবাব, আমি বড়ো হয়ে গেছি। কান্নাকাটির তোড়ে মা কৌশল অবলম্বন করেন। বলেন, তোমরা রোজা রাখতে পারো, তবে সেটা হবে কলসি রোজা। ছোট্ট শিশু সাহরিতে আর কতটা খেতে পারে? সকাল দশটা বাজতেই শিশুর ঠোঁট শুকিয়ে গেল। তৃষ্ণা পেলেও শিশু কিছু মুখে নেবে না, সে যে রোজা রেখেছে। মা তখন বললেন, শিশুদের রোজা হলো কলসি রোজা। ক্ষুধা পেলে, তৃষ্ণা পেলে রোজাটা মুখ থেকে মুঠোতে পুরে কলসিতে রাখতে হবে, খেয়েদেয়ে আবার কলসি থেকে রোজাটা মুখে পুরে নিতে হবে। আমরা জানি যে, শিশুর ওপর রোজা ফরজ নয়, রোজার তাৎপর্যও তার বোঝার কথা নয়। তবুও শিশু রোজা রাখতে চায়। এটা পরিবেশের প্রভাব। মন থেকে রোজাকে সে গ্রহণ করে ফেলেছে। তাই কলসি রোজা রাখতে পেরেও সে খুশি। কোনো কোনো পরিবারে শিশুদের রোজা রাখার এই যে চিত্র, তা আমাদের কী বার্তা দেয়? বার্তাটি হলো, শিশুদের সঠিকভাবে গড়তে হলে ওদের জন্য সঠিক পরিবেশ আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। এ কাজটি বড়োদের, অভিভাবকদের।

শিশুদের রোজা ও ঈদের একটি চিত্র আমরা পেলাম। আমরা যারা প্রবীণ, তাদের রোজা এবং ঈদের চিত্রটা কেমন? প্রবীণদের অনেকে ছোটোবেলা থেকেই রোজা থাকতে অভ্যস্ত। ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে তারা রোজা পালন করে থাকেন। আবার প্রবীণদের অনেকে পবিত্র কুরআনের মর্মবাণীর আলোকে রোজাকে পালন করতে চান। রাসূল (সা) এবং সাহাবিদের আচরণের আলোকে রোজার শিক্ষাকে সমাজে ছড়িয়ে দিতে চান। তারা উপলব্ধি করেছেন, ‘তাকওয়া’ তথা জীবনের সব কাজে ¯্রষ্টার কাছে জবাবদিহিতার চেতনাই রোজার আসল লক্ষ্য। ফলে তাদের ঈদ উদযাপনেও লক্ষ করা যায় তাকওয়ার চেতনা। ভোগের চাইতে ত্যাগের চেতনাই তাদের মধ্যে প্রবল। সংযম, ধৈর্য, ক্ষমা ও কোমলতা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারাও ভালো থাকতে চান, তবে আখেরাতের বিনিময়ে নয়। সুখ তাদেরও প্রিয় বিষয়, তবে অন্যকে কষ্ট দিয়ে নয়। প্রবীণদের এমন ভাবনাকে আমি সম্মান করি। ফলে এখন ঈদে আমার নতুন পোশাক না হলেও চলে। ভালো খাবারগুলো অন্যকে খাওয়াতে পারলে বেশ ভালো লাগে। তবে এখনও ঈদে শিশুদের নতুন পোশাক দিয়ে আনন্দ পাই। ওদের বায়না মেটাতে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে চাই। ঈদে এবং ঈদের পরেও সমাজের সব মানুষকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই। এমনটি হলেই খুঁজে পাবো ঈদের প্রকৃত আনন্দ। 

পুনশ্চ : যখন লেখার টেবিলে বসি তখন ভাবনার জগতে অনেক বিষয় এসে ভিড় করে। তবে লেখককে বাস্তবতার আলোকে সীমাবদ্ধতাকে উপলব্ধি করে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে লেখাটা শেষ করতে হয়। ঈদের লেখাটা লিখতে গিয়ে এবার বারবার মনে পড়ছিল মজলুম ফিলিস্তিনিদের কথা। সভ্যতা আছে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আছে, জাতিসংঘ আছে; তবে কোথাও যেন রূহ নেই। অবয়বের মানুষ তো অনেকেই আছে। সবাইকে এখন কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়। পৃথিবী নামক এই গ্রহটিতে এখন অনেক দেশ, অজ¯্র সভা-সমাবেশ, কত প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার-কর্মতৎপর এমন একটি গ্রহে ইসরাইল নামক ছোট্ট একটি দেশ কী করে ঘোষণা দিয়ে বোমা হামলায় গাজা নামক একটি জনপদকে এভাবে ধ্বংস করে দেয়, চালায় গণহত্যা? তাহলে কি আলো-ঝলমলে এক জাহেলিয়াতে এখন আমাদের বসবাস?

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ