উলুঘ খানুল-আজম  খান জাহান আলীর অমর কীর্তিগাথা    -আব্দুল্লাহ আল ইসলাম

উলুঘ খানুল-আজম খান জাহান আলীর অমর কীর্তিগাথা -আব্দুল্লাহ আল ইসলাম

ফিচার জুলাই ২০১৭

বাংলাদেশে তাওহিদের বাণী প্রচারে যাঁদের নাম চির অমর হয়ে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাঁদের মধ্যে খানজাহান রহ:-এর নাম অনন্য উচ্চতায় অবস্থান করছে। তিনি এ উপমহাদেশের মুকুটহীন রাজা, সুন্দরবনের চিরসম্রাট।

নাম পরিচয়
তাঁর নাম মূলত খান জাহান, খান মানে অভিজাত বা উচ্চতম, এটি বংশীয় উপাধি। তৎকালে তুরস্কের লোকেরা খান উপাধি ব্যবহার করতেন। জাহান মানে হলো জগৎ। উলুঘ তুর্কি শব্দ এর অর্থ নেতা, এটি আঞ্চলিক শাসকদের জন্য ব্যবহৃত হতো। খানুল আজম, খান তুর্কি ও আজম মূল আরবি থেকে ফার্সি শব্দ দিয়ে মহান সেনানায়ক বোঝানো হয়ে থাকে। তুর্ক-আফগান যুগে প্রধান সেনাপতির পদ নির্দেশের জন্য এই খানুল আজম ব্যবহার করা হতো। তাহলে বোঝা গেল তাঁর মূল নাম খান জাহানের সাথে উলুঘ খানুল আজম জুড়ে গেছে মূলত তাঁর হেড কমান্ডার বা প্রধান সেনানায়ক এবং একই সাথে আঞ্চলিক শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনের কারণে। আর নামের শেষে বর্তমানের ‘আলী’ শব্দটি পূর্বে ছিল না এটি স্থানীয়দের ‘আলী’ বলে ডাকার কারণে পরবর্তীতে যুক্ত হয়ে গেছে।

জন্ম সাল ও স্থান
খান জাহান কবে জন্মগ্রহণ করেন তা নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না, তবে মাজার গাত্রে তাঁর ইন্তিকালের সাল ৮৬৩ হিজরির ২৬ শে জিলহজ, ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে অক্টোবর। তাঁর সার্বিক জীবনের ঐতিহাসিক এবং যুগ পরম্পরায় বাস্তব সাক্ষীদের সাক্ষ্য মতে তাঁর আয়ুষ্কাল আনুমানিক ১০০ বছল ধরে হিসাব করলে তাঁর জন্ম সাল হবে ৭৬৩ হিজরি ও ১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর মাজারে লিখিত শিলালিপি থেকে জানা যায় যে তিনি তুরস্কের খাওয়ারিজিমে জন্মগ্রহণ করেন। যার বর্তমান নাম খিবা। এই খিবায় তাঁর মতো আরো অনেক মনীষী জন্মগ্রহণ করেন।
বঙ্গে গমন ও কর্ম
তিনি আসলে কত সালে বঙ্গে গমন করেন তা জানা যায় না। তবে তিনি গৌড়ের সুলতান জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ শাহের (১৪১৮-৩২ খ্রিস্টাব্দে) দক্ষিণ বঙ্গে গমন করেন। এ সময় দক্ষিণ বঙ্গে আগমনের একমাত্র পথ ছিল নৌপথ। তিনি প্রধান সেনাপতি ও ১১ জন আওলিয়াসহ দক্ষিণ বঙ্গে আগমনের অন্যতম মাধ্যম ভৈরব নদীর মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম বারোবাজারে অবস্থান করেন। এটির নাম সে অনুসারেই বারোবাজার হয়েছে। পাক-ভারতের মধ্যে বারোবাজার একটি প্রধান বাণিজ্য বন্দর হিসাবে পরিচিত ছিল। কে বা কারা এই বন্দর নগরীর সূত্রপাত ঘটান তা জানা না গেলেও জানা যায় এটি খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীর গঙ্গারিডি বা গঙ্গা রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল। খান জাহান রহ. এসে এখানকার আরো উন্নতি সাধন করেন। তার কোমল আচরণ ও ইসলামিক আদর্শ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আর মানুষ দলে দলে কলেমার বাণী পড়ে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। মুসলিমদের সালাত আদায়ের জন্য এখানে একগম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণ করেন। এটিই বারোবাজারের ইতিহাসে প্রথম মসজিদ। এই বারোবাজার বর্তমান যশোর শহর থেকে ১৫ কি.মি. উত্তরে যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের ওপরে এবং মরা ভৈরব নদীর বাম তীরে অবস্থিত। এখানে অন্যান্য এলাকার লোকেরা এসে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। তিনি তাদের সাথে পরিপূর্ণ সাদামনে মিশতেন এবং ইসলাম সম্পর্কে আলোচনা করতেন। এভাবে অন্যান্য এলাকার বিপুল লোকজন এখানে এসে বসতি স্থাপন করতেন ও তাঁর হাতে হাত দিয়ে কলেমা পড়ে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলেন। এভাবে বারোবাজার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়। এখানকার নামগুলো দ্বারা অনুধাবন করা যায় যেমন, সাদিকপুর, দৌলতপুর, রহমতপুর, এনায়েতপুর, মুরাদগড় ও হাসিলপুর। আর একারণে তিনি সত্যের বাণী অন্যত্র ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বারোবাজার ত্যাগ করে মুরলির দিকে যাত্রা শুরু করেন। মুরলি অতি প্রাচীন স্থান। এটিও ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত। খান জাহানের নাম রাখেন মুরলি কসবা। কসবা ফার্সি শব্দ, এর অর্থ শহর। কারণ এটি তখন শহরে পরিণত হয়েছিল। মুরলি বর্তমান যশোর শহরস্থ উপ-শহর। খান জাহান এখানে বেশি দিন অবস্থান করেননি। এখানে তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য তাঁর দুই সাথী বোরহান শাহ এবং গরিব শাহকে নিয়োজিত করে যান। এই দুই সাধক এখানেই মৃত্যুবরণ করেন। যশোর শহরের পশ্চিম দিকে এক মাইল দূরে বোরহান শাহের মাজার এবং পুরনো কসবায় ফৌজদারি কোর্টের উত্তরে ভৈরব নদীর তীরে গরিব শাহের মাজার এখনো বিদ্যমান রয়েছে। মুরলি কসবা থেকে খান জাহান তাঁর বাহিনীকে দু’ভাগে বিভক্ত করেন। একদল কপোতাক্ষ নদী বেয়ে বেতকাশীতে গিয়ে পৌঁছায়। এই বেতকাশী বর্তমান খুলনা জেলার পশ্চিমে কয়রা থানার সুন্দরবনাঞ্চলে অবস্থিত। এই দলের আমির ছিলেন বোরহান খাঁ, বৃদ্ধ বয়সে বুড়ো খাঁ নামে পরিচিতি পান। বোরহান খাঁর এক পুত্রসন্তান ছিল ফতেহ খাঁ। পিতা-পুত্র দু’জনই এখানে ধর্ম প্রচারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। তাঁরা সুন্দরবনের প্রথম যে স্থানে পদার্পণ করেন সে স্থানের নাম খান জাহানের নামের সাথে মিলিয়ে খানপুর রাখেন। খানপুরের দাওয়াতি কাজ শেষে বোরহান খাঁ সহযোদ্ধাদের নিয়ে বিদ্যানন্দ কাটিতে গমন করেন। দিকে-দিকে খান জাহানের বঙ্গে আগমনের কারণ ও ইসলামি বার্তা পৌঁছিয়ে দিতে থাকেন। তাঁরা এসব অঞ্চলে মসজিদ নির্মাণ, জলাশয় খনন, রাস্তাঘাট নির্মাণ ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কর্ম করতে থাকেন। এখানে তাঁরা ১৬০০ হাত দৈর্ঘ্য ও ৭০০ হাত প্রস্থ বিরাট একটি দিঘি খনন করেন। প্রতি বছর খান জাহানের নামে এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। খান জাহানের এক ভক্ত ত্রিমোহিনী সন্নিকটে গোপালপুরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। যা আজো বিদ্যমান। গোপলাপুরের দক্ষিণে খান জাহানের এক শিষ্য পীর মেহেরের মাজার। মেহেরের নামে এ জায়গার নাম হয়েছে মেহেরপুর। বোরহান খাঁর নেতৃত্বে সহযোদ্ধারা বিদ্যানন্দ কাটি থেকে সড়ক নির্মাণ করতে করতে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই রাস্তা যশোর থেকে শুরু হয়ে খানপুর, বিদ্যানন্দকাটি, কেশবপুর হয়ে মাগুরঘোনা, ভায়ড়া, তালা, কপিলমুনি ও সরল হয়ে শিবসা নদী অতিক্রম করেছে। এ রাস্তা সুন্দরবনের আমাদী, মসজিকুড় থেকে বেদকাশী পর্যন্ত পৌঁছিয়ে ছিল। এই আমাদী ছিল তাদের শেষ সীমানা। এখানে বোরহান খাঁ ও তার পুত্র ফতেহ খাঁ আস্তানা গড়েন। এখান থেকে তাঁরা সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে থাকে। এখানে তাদের গড়া নয় গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ অবস্থিত রয়েছে। যার নাম পীর খান জাহান আলী জামে মসজিদ। বোরহান খাঁ ও তার পুত্র ফতেহ খাঁ আমাদিতে ইন্তিকাল করেন। বোরহান খাঁ বা বুড়ো খাঁই ছিলেন খান জাহানের নির্বাচিত আঞ্চলিক প্রশাসক ও ধর্ম সৈনিক প্রতিনিধি। মুরলি কসবা থেকে অপর এক বাহিনী অগ্রসর হয়ে দক্ষিণে অবস্থিত পায়গ্রাম কসবায় উপনীত হয়। এ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং খান জাহান নিজেই। পয়গাম ফার্সি শব্দ, এর অর্থ সুসংবাদ, আর পয়গাম থেকেই পায়গ্রাম হয়েছে। এটি যশোর থেকে ২০ মাইল দূরত্বে অবস্থিত। এখানে আগমনকালে তিনি রামনগর গ্রামে বিরাট একটি দিঘি খনন করেন। এই দিঘিটি যশোর থেকে ৪ মাইল দূরে অবস্থিত। এভাবে তিনি ভৈরব তীর বেয়ে সিঙ্গিয়া হয়ে নওয়াপাড়ার পাশ দিয়ে ফুলতলা থানার শেষ প্রান্তে ভৈরব নদীর তীরে আস্তানা ফেলেন। এখানে তিনি বসতি স্থাপন করেন। এ স্থানই হলো পায়গ্রাম। বসতি ছাড়াও এখানে একটি মসজিদ ও দরবার গৃহও নির্মাণ করেন। তাঁর নামানুসারে এখানকার নামকরণ হয় খান জাহানপুর। এই খান জাহানপুরের পাশে পায়গ্রাম কসবা হাইস্কুল অবস্থিত। এখান থেকে তিনি একটি রাস্তাও নির্মাণ করেন। রাস্তাটির উত্তর দিকের নাম হয় উত্তর দিহি এবং দক্ষিণ দিকের নাম হয় দক্ষিণ ডিহি। এই পায়গ্রাম কসবায় তাঁর কয়েকজন শিষ্য স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। পায়গ্রাম কসবায় পিরালি সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয়। এখানে গোবিন্দ লাল রায় নামে একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ ছিলেন। তার ডাক নাম ছিল গোবিন্দ ঠাকুর, তিনি খান জাহানের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি পীরালি উপাধি লাভ করেন। তাঁর বংশধররা পীরালি নামে পরিচিত হয়। এছাড়া সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তিকে সম্মানসূচক পিরালি নামে ডাকা হতো। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর নতুন নাম হয় মোহাম্মদ তাহির। পরবর্তীতে হয়রত পীর আলী মোহাম্মাদ তাহিরের প্রচেষ্টায় বর্ণ হিন্দু প্রধান এলাকার বহু বর্ণ হিন্দু ও তাফসিলি হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। ফলে এসব অঞ্চলে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। হযরত খান জাহান তাই পায়গ্রাম কসবায় কিছুকাল থেকে এখানকার শাসনভার পীর আলী মোহাম্মদ তাহিরের ওপর ছেড়ে দিয়ে সহযোদ্ধাদের নিয়ে বাগেরহাটের পথে যাত্রা শুরু করেন। পীর আলী মোহাম্মদ তাহির পরে খলিফাতাবাদ রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি বাগেরহাটে ইন্তিকাল করেন। হযরত খান জাহানের রওজা মোবারকের পশ্চিম পাশে তদীয় বন্ধু ও সহকারী শাসনকর্তা পীর আলী মোহাম্মদ তাহিরের সমাধি অবস্থিত। তিনি বাঙালি শিষ্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি লাভ করেন এবং খান জাহানের সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে আমরণ পাশে থেকেছেন একে অন্যের। খান জাহান বাগেরহাটে যাওয়ার পূর্বে পায় গ্রাম কসবা থেকে পূর্ব দিকে বাসুড়ী গ্রামে আস্তানা গড়েন। এখানে তিনি ৭০ বিঘা জমি নিয়ে প্রকান্ড এক দিঘি খনন করেন। এখানে সত্যের আহ্বান পৌঁছিয়ে দিয়ে আবার দক্ষিণ দিকে পথ পাল্টে ভৈরব তীরে শুভরাড়া গ্রামে আস্তানা করেন। এখানে কিছুকাল থাকার পর শুভরাড়া থেকে রানাগাতি, গোপিনাথপুর ও নাউলী হয়ে ধুলগ্রামে আগমন করেন। ধুলগ্রাম থেকে ভৈরব তীর হয়ে সিদ্ধিপাশার মধ্যে দিয়ে বারাকপুর আসেন, ব্যারাক অর্থ শিবির। খান জাহান এখানে ছাউনি ফেলেছিলেন বলে এ জায়গার নাম হয় বারাকপুর। বারাকপুর থেকে তিনি সহসেনাদের নিয়ে নদী তীর বেয়ে ঘোলগাতি ও দিঘলীয়ার মধ্য দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করে বর্তমান দৌলতপুরের কাছে উপনীত হন। খান জাহান এখান থেকে সেনহাটি ও চন্দনী মহলের মধ্য দিয়ে সোলপুরের পথে সেনের বাজারে উপস্থিত হন। তিনি সেনের বাজার থেকে রাংদিয়া পৌঁছেন এবং বাদখালীর বিল হয়ে বাগেরহাটের সন্নিকটে সুন্দরঘোনা মৌজায় উপনীত হন। খান জাহানের আগমনকালে বাগেরহাটের কি নাম ছিল তা জানা যায় না। তবে সুন্দরঘোনা গ্রাম ও তার আশপাশের এলাকা নিয়েই বর্তমান বাগেরহাট জেলা অবস্থিত ছিল। বাগেরহাট কথাটি পরে তৈরি হয়েছে। শহরের পাশ দিয়ে ভৈরব নদীর উত্তর দিকের হাড়িখালী থেকে বর্তমান নাগের বাজার পর্যন্ত যে লম্বা বাঁক অবস্থিত, পূর্বে সে বাঁকেই সম্ভবত পুরনো বাজার এলাকায় একটি হাট বসতো। আর এই হাটের নামে এই স্থানের নামকরণ করা হয় বাঁকেরহাট। পরবর্র্তীতে এটি পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ালো বাগেরহাট। এখানেই খান জাহান স্থায়ীভাবে থাকার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাই এখানে জাঁকজমকপূর্ণ শহরের পত্তন করেন। এই শহরেই ছিল তাঁর প্রশাসনিক কেন্দ্র ও রাজধানী। এখান থেকেই তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এবং পূর্ববর্তী সকল স্থানে কার্য পরিচালনার জন্য নিজস্ব প্রতিনিধি রেখে আসেন। সর্বশেষ অবস্থান নেয়া স্থানের নামকরণ করেন খলিফাতাবাদ। এই খলিফাতাবাদ বলতে তিনি যে উদ্দেশ্য নিয়ে দূর দেশ থেকে রওনা করে এতদূর এলেন সেই অর্থ বুঝিয়ে ছিলেন। আল্লাহ মানবজাতিকে খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তিনি খলিফাতাবাদ বলতে আল্লাহর খলিফার শহর এমনটিই বুঝিয়ে গেছেন। খান জাহান তাঁর দীর্ঘ শাসনামলে এই অঞ্চলের ব্যাপক উন্নতি ঘটান। ২০-২৫টি গ্রাম নিয়ে তাঁর রাজধানী খলিফাতাবাদ নগরী গড়ে ওঠে। খান জাহান রহ.কে বাগেরহাট আগমনের পর এলাকার প্রভাবশালী হিন্দুরা সংঘবদ্ধ হয়ে খান জাহান রহ.কে এ এলাকা থেকে বিতাড়িত করতে ষড়যন্ত্র করে। তাঁরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এ এলাকার রণবিজয়পুর, রণভূমি, ফতেহপুর, পিল জঙ্গ প্রভৃতি স্থানে মুসলিমদের সাথে তাদের যুদ্ধ হয়। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে খান জাহান রহ. তাদেরকে পরাজিত করেন। তিনি খলিফাতাবাদ নগরী গড়ে তোলেন খ্রিস্টাব্দ পঞ্চাশ শতকের মধ্যভাগে। এ সময় নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহ বঙ্গের স্বাধীন সুলতান ছিলেন।

পরিবার ও বাসস্থান
খান জাহান রহ. বঙ্গে গমনের আগে সম্ভবত বিবাহ করেছিলেন। যেহেতু তিনি পরিপূর্ণ ধার্মিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তবে প্রিয়তমা সঙ্গিনীসহ আত্মীয়-স্বজনদের সম্ভবত তুরস্কে রেখে এসেছিলেন। তার এ অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবর গাত্রে। বঙ্গে এসে তিনি আর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন নি। ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে তাঁর বসতবাড়ি অবস্থিত ছিল। বর্তমানে সে বাড়ির অস্তিত্ব বিলীন। তবে সে বাড়ির কয়েকখানা পাথরের স্তম্ভ ও ইট এখনো দেখতে পাওয়া যায়। এখানে একটি ছোট মসজিদ ছিল। বাড়ির সামনে একটি পুকুরও ছিল। তাঁর বাড়ির চতুর্দিকে নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান ছিল বলে জানা যায়।

ষাট গম্বুজ মসজিদ নির্মাণ
মসজিদ প্রধানত সালাতের ঘর। যেহেতু এখানে আল্লাহর স্মরণে আসা হয় তাই একে বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর বলা হয়। বিশ্ব নবী হযরত মুহম্মদ (সা)-এর সময় থেকে মসজিদ মুসলিমদের প্রশাসনিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। খান জাহান রহ.ও একই পদ্ধতিতে তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনায় মসজিদকে ব্যবহার করতেন। আর এজন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অসংখ্য মসজিদ। ষাট গম্বুজ মসজিদ খান জাহান রহ. প্রতিষ্ঠিত কীর্তিরাজির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। এটি বাগেরহাট জেলা শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বিখ্যাত ঘোড়াদিঘির পূর্ব তীরে অবস্থিত। ষাট গম্বুজ মসজিদের মতো এত প্রাচীনত্ব বৃহত্তম মসজিদ বাংলাদেশে আর নেই! এর দৈর্ঘ্য ১৬০ ফুট ও প্রস্থ ১০৮ ফুট।
গৃহের অভ্যন্তরে গম্বুজের উচ্চতা ২২ ফুট। মসজিদের সম্মুখভাগের মধ্যস্থলে একটি বড় খিলান এবং তার দুই পাশে ৫টি করে ছোট খিলান রয়েছে। এর প্রাচীরের প্রশস্ততা প্রায় ৯ ফুট। সমস্ত অট্টালিকা পূর্ব-পশ্চিমে ৬০টি প্রস্তর স্তম্ভের ওপর নির্মিত। যদিও এটি ষাট গম্বুজ মসজিদ নামে পরিচিত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চতুষ্কোণের বরুজের ওপর ৪টি গম্বুজসহ এতে মোট ৭৪টি গম্বুজ আছে, এবং মধ্যের সারির বাংলা চালের অনুরূপ ৭টি চৌচালা গম্বুজসহ সর্বমোট ৮১টি গম্বুজ বিদ্যমান। মসজিদের পশ্চিম পাশে প্রধান মেহরাবের পাশে ১টি দরজাসহ মোট ২৬টি দরজা রয়েছে।
এই বিশাল গৃহের চার কোণে ৪টি মিনার রয়েছে, যা ছাদ থেকে কয়েক ফুট উঁচু। এবং তার মধ্যে ক্ষুদ্র কুঠুরি আছে। উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকের মিনারের মধ্যে ঘুরান সিঁড়ি আছে। তার একটির নাম আঁধার কোঠা ও অন্যটিন নাম শলক বা রওশন কোঠা। উপরে ওঠার সিঁড়ি দু’টি সংকীর্ণ এবং এখনকার সিঁড়ির মতো প্রস্তুত নয়। মসজিদটির এরূপ নামকরণের পেছনে দু’টি ধারণা প্রচলিত। চৌচালা ৭টি গম্বুজ থেকে ‘সাত গম্বুজ’ পরিবর্তিত হয়ে ষাট গম্বুজ এবং গম্বুজ ছাদের ভারবহনকারী অভ্যন্তরের ৬০টি স্তম্ভ থেকে “ষাট খামবাজ’ (খামবাজ অর্থ স্তম্ভ) পরিবর্তিত হয়ে ‘ষাট গম্বুজ’ হয়েছে।
তাঁর শিল্প নৈপুণ্য ছিল অসাধারণ। এদেশ নদীমাতৃক, এর পলিমাটিতে কোনো সৌধ চিরস্থায়ী হতে পারে না। জলবায়ু ও নোনার দোষে এ অঞ্চলের কোনো সৃষ্টি অবিকল থাকতে পারে না। তাই সৌধরাজি স্থায়ী করার জন্য তিনি বিশেষ মালমসলা ও প্রস্তর ব্যবহার করেন। এখানে অত্যধিক বৃষ্টিপাত হয় বলে তিনি তার স্থাপত্যের ছাদ বহুলাংশে চৌচালা গোলপাতার ঘরের মতো তৈরি করেন যা বৃষ্টিপাত বহুল দেশের জন্য একান্ত প্রযোজ্য। ষাট গম্বুজ মসজিদ স্থাপত্য কৌশলে ও লাল পোড়া মাটির ওপর লতাপাতার অলংকরণে মধ্যযুগীয় স্থাপত্য শিল্পের এই মসজিদ এক আশ্চর্য স্মৃতি নিয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে এই সুন্দরবন প্রদেশে! মসজিদটির গঠন বৈচিত্র্যের কারণে অনেকে এটিতে তুঘলক স্থাপত্যের প্রভাবান্বিত বলে মনে করেন। কিন্তু বাস্তবে সেটি নয়। এটি তাঁর পূর্বদেশ তুর্কি স্টাইলে তৈরি এবং তুঘলক স্থাপত্য মূলত তুর্কি নির্মাণশৈলী থেকে ধার করা! ষাট গম্বুজ মসজিদের মিনারে দাঁড়িয়ে মুয়াজ্জিন আজান দিয়ে মুসল্লিদের সালাতের প্রতি আকৃষ্ট করতেন। দেশি-বিদেশী রাজমিস্ত্রি দ্বারা এটি নির্মাণ করতে কয়েক বছর সময় লেগেছিল। এটি যেমন মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তেমনি এটি ছিল তাঁর দরবার গৃহ বা খলিফাতাবাদ রাজধানীর মূল শাসন কেন্দ্র। এখানে সালাত ও দরবার ব্যতীত মাদ্রাসার কার্যও পরিচালিত হতো। রাজস্ব সংগ্রহ ও নানা রকম অভিযোগের তদন্ত ও বিচারকার্য এখান থেকে চলত। অসংখ্য ছাত্র এখানে শিক্ষাগ্রহণ করত। সালাতের সময় হলে সবাই একত্রিত হয়ে সালাত আদায় করত। খান জাহানের আরেকটি উল্লেখযোগ্য মসজিদ হলো সিঙ্গার মসজিদ। এটিকে মসজিদ বললেও আসলে এটি ছিল একটি বিশ্রামাগার বা পাহারাগার। যা এক গম্বুজ বিশিষ্ট। এটি ষাট গম্বুজ মসজিদের দক্ষিণ দিকে রাস্তার অপর দিকে অবস্থিত। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনামলে প্রাচীন কীর্তিরাজির রক্ষা আইনের দ্বারা ষাট গম্বুজ মসজিদ সরকারের তত্ত্বাবধানে আসে। লন্ডনে প্রকাশিত ইতিহাস গ্রন্থে (ঈধসনৎরফমব ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ওহফরধ) ষাট গম্বুজ মসজিদের একটি চমৎকার ফটো দেওয়া আছে এবং এর স্থাপত্য শিল্পের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। জাতিসংঘের ইউনেস্কো ১৯৮৫ সালে এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে। ষাট গম্বুজ মসজিদের পাশে তৈরি হয়েছে প্রতœতত্ত্ব বিভাগের উদ্যেগে একটি স্মৃতিঘর। এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই স্মৃতি ঘরটি অনেকটা বঙ্গভবন সদৃশ। খান জাহান রহ.-এর স্থাপত্য কলাকৌশলে এঁকে সাজানো হয়েছে। ২০০১ সালে এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। এখানে সংরক্ষিত রয়েছে খান জাহানের অনেক তথ্য ও তত্ত্বভান্ডার। এখানে দেশি-বিদেশী অগণিত পর্যটক দৈনিক ভ্রমণ করে থাকেন।

ঘোড়াদিঘি খনন
খান জাহান রহ. বাগেরহাট অঞ্চলে ২৫-২৬টি বড় বড় দিঘিসহ অসংখ্য পুকুর ও জলাশয় খনন করেন। এখন কথা হলো এতগুলো দিঘি খননের প্রয়োজনীয়তা কী ছিল? কেউ কেউ বলেন অতি মাত্রায় লবণাক্ততার কারণে! এটি একেবারেই অজ্ঞ কথা। কারণ সুন্দরবনের অস্তিত্ব তথা জীবন প্রণালীর পেছনে মূল অবদান হচ্ছে হিমালয় পর্বতের সানুদেশে গঙ্গোত্রী নামক স্থান থেকে উৎপত্তি গঙ্গা নদীর। আর এই গঙ্গা নদীর পানি প্রবাহ থেকেই সুন্দরবনের উৎপত্তি। এতো সেই আদি কথা। এ ধারা অব্যাহত ছিল ১৯৭৫ সালে ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগ পর্যন্ত। তাহলে বোঝা গেল ১৯৭৫ সালের আগ পর্যন্ত খলিফাতাবাদের এ অঞ্চলের নদীতে মিষ্টি পানি প্রবাহ বিদ্যমান ছিল। হ্যাঁ তবে বাতাস ছিল ‘নোনাযুক্ত’ যেহেতু সমুদ্্র থেকে ধেয়ে আসত বাতাস তাই এমনটি হতো। নদীতে এখনকার দিনের থেকে তখনকার দিনে অনেক বেশি হিংস্র প্রাণী ছিল। তাই নদীতে পানি আনতে যাওয়া ও গোসল করা মোটেও নিরাপদ ছিল না। এবং নদীর দূরত্বেরও একটি ব্যাপার ছিল। আর রাস্তাঘাট, বসতবাড়ি ইত্যাদি নির্মাণের জন্যও মাটির প্রয়োজনীয়তা ছিল। আরো কথা হলো নিজস্ব নগর ব্যবস্থাপনার জন্য বিলাসবহুল দিঘির প্রয়োজনীয়তা ছিল এবং বিপুল মৎস্য ভান্ডারের আধার হিসেবেও কাজ করত। তাই সর্বদিক মিলিয়ে এসব অঞ্চলে পুকুর ও দিঘির প্রয়োজনীয়তা খুবই জরুরি হয়ে পড়ে। যাইহোক খান জাহান সর্বপ্রথম খলিফাতাবাদে যে বিশাল দিঘি খনন করেন তা হলো ঘোড়াদিঘি। এই দিঘির দৈর্ঘ্য ১৪০০ ফুট ও প্রস্থ ৫০০ ফুট। বছরের সবসময় এখানে পানি থাকে। এর গভীরতা ২৫ ফুটের অধিক। বর্তমানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ঘোড়াদিঘির পাশে একটি পাম্পিং স্টেশন নির্মাণ করেছে। বাগেরহাট শহরে পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় ঘোড়াদিঘি অপরিশোধিত পানি ধারা হিসেবে কাজ করে। এ দিঘি থেকে পানি পাম্প করে দশানী পানি পরিশোধনাগারে নেয়া হয়। এবং এখান থেকে পাইপের মাধ্যমে বাগেরহাট পৌর শহরে সরবরাহ করা হয়।

খাঞ্জেলী দিঘি খনন
বাগেরহাট শহর থেকে ষাট গম্বুজ ও ঘোড়াদিঘির দূরত্ব ৩ কিলোমিটার। এই প্রধান রাস্তা থেকে একটি রাস্তা দক্ষিণমুখী হয়ে দরগায় মিশেছে। খান জাহান খনিত সর্বশেষ ও সর্ববৃহত্তম দিঘি এখানে অবস্থিত। এই দিঘি তাঁর মৃত্যুর ১০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে খনিত। এই দিঘিটি একদিকে যেমন বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঠিক তেমনি বাংলাদেশের মধ্যেও বৃহৎ দিঘি! উত্তর দক্ষিণে লম্বা এই দিঘি ২ হাজার ফুট ও পূর্ব পশ্চিমে ১৮ শ’ ফুট।
এই দিঘির পানি সুপেয় ও স্বচ্ছ। এমন সুন্দর ও স্বচ্ছ বারিধারার দিঘি বাংলাদেশে নেই বললেই চলে! বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে এই দিঘি খনন করা হয়েছিল। যাতে ময়লা আবর্জনা পড়ে দিঘির পানিকে দূষিত করতে না পারে। এই দিঘিতেই ধলাপাহাড় ও কালাপাহাড় নামক কুমিরের বংশধরেরা বাস করে আসছে যুগ যুগ ধরে। ছোট বড় প্রচুর পরিমাণের মাছও রয়েছে এই দিঘিতে। এই দিঘিকে ঠাকুর দিঘিও বলা হয়। এই দিঘি খননকালে একটি বুদ্ধ ঠাকুরের মূর্তি প্রাপ্তির জন্য এর নাম হয় ঠাকুর দিঘি। খাঞ্জেলী দিঘি থেকে মূর্তিটি আবিষ্কারের পর মূর্তিটি দিঘির পূর্ব পাড়ে রেখে দেওয়া হয়। স্থানীয় হিন্দুগণ মূর্তিটিকে দেবতা শিবজ্ঞানে পূজা করত। খান জাহান ছিলেন পূর্ণ ইসলামিক তাই পরধর্মে সহিষ্ণু, তিনি মূর্তিটিকে হিন্দুদের ইচ্ছানুযায়ী মহেশচন্দ্র নামক একজন ব্রাহ্মণকে দান করেন। তারপর বৌদ্ধ মূর্তিটি বাগেরহাট থেকে ৪ মাইল পূর্বে কচুয়া থানার অন্তর্গত একটি গ্রামে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। তখন থেকে এ গ্রামের নাম হয় শিববাড়ি। স্বাধীনতার পর বৌদ্ধভিক্ষুরা এ মূর্তিটিকে ঢাকার কমলাপুর বৌদ্ধ মন্দিরে স্থানান্তরিত করে। মূর্তিটির কারুকার্য খুবই সুন্দর! পাঠ পীঠ বাদে এর উচ্চতা ৩ ফুট এবং প্রস্থ ১ ফুট ৮ ইঞ্চি। মূর্তিটি ৮ম শতাব্দীর বলে অনুমিত হয়।

রাস্তাঘাট নির্মাণ
খান জাহানের আমলে বারোবাজার থেকে মুরলি, পায়গ্রাম, আলাইপুর হয়ে খলিফাতাবাদ পর্যন্ত সুদীর্ঘ পাকা রাস্তা নির্মিত হয়েছিল।
আবার বারোবাজার-খলিফাতাবাদ সড়কের সাথে মনিরামপুর- কেশবপুর-বিদ্যানন্দকাটি হয়ে আটরাই-তালা- পাইকগাছা-আমাদী ও বেতকাশী পর্যন্ত একটি দীর্ঘ পাকা রাস্তা নির্মিত হয়। অপর একটি সড়ক পায়গ্রাম- ফুলতলা - ডুমুরিয়া-আরশনগর- আটরাই- তালা হয়ে লাবসা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
এছাড়া খান জাহানের আরো কিছু রাস্তা রয়েছে যা বিভিন্ন স্থান থেকে খলিফাতাবাদে এসে মিলিত হয়েছে। প্রথমে পার্শ্ববর্তী জমি থেকে আধুনিক কায়দায় মাটি ফেলে কাঁচা রাস্তা তৈরি করা হতো। রাস্তা পাকা করার জন্য তিনি একটি সুন্দর নিয়ম জানতেন। বর্তমানের মতো একফর্দ ইট পেতে তার ওপর খোয়া ফেলে তিনি সংক্ষেপে কাজ সারতেন না। তাঁর ব্যবহৃত ইট ছিল ৬ ইঞ্চি লম্বা ও ২ ইঞ্চির চেয়ে কম পুরু। রাস্তায় লম্বালম্বিভাবে সমদূরে ৫ সারি আস্ত ইট পাতা হতো। প্রত্যেক সারিতে দুইখানা ইট থাকত। দুই একটি সারির মধ্যে ৪/৫ খানা ইট আড়াআড়িভাবে বসানো হতো। কোনো ইটই চিত করে লাগানো হতো না, কাৎ করে পাশাপাশি বসান হতো। এ রাস্তা চট্টগ্রাম পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছিয়ে ছিল বলে জানা যায় তবে সে রাস্তার পরিচয় পাওয়া দুষ্কর। জনকল্যাণে নির্মিত এসব সড়ক নির্মাণে খান জাহান যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তা এক বিরল ইতিহাস! তিনি বুঝতেন যে সুন্দর রাজপথ ব্যতীত যাতায়াতের সুবিধা ও শহরের শোভা বর্ধিত হতে পারে না।
সুন্দরবন রাজ্যে তিনি যে রাস্তা ঘাট নির্মাণ করে গেছেন ৫ শতাব্দী পূর্বে বাংলাদেশে এমন রাস্তাঘাটের সন্ধান আর কোথাও পাওয়া যায় না!

সেনানিবাস স্থাপন
সর্বসাধারণের নিরাপত্তার জন্য, বহিরাগতদের আক্রমণ থেকে নিজ রাষ্ট্রকে হেফাজত করার জন্য খান জাহান রহ. সেনানিবাস স্থাপন করেন। শহরের শান্তি রক্ষা ও নদীপথ প্রহরার জন্য কোতোয়ালি চৌতারার অবস্থান দেখে ধারণা করা যায় বারাকপুরে খান জাহান ও পরবর্তী শাসকদের প্রধান সেনানিবাস ও দুর্গ ছিল। এ স্থানের বর্তমান অবস্থা ও ধ্বংসাবশেষগুলো সে ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়।
খলিফাতাবাদ নগরে একাধিক অস্ত্রাগারের পরিচয় মেলে। কোতোয়ালি চৌতারার পাশে অস্ত্রাগার নগর কোতোয়ালের অধীন নগররক্ষী সেনাদের জন্য নির্মিত হয়। খান জাহানের দীর্ঘ শাসনামলে নগরী ও এতদঞ্চলে অব্যাহত শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজিত ছিল। তাঁর আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থাপনা দেখে শত্রুপক্ষ কখনো তাঁর রাজ্যে আক্রমণ করার সাহস পায়নি! যদিও প্রথমে তাকে হটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়।

মুসাফিরখানা স্থাপন
পরদেশী বা অন্য অঞ্চলের পথিকদের জন্য খান জাহান রহ. মুসাফিরখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মুসাফিরখানায় এসে যেকোনো আগন্তুক খাবার খেতেন। মুসাফিরখানাকে সরাইখানাও বলা হতো। আর এ সরাইখানা থেকেই বাগেরহাটের সোরাই বা সরই গ্রামের উৎপত্তি হয়েছে।

জ্ঞানার্জন কেন্দ্র স্থাপন
খান জাহান রহ. নিজে ছিলেন একজন দ্বীন দুনিয়া বিষয়ে উচ্চ শিক্ষিত লোক। ধর্মীয় শিক্ষা, শিল্পকলা ও সাহিত্যে তিনি বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়েছিলেন। তাঁর শাসিত এলাকাগুলোয় ফার্সি সাহিত্যের দারুণ উন্নতি সাধন হয়। ষাটগম্বুজ মসজিদে তাঁর একটি মাদ্রাসা ছিল। এছাড়া পায়গ্রাম, কসবা, যশোর ও বারোবাজার প্রভৃতি স্থানে তাঁর ব্যবস্থাপনায় জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র স্থাপিত হয়।

শেষ জীবনের কর্ম
সমাধি সৌধের পূর্বদিকে খান জাহানের বাবুর্চিখানা ছিল। অসহায়ের বন্ধু খান জাহান রহ. জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অসংখ্য অসহায় ব্যক্তিকে ও আগন্তুক মেহমানদেরকে তৃপ্তিসহকারে ভোজন করাতেন।
তিনিই সর্বপ্রথম অভিযানকারী যিনি সুন্দরবনাঞ্চলের গহিন বনের মধ্যে জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন করতে সক্ষম হন। তবে তিনি প্রচলিত রাজা-বাদশাদের মতো রাজ্য চালাতেন না। তাহলে তিনি নিজ নামে মুদ্রাঙ্কন করতেন। কিন্তু তিনি এসবের মূল্য দিতেন না বলেই মনে হয়। সুশাসক ও ইসলাম প্রচারক হিসেবে তিনি যে নজির স্থাপন করে গেছেন তা বাংলার ইতিহাসে বিরল! বিশেষ করে মৃত্যুর কিছুদিন পূর্ব থেকে তিনি আরো বেশি করে শুধু আল্লাহর আরাধনায় ব্যস্ত থাকতেন। খান জাহান বলিষ্ঠ ও দীর্ঘাকৃতি সুপুরুষ ছিলেন। তাঁর আয়ুষ্কাল ১০০ বছরে উপনীত হয়েছিল। বার্ধক্যে তাঁর মাথার চুল পেকে সাদা হয়ে গিয়েছিল। তিনি প্রথম জীবনে রাজকীয় পোশাক পরিধান করতেন। তাঁর মস্তোকোপরি মনোরম জরির শিরস্ত্রাণ শোভা পেত। শেষ জীবনে দলে-দলে লোক এসে তাঁর খেদমত করতেন এবং ইসলামের কালজয়ী বাণী শ্রবণ করতেন। অবশেষে খান জাহান রহ. ৮৬৩ হিজরির ২৬ শে জিলহজ, ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে অক্টোবর রোজ বুধবার রাতের বেলায় তিনি ইন্তেকাল করেন! পরদিন বৃহস্পতিবার তাঁর জানাজা নামাজ শেষে আসরের সময় তাকে কবরস্থ করা হয়। তাঁর জানাজার নামাজে ইমামতি করেন তার প্রধানমন্ত্রী ও বন্ধু পীরালি মোহাম্মদ তাহির। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে খলিফাতাবাদ শহরসহ পুরো দক্ষিণ-পঞ্চিমাঞ্চলের জনপদে!

খাঞ্জেলী দরগাহ
খাঞ্জেলী দিঘির উত্তর পাড়ে খান জাহানের মাজার অবস্থিত। খান জাহান রহ.-এর মাজার এক গম্বুজবিশিষ্ট। মাজারটি বর্গাকারে নির্মিত। প্রত্যেক পাশের দেয়াল ৪৬ ফুট এবং ৮ ফুট ৩ ইঞ্চি প্রশস্ত। মাটি থেকে দেয়ালগুলি তিন ফুট পর্যন্ত পাথরের এবং এরপর থেকে ইটের গাঁথুনি। গোলাকার চারকোণের মিনারের ওপর ছোট গম্বুজ দ্বারা শোভিত। উত্তর দিক থেকে দিঘি ও দরগায় প্রবেশ করতে একটি বিশাল গেটের মধ্য দিয়ে আসতে হয়। এ ছাড়া মূল মাজারে ঢুকতেও ৩টি গেট রয়েছে। দক্ষিণের গেট দিয়েই মাজারে প্রবেশ করতে হয়। অন্য দু’টি সাধারণত বন্ধ থাকে। সৌধটির চতুর্দিক প্রায় ৪ হাত পুরু প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত এবং এর বাইরে অপর একটি প্রাচীর বেষ্টনী রয়েছে। শেষোক্ত প্রাচীর বেষ্টনীর উত্তরের তোরণ দ্বারা ভেতরে প্রবেশ করা যায় এবং ডানে ঘুরে দিঘির পাড়ের দ্বিতীয় প্রাচীরের দক্ষিণের গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই সামনে সমাধি সৌধ ও এর প্রবেশদ্বার। এই প্রবেশদ্বার অতিক্রম করলে সামনেই কবর। কবরটি বর্তমানে রেলিং ঘেরা ও গিলাফে আবৃত। এছাড়া সৌধের বাইরের প্রাচীরের পূর্বদিকেও একটি গেট আছে, যা সাধারণত বন্ধ থাকে। তাঁর মাজার লিপিতে তাঁর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কথা লিখিত আছে। কলেমার অমর বাণী লিখিত আছে।
এ অঞ্চলের লোকজন তাকে খাঞ্জেলী পীর বলে সম্বোধন করে। তার পূর্ব নিবাস হওয়ারিজিম বা খিবা থেকে এ খাঞ্জেলী কথাটির উৎপত্তি হয়েছে। যেহেতু অধিকাংশ পীর তার নিজ এলাকার নামে পরিচিতি পান। বছরের যেকোনো সময়ে তাঁর মাজারে লোক সমাগম হলেও ২/৩টি উৎসবে লোক সমাগম হয় সবচেয়ে বেশি। প্রতি বছর চৈত্র মাসের পূর্ণিমাতে এখানে বড় একটি মেলা বসে থাকে ও ২৫ শে অগ্রহায়ণে পীর সাহেবের নামে একটি ওরস শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া মাঘ ও ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমার সময়েও প্রচুর লোক সমাগম হয়ে থাকে। বিভিন্ন জেলা থেকে অনেক লোক হাজত মানত নিয়ে এখানে উপস্থিত হয়। অনেকে মেলা ও ওরসকে একই পর্যায়ের মনে করে। কিন্তু এ দু’টি ভিন্ন জিনিস। চৈত্র মাসের পূর্ণিমার সময় খুব জাঁকজমকের সাথে মেলা বসে থাকে। কবে থেকে এই মেলার প্রচলন তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে অনেকে বলেন পূর্বের একটি ঈসালে সওয়াবের মাহফিল আজ এই মেলায় পরিণত হয়েছে। তবে কুরআন তেলাওয়াত ও ওয়াজ মাহফিলের অনুষ্ঠানটি আজ একটি উদ্দেশ্যহীন ভেলকিবাজি মেলায় পরিণত হয়েছে এটি অতি দুঃখের বিষয়! এমন একজন ওলির মাজারে শিরক-বিদয়াত ও সকল প্রকার ভন্ডামিতে ভরে গেছে!
চৈত্র মাসের পূর্ণিমার রাত্রি ছাড়াও প্রায় প্রতি পূর্ণিমার রাতে এই দরগায় লোক সমাগম হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে হাজত মানত নিয়ে লোকেরা হাজির হয়। মাজারের বিভিন্ন স্থানে হাঁড়ি পেতে শিন্নি রান্না করে এবং সেই শিন্নি বিতরণ করে তাদের মানত শোধ করেন। কেউ কেউ আবার কুমিরকে টাকা-পয়সা, মোরগ-মুরগি দান করে থাকে! কেউ কেউ মাজারে সিজদা দেয়! ভন্ড ফকিরেরা সরল লোকদের ডেকে নিয়ে বলে এদিকে আসেন মাজারের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে বলে এখানে হাত রাখুন তারপর শপথ বাক্য পাঠ করানো তারপর খুশি হয়ে এই গর্তের মধ্যে কিছু দান করুন। পরে ঐ ফকিরে তা বের করে নিয়ে যায়! যাই হোক আল্লাহর এই প্রিয় ওলির মাজার থেকে সকল প্রকার ধোঁকাবাজি ঈমানবিধ্বংসী অপকর্ম ও মানবতাহীন কর্ম বন্ধ হোক! আমরা তাঁর আদর্শগুলো যেন ধরে রেখে আলোকিত পথে চলতে পারি, আল্লাহ তাকে ও তাঁর সহযোদ্ধাদের জান্নাতুল ফেরদাউসে পরম শান্তিতে রাখুন, আমিন!
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ