উপহার   -ফাতেমা নার্গিস

উপহার -ফাতেমা নার্গিস

গল্প জুন ২০১৮

কিছুক্ষণ ধরেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে মিতু। রমজানের শেষ। প্রচণ্ড ব্যস্ত শহর। কিছুক্ষণ পর একটা রিকশা পেয়ে উঠে পড়ে। গন্তব্য কমলাপুর স্টেশন। ধানমন্ডি থেকে যেন অনেকটাই দূরে স্টেশন। স্টেশনে পৌঁছে দেখলো ট্রেন এখনো প্লাটফর্মে আসেনি। বসে থাকে মিতু। ট্রেনের সময় ছিলো দুপুর ১২টায়। কিন্তু ট্রেনের দেখা নেই। অপেক্ষার প্রহর গুনে মিতু। এখনো ঈদের চারদিন বাকি। স্টেশন লোকে লোকারণ্য। যাত্রীদের মধ্যে ব্যস্ততা উদ্বিগ্নতা দেখে মিতু। সে একাই যাচ্ছে দেশে মায়ের কাছে। মাকে অনেকবার ঢাকায় নিজের কাছে আনার চেষ্টা করেছে সেকি মায়ের সেই প্রচণ্ড এক অজুহাত। না স্বামীর ভিটে ছেড়ে যাবেন না। এক সময় সেই ভিটে থেকে উৎখাত হয়েছেন তবু শেষ বয়সে এখন সে ভিটেকেই স্বামীর স্মৃতি হিসেবে ধরে বসে আছেন।
- আপা দুইটা টাকা দ্যান। সকাল থাইক্যা কিছু খাই নাই। হঠাৎ করে চমকে উঠেন মিতু। ভাবনার অতল গহ্বর থেকে যেন বেরিয়ে আসেন।
- এ্যাই তুই ভিক্ষা করছিস কেন? তোর মা বাবা কেউ নেই? সাত-আট বছরের একটি মেয়ে। অপুষ্টির চিহ্ন সারা শরীরে। শীর্ণ মুখে সলাজ প্রার্থনা।
-আপা আমি কোনদিন ভিক্ষা করি নাই। মায় আমারে কিছু করতে দেয় নাই আইজ তিন দিন ধইরা মায়ের খুব জ্বর। উইঠ্যা বইতেও পারে না। জ্বরের লাইগ্যা মায়ে রোজা রাখতে পারে নাই। ঘরে খাওনের কিছু নাই বইল্যা ভিক্ষা করতে বাইর হইছে।
-তা থাকিস কোথায়? বাবা নাই?
- বাবায় তো পাঁচ বছর আগেই মইরা গ্যাছে। যক্ষ্মা হইছিলো তার। এই ঢাহা শহরে আইছি এক বছর হইলো। মায় মাইনসের বাসায় কাজ করতো আর বিয়ালে রাস্তার ধারে বইস্যা পিঠা বানাইতো। এহনতো মায়ের অসুখ তাই কিছু করতে পারে না। আমরা থাকি ঐ ফুটপাথের ঐপারে কয়টা ঘর আছে। আমার এক দূর সম্পর্কের খালার ঘরে থাকি। হেই খালায় কইছে স্টেশনে আইস্যা ভিক্ষা করতে। খালায় বিকালে আইয়া লইয়া যাইবো। বলে কাঁদতে থাকে মেয়েটি। বিব্রত বোধ করে মিতু। মেয়েটির বেদনায় কাতর হয়। ব্যাগ থেকে নিজের কার্ড বের করে। বলে-
-শোন। এই কার্ডটি রাখ। এখানে আমার ঠিকানা আর ফোন নাম্বার আছে। ঈদের পরের সপ্তাহে আমি ঢাকা চলে আসবো। তখন তুই আমাকে ফোন করিস। তখন আমি তোর বাসায় গিয়ে আমি তোকে আমার কাছে রেখে দেবো। তুই আমার কাছে থাকবি। স্কুলে ভর্তি করে দিবো।
- মায়েতো আমারে কইছিলো শাওন তোর কোন কাম করার দরকার নাই, তুই লেখা পড়া করবি। আমি একটু টাকা পয়সা জমাইলেই তোরে স্কুলে ভর্তি কইরা দিমু। হেই মায়েই তো এহন মরার মতো পইড়া রইছে। অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ে মেয়েটি। পরম মমতায় ওকে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় মিতু। আশ্বাস দেয় তুই কোনো চিন্তা করিস না। আমি ঈদের পর ঢাকা এসে তোর মাকে আমার অফিসেই একটা আয়ার কাজ ঠিক করে দিবো। এখন এই পাঁচশো টাকা রাখ। তুই মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবি। ঔষধ কিনে মাকে খাওয়াবি মা ভালো হয়ে যাবে। মেয়েটি স্নেহের এই উষ্ণ প্রবণে যেন বেদনায় গলে গলে পড়তে থাকে-
- আপা আমাগো বাড়ি আছিল, পুকুর আছিল, বাবায় ক্ষেতের কামলা আছিল, মায়ের গরু, হাঁস-মুরগি সব আছিল। আমাগো ঘরেও অভাব আছিল তয় কোনদিন না খাইয়া থাকি নাই। একদিন বাবায় ক্ষেত থাইক্যা আইলো গায়ে জ্বর লইয়া। চাইর দিন জ¦রে ভুইগ্যা বাবায় মইরা গেল। মায়ে আমারে লইয়া গ্রামে থাকনের চেষ্টা করলো কিন্তু মানুষের যন্ত্রণায় থাকতে পারলো না। গরু হাঁস মুরগি সব মাইনসে চুরি কইরা লইয়া গেল। শেষমেশ মায়ে ঘরতালা দিয়া আমারে লইয়া এই খালার কাছে চইল্যা আইলো। মিতু স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন। এই মেয়েটির দুঃখে যেন নিজের মনও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। এমন সময় প্লাটফর্মে মিতুর ট্রেন এসে দাঁড়াল। মিতু বললো- শাওন আমারতো ট্রেন এসে গেছে তুই এখন ঘরে যা। এই পাঁচশো টাকা লুকিয়ে রাখ কেউ যেন না দেখে। এটা মায়ের হাতে দিবি। আর এই বিশ টাকা নে কিছু কিনে খেয়ে নে। আমার অফিসের কার্ডটা যতœ করে রাখিস। আমি ঈদে আমার মায়ের কাছে যাচ্ছি। আমি এক সপ্তাহ পর ঢাকা আসব তখন তুই ফোন করবি। মিতু দ্রুত পায়ে ট্রেনে উঠে নিজের সিট খুঁজে বসে পড়ে। অসম্ভব গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। জানালার কাছে বসে মিতু বাইরের দিকে তাকায়, দেখে মেয়েটি অপলক দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মেয়েটির দুচোখে পানি। ট্রেন ছেড়ে দিল। মিতু দুচোখ বন্ধ করে বসে থাকলো। নিজের মনে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো- এই মেয়েটির জন্য কেন এত দুঃখ অনুভব করছে। সেকি ঐ শাওনের সাথে নিজের শৈশবকে তুলনা করছে? স্মৃতির পাতায় নিজের শৈশবের ছবিগুলো ভেসে আসে। ঠিক এই বয়সেই বাবাকে হারিয়েছিলেন মিতু। বাবা চলে যাওয়ার পর মা সংসারের হাল শক্ত হাতেই ধরেছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর মা বাবার অফিসে ধরনা দিয়ে দিয়ে পেনশনের টাকা প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলেছিলেন। সেই টাকা ব্যাংকে রেখে সেই টাকা দিয়েই একটু একটু খরচ করে মিতুকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। এটা নিয়ে চাচাদের সাথে কত মনোমালিন্য হয়েছে। চাচারা সেই টাকার ভাগ চেয়েছেন। বলেছেন মেয়েকে পড়িয়ে কী হবে? তার চেয়ে ওকে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও। মা রাজি হননি। বলেছেন না আমি ওকে লেখাপড়া শেখাবো। যাতে আমার মতো অবস্থায় পড়লে যেন ওকে কারো মুখোমুখি হতে না হয়। চাচারা এরপর কঠোর অবস্থানে চলে যায়। মাও চাচাদের থেকে বাঁচতে নিজের বাড়ি ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন। জীবনের সব বিলাসিতাকে বিসর্জন দিয়ে নিজে ঘরে বসে সেলাইয়ের কাজ করতেন। তার পেছনেই মা তার সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সেই মিতু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়। কিন্তু মাকে সে ঢাকায় আনতে পারেনি। চাচারা শেষ বয়সে ভুল বুঝতে পেরে মাকে আবার নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। জীবনযুদ্ধে সফল মা এখন ভালোই আছেন। তিনি কোলাহল পূর্ণ ঢাকায় থাকতে চান না। মিতু ভাবে মা যদি তাকে সঠিকভাবে মানুষ না করতে পারতেন তবে তার অবস্থাও হয়তো শাওনের মতো হতো। মিতু ভাবেন ঢাকায় শাওনকে নিজের কাছে নিয়ে আসবে এবং তাকেও একজন সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। ভাবতে ভাবতে দুচোখ বন্ধ হয়ে আসে। গত রাতে ঘুম না হওয়ায় ঘুম এসে যায়। হঠাৎ করে কার স্পর্শে যেন ঘুম ভেঙে যায় মিতুর। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেন তার সামনে শাওন দাঁড়িয়ে। মিতু অবাক হয়ে বলেন- কী ব্যাপার তুই ট্রেনে এলি কী করে?
- আপা আপনে ট্রেনে উঠার পর দেখি আমার কাছে আপনার দেয়া কার্ড নাই। এত মানুষের মধ্যে আমি কই খুঁজমু কার্ড? এই এত বড় ঢাকা শহরে আমি তো আর আপনেরে খুঁইজ্যা পামু না। হের লাইগ্যা ট্রেন ছাড়ার লগে লগে আমি ট্রেনে উইঠ্যা পড়ছি। হেই পিছের ডাব্বায় উঠছিলাম। এতক্ষণ ধইরা আপনেরে খুঁইজ্যা খুঁইজ্যা এই ডাব্বায় আইয়া আপনেরে পাইছি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে মেয়েটি। জীবনের পরম নির্ভরতার একটি আশ্রয়ের জন্য মেয়েটি এই ঝুঁকি নিয়েছে বুঝতে পারেন মিতু।
- কিন্তু তোর মায়ের কী হবে? আর তো খালা যে তোকে খুঁজবে তার কী হবে?
- খালায়ই মারে দেখবো। আমি এখন থাইক্যা আপনার কাছেই থাকুম। আপনের সব কাম আমি কইরা দিমু। এই ধরেন আপনের টেকা। বলে পাঁচশো টাকার নোটটি মিতুর হাতে দেয়। মিতু বলে ঠিক আছে আমি ট্রেন থেকে নেমে তোর জন্য ঈদের জামা কিনে দিবো।
- আপা আমার জামা লাগবো না। আমি তো ঈদের সব থাইক্যা বড় উপহার পাইছি। আমি আপনেরে পাইছি। আমারে আর ভিক্ষা করতে হইবো না। না খাইয়া থাকতে হইবো না। আল্লায় তো আমারে সব থাইক্যা বড় উপহার দিয়া দিছে গো আপা। অবাক বিস্ময়ে মিতু শাওনকে জড়িয়ে ধরেন। দু বেলা খাবার প্রত্যাশায় একটু ভালোবাসা তার জন্য শাওন তার মাকে ফেলে তার কাছে চলে এসেছে। মানুষের জীবনের এই বিশ্বাসটুকু মিতু ভাঙবে কী করে। ট্রেন গন্তব্যে এসে পৌঁছেছে মিতু উঠে দাঁড়ায় নামার জন্য। শক্ত করে শাওনের হাত ধরে- চল শাওন আমরা ট্রেন থেকে নামবো।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ