ঈদের কথা

ঈদের কথা

তোমাদের গল্প আগস্ট ২০১২

সাজিদ হাসান সৈকত..

সাকিবদের বাড়ির সামনে বিশাল মাঠে সবাই জড়ো হয়েছে। পশ্চিমাকাশে আবীর রাঙা মেঘেরা লুকোচুরি খেলছে। একটু পরই চাঁদ উঠবে। সবাই ‘চাঁদ দেখা’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। সাকিব, সজিবসহ সবাই দাদুর সাথে দাঁড়িয়ে। একটু পরই ইফতারের সময় হবে।
দাদু বললেন, চাঁদই ঈদের খুশি ছড়িয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু আকাশের যা অবস্থা, চাঁদ নাও দেখা যেতে পারে।
সজিব ধৈর্যহারা হয়ে গেল। বলল, চল দাদু, মনে হয় চাঁদ দেখা যাবে না।
সাকিব ফিরে যেতে মনস্থ করলো। মেঘের যা মতিগতি তাতে চাঁদ উঠবে বলে মনে হয় না। হঠাৎ সে যেন ক্ষুদ্র একটা জিনিস দেখতে পেলো। রুদ্ধশ্বাসে সে কয়েক মুর্হূত অপেক্ষা করলো। হ্যাঁ, ঐতো চাঁদ উঠেছে। শাওয়ালের চাঁদ। কালই ঈদ।
সে আনন্দে লাফিয়ে উঠলো- দাদুভাই, ঈদ মোবারক। ঐ তো চাঁদ দেখা গিয়েছে।
ধীরে ধীরে সবাই চাঁদ দেখলো। আকাশে মেঘের নদীতে চাঁদ তার ময়ূরপঙ্খি ভাসিয়ে দিয়েছে।
দাদুও কিছুক্ষণ পর চাঁদ দেখলেন। আশি বছর বয়স। চোখে ভালো দেখতে পান না।
সবাই মসজিদে রওয়ানা হল। আজ সেখানেই ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজ আর তারাবি পড়তে হবে না।
সাকিব ঢাকায় একটি ভালো কলেজে ভর্তি হয়েছে। তাই বাড়িতে সে কমই থাকতে পারে। এ জন্য দাদুকে কাছে পেলে যে তাঁকে ছাড়তেই চায় না। এই দাদুতো তার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। ঈদের ছুটি উপলক্ষে বাড়িতে এসে সে দাদুর নিত্যসঙ্গী।
নামাজ শেষে সাকিব তাদের উঠানে মস্ত বড় শীতল পাটি বিছিয়ে দিলো। আর তাতে সজিব সৌরভসহ পাশের বাড়ির শুভ, জয়, রাজুও এসে জেঁকে বসেছে। আর এল মাসুম। সে সাকিবের সহপাঠী ছিল। আবার ভালো বন্ধুও। মাসুমও দাদুর খুব ভক্ত।
দাদু আসরের মধ্যমণি, জলচৌকিতে আরাম করে বসলেন।
আসরের মাঝে মা এসে হারিকেন দিয়ে গেলেন। তারাও ঈদ নিয়ে মহা ব্যস্ত। সাকিব বলল, দাদু গল্প বলেন।
কিসের গল্প বলবো, দাদুভাই?
সজিব বললো, ভূতের গল্প বলুন দাদু।
সৌরভ যা! কাল হবে ঈদ। আর তিনি শুনবেন ভূতের গল্প।
দাদু, আপনি রূপকথার গল্প বলুন।
মাসুম বলল, না, আজগুবি গল্প শুনে ফায়দা নেই। আচ্ছা দাদুভাই, এমন গল্প বলুন, যা আমরা কখনো শুনিনি।
সাকিব তাকে সমর্থন দিল। হ্যাঁ দাদুভাই, সাথে গল্পটি হতে হবে ঈদ সম্পর্কিত ও রোমাঞ্চকর।
দাদু হাসলেন, হ্যাঁ এমন একটা গল্প তোমাদের জন্য আমার ঝুলিতে লুকিয়ে রেখেছি। তবে শুনলে বিশ্বাস করবে না, তাই বলব না।
না, না বিশ্বাস করবো, করবো... সবাই হইচই শুরু করলো।
আচ্ছা, আচ্ছা, বলছি শোনো তবে কেউ বিরক্ত করবে না।
সবাই মাথা নাড়লো। দাদু নড়ে চড়ে বসলেন।
‘সালটা সম্ভবত ত্রিশ-এর দিকে। এখন জায়গাটা যেমন দেখছো, তখন এ রকম ছিল না। আমাদের ঘর ছিল ছনের তৈরি। আর ছিল গোয়ালঘর। আমাদের বাড়ির চার পাশে ছিল ঘন জঙ্গল। সেখানে বাঘডাশ, গেছো বাঘসহ অনেক কিছু থাকতো, মানুষের সংখ্যাও ছিল হাতেগোনা।
তখন যানবাহন ছিল গরু আর মহিষের গাড়ি। সে সময় এক ঈদের কথা। রমজান মাস, এক বিকেলে মা আমাকে বললেন, গাছ থেকে বেল পেড়ে আনতো। মা শরবত বানাবেন। আমি বেশ ছোট, তাই রোজা রাখতে দিতেন না।
এখন যেখানে পুকুরটা দেখছো, তার সামনেই ছিল প্রকাণ্ড বেলগাছ। লম্বায় তিনতলা ভবনের সমান।
আমি গাছে উঠে পড়লাম। তাড়াতাড়ি একটা পাকা বেল নিয়ে নামতে লাগলাম। বাবা তখন গোয়ালঘরে গরু নিচ্ছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে খ্যাপাটে যে ষাঁড়, সেটি বাঁধার সময় দড়ি বাবার হাত ফসকে গেল। আর ষাঁড়টি দিগন্তের পথে লাগাল ছুট। আমি গাছের সর্বশেষ ডাল ধরে ঝুলছি। যখন লাফ দেবো দেখলাম অগ্নিমূর্তি ধারণ করা গরু আমার সামনে। আমিতো ভয়ে আত্মারাম খাচাছাড়া। হঠাৎ করে হাত গেল ফসকে। আর পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে। সোজা আসনের মত গরুর পিঠের ওপর পড়লাম। আর বেলটা গরুর মাথায় পড়ে ফেটে গেল। মাথায় বেল ভাঙার কারণে গরু দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গেল। আমি কোনো মতে হাতড়িয়ে গরুর শিং ধরে বসে রইলাম। গরু আমাকে নিয়ে গাঁয়ের প্রধান রাস্তায় নেমে পড়ল। আর আমাকে পিঠ থেকে নামাতে ল¤ফঝম্প শুরু করে দিলো।
আমি গরুর পিঠের সাথে মিশে গেলাম। গরু আমায় নিয়ে এবার পাশের বনে ঢুকে পড়ল। হায় হায়! আমি তো এ বনের কিছুই চিনি না। তবে কিছু দূর এগিয়ে যেতেই গরু একটা পায়েহাঁটা পথ ধরে ছুটল। আর চার পাশের ডালের আঘাতে আমার চামড়া ছিঁড়ে যেতে লাগল। পথটি বিরাট বড়। আমি একটা ডাল ভেঙে হাতে নিলাম। পথটি শেষ হতে আন্দাজ করলাম, এটা পাশের গ্রাম। তাই তাড়াতাড়ি ডাল দিয়ে বাড়ি মেরে আমাদের গ্রামের দিকে গরুর মুখ ঘুরালাম। লোকজন আমাকে দেখে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। আমি এই দুরবস্থায়ও হেসে ফেললাম। গরুকে বাগে রাখতে আমাকে খুবই বেগ পেতে হচ্ছিল। তারপরও প্রাণের ভয়ে শিং দু’টি ধরে আছি।
বাবা তখন গোটা পাড়া এক করে ফেলেছেন। সবাই অস্থির। না জানি আমি এতক্ষণে পটোল তুলেছি।
ওই দিকে অন্ধকার হয়ে আসায় আমি পথ-ঘাটও ভালো দেখছিলাম না। হঠাৎ আবছা অন্ধকারে দেখলাম এক রাখাল তার কয়েকটি গরু নিয়ে আসছে। আমার তো জান বেরিয়ে আসার উপক্রম।
এমনিতে নাচুনি বুড়ি, তার ওপর ঢোলের বাড়ি। ষাঁড়টা দেখতে পেলে আমার আর কিছু করতে হবে না। আমি লাঠিটা দিয়ে গরুর পেছনে সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করতে লাগলাম। রাগের চোটে এটা রকেটের মতো ছুটতে থাকে। আমিও কোনো রকমে শিং বাগিয়ে ধরে আছি।
দাদু একটু থামলেন। মা এসে চা দিয়ে গেছেন। আমরা ফিসফাস করতে লাগলাম। সজিব ভয়ে কুঁকড়ে আছে। এমনিতে ছোট মানুষ তার ওপর ভীতুর ডিম। ওকে দেখে হাসি পেল।
চায়ের কাপ খালি করে দাদু গল্প শুরু করলেন।
আমি তখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। কিন্তু ষাঁড়টার থামার কোনো লক্ষণ দেখলাম না। কিছুক্ষণ পর আমাদের গাঁয়ে ঢুকলাম। আরেকটু এগিয়ে দেখি, আমাদের বাড়ি লোকে লোকারণ্য। সবাই আলো হাতে ভিড় জমিয়েছে। আর রাস্তায় তকা বুবু উন্তের মতো দাঁড়িয়ে।
আমি চিৎকার করে বললাম, বুবু সরে দাঁড়া। কিন্তু বুবু শুনতে পেল না। সে তখন আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে। আমার মাথা দ্রুত কাজ করতে লাগলো।
ষাঁড়টা তার গতি বাড়িয়ে দিলো। বুবু যখন আমাকে আবছা আলোয় দেখতে পেল, ষাঁড়টা তার বিশ হাত দূরে। সে ভয়ে জমে গেলো। আমি প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লাম। হঠাৎ মনে পড়ল, ঘোড়ার তো লাগাম ধরে গতিরোধ করা হয়। শেষ চেষ্টা করে দেখি, গরুটাকে থামানো যায় কি না।
আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে গরুর শিং ধরে টান দিলাম। গরুটাও সামনের দু’পা উঁচিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে গেল। ঠিক যেন তেজি ঘোড়া। তারপর হাম্বা বলে বিকট চিৎকার ছিল। সবাই ডাক শুনে এদিকে তাকালো। চাচা দৌড়ে এসে দড়ি ধরে ফেললেন। বুবুকে মা সরিয়ে নিলেন, তার ছয় হাত সামনে গরু থেমে যায়। আর বাবা আমাকে গরুর পিঠ থেকে নামালেন।
তারপর থেকে আমি এলাকার নায়ক। সবাই আমাকে দেখে বলতো ‘ঐ দেখো, আবদুর রহমানের ছেলে আবদুল্লাহ যায়।’ মা আমাকে এরপর কখনো বকতেন না। আর আমার ঈদটাও স্মরণীয় হয়ে রইল জীবনে।
এরপর আমি কখনো ঐ গোয়ালঘরমুখী হইনি। আর পরের ঈদে বাবা ঐ ষাঁড়টি কোরবানি দেন। গরুটার জন্য আমার সামান্য মায়া হয়েছিল। আহারে বেচারা!
দাদু গল্প বলা শেষ করলেন। সজিব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সাকিব যেন সম্বিত ফিরে পেলো। কারো চোখের পলক পড়েনি। হঠাৎ সবাই নড়েচড়ে উঠলো।
একটি বড় নিঃশ্বাস ফেললো। এ যেন রূপকথার চেয়েও রূপকথাময়। তারপর হইচই করে তারা রাতটা কাটিয়ে দিলো। তবে সেদিন রাতে সজিব একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখলো। দেখলো একটা ষাঁড় তাকে তাড়া করছে। আর সে দৌড়াচ্ছে হঠাৎ ষাঁড়টা তার কোমরে গুতো মারল।
তার ঘুম ভেঙে গেলো। দেখলো সাকিব, সৌরভ, শুভ, জয়, মাসুম সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আর হাসছে। সে নিচে পড়ে আছে। সে লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। তারপর বললো, দাঁড়িয়ে আছো কেন চল, নামাজ শুরু হয়ে যাবে। বলে বেরিয়ে গেল।
সবাই মুচকি হেসে তার সাথে এগুলো। নামাজ পড়ে সবাই বাড়ির দিকে এগুলো। সঙ্গে তাদের দাদুও রয়েছেন। দাদু একটু একটু হাসছেন। কোথায় যেন একটা দোয়েল অনবরত শিষ দিয়ে যাচ্ছে। দোয়েল ডাকা ভোরে গ্রামটা যেন খুশির দোলায় দুলে উঠছে। আর প্রকৃতিও যেন তাদের ডেকে কী বলছে। দাদু জুতো খুলে খালি পায়ে হাঁটছেন। সবাই তাকে অনুসরণ করলো। ভোরের শিশির পায়ে স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দিতে লাগলো। সেও তাদের যেন ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। তারা সবাই বাতাসে কান পাতলো। হ্যাঁ, ঐ তো শোনা যাচ্ছে। গানে গানে পাখিরা বৃক্ষরা আর শিশির ফোঁটা তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। সবাই যেন সুমধুর কণ্ঠে বলছে- ঈদ মোবারক। আসসালাম! ঈদ মোবারক। ...

 


                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ