ঈদের আনন্দ

ঈদের আনন্দ

স্মরণ আগস্ট ২০১১

মাহবুবুল হক.....

অনেক আনন্দ আছে, উপভোগ করা যায়- আনন্দের মাঝে বিলীন হওয়া যায়, কিন্তু লিখে তার ভাব প্রকাশ করা যায় না। ‘ঈদ’ তেমনই একটা আনন্দ। বিশেষ করে মুসলমানদের কাছে এবং আরো নির্দিষ্ট করে আল্লাহ-সচেতন মুমিনদের কাছে।
আমাদের ছেলে মুসা ইব্রাহিম পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বত হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে পা রেখেছে- এ খবর তোমরা সবাই জান। তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় এভারেস্ট জয় করার পর তার কাছে যে আনন্দ লেগেছে, সে আনন্দ বড়, না আমাদের ঈদের আনন্দ বড়? সম্ভবত সে জবাব দেবে ঈদের আনন্দ বড়। অন্তত শৈশবের ঈদের আনন্দ তার কাছে এভারেস্ট জয়ের আনন্দের চেয়ে বড়, অবশ্যই বড়।
আমরা যারা বড়, শৈশবের ঈদের আনন্দ এখন আমাদের কাছে এক মহা আনন্দের স্মৃতি? সেই স্মৃতি কস্মিনকালেও ভোলার নয়। জীবনে অমন নির্মল আর নিষ্কলুষ আনন্দ আমরা আর পাইনি। আমরা কেনÑ কেউ পায়নি, কেউ পায় না। কিসে এই আনন্দ? তাও ব্যাখ্যা করে বোঝানো দায়। এ এক মহা আনন্দের উপলব্ধি- এক অনির্বচনীয় সুখের লহর। আমাদের ছোটকালে আনন্দের আতিশয্য কি খুব বেশি কিছু ছিল? আনন্দের নানা উপকরণও কি ছিল? ছিল না। এখনও যে খুব একটা আছে তাও নয়। কারণ আমরা দরিদ্র সমাজের মানুষ- আমাদের নুন আনতে এখনও বেশির ভাগ মানুষের পান্তা ফুরায়। কিন্তু ঈদে আমাদের আনন্দ ছিল- এখনও আছে। হয়তো কিছু রকমফের হয়েছে। কিন্তু না, আনন্দটা এখনও পুরোপুরি আছে। এ আনন্দের উৎস কোথায়? উৎস মনে, উৎস হৃদয়ে। আমাদের হৃদয় বা মনের যিনি একমাত্র অধিকারী সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালাই আমাদের মনে ঈদের আনন্দ স্থাপিত করে দিয়েছেন। ঈদ এলেই সকল দুঃখ-ব্যথা ভুলে ঈদের আনন্দে আমরা অবগাহিত হই। এ যেন এক ‘ইনবিল্ট’ উচ্ছ্বাস- প্রকৃতিগত অনাবিল এক আনন্দ। যে আনন্দের সাথে দুনিয়ার কোনো আনন্দের তুলনা হয় না।
ছোট্টকালে দেখেছি, টুপি মাথায় খালি গায়ে ছেঁড়ালুঙ্গি পরে কী আনন্দের সাথে আমাদের বন্ধুরা ঈদগাহে আসতো, সবার সাথে ঈদের নামাজে শামিল হতো। নামাজের পর অন্য বাচ্চাদের সাথে প্রাণ খুলে কোলাকুলি করতো। দু’ পয়সার বাঁশি বা বেলুন কিনতো। মহা আনন্দে বন্ধুদের নিয়ে পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরতো। হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্ধা বা জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলতো। সেকালের ধনী-দরিদ্রের মধ্যে আজকের মতো এতো ভেদাভেদ ছিল না। ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধানেও ছিল কম।
তবে এটা ঠিক, যারা রোজা রাখতো তাদের আনন্দই ছিল বেশি। এখনও তাই। সেকালে কিশোররা রোজা রাখার জন্য যে প্রতিযোগিতা করতো, এখনকার কিশোররাও তাই করে। হয়তো প্রতিযোগিতার ধরন ও প্রকৃতি পৃথক হয়ে গেছে। মুসা ইব্রাহিম হিমালয় জয় করে যে আনন্দ পেয়েছে সে আনন্দ কি যারা হিমালয়ে ওঠেনি, তারা পেয়েছে? না, তা কি কখনও হয়? যারা সারা মাস রোজা রেখে ঈদের আনন্দে প্রবেশ করবে এবং যারা রোজা না রেখে ঈদের আনন্দে প্রবেশ করবে, তাদের আনন্দ কি একরকম হবে? নিশ্চয়ই হবে না। এসব তো সহজেই হৃদয়ঙ্গম করা যায়। বিষয়টা স্বচ্ছতার। বিষয়টি অনুভূতির। নির্মল ও পবিত্র আনন্দে অবগাহন করতে হলে রমজান মাসে সিয়াম সাধনা করতে হবে। মানুষ সব কিছু পারে। শুধু পারে না নিজেকে ফাঁকি দিতে। যে কিশোর রোজা রাখেনি, সে দামি পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করলেও এবং দামি দামি আনন্দের উপকরণ সংগ্রহ করলেও তার মনে তত আনন্দ ভিড় করবে না যত আনন্দ ভিড় করবে এক রোজাদার কিশোরের মনে- ঈদের দিনে যে হয়তো একটি নতুন জামাও সংগ্রহ করতে পারেনি।
দুনিয়ার সব আনন্দ স্থান-কাল-পাত্র ভেদে আলাদা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। শুধু ঈদের উৎসব বা আনন্দ শাশ্বত। এ আনন্দ চিরকালীন এবং চির অমলিন। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এ আনন্দের অনুভূতি ভিন্নতর হয় না। বরং কালে কালে এর রূপ ও মাধুর্য বৃদ্ধি হয়। এর উপলব্ধি গভীরতর হয়।
বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশ। এখানে শতকরা ৮৫ জন মুসলিম। সে দিক থেকে ঈদ উৎসব আমাদের জাতীয় উৎসব তথা সার্বজনীন উৎসব। এই সার্বজনীন কথাটা কেউ কেউ মানতে চান না। তাঁরা বলেন, এদেশে শতকরা ১৫ ভাগ লোক ভিন্ন ধর্মেরÑ তাঁরাতো আর ঈদ উৎসব পালন করেন না। কথাটা সর্বাংশে সত্য নয়। কারণ বয়স্করা ঈদ উৎসব পালন না করলেও তোমাদের মতো শিশু-কিশোররা, ভিন্ন ধর্মের হলেও ঈদ উৎসবে যোগদান করে। ঈদের দু’টি দিক- ১. ধর্মীয় ও ২. সামাজিক। ভিন্ন ধর্মে শিশু-কিশোররা ঈদের ধর্মীয় দিকে অংশগ্রহণ না করলেও ঈদের সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক দিকে অংশগ্রহণ করে। খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে তারা অংশগ্রহণ করে। আর ভিন্নধর্মী বয়স্করা বা বড়রা ঈদের উৎসব থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে, এমনও তো নয়। মুসলিম বন্ধু-বান্ধব বা পাড়া-প্রতিবেশীদের দাওয়াতে বা আমন্ত্রণে তারা অংশগ্রহণ করে। অনেকের মাঝে উপহার লেনদেনেরও রেওয়াজ রয়েছে। মুসলিমরা ঈদের সময় ভিন্ন ধর্মের বন্ধু-বান্ধব বা পাড়া-প্রতিবেশীকে উপহার দেয় আবার ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও তাদের পালা-পার্বণ বা ধর্মীয় উৎসবের সময় মুসলিম বন্ধু বা পড়শিদের উপহার দেয়। এ এক চিরকালীন রেওয়াজ বা রীতি। বাঙালি বা বাংলাদেশী সমাজে এ এক রূপময় সৌন্দর্য বা ঐশ্বর্য। এসব কারণেই ঈদ উৎসবকে সার্বজনীন উৎসব বলা যায়।
কেউ কেউ বলেন, পহেলা  বৈশাখ হলো সার্বজনীন উৎসব। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই নববর্ষ পালন করে। এ কথাটাত আংশিক সত্য। বাংলাদেশের সকল মানুষ একই দিনে নববর্ষ পালন করে না। সনাতন ধর্মের লোকেরা ১৫ এপ্রিলে নববর্ষ পালন করে আর আমরা পালন করি ১৪ এপ্রিলে। সুতরাং পহেলা বৈশাখকে সার্বজনীন জাতীয় উৎসব বলা যায় না।
একবার ১৪ এপ্রিল তথা পহেলা বৈশাখে ঈদ ছিল। দেখা গেল সেবার আর পহেলা বৈশাখ সেভাবে পালিত হয়নি। দেশের সকল মানুষ সাড়ম্বরে ঈদ উৎসব করেছে।
আরেকবার ২১ ফেব্রুয়ারি তথা ভাষা দিবসে ঈদ ছিল। দেখা গেল ২০ তারিখ রাত ১২টায় শহীদ মিনারে তেমন কেউ উপস্থিত হয়নি। পরের দিনের অনুষ্ঠানও হয়নি। বাংলা একাডেমীর বইমেলা তেমন জমেনি।
ঈদের সময় শহরবাসীর শতকরা ৭৫ জন নাড়ির টানে গ্রামে ছুটে যায়। আত্মীয়-পরিজনের সাথে ঈদের উৎসব পালন করে। জীবনের মজা ও আনন্দ আত্মীয়-পরিজনের সাথে ভাগাভাগি করে উপভোগ করে। এসব থেকেই অনুভব করা যায় ঈদ আমাদের আত্মার উৎসব। ঈদ আমাদের আনন্দের এবং সুখের উৎসব। ঈদ আমাদের শ্রেষ্ঠতম উৎসব। ঈদ আমাদের সার্বজনীন জাতীয় উৎসব।
ঈদে জাতীয়ভাবে যে মিলনমেলা আমরা উপলব্ধি করি, তা আর কোনো উৎসবে উপলব্ধি করি না। আমাদের ধর্মীয় আদর্শ, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির খোলামেলা বাহ্যিক রূপ আমরা ঈদের প্রাক্কালে প্রত্যক্ষ করি। আমাদের আত্মপরিচয় বা জাতিসত্তা ঈদের প্রাক্কালেই আমরা দেখতে পাই। শুধু আমরা কেন, বিশ্বসভার সবাই দেখতে পায়। আমাদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য কত উদার ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত তা আমরা দেখি ঈদের দিনগুলোতে। ঈদের সময় আমাদের সমাজে ধনী-গরিবে কোনো ব্যবধান থাকে না। এটাই ঈদের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ