ঈদে রাজহাঁস এবং লাল মোরগের গোশত-সাজজাদ হোসাইন খান

ঈদে রাজহাঁস এবং লাল মোরগের গোশত-সাজজাদ হোসাইন খান

স্মৃতিকথা জুন ২০১৭

প্রতিরাতেই মিটিং বসে। যুক্তি-তর্ক আলোচনা সমালোচনা হয়। এসব মিটিংয়ের প্রধান আলোচক দু’জন। আব্বা এবং আম্মা, আর দর্শক এবং শ্রোতা আমি ও আমার দুই ছোট ভাই। কোনো কোনো দিন তর্কাতর্কি সপ্তমে উঠে যায়। তখন মিটিং আটকা পড়ে যুক্তি-তর্কের ফান্দে। আম্মা বসে থাকলেও আব্বা স্থান ত্যাগ করেন। বারান্দায় পাতা ইজি চেয়ারে গিয়ে বসেন। ফর্সি হুক্কার নল দুই ঠোঁটের মাঝখানে পুরে দিয়ে আয়েশ করে টানতে থাকেন। মেজাজটা ঠান্ডা হওয়ার আগ পর্যন্ত টানাটানি চলে। তখন সুগন্ধি ধোঁয়া ওড়ে বাতাসে। এক সময় গাঢ় হয়ে যায় বারান্দা-উঠান। কালোর তলায় চাপা পড়ে আব্বা, ইজি চেয়ার এবং ফর্সি হুক্কা। মাঝে মধ্যে কলকিতে রাখা টিকাটি জ্বলে আর নিভে। সেদিন বিকালের নাস্তাটা মাটি হয় আব্বা আম্মার রাগ-গোসায়। কদিন বাদেই রমজান এলো বলে। এই বিশেষ মাসটিতে একটা অন্যরকম আয়োজন হতো বাড়িতে। আশপাশের বাড়িঘরেও সাজসাজ রব উঠতো। বেশি বাজার সদায় হতো। ইফতারি-সেহরি নিয়ে বড়দের সাথে সাথে আমাদের মতো ছোটদের মনেও আলাদা ফুর্তি জাগতো।
একটা খুশি খুশি ভাব নিয়ে অপেক্ষায় আছি। রোজা ইফতারি সেহরি সব শেষে আনন্দের ঈদ। প্রতি বছরই ঈদ করি গ্রামে। কোনো বছর দাদাবাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘাটুরায়। আবার পরের বছর নানাবাড়ি ভৈরবের আগানগর। গ্রামের ঈদের মজা অন্য কিসিমের, প্রজাপতি পাখার মতো ঝলমলে। রোদ ঝুরঝুর, উম উম। এবারের ঈদ উদযাপন নিয়ে মিটিং শেষ হলো অবশেষে। যুক্তিতর্ক কথাকাটাকাটি এরপর ঠিক হলো আগামী ঈদ করবো ভৈরবের আগানগর গ্রামে। আগানগর আমার নানাবাড়ি। মেঘনা পাড়ি দিয়ে তবে পৌঁছতে হয় সে গ্রামে। চারপাশ ঘিরে পানি থৈ থৈ। এমন দৃশ্য বর্ষাকালে। অন্য সময় মাঠ ভরা ফসল। ধান সরিষার মউ মউ গন্ধ। গরু-ছাগল নিয়ে রাখালের দাপাদাপি। সকালে উঠান দাবড়ে বেড়ায় হাঁস-মুরগির দল। এমন অনেক চমৎকার চমৎকার দৃশ্যের মুখোমুখি হওয়া যায়, রোজ। তাছাড়া মামাতো ভাই-বোনদের সাথে দেখা হবে আনন্দ হবে। কোনো কোনো ঈদে খালারাও আসেন, সাথে খালাতো ভাই-বোন। মজার খবরটা কানে আসতেই পুলকে লাফিয়ে উঠলাম আমরা ক’ভাই। সেদিন থেকেই ভাবনা শুরু হয়ে গেলো, কবে আসছে ঈদ।
আমরা তখন অশোকতলায় থাকি। অশোকতলা কুমিল্লা শহরের একটি এলাকা। গ্রামগ্রাম ভাব। গাছে গাছে ছাওয়া। তবে কোনগুলো যে অশোকগাছ তখনো ছিলো জানার বাইরে। আম কাঁঠাল নারিকেল গাছ আছে অগুনতি। এদের মধ্যে যে অশোকগাছ কোনটি কে জানে। এ পাড়ার বাড়িগুলো বেশ আলগা আলগা। প্রতিটি বাড়িতেই দু’চারটি করে নারিকেল গাছ। এলাকাটির নাম অশোকতলা না রেখে নারিকেলতলা রাখলেই বোধ হয় সঠিক হতো। এমনটাই ভাবনা আসে মাঝে মধ্যে। আমরা যে বাড়িতে বসবাস করি সে বাড়ির পাকঘর ঘেঁষেও চারটি নারিকেল তরু। গাছ থাকলে কি হবে নারিকেল বাড়িওয়ালার। সময় মতো বাড়িওয়ালার লোকজন এসে নারিকেল কেটে নিয়ে যেতো। মনখোশ থাকলে দু’চারটি নারিকেল আমাদের জন্য রেখে যেতো কোনো কোনো দিন। অশোকতলায় নারিকেলগাছ এগুলো বারবার পিছলে পিছলে পড়ে যায় মন থেকে। তখন সেখানে কেবল ঈদের ভাবনা এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফালাফি করে।
আমি দুই ক্লাসে পড়ি। ১৯৫৭ সালের মাঝামাঝি সময় তখন সম্ভবত। রামচন্দ্র পাঠশালা স্কুলের নাম। রানীর বাজারের কাছাকাছি ছিল পাঠশালাটি। রোজা এবং পূজার বন্ধ একসাথে হয়ে গেল। এমনটাই নিয়ম ছিল সে সময়। বন্ধ ঘোষণার দিন। ক্লাসে ক্লাসে অনেক মজা হতো। ফুলটোল এনে সাজানো হতো প্রতিটি ক্লাস। ক্লাস স্যারকে উপহার দেয়ার রেওয়াজ ছিল এই দিনে। উপহার থাকতো ধুতি পাঞ্জাবি ছাতা ইত্যাদি। ছাত্ররা চাঁদা তুলেই এসবের আয়োজন করতো। তখন প্রতিটি স্কুলেই খুশির হুল্লুড় বইতো। এই আনন্দেরও পাতা ঝরে গেছে বেশ আগে। এখন মনের দরজায় ঝুলছে ঈদ আনন্দ। কেবল দিন গুনছি কখন যাব আগানগর। ঝাঁপিয়ে পড়বো ঈদ পুলকে। আম্মা তৈরি হচ্ছেন কদিন থেকেই। সপ্তাখানেক বাদেই ঈদ। রেলগাড়ি তারপর নৌকা। পথে অনেক ধকল। তাই ধীরস্থির হয়ে যাত্রার ব্যবস্থা। দরকারি জিনিসপত্র যাতে বাদ না পড়ে সে দিকে নজর রাখছেন আম্মা। আমি এবং ছোটরা খুশিতে দশখান। নানাবাড়ি যাচ্ছি আনন্দ হবে। ঈদের আনন্দ। এরি মধ্যে বড়মামা এসে গেছেন কুমিল্লায় আমাদের সবাইকে নেয়ার জন্য।
সকাল না দুপুরে রেলগাড়িতে চড়েছিলাম মনে নেই। প্রায় বিকালনাগাদ আশুগঞ্জ স্টেশন গিয়ে পৌঁছলাম। আগ থেকেই নৌকা হাজির ছিল নদীর ঘাটে। নানাদের নিজস্ব নৌকা এটি। রেলস্টেশন থেকে একটু দূরেই নদী। কখন গিয়ে পৌঁছাব নানাবাড়ি আঁকুপাঁকু করছে মন। লাফিয়ে গিয়ে উঠলাম নৌকায়। কারো সাহায্যের অপেক্ষায় থাকলাম না। আম্মা অবশ্য একটু ধমক দিলেন। যদি পড়ে যাই পানিতে? ভয়-ডর তখন আনন্দের তলায় চাপা পড়েছে। ছৈয়ের ভেতর বিছানা পাতা ছিল আম্মা সেখানে গিয়ে বসলেন। আমাদেরকে ছৈয়ের বাইরে যেতে বারণ করলেন। মেঘনার পানি কেটে কেটে আগে বাড়ছে নৌকা তরতর করে। নানা রঙে আঁকিবুঁকি ছিল নৌকা জুড়ে। ফুলটুল আঁকা ছিল দরজায়। অনেকটা পঙ্খিরাজের মতো। এ নৌকা চড়ে নানারা চলাফেরা করেন, বর্ষায়। এটাই ছিল তাদের রাজকীয় বাহন। নৌকার পাশ ঘেঁষে ভেসে যাচ্ছে কচুরিপানা, মাঝে মাঝে লাফিয়ে উঠছে নানা পদের মাছ। সাথে গাঙচিলের ওড়াউড়ি। নদীর মাঝবরাবর পাড়ি দিচ্ছে আমাদের পঙ্খিরাজ। দাঁড় টানছে দু’জন, আর একজন হাল ধরে আছে নৌকার পেছনে। হালকা বাতাসে বেশ মজাই লাগছে পানিপথে। নৌকার কপাট খুলে বসে আছি কখন পৌঁছে যাব নানাবাড়ির ঘাটে। এদিকে আম্মা বারবার সাবধান করছেন। দরজার কাছ থেকে সরে আসতে বলছেন। বড়মামা খোশগল্পে মজে আছেন মাঝিদের সাথে। এ নৌকার মাঝিরা মামাদের রায়ত। বছরভরই ওরা মামাদের ফুটফরমাশ করে। নৌকা বায়। ধান, পাট লাগায় কাটে। এই সুবাদে ওরা নানাবাড়ির লোকজনদের কাকা মামু ভাইজান বলে ডাকাডাকি করে। সেই রকম রিসতায় আমিও ওদের মামু। নৌকার মাঝিগণ আম্মাকে ডাকে বুবুজান। আলাপসালাপ আর দেখাদেখির কোন ফাঁকে মেঘনা পাড়ি দিয়ে ফেলেছে আমাদের নৌকা। দাঁড় গোটানো হয়ে গেছে। মাঝিদের হাতে এখন ইয়া লম্বা লগি। এসব নতুন আয়োজন দেখে বুঝলাম নানাবাড়ি আর বেশি দূরে নয়। একসময় ঘাটে এসে ভিড়লো নৌকা। তখন সূর্য ডুবু ডুবু। আগে থেকেই মামাতো ভাই-বোনরা অপেক্ষায় ছিল ঘাটে। একটা হৈ হৈ রৈ রৈ রব সারা বাড়ি জুড়ে।
কদিন বাদেই ঈদ। ঘরে ঘরে ঈদের আয়োজন। চালের গুঁড়ো কুটার ধুম বাড়ি বাড়ি। কোনো বাড়িতে চলছে হাতে বানানো সেমাই তৈরির ব্যবস্থা। তখন তো আর কলে বানানো সেমাইর চল ছিল না। থাকলেও তা শহর টহরে পাওয়া যেতো। বাড়ির বৌ-ঝিরা সেমাই কাটতো হাতে। ঈদ ভাবনা এবং ঈদ কাজ-কর্মে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতো প্রতিটি বাড়ি। বিশেষ করে মহিলারা। আমাদের মতো ছোটরাও ঘুমহীন, ঈদ আসছে এই খুশিতে। নানাবাড়িতেও ঈদের মহা আয়োজন। আমার আবার রাজহাঁসের গোশতো খুব পছন্দের। নানি জানতেন সে খবর। ঘরে পোষা বড় দু’টি রাজহাঁস ঠিক করা হলো, সাথে আরো দু’টি মোরগ। ঈদের দিন জবাই হবে। দেখতে দেখতে এসেই গেল ঈদ। হাঁস এবং মোরগের গোশতো দিয়ে ভোজ হলো মহা ধুমধামে। কিন্তু আনন্দের পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলো বিষাদও। ছোট খালার চোখ ফুলে ফুটবল। ফোলার কারণ জানা গেলো পরে। জবাই করা হাঁস দু’টি নাকি ছিল তার খুবই আদরের। হ
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ