ঈদ কার্ড

ঈদ কার্ড

তোমাদের গল্প অক্টোবর ২০১৩

মুহাম্মাদ রিয়াজ উদ্দিন গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটি নদী। প্রতাপকাঠি গ্রামের হাই স্কুলটি এই নদীর পাড়েই অবস্থিত। রাজিব প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত একই স্কুলে পড়েছে। কারণ হাই স্কুলের পাশেই প্রাইমারি স্কুল। দু’স্কুলের একটিই খেলার মাঠ। একই পুকুর সবাই ব্যবহার করে। অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষার পর একদিনই রাজিব স্কুলে এসেছিল। জেএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের পর। সার্টিফিকেট আর টিসি নিতে। অনিমেষ, রতন, ফারুক, মেহেদি আর রায়হানরা সেদিন রাজিবের সাথেই ছিল। রায়হান রাজিবের ছোট্ট বেলার বন্ধু। দুজনার ভেতর অনেক মিল। স্কুলের টিউবওয়েলের কাছে আসার পর রায়হান জানতে চায়, ‘রাজিব, যা শুনেছি তা সত্যি?’ কথাটির শোনার পর রাজিব চমকে ওঠে। মুখের ভাষা যেন হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ‘কী শুনেছিস রায়হান?’ কথাটি বলতে রাজিবের ভীষণ কষ্ট হলো অথচ কেউই বুঝতে পারেনি। ‘তুই নাকি এই স্কুলে আর থাকবি না? শহরে ভর্তি হবি?’ কিছুক্ষণ পর বলে ওঠে মেহেদি। পিনপতন নীরবতা। টিউবওয়েলের সামনেই দাঁড়িয়েছে সবাই। রাজিবের মুখ অন্ধকার। ওর কল্পনার মানসপটে ভেসে ওঠে এই স্কুলের সাথে ওর হাজারো স্মৃতিময় অনেক দৃশ্য। বিকেলে ফুটবল খেলা, সবার সাথে হৈ হুল্লোড়, ক্ষুধা পেলে পাশের বাজারে গিয়ে ফজলের দোকানে চা রুটি খাওয়া। রাজিব লাল চায়ের সাথে পাউরুটি পছন্দ করত তা ফজলের বেশ জানা ছিল। রাজিব গরম গরম চা খেয়ে ফেলত। ফজল রাজিবকে অনেক বকা দিয়েছে। রাজিবের এসবও মুহূর্তের ভেতর মনে পড়ে গেল। ‘কিরে রাজিব কথা বল।’ কয়েক মিনিটের নীরবতা ভেঙে বলে ওঠে ফারুক। রাজিব এই স্কুরের পরিচিত মুখ। পড়ার পাঠে যতটা মেধাবী এর চেয়ে বেশি ছিল খেলার মাঠে। কী ফুটবল আর ক্রিকেট। সমান পারদর্শী ছিল রাজিব। গ্রাম পেরিয়ে খেলার ডাক পেলে দূরেও যেত। ওর বাবা শহরে থাকায় এই স্বাধীনতাটুকু খুব সহজেই পেয়েছে। তবে পড়ার টেবিলেও বসত নিয়মিত। তাই ক্লাসের ফার্স্ট হওয়াটা হাতছাড়া হয়নি কখনো। ‘হু। যা শুনেছিস সব সত্যি। আমি বলব বলব করে বলা হয়নি। আর কীভাবেই বা বলতাম। আমারও তো ভীষণ কষ্ট হত বলতে।’ আস্তে আস্তে হাঁটছে রাজিব। স্কুলের বিজ্ঞানাগারের পেছনে এসে দাঁড়াল। এখানকার বড় তালগাছটির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে রাজিব। ওর সামনে সবাই। এখানে আসার পর সৈকত আর শরীফ এসে যুক্ত হয়। সৈকত আর শরীফ এমনই। এরা দুজন স্কুলের এইখানে এখন আছে তো খানিকক্ষণ পর অন্যখানে। কখনো কখনো হেড স্যারের রুমেও উঁকি মারে। শরীফের হেড স্যারের হাকিমপুরী জর্দা দিয়ে পান আনা এখন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শরীফ যখন হেড স্যারের সাথে কথা বলে তখন মনে হয় ও এ স্কুলের নির্বাচিত কোনো ছাত্র প্রতিনিধি অথচ সৈকত আর শরীফ পরীক্ষায় কাটায় কাটায় নম্বর পেয়ে পাস করে। তবুও ওরা ফেলুদের কাতারে কখনো যায়নি। শরীফের হাসিভরা মুখকে সবাই পছন্দ করে। আর রাজিবের সাথেও ছিল গলায় গলায় খাতির। রাজিব ওর বাবার কথা সব খুলে বলে। শহরে নামকরা একটি স্কুলের নবম শ্রেণীর ভর্তি ফরম তুলেছেন ওর বাবা। এবার মাকে নিয়ে যাবেন। গ্রামের বাড়িতে মাঝে মাঝে আসবেন তেমনিই রাজিবকে বলেছেন ওর বাবা। দুরন্ত সৈকতও এখন শান্ত দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। চোখের কোণে জমেছে কিছু নোনা জল। বন্ধুত্বের সম্পর্কটা কত গভীর তা যেন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সৈকত। শুধু সৈকতই নয় প্রত্যেকেরই ভেতর একই অনুভূতি। সৈকতের যেন বলতে ইচ্ছে করে- ‘রাজিব আমরা কেউই এই স্কুলে থাকব না।’ না। সৈকত মুখ খুলে কিছুই বলতে পারেনি। রাজিব কিছুটা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বলে, ‘রাগ করিস না তোরা। মাঝে মাঝে আসব। মাঠে এসে তোদের সাথে খেলব। এই বর্ষায় টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন ট্রফিটা আমাদের স্কুলে রাখতেই হবে।’ রাজিবের কথাগুরো সবাই শুনে যাচ্ছিল। তালগাছে কয়েকটি পাখি এসে কিচির মিচির শব্দ করছে। তালগাছের লম্বা পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে ওদের মুখে পড়েছে। রাজিব পাখিগুলো দেখার চেষ্টা করে। তালগাছের পাতার ওপর বসে লেজ নাড়িয়ে ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে। রাজিব ওদের সবাইকে খুশি করার চেষ্টা করে। ওদের কাউকে ভুলে যাবে না। সবাইকে নিয়মিত পড়ালেখা করার পরামর্শ দিতেও ভুল করেনি। এতোদিন যা ক্লাসে সবার সামনে যেমনটি বলত তেমনি বলে যাচ্ছিল। শুধু পার্থক্য এইটুকু ক্লাসে অনেক চিৎকার দিয়ে বলতে হত আর এখন বলছে শান্ত, ধীরে আর কান্না স্বরে। রাজিব স্কুলের অফিস থেকে সব কাগজ নিল। স্যারদের কাছে বলতেও ভুল করেনি। প্রতিটি বিদায়বেলা যেন কষ্টের আর কান্নার। রাজিবের চিরচেনা স্কুল থেকে বিদায় নিতেও কষ্ট হলো। বুকের ভেতর এক অচেনা কষ্ট নাড়া দিয়ে উঠল। যা দুচোখে বেরিয়ে আসল নোনা জলরূপে। রাজিব স্কুল, গ্রাম আর বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে শহরে এসেছে মাস কয়েক হয়ে গেছে। নতুন স্কুলে খাপ খাইয়ে নিতে বেশ কষ্ট হলেও এখন ভালোই লাগছে। মাঝে মাঝে অবসরে গ্রামের স্কুল বন্ধুদের কথা ভাবে। গ্রামের সেই দুরন্ত স্বাধীনতা নেই আছে নানা নিয়ম। স্কুলের বাউন্ডারির ভেতর থাকতে হয়। বাসায় এলেও স্বস্তি নেই। কত দিন যে খেলার মাঠে দৌড়াতে পারছে না রাজিব। মাঝে মাঝে এসব ওকে ভীষণ নাড়া দেয়। বিকেল কিংবা বৃষ্টি হলেই মনে পড়ে গ্রামের ফুটবল খেলার পুরনো দৃশ্যগুলো। বাবাকে কয়েকবার বলেছিল গ্রামে যাবার কথা। অন্তত একদিনের জন্য হলেও রাজিব গ্রামে যাবে। বাবা তার অফিসের ব্যস্ততার কথা শোনায়। এ মাস না পরের মাস। বলতে বলতে এভাবেই রমজান মাস চলে আসে। গত রমজানে রাজিব গ্রামে ছিল। ইফতারির পর বন্ধুদের সাথে একত্রে মসজিদে যাওয়া, নামাজ শেষে বাড়ি ফেরা এসব কেবলই এখন স্মৃতি। রমজানের মাঝের দিকে রাজিবকে বাবা মা ঈদের কেনাকাটা করতে যায়। সবার পছন্দ মতো পোশাকাদি কেনা হয়। রাজিব ফেরার পথে ঈদ কার্ড কিনবে জানায়। পছন্দ মতো হরেক রকমের ঈদ কার্ড কিনে রাজিব। বাসায় এসে প্রতিটি কার্ডের ভেতর সাদা কাগজে নামসহ গ্রামের বন্ধুদের ঈদের আমন্ত্রণ জানায়। ওর এই আমন্ত্রণে কেউ সাড়া দিতে পারবে না জেনেও রাজিব বন্ধুদের ঠিকানায় কার্ড পাঠানোর সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। পুরো একটি বছর গ্রামের স্কুলের বন্ধুরা বদলে গেছে। কেউবা অনিয়মিতভাবে স্কুলে আসছে। রাজিবকে ওরা বড্ড মিস করছে। স্কুল মাঠে খেলা হয় কমবেশি সবাইকে দেখা যায় শুধু রাজিব নেই। রাজিবের হাসিমাখা কথার আওয়াজ নেই। ঠিক ঈদের কয়েক দিন আগে রাজিবের পাঠানো ঈদ কার্ডগুলো গ্রামের বন্ধুদের ঠিকানায় পৌঁছে যায়। রাজিবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রায়হান ওর পাঠানো কার্ড হাতে পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলে। চোখ দুটি বড় করে খাম খুলে পড়ল, ‘রায়হান, ঈদে বাড়িতে আসার ভীষণ ইচ্ছে ছিল। কিন্তু যাওয়া হল না। আমি তোদের কাউকে ভুলিনি। ঈদ মোবারক।’ রায়হান এবার দরজার দিকে তাকাল। ততক্ষণে ডাক পিয়ন অনেক দূর চলে গেছে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ