ঈদ এলে বাবাকে মনে পড়ে

ঈদ এলে বাবাকে মনে পড়ে

স্মরণ আগস্ট ২০১২

জাহানারা আরজু..

ঈদ এলে আমার বাবাকে মনে পড়ে
সুঠাম দেহী বাবার পরনে ঘিয়ে রঙ
শেরোয়ানি, মাথায় রক্তলাল রুমি টুপি
সুরমা আঁকা ডাগর দু’চোখ
ঈদগাহে যাবার ব্যস্ততা, সে আমার বাবা
যিনি আজিমপুরের কবরগাহে ঘুমিয়ে
এখন, শিয়রে ঝরছে তাঁর অগণন
কামিনী ফুলের নিঃশব্দ সফেদ শিশির!
বাবার হাতে চাঁদরাতে নিয়ে আসা
ছোট্ট একটি প্যাকেট, যার ভেতর রয়েছে
স্নেহের উত্তাপে জড়ানো ফুল তোলা
একটি লাল জামা!

বাবা ডাকেন ‘খুকুমা, এই নে তোর
লাল জামা, পরে ফেল, দেখি তোকে কেমন মানায়।’
বাবার কণ্ঠ, জামার নতুন ঘ্রাণ
আকাশে রূপালী ঈদের চাঁদ
আম-জাম-কাঁঠাল বাগানের
ফাঁক দিয়ে দু’চোখে ঝিকিয়ে ওঠে
আনন্দ আবেগে হাজারো খুশির ফুলকি
নীল আসমানে তারাবাতি হয়ে জ্বলে।

আমার নিজের লেখা কবিতা থেকেই এই অংশটুকু তুলে দিলাম।
ঈদ মানেই আনন্দ। মুসলিম বিশ্বে এ আনন্দের বার্তা শওয়ালের চাঁদ ওঠার সাথে সাথেই আকাশের নীলে মহান আল্লাহ যেন সে লিপি পাঠিয়ে দেন। বিশ্ব নিখিলের ঘরে ঘরে এ আনন্দের ঢেউ উপচে পড়ে।
পর্নকুঁড়ের ভাঙা চালা থেকে সুরম্য প্রাসাদ পর্যন্ত ঈদের আনন্দবার্তা ঘোষিত হয়। ভৌগোলিক অবস্থানভেদে এবং ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের জন্য এ আনন্দের বহিঃপ্রকাশ এবং রূপরেখা ভিন্নভাবে আমাদের কাছে ধরা দেয়।
মনে মনে প্রশ্ন জাগে কেন এই বৈষম্য! এ প্রসঙ্গে আমি পঞ্চাশ দশক থেকে আজও আমার বিভিন্ন কবিতায় বলতে চেষ্টা করেছি। আমি লিখেছিÑ
এ আকাশ মরে গেছে বহু আগে
কেন ওঠে চাঁদ তবু
ক্ষুধাতুর বুকে প্রতিদিন রোজা
ঈদ তো আসেনি কভু!

দুই.
ছোটবেলায় ঈদ সম্পর্কে আমার অনুভূতি এই নিবন্ধের আমার কবিতা থেকে ক’টি লাইন তুলে দিলাম। আমাদের ছোটবেলার সময় ঈদের আনন্দ প্রচুর উপভোগ করছি। তখন এ যুগের মত এত আড়ম্বর না থাকলেও আনন্দ ছিল প্রচুর। এ যুগের প্রাচুর্য এবং অঢেল বিত্ত-বৈভবের ভেতরে নয়। আমাদের সময় পারিবারিক বন্ধনে আমরা পরিতৃপ্ত ছিলাম এবং আমাদের চাহিদা খুবই সীমিত ছিল।
ঈদের আগের দিন অর্থাৎ চাঁদরাত থেকে মা এবং দু’জন কাজের লোক নিয়ে (ঝি) প্রচুর রান্না-বান্নায় ব্যস্ত থাকতেন। আমরা খুব ভোরে উঠে গোসল সেরে নিতাম। বাবার হাতের আগের দিনের দেয়া ঈদের জামা-জুতা পরে ফেলতাম। মা এসে চুল আঁচড়িয়ে চুলের ক্লিপ লাগিয়ে দিতেন। আমার পিঠাপিঠি ভাইয়েরা, ওরাও বাবার কেনা নতুন জামা-কাপড় পরে নিত। ঈদগাহ বাবার সাথে যাওয়ার জন্য তৈরি হতো। আমরা মেয়েরা কখনই ওদের সাথে যেতে পারতাম না। তখন মেয়েদের যাওয়ার রেওয়াজ ছিল না।
বাবাকে দেখতাম, ঘিয়ে রঙের শেরোয়ানি পরা মাথায় খয়েরি রঙের উঁচু রুমি টুপি, যার পাশ দিয়ে কালো ঝুলানো লেজ ছিল। সাদা পাজামা এবং কালো পাম সু পরিহিত। ঐ দিন বাবা সুগন্ধি আতর মাখতেন এবং চোখে সুরমা লাগাতেন। ততক্ষণে মা রান্নার কাজ অনেকটা গুছিয়ে বের হতেন। সদ্যস্নাতা মায়ের গা থেকে মনে হতো যেন চাঁপা ফুলের সুগন্দ ছড়াচ্ছে। আমার মা ছিলেন উজ্জ্বল গৌর বর্ণে অত্যন্ত সুন্দরী। আমরা টুপটাপ করে ভাই-বোনেরা মা-বাবাকে সালাম করতাম। বাবা দুধে ভেজানো কোরমা, ফিরনি, ক্ষীর (পায়েস), সেমাই খেয়ে ঈদের জামাতে যেতেন। বাবাকে দেখতাম, বাবা জামাত থেকে ফিরে বাড়ির বেটাছেলে, কাজের লোক থেকে শুরু করে আত্মীয় এবং অনাত্মীয় সকলের সাথে কোলাকুলি করতেন।
বাড়ির দেউরিতে আমাদের কাজের বড় ছেলেটি বড় একটা ধামা (বেতের তৈরি পাত্র) এবং বড় একটি গামলায় খাবার নিয়ে বসতো। ধামায় থাকতো গোশত দিয়ে রান্না করা খিচুরি এবং গামলায় থাকতো দুধের মিষ্টি ক্ষীর। আমাদের এলাকায় ঈদের দিন সকাল থেকেই ভিখেরিরা আসতে থাকতো, তাদেরকে ক্ষীর ও খিচুরি দিয়ে দেয়া হতো।
আমাদের বসবাস ছিল মফস্বল শহরে, বাড়ির নাম বনশ্রী। বর্তমান মানিকগঞ্জ জেলা। এখানে আমার শৈশব থেকে বড় হওয়া এবং লেখাপড়ার স্কুলজীবন শুরু। পরবর্তী সময় ঢাকা ইডেন কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ এম এ করি।
ঈদের দিন আমাদের সময়ে মুরব্বিদের সালাম করেছি। তাঁরা প্রাণভরে আমাদের দোয়া করেছেন, সে যুগে ঈদ-ই দেয়ার রেওয়াজ ছিল না।
আমাদের সময় ঈদ উপলক্ষে তেমন কোন অনুষ্ঠান হতো না তবে গ্রামের দিকে মেলা হতো।
আমাদর সব ঘরে ঘরেই আদর আপ্যায়নÑ প্রচুর খাওয়া দাওয়া হতো।
ঈদ উপলক্ষে ঈদসংখ্যা পত্রিকা আমাদের বাড়িতে বাবা রাখতেন। এটা ছিল আমার কাছে অনেক বড় আকর্ষণ। মনে পড়ে, ঈদসংখ্যা আজাদ, সওগাত, ইত্তেহাদ, নওরোজ, বেগম প্রমুখ পত্রিকা। এসব পত্রিকাতেই অবিভক্ত বাংলার ১৯৪৫ সাল থেকে আমার কবিতা, গল্প ছাপা হতে থাকে। বিশেষ করে ঈদসংখ্যাগুলাতে।
আল্লাহর রহমতে একবিংশ শতাব্দীতে এসে আজও ঈদসংখ্যায় বিভিন্ন পত্রিকায় লিখে চলেছি। পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের জন্য বিভিন্ন পত্রিকায় লিখছি। এ ছাড়া আমার প্রকাশিত বই অর্ধশতের ওপরে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, নাটক (শিশু-কিশোরদের জন্য) রয়েছে।
শিশু-কিশোর সাহিত্যের ভাণ্ডারে আমার ছড়া কবিতা স্মৃতিকথা মিলিয়ে এ যাবৎ ১২টি প্রকাশিত বই রয়েছে। হাতে রয়েছে অপ্রকাশিত কয়েকটি পাণ্ডুলিপি। প্রায় ছয় বছর ধরে আমি অসুস্থ। আমি স্ট্রোকজনিত অবস্থায় আক্রান্ত। আমি সকলের দোয়াপ্রার্থী

উপসংহারে আমার প্রার্থনা, সর্বকালে সব শিশুর জন্য শুধু একটি দিনের ঈদ-আনন্দ নয়। নিত্যদিনের আনন্দ যেন সব শিশুই উপভোগ করতে পারে। আমাদের সমাজব্যবস্থা যেন সেভাবেই গড়ে ওঠে।
আমার কবিতায় তাই বলি-
শাওয়ালের চাঁদ তুমি আস, তুমি আস,
মৃত মরুর বিয়াবানে খুশির পরাগ ছড়িয়ে দাও।
সব মানুষের মুনাজাতে তুমি আবার সবার হও!

 


                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ