ঈদ এক অবারিত আনন্দের স্রোতধারা

ঈদ এক অবারিত আনন্দের স্রোতধারা

ফিচার আগস্ট ২০১২

আনিসুর রহমান..

মাসব্যাপী কঠোর সিয়াম সাধনার পর বিশ্ব মুসলমানদের মাঝে আবার আনন্দের বার্তা নিয়ে আগমন করেছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। বিশ্বের প্রতিটি  জাতির জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিন আছে যে দিনে তারা তাদের নিজস্ব রীতি-নীতি ও অনুষ্ঠানের প্রচলন করে থাকে। সভ্য-অসভ্য প্রত্যেক জাতির মধ্যে এ প্রচলন দেখতে পাওয়া যায়। অন্যান্য সাধারণ দিনের তুলনায় এ দিনগুলোতে  তারা পোশাক পরিচ্ছদ ও মেলা মেশার পদ্ধতির মধ্যেও বেশ পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যায়। বিশ্ব মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে বড় উৎসব হলো ঈদ। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পাশাপাশি চলে ঈদের কেনাকাটাসহ অন্যান্য প্রস্তুতি। সেই সাথে দূরের কাছের সব বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে মোবাইলের মাধ্যমে এসএমএস বিনিময়, পুরো মাস জুড়েই যেন চলতে থাকে ঈদের খুশির জোয়ার। ঈদের  আনন্দ শুরু হয় মূলত রমজান মাস থেকে এবং চলতে থাকে ঈদের পর কমপক্ষে সপ্তাহ জুড়ে। সবার ভিতর যেন নতুনের অবগাহন। নতুন জামা-জুতা, নতুন টুপি, নতুন সুগন্ধি চারদিকে নতুনের আহবান। এ নতুন যেন আমাদেরকে আগামী একটি নতুন সমাজ বির্নিমাণের ডাক দিয়ে যায়। নতুনের এ আনন্দ ধনী-গরিব, আমীর-ফকির, সবার মাঝে চলতে থাকে সমানভাবে। যার যতটুকু সাধ্য আছে সে তার সাধ্যানুযায়ী খুশির আমেজে নিজেকে আবদ্ধ করার প্রয়াস চালায়। 
ঈদের নামকরণ : ঈদ আ’ওদুন ধাতু থেকে উৎসারিত একটি আরবি শব্দ যার অর্থ বার বার ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা। প্রতিবৎসর নিয়মিতভাবে দু’বার এর আগমন ঘটে তাই এর নাম ঈদ।
আবার এই দিনে আল্লাহ তা’য়ালা বিশেষ রহমত সহকারে বান্দার প্রতি প্রত্যাবর্তন করেন তাই এর নাম ঈদ।
আবার প্রতিবছর ঈদ আনন্দের অবারিত ঝর্ণাধারা নিয়ে প্রত্যাবর্তন করুক, ফিরে আসুক, মুসলিম উম্মাহ্ এর দ্বারা উপকৃত হোক এই শুভ কামনার দিকে লক্ষ করে এর নামকরণ করা হয়েছে ঈদ।
ঈদের আগমনের ইতিকথা : ইসলামে ঈদের আগমন ঘটে আমাদের প্রিয় নবীজির (সা) মদিনায় হিজতের পর। নবীজি (সা) মদিনায় গিয়ে দেখলেন পারসিক প্রভাবে মদিনাবাসীরা তখনও শরতের পূণিমায় নওরোজ উৎসব এবং বসন্তের পূর্ণিমায় মিহ্রিজান উৎসব নিয়মিতভাবেই উদযাপন করছে। এই উৎসবগুলি ছিল বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও আনন্দ ভরা, ইসলামী রিতিনীতির পরিপন্থী এবং বিজাতীয় সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত। তাই নবী (সা) মুসলমানদেরকে ওই উৎসব দু’টি  থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের জন্য  পুতঃপবিত্র ও অনেক আনন্দের দুটি দিন নির্ধারণ করেছেন, তা হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা।
ঈদ আনন্দ প্রাণে প্রাণে : ২৯ রমজান থেকে শুরু করে ৩০ রমজান শাওয়ালের ঈদের বাঁকা সরু চাঁদ খানা দেখার জন্য ইফতার করেই মাগরীবের নামাজ পড়েই ছুটে চলে মসজিদের পশ্চিম পাশে কেউ কেউ মসজিদের ছাঁদের উপরে চড়ে ওঠে। শিশু-কিশোর, অবাল-বৃদ্ধ সবাই উঁকি দেয় যেন সরু চাঁদটিকে বাঁশের লগি দিয়ে নামিয়ে আনার অপচেষ্টা। চাঁদ দেখার পর থেকে তাকবির ধ্বনি দিয়ে সারা গ্রাম জানিয়ে দেয় ঈদের বাঁকা চাঁদ দেখা গেছে, আগামীকাল পবিত্র ঈদুল ফিতর।  চলতে থাকে আনন্দের মিছিল। রাত যতই গভীর হয় ভারি হয়ে ওঠে মিছিলের ধ্বনি, সেই সাথে চলতে থাকে ঈদগাহ সাজানোর কাজ। গ্রামের মুরব্বী থেকে শুরু করে শিশুরাও শামিল হয় ঈদগাহ সজ্জিত করার কাজে। সারা রাত যেন আর দু’চোখে ঘুম আসে না। ফজরের আজানের সাথে সাথে মসজিদের দিকে ছুটে চলে পুলকিত মনে। নামাজ শেষে শুরু হয় মসজিদ থেকেই ফিরনি পায়েশ খাওয়ার পালা এ যেন একমাস না খাওয়ার কাফ্ফারা আদায়। সকাল থেকে শুরু হয় গোসল, পুকুর পাড়গুলো ভরে ওঠে নতুন বাহারী গন্ধের সাবান-শ্যাম্পুর মুগ্ধকরা সৌরভে। এরপর নতুন জামা কাপড়ের বাহারী নকশা খচিত পাঞ্জাবী মনকাড়া আতরের গন্ধে চারদিক মুখরিত করে তোলে। উচ্চস্বরে তাকবির বলতে বলতে সবাই ছুটে চলে ঈদগাহের পানে। দেখে মনে হয় যেন মক্কা অথবা মদিনার পথের কোন কাফেলার সারিÑ কারো মনে কোন হিংসা নেই, নেই কোন বিদ্বেষ। সবার মনে এক জান্নাতি আবহ তৈরি হয়, দেখে দ’ুচোখ জুড়িয়ে আসে। পস্পরের প্রতি সালাম বিনিময়, ছোটরা বড়দের সালাম করে ঈদ ছেলামী আদায় করে এটা ছোটদের প্রতি বড়দের নতুন এক দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ করে তোলে। ঈদের নামাজ শুরু হওয়ার আগে গ্রামের আলেম ওলামা ও মুরব্বিরা বয়ান করতে থাকেন। যেন বছরজুড়ে পুরো রমজানের শিক্ষা কার্যকারী করার শেষ সবক। নামাজ শেষ করেই শুরু হয় এক অবারিত আনন্দের স্রোতধারা। একে আপরের সাথে কুলাকুলি, মাসফাাহা যেন শত বছরের হিংসা, বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে একে অপরের প্রতি সবটুকু দরদ দিয়ে কাছে টেনে নেয়া। এক স্বর্গীয় ভ্রাতৃত্বের সীসা ঢালা প্রাচীরের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। মনে হয় মাটির পৃথিবীতে এক নতুন সুখ ও শান্তির সভ্যতার অভ্যুদয় ঘটেছে। আহ! কী আনন্দ ঈদের এই পবিত্র দিনে। এই পবিত্র ও সুন্দরতম আদর্শের দৃষ্টান্ত অন্য কোন জাতি বা ধর্মের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না।
সৃষ্টি ও স্রষ্টার প্রতি মানুষের কর্তব্যবোধের চেতনাকে জাগিয়ে তুলে তা বাস্তবায়নের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ইসলামের বিভিন্ন ইবাদত আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন। ঈদের প্রকৃত আনন্দও যেন সেই কর্তব্যবোধকে আরো একবার জাগিয়ে দেয়। দীর্ঘ সিয়াম সাধনার পর যে ঈদ আমাদের মাঝে আনন্দ ফল্গুধারা প্রবাহিত করে দিল, মহামিলনের এ দিনের শেষেও যেন এ আনন্দ জাগরুক থাকে প্রতিটি অন্তরে, গড়ে তোলে এক ঐক্যের  সৌধ যা আমাদেরকে উৎসাহিত করবে সুখী ও সমৃদ্ধশালী এক সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার।

 
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ