ঈদ আসে

ঈদ আসে

তোমাদের গল্প আগস্ট ২০১৩

সুমাইয়া বরকতউল্লাহ্
আমি ছোট্ট একটা মানুষ। আর আমার মাথায় এসে ঘুর ঘুর করছে যত্তসব আজব চিন্তা।
গ্রামের গরিব মানুষেরা ঈদে কী খাবে, কী পরবে, বড়লোকের ছেলে-মেয়েরা যখন নতুন জামা-জুতো পরে আনন্দে টগবগ করবে, অনেক মজার মজার বাহারি খাবার খাবে, গরু জবাই করবে তখন এ গরিবদের মনের অবস্থাটা কেমন হতে পারে? কেমন কাটবে ওদের ঈদ? এসব নিয়ে চিন্তা করছি আমি। কিন্তু করতে পারছি না কিছুই। আমি মন খারাপ করে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
গভীর রাত। দরজা-জানালা কেঁপে উঠল। ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। চোখ কচলাতে কচলাতে তাকালাম। দেখি আমার ঘরে একটা দৈত্য এসে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ঙ্কব চেহারা তার। আমি দৈত্য দেখে ভয়ে একেবারে ‘থ’ হয়ে গেলাম! আমার মুখ থেকে কোনো রা বের হচ্ছে না।
‘আপনি আমাকে ভয় পাবেন না। আমি এ পথ ধরে যাচ্ছিলাম। আপনার কষ্ট কষ্ট মুখটা দেখে চলে এলাম। আমি আপনার একটা ইচ্ছা পূরণ করতে এসেছি। বলুন আপনার কী ইচ্ছা।’ গম গম আওয়াজ করে বলল দৈত্যটি।
আমি দৈত্যের কথা শুনে ভয়ের মধ্যেও আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললাম, ‘সত্যি তুমি আমার ইচ্ছা পূরণ করবে দৈত্য?’
‘আমরা কখনো মিথ্যা বলি না। আপনি শুধু একটা ইচ্ছা পূরণের জন্য আদেশ করতে পারবেন আমাকে, এর বেশি না।’ বলল দৈত্য।
মহাচিন্তায় পড়ে গেলাম আমি। ‘ইশ্, একটা মাত্র ইচ্ছা! কী বলা যায়, কী চাওয়া যায়, কোন্টা বলি।’ মাথা চুলকাচ্ছি আর ভাবছি। চট্ করে মনে হলো, ‘আরে, আগামীকালই না ঈদ। কত গরিব মানুষ না আছে গ্রামে। তারা তো ভালো কাপড় পরতে পারে না, ভালো খেতেও পারে না। আমি তাদের জন্য কিছু চাই না কেন দৈত্যের কাছে?’ আমি আনন্দে শরীর ঝাঁকিয়ে ঝটপট দৈত্যকে আদেশ করে বললাম, ‘যত গরিব-দুঃখী আছে, এবারের ঈদে এদের সবাইকে মহা আনন্দে ঈদের উৎসব করার ব্যবস্থা করে দাও।’
‘এ কী বলছেন আপনি! সবাই তো খালি নিজের জন্য টাকা-পয়সা, সোনা-দানা, বাড়ি-গাড়ি আর জায়গা-জমি চায় আর আপনি এসব না চেয়ে কী চাইছেন এগুলো? এতে আপনার কী লাভ?’ অবাক হয়ে বলল দৈত্য।
আমি বললাম, ‘এতো লাভ-ক্ষতির হিসেব করার দরকার নেই আমার। এর মধ্যে বিরাট আনন্দ আছে আর এটাই আমি চাই।’
দৈত্যটি খুশি হয়ে ঘর-বাড়ি কাঁপিয়ে হাঃ হাঃ হাঃ, হিঃ হিঃ হিঃ করে বলল, ‘এর চেয়ে ভালো আদেশ আর হয় না। এতে আমারও আনন্দ। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমি আপনার এই মহৎ ইচ্ছাটা অবশ্যই পূরণ করব।’ এ কথা বলে দৈত্যটি হাঃ হাঃ হাঃ করে লাটিমের মত ঘুরতে ঘুরতে আমার সামনে থেকে উধাও হয়ে গেল।
ঈদের দিন। গরিবেরা গোসল করে জামা পরতে গেল। ওরা পুরনো জামা ধরে টান দিতেই হরহর করে হাতে চলে এলো চকচকে নতুন জামা। চিকচিক করছে জামাগুলো। নানা রঙের আর নানা ডিজাইনের জামা। চকির তলে পুরনো ছেঁড়া জুতো। পা দিয়ে টেনে আনল। দেখে, নতুন জুতোর জোড়া। অসম্ভব সুন্দর কারুকাজ করা! এমন করে হাতে চলে আসতে লাগল কামিজ, সেলোয়ার, ওড়না আর কাতান, জামদানি, বেনারশি শাড়ি। চলে এলো বাহারী পাঞ্জাবি, পায়জামা আর টুপি। এত সুন্দর জামা-জুতো ওরা জীবনেও দেখেনি। ওরা ওসব হাতে নিয়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুই বুঝতে পারছে না তারা। অবাক কাণ্ড!
ওরা পাড়ার লোকেদের এই আজব ঘটনা বলার জন্য ছুটে চলেছে। দেখে, যাদের কাছে যাচ্ছে তারাও এমন জামা-জুতো হাতে নিয়ে ছুটাছুটি করছে আর নাকে-মুখে এসব ঘটনা বলছে। গ্রামের অসংখ্য গরিব শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ নারী-পুরুষ হাসি হাসি মুখে বলাবলি করছে এই অদ্ভুত ব্যাপারটি!
নাস্তা করে রওনা দিবে ঈদগাহ মাঠে। গরিবেরা সেই পুরনো খাবারই খাবে আজ। কিন্তু পাতিলে চামচ দিতেই দেখে পায়েস, ফিরনি, পোলাও, জর্দা আর নানাজাতের মজার খাবার বেরিয়ে আসছে! তারা চোখ বড় করে হা-করে রইল। আঙুলে একটু নিয়ে চেটেচুটে দেখল। ওহ্ কী মজার খাবাররে বাবা! শুরু করে দিল খাওয়া। আহা, পরাণভরে খেল সবাই। এমন মজার খাবার খায়নি তারা কোনোদিন।
সবাই ঈদগাহ মাঠ হতে নামাজ পড়ে হাসি মুখে চলে এলো বাড়ি।
ঈদের দিন পোশাক-আশাকে, খাবার-দাবারে আনন্দ-ফূর্তিতে ছোট-বড় আর ধনী-গরিবের মধ্যে কোনো পার্থক্য বোঝা গেল না। আনন্দের বান ছুটেছে গ্রামে। কী মজা! এমন ঈদ আর হয় না। সবাই আফসোস করে বলতে লাগল, ‘আহারে, সারাটা বছর যদি এমন আনন্দের হতো!‘
কিন্তু একি! ঈদের পরের দিন দেখি সবাই আবার আগের মতো হয়ে গেছে! ধনীরা ধনী আর গরিবেরা গরিব। আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
পরের দিন দৈত্যটি এলো আবার।
আমি বললাম, ‘সারাবছরের জন্য সবাইকে ঈদের দিনের মতো করে রাখা যায় না, দৈত্য?’
‘না, না, না, রাখা যায় না। আমি তা পারি না। এটা করবে মানুষেরা।’ বলল দৈত্যটি।
আমি বললাম, ‘তোমার মত এত শক্তি-সামর্থ্য তো মানুষের নেই, ক্ষমতাও নেই। কীভাবে করবে?’
‘ভুল, বিলকুল ভুল বলেছেন আপনি। আমার মতো অনেকগুলো দৈত্যের যে শক্তি-সামর্থ্য আছে একটা মানুষের মধ্যে এর চেয়ে ঢের বেশি শক্তি আছে। কিন্তু আপনারা নিজেরাই আপনাদের শক্তির খবর রাখেন না’। দৈত্যটি বলল।
আমি বললাম, ‘আমি তো সারাদিনই মানুষের জন্য ভালো কিছু করার চিন্তা করি, কই, আমি তো কিছুই করতে পারি না। তুমি তো চোখের পলকেই তা করতে পারলে।’
‘আমি ইচ্ছা করলেই সব কিছু করতে পারি না, কিন্তু আপনারা পারেন। আমি খালি চমক দেখাতে পারি। এই যে মানুষে মানুষে এতো ভেদাভেদ, এতো সুখ আর দুখ এগুলি তো মানুষেরই তৈরি করা। আপনারা মনে-প্রাণে চাইলে আর চেষ্টা করলেই মানুষের মধ্যে এতো পার্থক্য ও দুঃখ-কষ্ট কমাতে পারেন, অসাধ্যকে সাধন করতে পারেন আর অসম্ভবকে করতে পারেন সম্ভব। কারণ মানুষ যা ভাবে তা করতে পারে, আর কেউ তা পারে না।’ এ কথা বলেই দৈত্যটি ঘর-দোর কাঁপিয়ে হাঃ হাঃ হাঃ, হিঃ হিঃ হিঃ, হোঃ হোঃ হোঃ  করে পাক খেতে খেতে উধাও হয়ে গেল।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ