ইসলামে ঈদ উৎসব ও ঈদুল ফিতর

ইসলামে ঈদ উৎসব ও ঈদুল ফিতর

বিশেষ রচনা জুলাই ২০১৫

ইকবাল কবীর মোহন#

প্রত্যেক জাতির নিজেদের বিশেষ বিশেষ কিছু উৎসব আছে। এসব উৎসব বা পর্ব ঐসব জাতির পরিচয় বহন করে। কোনো কোনো জাতির লোকেরা নিছক আনন্দ পাওয়ার জন্য উৎসব পালন করে। কেউবা ঐসব জাতির বা গোষ্ঠীর স্বার্থগত বা ঐতিহ্যগত পরিচয় প্রকাশের জন্য উৎসব পালন করে। ইসলামী সংস্কৃতির অনন্য উৎসব ঈদ। এটি চিরাচরিত কোনো পর্ব নয়। দুনিয়ার অন্যান্য জাতির পর্ব বা উৎসব থেকে তা সম্পূর্ণ আলাদা। এই উৎসব না কোনো গোষ্ঠীগত স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করার জন্য পালন করা হয়, না কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণে পালন করা হয়। বরং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত হিসাবে পালিত হয় এই উৎসব। কারো ব্যক্তিগত উৎসাহে বা চিন্তাভাবনা থেকে এই উৎসব উৎসারিত নয়। বরং শুধু আল্লাহর নির্দেশ হিসাবে চলে আসছে এই পর্ব। এর মূল লক্ষ্য মানুষের আত্মসংশোধন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
ইসলামে ঈদ আল্লাহর পক্ষ থেকে ইসলামে দু’টি ঈদের কথা বলা হয়েছে। একটি ঈদুল ফিতর (যা রমজানের রোজা পূর্ণ করে পালন করা হয়)। অন্যটি ঈদুল আজহা (যা হজ বা কোরবানি উপলক্ষে পালন করা হয়)। ঈদ মানে আনন্দ, খুশি। তবে ঈদের সঠিক অর্থ বারবার আসা। ঈদ যেহেতু সময়ের ব্যবধানে পৃথিবীতে বারবার আসে সেহেতু ঈদকে এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। ঈদ পর্বটি নিয়ে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে। সুনানে আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত হজরত আনাস (রা) বলেন, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা) যখন মদিনায় হিজরত করেন তখন সেখানকার লোকেরা দু’টি দিনকে বিশেষ দিন বা পর্ব হিসেবে পালন করতো। ঐদিন তারা খেলাধুলা ও আমোদ-ফুর্তি করতো। মহানবী (সা) জিজ্ঞেস করলেন, এ দু’টি দিন কি? এমন কী কারণ আছে যে, তোমরা এদিন দু’টি পালন করছো? তখর লোকেরা বলল, এ দু’টি দিন এমন দিন, যা আমরা জাহিলিয়াতের যুগে পালন করতাম। তখন রাসূল (সা) বললেন, আল্লাহতাআলা তোমাদেরকে এগুলোর বদলে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার মতো দু’টি মহান দিন দিয়েছেন। তোমরা এগুলো পালন করবে। অতএব, আল্লাহর পক্ষ থেকে সরাসরি বরকত ও মঙ্গলময় দিন হিসেবে ঈদ উৎসব মুসলমানদের প্রতি নির্দেশিত হয়েছে। দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ ও মুক্তির দিন হিসাবে ঈদ পর্ব দু’টি আমাদের জীবনে এসেছে।
ঈদুল ফিতরের তাৎপর্যis2
ঈদুল ফিতর মুসলিম জীবনে একটি অনন্য দিন। এক মাস রোজা পালনের পর আসে এই ঈদ। রোজা পালনের মাধ্যমে মুসলমানরা নিজেদের পাপ ও পাশবিক প্রবৃত্তি দমন করে উৎসব হিসেবে পালন করে ঈদ। এ উৎসব পালনের মাধ্যমে মুসলমানরা আখিরাতে নাজাত পাওয়ার প্রয়াস পায়। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তারা যে গুণাবলি ও প্রশিক্ষণ অর্জন করে ঈদ উৎসব পালনের মাধ্যমে মুসলমানরা তাকে পরিপূর্ণ করে। এই উৎসব মানুষে মানুষে যে বিভেদের প্রাচীর তৈরি হয়, তাকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। ধনী-গরিব, আশরাফ-আতরাফ, রাজা-প্রজা, মালিক-শ্রমিকের ভেদাভেদ ভুলে মানুষ সেদিন একাকার হয়ে যায়। ঈদের দিনটি একজন মুমিনের জন্য বড় আনন্দের দিন। পরম প্রাপ্তির দিন। হজরত সাদ বিন আওস আনসারী (রা) থেকে বর্ণিত আছে, মহানবী (সা) বলেছেন, ঈদুল ফিতরের দিন ফেরেশতারা রাস্তার প্রতিটি গেটে দাঁড়িয়ে যায় এবং মুসলমানদেরকে ডেকে বলে, ‘হে মুসলমানগণ! তোমরা তোমাদের সেই পরম দাতা প্রভুর দিকে চল যিনি নিজ কৃপায় তোমাদেরকে শান্তি ও মঙ্গলের শিক্ষা দেন, তার ওপর আমল করার শক্তি দেন, অতঃপর এর ওপরই তোমাদেরকে পুরস্কৃত করেন। তোমাদেরকে তিনি রাতে নামাজে দাঁড়ানোর হুকুম করেছেন তোমরা তা পালন করেছো। তিনি তোমাদেরকে দিনের বেলায় রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন তোমরা তাও পালন করেছো। তিনি তোমাদেরকে আরো যে সব হুকুম করেছিলেন তোমরা তা পালন করেছো। অতএব, এখন তোমরা সেই মহান দাতা আল্লাহতাআলার সাথে সাক্ষাৎ করে ঐসব ইনাম ও পুরস্কারাদি নিয়ে এসো যা তিনি তোমাদের ঐ সমস্ত পুণ্য কর্মের ওপর নির্ধারণ করে রেখেছেন।’ অতঃপর যখন মুসলমানরা তাদের নামাজ শেষ করে তখন একজন আহবায়ক তাদেরকে এই বলে আহ্বান জানাতে থাকে : ‘তোমরা ভালোভাবে জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রভু তোমাদেরকে যথাযথভাবে পুরস্কৃৃত করেছেন, অতএব এখন তোমরা শান্তি ও মঙ্গলে ধন্য হয়ে নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাও। অতএব, ঈদের দিন প্রতিদান ও পুরস্কার লাভের দিন। এ কারণে আসমানেও এ দিনের নাম ‘ইয়ামুল জায়িযাহ’ বা ইনাম প্রাপ্তির দিন। (তারবানি)
ঈদ উৎসব শুরু হয় মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার মধ্য দিয়ে। আর তা সালাতুল ঈদ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত ঘোষিত হতে থাকে। ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈদের চাঁদ দেখবে তার উচিত পরের দিন ইমাম ঈদগাহে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত যেন তাকবির পড়ে।’ হজরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত মহানবী (সা) বলেছেন, ‘তোমরা  তোমাদের ঈদগুলোকে তাকবির (আল্লাহু আকবার ধ্বনি) দ্বারা সুসজ্জিত করো।’ তাকবির অর্থ হচ্ছে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করা। তাকবিরের ভাষা হচ্ছে : আল্লাহু আকবার আল্লøাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার আল্লøাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ। অর্থ হচ্ছে : আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা। এ উৎসবের অন্যতম পর্ব হচ্ছে দু’রাকাত নামাজ আদায় করা। এখানেও উচ্চারিত হয় আল্লাহতালার শ্রেষ্ঠত্ব ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি। is3
ঈদ উৎসব শুধু ধনীর জন্য নয়। মুসলিম সমাজের প্রতিটি মানুষ গরিব দুঃখী অসহায় সবাই সমানভাবে এতে অংশ নিতে পারে। সুতরাং ঈদের এই উৎসব শুধু আনন্দ উৎসব নয়, বরং এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব যা ইবাদতের শামিল।
ঈদুল ফিতরে করণীয়
ঈদুল ফিতরের দিন নিচের কাজগুলো পরিপালন করা ইসলামী শরিয়াহর নির্দেশিত হয়েছে।
তাকবির পাঠ : শাওয়ালের চাঁদ দেখার পর থেকে শুরু করে সালাতুল ঈদের খুতবা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত যথাসম্ভব তাকবির পাঠ করা উত্তম। তাকবিরটি হচ্ছে : আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ। অর্থ হচ্ছে : আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা।
গোসল করা, সুগন্ধি ব্যবহার এবং সুন্দর পোশাক পরিধান করা : হজরত হাসান ইবনে আলী তার পিতা আলী (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন- রাসূল (সা) আমাকে দু’ঈদে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান এবং সর্বোত্তম সুগন্ধি ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যত্র বলা হয়েছে, ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূল (সা) ফিতরের দিন সকাল সকাল হওয়ার পূর্বে গোসল করতেন।’
ঈদের সালাতের আগে খাবার গ্রহণ : ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের আগে কোন কিছু আহার করা উত্তম। তবে খেজুর খাওয়া সুন্নাত। আনাস (রা) বর্ণনা করেন, ‘রাসূল (সা) খেজুর খাওয়া ব্যতীত ফিতরের দিন অতিবাহিত করতেন না।’
সাদাকাহ প্রদান করা : এই দিনে ধনীদের পক্ষ থেকে গরিব দুঃখীদের জন্য নির্ধারিত পরিমাণ দান করাকে আবশ্যক করা হয়েছে। একে সাদাকাতুল ফিতর বলা হয়। বুখারী শরীফের এক হাদিসে বর্ণিত ইবনে উমার (রা) বলেছেন, রাসূল (সা) জাকাতুল ফিতরকে অত্যাবশ্যক করেছেন। এবং সালাতের আগেই তা দিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।’
চলার পথ পরিবর্তন করা : ঈদগাহে এক পথে যাওয়া এবং অন্য পথে ফিরে আসা সুন্নাত। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেন, ‘রাসূল (সা) ঈদের দিন ভিন্ন ভিন্ন পথে চলতেন।’
সালাত আদায় : ঈদের দিন তাকবির সহকারে দু’রাকাত সালাত আদায় করা ওয়াজিব। খোলা ময়দানে ঈদের নামাজ পড়া উত্তম। মসজিদেও এই নামাজ আদায় করা যেতে পারে। মহানবী (সা) একবার শুধুমাত্র বৃষ্টির কারণে মসজিদে সালাতুল ঈদ আদায় করেছেন।
খুতবা শ্রবণ : ঈদুল ফিতরের দিন সালাত শেষে ইমামের খুতবা শ্রবণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবু সাঈদ খুদরি (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূল (সা) ঈদুল ফিতর ও আজহায় বের হতেন এবং প্রথমে সালাত আদায় করে বসে থাকা জনগণের দিকে ফিরতেন, তিনি তাদেরকে উপদেশ দিতেন, দিকনির্দেশনা দিতেন।’
পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় : যুবাইর ইবনে নুফায়ির (রা) বলেন, ‘রাসূল (সা) এর সাহাবীগণ ঈদের দিন পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন।’
বৈধ বিনোদন : ঈদের দিন বৈধ খেলাধুলা বাজনাবিহীন গান করায় কোনো আপত্তি নেই। হজরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘ঈদের দিন হাবশার লোকেরা রাসূল (সা)-এর উপস্থিতিতে খেলা করতেন। আমি রাসূল (সা)-এর কাঁধের ওপর ভর দিয়ে তাদের খেলা দেখতাম।’

উপসংহার
ইসলামের প্রতিটি বিধানের তাৎপর্য রয়েছে। আপ্লাহপাক তার বান্দাদের প্রশিক্ষণ ও মঙ্গলের জন্য বিভিন্ন বিধান ও অনুশাসন চালু করেছেন। ঈদও আমাদেরকে অনুপম শিক্ষা প্রদান করে। আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি ঈদ আমাদেরকে পাপমুক্ত করে এবং একটি সুন্দর জীবন দান করে। সমাজের মানুষের মধ্যে ঈদ একটি পবিত্র সম্পর্ক গড়ে তুলে, দেয় ঐক্য ও সংহতির শিক্ষা, পারস্পরিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মানুষে মানুষে সহমর্মিতা প্রকাশের একটি মাধ্যম হলো ঈদ। আমরা ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য অনুধাবন করে এই উৎসব থেকে ফায়দা লাভ করতে সমর্থ হই-এই কামনা করছি। আমিন।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ