ইমাম গাজ্জালী

ইমাম গাজ্জালী

স্মরণ নভেম্বর ২০১২

ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম

ইমাম গাজ্জালীর নাম শোননি এমন কেউ তোমাদের মধ্যে হয়ত নেই। জ্ঞানের গভীরতায় এবং চিন্তার মৌলিকতায় বিশ্ব ইতিহাসে ইমাম আল গাজ্জালীর নাম অবিস্মরণীয়। মুসলিম ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তাধারার ইতিহাসে আল গাজ্জালী এক অনন্য স্থান দখল করে আছেন। তিনি হুজ্জাতুল ইসলামÑ ইসলামের প্রমাণ (Proof of Islam, Hujjatal Islam), জইনুদ্দীন বা বিশ্বাসের শোভা বা দ্বীনের অলঙ্কার (Ornament of Din- Zain al Din), দ্বীনের মুজাদ্দিদ- দ্বীনের পুনরুজ্জীবনকারী (Renwer, Mujaddid) ইত্যাদি উপাধি দ্বারা ভূষিত হয়েছিলেন। এই বিশ্ববিশ্রুত মহাপণ্ডিত তাঁর অসাধারণ প্রতিভা ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখনীর মাধ্যমে ইসলামবিরোধী সকল মতবাদকে চিরকালের মত ভ্রান্ত প্রমাণ করে ছেড়ে দেন। ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে নিঃসন্দেহে, ইসলামে তাঁর স্থান অতি উচ্চে। গাজ্জালীর পুরো নাম আবু হামিদ ইবনে মোহাম্মদ আল তুসী আস শাফী আল গাজ্জালী। তবে ইমাম গাজ্জালী হিসেবেই তিনি বিশ্বময় পরিচিত। ইরানের খোরাসানের অন্তর্গত তুস নগরে তিনি ১০৫৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন সৎ ব্যবসায়ী। শৈশবেই মা-বাবাকে হারানোর পর গাজ্জালী প্রতিপালিত হন তাঁর পিতার ধর্মপরায়ণ একজন বন্ধুর তত্ত্বাবধানে এবং গ্রহণ করেন উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষার সবরকম সুযোগ। অতিঅল্প বয়সেই তিনি পরিচিতি লাভ করেন জ্ঞান ও সত্যের অনুরাগী একজন অসাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে। ফিকহ, তাফসির, হাদিস, ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, নীতিবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে তিনি ব্যাপক অধ্যয়ন করেন। বিশ বছর বয়সে তিনি নিশাপুরে নিজামিয়া একাডেমিতে ভর্তি হন। সেখানে তিনি তৎকালীন ইমাম আল হারামায়েন নামে পরিচিত বিশিষ্ট আশারীয় ধর্মতত্ত্ববিদ ও পণ্ডিত আবু মালি আল জুয়াইনির অধীনে আসেন এবং তাঁর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর কাছেই গাজ্জালী ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা অধ্যয়ন করেন বলে জানা যায়। ইমাম আল হারামায়েন তাঁর ছাত্রদেরক পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেন এবং স্বাধীন মত প্রকাশের অনুমতি দেন। সকল প্রকার বিতর্ক ও আলোচনার কাজে নিয়োজিত থাকার জন্য ছাত্রদেরকে উৎসাহ প্রদান করা হয়। আর গাজ্জালী শুরু থেকে মহান পাণ্ডিত্যের প্রমাণ রাখেন এবং দার্শনিক উপায়ে চিন্তা করার দিকে ঝুঁকে পড়েন। মরমি তত্ত্ব অধ্যয়ন ও অনুশীলনে তিনি যার কাছ থেকে প্রত্যক্ষ সহায়তা লাভ করেন তিনি হলেন বিখ্যাত সুুফী আল ফারমাবী (মৃত্যু ১০৮৪ খ্রি.)। তাঁর মহান শিক্ষক ইমাম আল হারামায়েন ১০৮৫ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। আল গাজ্জালী তখন ২৮ বছরের উচ্চাকাক্সক্ষী ও উৎসাহী যুবক। ইসলামী বিশ্বে তার খ্যাতি ও পাণ্ডিত্য সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। আল গাজ্জালীর জীবনের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিলো সেলজুক সুলতান মালিক শাহের (১০৭২-১০৯২) বিদ্যানুরাগী মন্ত্রী নিজামুল মুলকের সঙ্গে পরিচয়। বস্তুত এ ঘটনার সাথেই ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল তাঁর কর্মবহুল ও সফল পাণ্ডিত্যপূর্ণ জীবন। নিজামুল মুলক নিজেও ছিলেন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি এবং জ্ঞানের প্রেমিক ও সাধকদের প্রতি তাঁর সমর্থন ও আনুকূল্য ছিল তুলনাহীন। অন্য কথায় নিজামুল মুলক জ্ঞান ও শিল্পের প্রচুর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং দরবারে উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময় জ্ঞানী-গুণীদের সমাবেশ ঘটাতেন। তিনি প্রায়শই বিতর্ক ও আলোচনার জন্য সভা ডাকতেন। এসব ক্ষেত্রে আল গাজ্জালী তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং অচিরেই তাঁর বিতর্ক কৌশল সবার নিকট সুপরিচিত হয়ে ওঠে। মুসলিম আইন, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনে আল গাজ্জালীর গভীর জ্ঞান নিজামুল মুলককে আকর্ষণ করে। তিনি গাজ্জালীকে বাগদাদে নিজামিয়া একাডেমিতে ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দান করেন। আল গাজ্জালীর বয়স তখন ৩৪ বছর। মুসলিম বিশ্বে এ পদ তখন ছিল অত্যন্ত গৌরবের ও অত্যন্ত সম্মানের। এ পদ ছিল লোভনীয় ও আকর্ষণীয় এক পদ। আল গাজ্জালীর পূর্ব পর্যন্ত এত অল্প বয়সে কেউ এ পদ অলঙ্কৃত করতে পারেননি। নিজামিয়া একাডেমির অধ্যাপক হিসেবে আল গাজ্জালী চরম সফলতা লাভ করেন। তাঁর উৎকৃষ্ট ভাষণ, জ্ঞানের গভীরতা এবং স্বচ্ছ ব্যাখ্যা তৎকালের প্রধান পণ্ডিতবর্গসহ বহুশ্রেণীর মানুষের মনোযোগ ও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তাঁর বাগ্মিতা, পাণ্ডিত্য এবং দ্বান্দ্বিক কৌশল প্রশংসিত হয়। তাঁকে আশারীয় ঐতিহ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। ধর্মীয় এবং রাজনীতির ব্যাপারে তাঁর উপদেশ গ্রহণ করা হয় এবং রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার তুলনায় তাঁর সুদক্ষ প্রভাব সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হতে থাকে। ইমাম গাজ্জালীর ন্যায় প্রতিভাশালী লেখক খুব কমই দৃষ্ট হয়। তাঁর অতুলনীয় লেখনী প্রতিভায় সুধীমণ্ডলী আশ্চর্যান্বিত হয়েছেন। তাঁর প্রণীত ক্ষুদ্র-বৃহৎ গ্রন্থের মোট সংখ্যা চারশত। তাঁর সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ কুরআনুল করীমের তাফসির। এটি ৪০ খণ্ডে বিভক্ত। ফিকহ বিষয়ে তাঁর গ্রন্থগুলো হচ্ছে ১. কে ওয়াজিজ ২. রিসালাতুল কুদসিয়া ৩. আল কুদউল মুখতাসার ৪. গায়েত উল গোর ফি মাসায়েল ইদদোর ৫. গাউ উদ দুবার ৬. কানুন উর রসুল। ব্যবহার তত্ত্ব বিষয়ে গ্রন্থগুলো হচ্ছেÑ ৬. আল মুসতাসফা ৭. আল মানহুল ওয়াল মুনতাহাল ৮. ওয়াজিজ ফিল ফুরু ১০. খোলাসাতুল ফিকাহ ১১. আদুল উল মনজুম ফি সিররিল মকতুম ওয়াসিত। দর্শন শাস্ত্রবিষয়ক গ্রন্থ হচ্ছে ১২. এহিয়াউল উলুম উদ্দীন ১৩. মাকাসিদুল ফালসিফা ১৪. আল ফিকরাত উল ইবরাহ ১৫. তাহফাতুল ফালাসিফা ১৬ আল মিনকাজ মিনাল জালাল ১৭. হাকিকাতুর রুহ ১৮. কিতাব উল আরবায়েন। নীতিশাস্ত্রবিষয়ক গ্রন্থ হচ্ছে ১৯. বাদায়া ইল হিদায়া ২০. কিমিয়ায়ে সাদাত ২১. তিবরুল মাসবুক। ধর্মতত্ত্ববিষয়ক গ্রন্থ হচ্ছে ২২. আল দুর উল ফি ফাকিরা ২৩. ইকতিমাদ ফিল ইতিকাদ ২৪. ফাজাহ উল আবাহিয়া ২৫. আল কিস্তাস উল মুস্তাকিম ২৬. তাদলিস ইবলিস ২৭. রিসালাত উল আকায়েদ ২৮. জাওয়াহির উল কুরআন ২৯. হাকিকাতুল কুয়ালায়েন। সুফী মতবাদবিষয়ক গ্রন্থ হচ্ছে ৩০. আল কাওয়ায়েদুল আশারা ৩১. মিনহাজ উল আবেদীন ৩২. নাসিহাত উল তেলমিজ ৩৩. কিতাবে আসরার আল আনোয়ার ৩৪. মোর্শেদ উদ তালেবিন ৩৫. তাজরিদ ফিল কালেমাতুত তাওহিদ ৩৬. মাকাশিকাতুল কুলুব ৩৭. সিবরুল আলামিন প্রভৃতি। ইমাম গাজ্জালী দৈনিক গড়ে ৩২ পৃষ্ঠা করে লিখতেন। মুসলিম ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চিন্তার বিকাশে গাজ্জালী যে ব্যাপক অবদান রেখে যান তা নিঃসন্দেহে ছিল অমূল্য ও অসাধারণ। তাঁর এই অবদানের কথা বিবেচনা করেই কেউ কেউ তাকে ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী বলে বর্ণনা করেছেন। দ্বীন ইসলামের মূল বাণী ও নির্যাসের যে সুবিচার বিশ্লেষণ তিনি করেছেন, ইসলামের স্বতন্ত্র ও স্বকীয়তার সমর্থন ও সংরক্ষণে তিনি যে বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, এর স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে যথার্থই অভিহিত করা হয় হুজ্জাতুল ইসলাম বা ইসলামের সংরক্ষক বলে। তিনি সত্য সত্যই মুসলিম চিন্তাধারার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে আছেন এবং তাঁর এই শ্রেষ্ঠত্ব ভবিষ্যতে অমলিন থাকবে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ