ইব্রাহিম জাদরান আগামীর তারকা

ইব্রাহিম জাদরান আগামীর তারকা

খেলার চমক আবু আবদুল্লাহ জানুয়ারি ২০২৪

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুব দ্রুত উন্নতি করছে আফগানিস্তানের ক্রিকেট দল। এবারের ওয়ানডে বিশ্বকাপে দলটি সেমিফাইনালে যাওয়ার দৌড়েও ছিল। শেষ পর্যন্ত নেট রানরেটের ব্যবধানে তারা বাদ পড়ে যায়। তবু এই সাফল্য ক্রিকেট ভক্তদের দলটির প্রতি নতুন করে ভালোবাসা তৈরিতে সাহায্য করছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির ক্রিকেটাররা নানা সীমাবদ্ধতার মাঝে দিনে দিনে এগিয়ে চলছেন। মোটা অঙ্কের বেতন নেই, খুব উন্নত অনুশীলন সুবিধা নেই, দেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ নেই- তবুও তারা ধীরে ধীরে নিজেদের মেলে ধরছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যারা নজর কেড়েছেন তাদের একজন তরুণ ওপেনার ইব্রাহিম জাদরান। খুব বেশি দিন হয়নি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। অল্প কিছু ম্যাচ খেলেছেন; কিন্তু এরই মধ্যে সম্ভাবনার জানান দিয়েছেন। নিজের প্রতিভাকে মেলে ধরছেন দিনে দিনে।

গত ওয়ানডে বিশ্বকাপ পর্যন্ত ইব্রাহিম জাদরান ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছে মাত্র ২৮টি; কিন্তু এরমধ্যেই তার নামের পাশে জমা হয়েছে ৫টি সেঞ্চুরি আর ৫টি হাফ সেঞ্চুরি। গড় পৌঁছে গেছে ৫১ এর ওপরে। বিশ^কাপে দারুণ কয়েকটি ইনিংস খেলেছেন। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তার লড়াকু ইনিংসটি অনেক দিন মনে থাকবে আফগান সমর্থকদের। সেদিন অস্ট্রেলিয়ার বিশ^সেরা বোলিং লাইনআপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অপরাজিত ১২৯ রানের ইনিংস খেলেন। যার ফলে দল পায় ২৯১ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর। শেষ পর্যন্ত গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের দানবীয় ইনিংসের কাছে হার মানলেও ইব্রাহিম পেয়েছেন ভক্তদের ভালোবাসা আর বিশেষজ্ঞদের প্রশংসা।

এর আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে তার ৮৭ রানের ইনিংসে ভর করেই জয় পেয়েছে আফগানরা। সেদিন ম্যাচ সেরার পুরস্কারও পেয়েছেন ইব্রাহিম। প্রথমবারের মতো দলটি হারিয়েছে পাকিস্তানকে। এছাড়া বিশ্বকাপের অন্য ম্যাচগুলোতেও কম বেশি রান পেয়েছেন। এরকম একটি বড় আসরে এমন খেলতে পারাটা তার সম্ভাবনার কথাই তুলে ধরছে। বিশ^কাপের আগে এশিয়া কাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে ৭৫ ও স্বাগতিক পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮০ রানের ইনিংস খেলেছেন।

ইনিংস ওপেন করতে নেমে দেখেশুনে রান তুলতে পছন্দ করেন ইব্রাহিম। সময়ের সাথে সাথে তার ব্যাট ধারালো হতে শুরু করে। খুব বেশি পাওয়ার হিটিংয়ের বদলে হিসেবি ক্রিকেট খেলেন। যা তাকে ইনিংস বড় করতে সাহায্য করে। টেকনিক আর শট সিলেকশন তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। অযথা ব্যাট না চালিয়ে বলের মেধা বিচার করে শট খেলতে পছন্দ করেন।

২০১৯ সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক তার। বয়স তখন ১৮ বছর। অভিষেক ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৭ রানের দারুণ একটি ইনিংস আসে তার ব্যাট থেকে।  দুই মাস পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে অভিষেক। শুরুর দিকে বছর দুয়েক জাতীয় দলে জায়গা পেতে সমস্যা হয়েছে। মোহাম্মাদ শাহজাদের দল থেকে বাদ পড়ার পর অনেক দিন ধরেই একজন কার্যকর ওপেনার খুঁজছিল আফগান বোর্ড। অবশেষে ইব্রাহিমের মাঝে সেই সম্ভাবনা দেখতে পায় তারা। ক্যারিয়ারের চতুর্থ ওয়ানডেতেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারেতে অপরাজিত ১২১ রানের ইনিংস খেলেন। এরপর রান করেই চলছেন বলে দলে জায়গা নিয়ে আর ভাবতে হয়নি। ২০২২ সালের নভেম্বরে শ্রীলঙ্কা সফরে খেলেছেন ওয়ানডের ক্যারিয়ার সেরা ১৬২ রানের ইনিংস। টি-টোয়েন্টি আর টেস্টেও রান পাচ্ছেন নিয়মিত।

ইব্রাহিম জাদরানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা আফগানিস্তানের খোস্ত প্রদেশে। আফগানিস্তানের প্রথম প্রজন্মের ক্রিকেটারদের বেশির ভাগেরই জন্ম পাকিস্তানের উদ্বাস্তু শিবিরে, সে দেশেই ক্রিকেট খেলা শিখেছেন রশিদ, নবীরা। যুদ্ধ পরিস্থিতি ক্রমশ শান্ত হওয়ায় দ্বিতীয় প্রজন্মে দেশে বেড়ে ওঠা ক্রিকেটার পেতে শুরু করেছে দলটি। ইব্রাহিম তাদেরই একজন। তার জন্ম অবশ্য ২০০১ সালে যুদ্ধের মাঝেই। তবে যখন  কৈশোরে পা রেখেছেন তখন দেশ কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে এবং ক্রিকেট চর্চার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাছাড়া পরিবারেও ছিল ক্রিকেটের চর্চা।

আফগান জাতীয় দলের সাবেক ওপেনার নুর আলী জাদরান তার চাচা। নুর আলী ২০১০ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ^কাপে ভারতের বিপক্ষে দারুণ ব্যাটিং করে হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন। ৯ বছর বয়সি ইব্রাহিম সেই ম্যাচ দেখেছিলেন টিভির পর্দায়। সেদিন থেকেই চাচার মতো ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। চাচাও তার মাঝে সম্ভাবনা দেখে সব রকম সহযোগিতা করতে থাকেন। আরেকটি কথা বলি, ইব্রাহিম জাদরানের চাচাতো ভাই মুজিব উর রহমান। মুজিব এখন আফগান দলের তারকা স্পিনার। দলটির সেরা অফস্পিনারও তিনি। বয়সে মুজিব আর ইব্রাহিম কাছাকাছি। যৌথ পরিবারে একসাথে বেড়ে ওঠা এবং ক্রিকেট শিখেছেন দু’জনে। জাতীয় দলে অভিষেকও হয়েছে কাছাকাছি সময়ে।

জাতীয় দল থেকে অবসরের পর খোস্ত প্রদেশে নিজেদের কৃষি জমিতেই একটি ক্রিকেট অ্যাকাডেমি গড়ে তোলেন নুর আল জাদরান। যৌথ পরিবারের বিশাল কৃষি খামারের এক পাশে কয়েকশো মিটার জায়গা দখল করে


প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড গড়ে তোলেন। সেখানে নিজ হাতেই খেলা শিখিয়েছেন দুই ভাতিজা মুজিব আর ইব্রাহিমকে। তারা দু’জনেই আজ আফগান জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্য।

চাচা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হওয়ার কারণে শৈশবে বাড়িতেই উন্নত প্রশিক্ষণ আর ক্রিকেট সরঞ্জাম পেয়েছেন ইব্রাহিম। আন্তর্জাতিক মানের ব্যাট-প্যাড যখন আফগানিস্তানের অন্য কিশোরদের স্বপ্নেরও বাইরে ছিল, তখন সেই সুবিধা পেয়েই ইব্রাহিম দ্রুত নিজেকে পরিণত করেছেন। নুর আলী জাদরান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ইব্রাহিমকে কোনোদিন ওর বাবার কাছে ক্রিকেটের জন্য কিছু চাইতে হয়নি। ওর যা দরকার সবই আমি দিতাম। আমাকে স্পন্সররা ৪-৫টি ব্যাট দিলে তার থেকে একটি ওকে দিতাম। অন্য সরঞ্জামও পেত আমার কাছ থেকে। যার কারণে ও শুধু খেলার দিকেই মনোযোগ রাখতে পেরেছে।

পরিবারে ক্রিকেটের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে ইব্রাহিম সুযোগটাকে দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের পর রান করেছেন। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটেও দেখিয়েছেন সাফল্য।

১৬ বছর বয়সেই আফগান অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে যুব বিশ্বকাপ খেলেছেন। জাতীয় দলে এসেও নির্বাচকদের আস্থার প্রতিদান দিয়ে চলেছেন। যার কারণে তাকে এখন ভাবা হচ্ছে আফগান ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নির্ভরতা হিসেবে। বয়স মাত্র ২২ বছর। ফিটনেস নিয়েও সে যথেষ্ট সিরিয়াস। তাই আগামী দিনে তার ব্যাট থেকে আরো ভালো ভালো ইনিংস আমরা হয়তো দেখতে পাবো। আর এক যুগ টানা খেলে যেতে পারলে হয়তো বিশ্বে ক্রিকেটের উল্লেখযোগ্য অবস্থানে নিজেকে নিয়ে যেতে পারবেন এই ডানহাতি ওপেনার।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ