ইংরেজি বর্ষপঞ্জি এলো কেমন করে    -হারুন ইবনে শাহাদাত

ইংরেজি বর্ষপঞ্জি এলো কেমন করে -হারুন ইবনে শাহাদাত

বিশেষ রচনা জানুয়ারি ২০১৭

ছোট্ট বন্ধুরা, প্রতিদিন ভোরে মুয়াজ্জিনের আজানের সুরে ঘুম ভাঙার সাথে সাথে শুরু হয় নতুন একটি দিন। ভোরের আভা শেষে পুব আকাশে লাল সূর্য ওঠে, পৃথিবীটাকে আলোকিত রাখে সারা দিন। একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথ ধরে সূর্যটি আস্তে আস্তে চলে যায় পশ্চিম আকাশে। তারপর আবারও লাল রঙ ধারণ করে হারিয়ে যায়। মসজিদ থেকে ভেসে আসে মাগরিবের নামাজের আজান। সূর্যের চলার গতির সাথে তাল রেখে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সময়কে ভাগ করেছেন সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিন, মাস, বছর, যুগ, অব্দ হিসেবে। সময় গণনা সাধারণত সূর্য ও চাঁদের পথচলার হিসাবের ব্যবধানকে ভাগ করে করা হয়। সূর্যের হিসাবে করা বর্ষপঞ্জি বা ক্যালেন্ডারকে সৌর এবং চাঁদের হিসাবে করা এক বছরকে চন্দ্রবর্ষ, সাল বা সন বলা হয়।
তোমরা শুনে খুশি হবে সময় হিসাবের এই দু’টি পদ্ধতির কথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে। আল্লাহতায়ালা সূরা বনি ইসরাইলের ১২ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেছেন: ‘দেখো, আমি রাত ও দিনকে দু’টি নিদর্শন বানিয়েছি? রাতের নিদর্শনকে বানিয়েছি আলোহীন এবং দিনের নিদর্শনকে করেছি আলোকোজ্জ্বল, যাতে তোমরা তোমাদের রবের অনুগ্রহ তালাশ করতে পারো এবং মাস ও বছরের হিসাব জানতে সক্ষম হও। এভাবে আমি প্রত্যেকটি জিনিসকে আলাদাভাবে পৃথক করে রেখেছি।’
আমাদের দেশে ইংরেজি, বাংলা ও হিজরি এই তিনটি সালের প্রচলন রয়েছে। আমাদের প্রয়োজনই আমরা তিনটি সনের দিন তারিখের দিকে চোখ রাখতে বাধ্য। আর একটি কথা তোমাদেরকে আগেই বলে রাখছি, ইংরেজি ও বাংলা সনের হিসাব করা হয় সূর্যের চলার গতির ওপর ভিত্তি করে। অন্য দিকে হিজরি সনের হিসাব রাখা হয় চাঁদের গতির ওপর ভিত্তি করে। হিজরি সন/মাস মুসলমানদের ধর্মীয় কারণেই আমাদের দেশে ব্যবহার করা হয়। ইংরেজি সন ব্যবহার করা হয় আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে যোগাযোগের সুবিধার জন্য। আমাদের সরকারি-বেসরকারি সব অফিস আদালত, স্কুল, কলেজ, কারখানায় ব্যবহৃত হয় ইংরেজি দিন তারিখ। কৃষি কাজের সুবিধার জন্য ব্যবহৃত হয় বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন। এক সময় শকাব্দের প্রচলন ছিল যা এখন আর নেই, অবশ্য ভারতের পশ্চিম বাংলায় এখনো শকাব্দের প্রচলন বিদ্যমান।
এবার চলো আমরা জেনে নিই ইংরেজি বর্ষের জন্ম ইতিহাস। খুব ভালো করে বিষয়টি খেয়াল করতে হবে। কারণ অনেক বিবর্তন, পরিবর্তন ও পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে আজকের এই পর্যায়ে আমরা পেয়েছি ইংরেজি বর্ষপঞ্জি। আর একটি কথা তোমাদেরকে কানে কানে বলে রাখছি মনে রেখো, আমরা যে ইংরেজি সাল বা খ্রিস্টাব্দ বলি আসলে এটা হচ্ছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। এটা একটি সৌর সন। নানা পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন, বিবর্তন এবং যোগ-বিয়োজনের মধ্য দিয়ে বর্ষ গণনায় বর্তমান কাঠামো লাভ করেছে। জানা যায়, মানুষ যেদিন বর্ষ গণনা করতে শিখল সেদিন চাঁদের হিসাবেই শুরু করে বর্ষ গণনা। চাঁদের বিভিন্ন অবস্থা দিয়ে তারা মাসের বিভিন্ন সময়কে চিহ্নিত করত। চাঁদ ওঠার সময়কে বলা হতো ক্যালেন্ডস, পুরো চাঁদকে বলত ইডেস, চাঁদের মাঝামাঝি অবস্থাকে বলত নুনেস। সূর্যের হিসাবে বা সৌর গণনার হিসাব আসে অনেক পরে। সৌর গণনায় ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকে, কিন্তু চান্দ্র গণনায় ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না।
ইংরেজি সনকে খ্রিস্টাব্দ বলা হয় কেন জান? তাহলে বলি শোন, আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ সা:-এর জন্মের আগে আরো অনেক নবী ও রাসূল এই পৃথিবীতে আল্লাহতায়ালা প্রেরণ করেছেন। তাঁদেরই একজন ছিলেন হজরত ঈসা আ:। খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসীরা তাকে যিশু খ্রিস্ট বলেন। খ্রিস্টপূর্ব মানে হজরত ঈসা আ:-এর জন্মের ১৫৩ বছর আগে ১ জানুয়ারিতে নতুন বছর পালনের সিদ্ধান্ত নেয় রোমান সিনেট। আর বছরের প্রথম মাস জানুয়ারির নামকরণ করা হয় রোমানদের দেবতা জানুসের নামে। লাতিন শব্দ জানুস, অর্থ দরজা। এই দরজা মানেই ইংরেজি নতুন বছরের আগমন, ইংরেজি নতুন বছরের শুরু।
যদিও খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে মেসোপটেমীয় সভ্যতায় প্রথম বর্ষবরণ চালু হয়। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাকে বলা হয় মেসোপটেমীয় সভ্যতা। বর্তমানের ইরাককে প্রাচীনকালে বলা হতো মেসোপটেমিয়া। এই মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার ৪টা আলাদা আলাদা ভাগ আছে সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, আসিরীয় সভ্যতা ও ক্যালডীয় সভ্যতা। এদের মধ্যে বর্ষ গণনা শুরু হয় ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়। কিন্তু তখন বর্তমানের মতো জানুয়ারির ১ তারিখে নতুন বর্ষ গণনা শুরু হতো না। তখন নিউ ইয়ার পালন করা হতো যখনই বসন্তের আগমন হতো। অর্থাৎ শীতকালের রুক্ষতা ঝেড়ে প্রকৃতিতে যখন গাছে গাছে নতুন করে পাতা গজাতে থাকে, ফুলের কলিরা ফুটতে শুরু করে-তখনই নতুন বর্ষ!
অন্যান্য দেশের মতোই আমাদের দেশেও প্রাথমিক বর্ষ পঞ্জিকায় অল্প পরিসরে সুমের/সুমেয়ী সভ্যতায় পরিলক্ষিত হয়। তবে মিসরীয় সভ্যতাই পৃথিবীর প্রাচীনতম সৌর ক্যালেন্ডার চালু করে বলে জানা যায়। প্রাচীন মিসরীয় ক্যালেন্ডার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, খ্রিস্টপূর্ব ৪৩৬ অব্দ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্যালেন্ডার ব্যবহার শুরু হয়। আরো জানা যায়, রোমানরা তাদের প্রথম ক্যালেন্ডার লাভ করে গ্রিক গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদদের কাছ থেকে। রোমানদের প্রাচীন ক্যালেন্ডারে মাস ছিল ১০টি এবং তারা বর্ষ গণনা করত ৩০৪ দিনে। মধ্য শীত মৌসুমের ৬০ দিন তারা বর্ষ গণনায় আনত না। রোমানদের বর্ষ গণনার প্রথম মাস ছিল মার্চ। তখন ১ মার্চ পালিত হতো নববর্ষ উৎসব। শীত মৌসুমে ৬০ দিন বর্ষ গণনায় না আনার কারণে বর্ষ গণনা যে দু’টি মাসের ঘাটতি থাকত তা পূরণ করার জন্য তাদের অনির্দিষ্ট দিন-মাসের দ্বারস্থ হতে হতো। এসব নানা জটিলতার কারণে জনসাধারণের মধ্যে তখন ক্যালেন্ডার ব্যবহার করার প্রবণতা একেবারেই ছিল না বলে জানা যায়।
রোম উপাখ্যান খ্যাত প্রথম সম্রাট রমুলাসই আনুমানিক ৭৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান ক্যালেন্ডার চালু করার চেষ্টা করেন। পরবর্তীকালে রোমান সম্রাট নুমা পন্টিলাস ১০ মাসের সঙ্গে আরো দুটো মাস যুক্ত করেন। সে দুটো মাস হচ্ছে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি। তিনি জানুয়ারিকে প্রথম মাস ও ফেব্রুয়ারিকে শেষ মাস হিসেবে যুক্ত করেন। জানুয়ারি মাস ধার্য করা হয় ২৯ দিনে এবং ফেব্রুয়ারি মাস ধার্য করা হয় ২৮ দিন। এছাড়াও তিনি মারসিডানাস নামে অতিরিক্ত একটি মাসেরও প্রবর্তন করেন। এই মারসিডানাস মাস গণনা করা হতো ২২ দিনে। এই অতিরিক্ত মাসটি গণনা করা হতো এক বছর অন্তর ফেব্রুয়ারি মাসের ২৩ ও ২৪ তারিখের মাঝখানে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩২ অব্দে সম্রাট নুমা প্রবর্তিত মাসের হিসাব পরিমার্জন ও পরিবর্তন করা হয়। পরবর্তীকালে রোমানরা চার বছর অন্তর লিপ ইয়ারের হিসাব প্রচলন করে। এ হিসাবেও এক বছরের সঙ্গে অন্য বছরের দিন সংখ্যার হেরফের হতে থাকে। চার বছর অন্তর অতিরিক্ত একটি দিন যোগ করলে দেখা যেত দিনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার মিসরীয় ক্যালেন্ডার রোমে চালু করেন। তিনি জ্যোতির্বিদদের পরামর্শে খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ অব্দে সেই বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের মাঝখানে ৬৭ দিন এবং ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে ২৩ দিন এই মোট ৯০ দিন যুক্ত করে ক্যালেন্ডার সংস্কার করেন। এই ক্যালেন্ডার জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত হয়। এই ক্যালেন্ডারে মার্চ, মে, কুইন্টিলিস ও অক্টোবর দিন সংখ্যা ৩১ দিন, অপরদিকে জানুয়ারি ও সেক্সটিনিস মাসের সঙ্গে দু’দিন যুক্ত করে ৩১ দিন করা হয়। ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনেই গণনা হতে থাকে। তবে প্রতি চার বছর অন্তর একদিন যুক্ত করা হয়। জুলিয়াস সিজারের নামানুসারে প্রাচীন কুইন্টিলিস মাসের নাম বদলিয়ে রাখা হয় জুলাই।
অন্যদিকে সম্রাট অগাস্টাসের নামানুসারে সেক্সটিনিস মাসের নাম পাল্টিয়ে আগস্ট করা হয়। মিসরীয়রা সৌর বর্ষ গণনা করত ৩৬৫ দিনে। কিন্তু জুলিয়াস সিজারের সংস্কারের ফলে তা তিন শ’ সাড়ে পঁয়ষট্টি দিনে এসে দাঁড়ায়। এই ক্যালেন্ডারটি তৈরি করা হয় ১৫৮২ সালে। যিশুখ্রিস্টের জন্ম বছর থেকে গণনা করে ডাইওনিসিয়াম এক্সিগুয়াস নামক এক খ্রিস্টান পাদ্রি ৫৩২ অব্দ থেকে খ্রিস্টাব্দের সূচনা করেন। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে রোমের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি জ্যোতির্বিদদের পরামর্শে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার সংশোধন করেন। তার নির্দেশে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর ১০ দিন বাদ দেয়া হয়, ফলে ওই বছরের ৫ তারিখকে ১৫ তারিখ করা হয়। পোপ গ্রেগরি ঘোষণা করেন যে, যেসব শতবর্ষীয় অব্দ ৪০০ দ্বারা বিভক্ত হবে সেসব শতবর্ষ লিপ ইয়ার হিসেবে গণ্য হবে। এই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারই আমাদের দেশে ইংরেজি ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ