আহা খেজুরের রস!

আহা খেজুরের রস!

ফিচার জানুয়ারি ২০১৩

মাহমুদ হাসান.. ঋতুচক্রের পাখায় ভর করে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে এখন শীতকাল। আর শীতের দিন মানেই গ্রামাঞ্চলে খেজুর রস ও নলেন গুড়ের মৌ মৌ গন্ধ। শীতের সকালে খেজুরের রস যে কতটা তৃপ্তিকর তা বলে শেষ করা যায় না। আর খেজুর রসের পিঠা এবং পায়েস তো খুবই মজাদার। এ কারণে শীত মৌসুমের শুরুতেই গ্রামাঞ্চলে খেজুর রসের ক্ষীর, পায়েস ও পিঠে খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাড়িতে খেজুর রসের তৈরি খাদ্যের আয়োজন চলে। শীতের সকালে বাড়ির উঠোনে বসে সূর্যের তাপ নিতে নিতে খেজুরের রস যে পান করেছো, তার স্বাদ বোধহয় কোনোদিন ভুলতে পারবে না। শুধু খেজুরের রসই নয়, এর থেকে তৈরি হয় সুস্বাদু পাটালি, গুড় ও প্রাকৃতিক ভিনেগার। আর পাটালি গুড়ের তৈরি শীতের নানারকম পিঠাপুলি বা মিষ্টান্ন দিয়ে অতিথি আপ্যায়ণ গ্রামবাংলার মানুষের দীর্ঘকালের ঐতিহ্য। গাছ কাটে গাছি ভাই কাঁধের ওপর সাড়ে তিন হাত বাঁক। তার দু’দিকে ঝুলছে কয়েক গণ্ডা ভাঁড় (কলস)। কোমরে পেঁচানো দড়ি। এর সাথে পেছন দিকে লটকানো কঞ্চির তৈরি ঝোলা। ভেতরে দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো ধারালো দা। বেশ দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলা লোকটির বেশবাস দেখে চমকে ওঠার কথা। তবে গ্রামাঞ্চলের মানুষ তাকে দেখে অবাক হন না, শঙ্কিত হয় না শিশুরাও। শীতকালে গাঁও-গেরামের রাস্তাঘাটে হরহামেশা দেখতে পাওয়া এ সব ব্যক্তিরা হলেন ‘গাছি’। গাছি বলতে যারা খেজুর গাছ কেটে তা থেকে রস বের করেন তাদের বোঝায়। আভিধানিক শব্দ ‘সিউলি’। সাধারণত কার্তিক মাস এলেই তারা গাছ কাটা শুরু করেন। গাছিদের গাছ কাটার জন্য কয়েকটি উপকরণ দরকার হয়। যেমন- তাদের কাছে থাকে দুটি লম্বা দা, এর মধ্যে একটি দীর্ঘ ও ধারালো। একে বলে গাছি দা। অপরটি অপেক্ষাকৃত ছোট। দা রাখার জন্য একটি ঝাঁপি, দড়ি এবং এক টুকরো চামড়া বা পুরনো বস্তাও লাগে তার। গাছি যে ঝাঁপি ব্যবহার করেন তা বাঁশ দিয়ে তৈরি। গাছ কাটার সময় গাছি ওই দা সাধারণত বাঁশের তৈরি ঝাঁপিতে রাখেন। ঝাঁপিটি শক্ত করে বাঁধা থাকে কোমরের সাথে। এছাড়া গাছির প্রয়োজন হয় শক্ত ও মোটা একটি দড়িও। শরীরের পুরো ভর ওই দড়ির মাধ্যমে চামড়ার ওপর পড়ে। গাছ কাটার কৌশল খেজুর গাছ কাটা হয় এক বিশেষ প্রক্রিয়ায়। গাছি দা দিয়ে খেজুর গাছের মাথার এক দিকে পাতাসহ ডগা কেটে বুক চেঁছে পরিষ্কার করা হয়। কাটা অংশের নিচের দিকে দু’টি খাঁজ কাটা হয়। খাঁজ থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচে একটি সরু পথ বের করা হয়। এই সরু পথের নিচে বাঁশের তৈরি নলি বসানো হয়। নলির পাশে বাঁশের তৈরি খিল বসানো হয়। তারপর এই খিলে বাঁধা হয় মাটির হাড়ি বা ভাঁড়। মাটির ভাঁড়ে ওই নলি দিয়ে টপটপ করে রাতভর রস জমা হয়। খেজুর গাছ কাটা থেকে শুরু করে পাটালি ও গুড় প্রস্তুত পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটিতেই দক্ষ গাছি আর গুড় প্রস্তুতকারীর ভূমিকাই মুখ্য। আগেই বলা হয়েছে যে, কার্তিক মাসে ওই গাছ তোলা হয়। আর রস পাওয়া যায় তখন থেকেই। এরপর অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন। কোনো কোনো গাছে চৈত্রমাস পর্যন্ত রস মেলে। প্রকৃতপক্ষে রস মৌসুম হলো অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ। তবে শীত যত বেশি পড়ে রস তত বেশি বাড়ে। সাধারণত গাছ কাটার পর তিন দিন রস পাওয়া যায়। প্রথম দিনের রসের নাম জিরান কাট। এই রস খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি গুড় তৈরির জন্য উৎকৃষ্ট। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনের রসকে যথাক্রমে দোকাট ও তেকাট বলা হয়। সাধারণত তিনদিন গাছ কাটার পর মাঝখানে তিনদিন বাদ দিয়ে আবার গাছ কাটা হয়। গাছের কাটা অংশ শুকানোর জন্য এই সময় দেয়া হয়। কাটা অংশ শুকানোর সুবিধার জন্যই সাধারণত পূর্ব ও পশ্চিম দিকে গাছ কাটা হয়, যাতে সূর্যের আলো সরাসরি কাটা অংশে পড়ে। আর কেউ যদি খেজুর গাছের বয়স বের করতে চাও তাহলে কাটা অংশ দেখে মোটামুটি কত বছর ওই গাছ থেকে রস বের করা হয়েছে সেটা জানা সম্ভব হবে। গুড় ও পাটালি তৈরিকরণ শীতের সাথে রস ঝরার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। শীত যত বেশি পড়বে তত বেশি রস ঝরবে। রসের স্বাদও তত মিষ্টি হবে। অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ হলো রসের ভর মৌসুম। হাড়ি বা ভাঁড়কে অনেক অঞ্চলে ঠিলে বা ঠিলা বলা হয়। এটা দেখতে অনেকটা ছোট আকৃতির কলসের মতো। ভাঁড়ের রস সংগ্রহের পর যদি তা থেকে গুড় বা পাটালি বানাতে হয় তাহলে তাকে বিশেষ কায়দায় জ্বাল দিতে হয়। রস জ্বাল দেয়া হয় মাটির জালায় বা টিনের তাপালে। বাড়ির গৃহিণী, অপেক্ষাকৃত বয়স্করা রস জ্বাল দিয়ে গুড় বা পাটালি তৈরির কাজটি করে থাকেন। রস জ্বাল দিদে দিতে একসময় তা ঘন হয়ে গুড় হয়ে যায়। তবে তাপালের রস ঘন ঘন বিশেষভাবে তৈরি খেজুরের ডাল বা বেকলো তথা বাকল দিয়ে নাড়তে হয়। পাটালি বানাতে হলে এই গুড়ের কিছু অংশ তাপালের একপাশে নিয়ে উক্ত খেজুর ডাল দিয়ে ঘষতে হয়। ঘষতে ঘষতে এই অংশটুকু শক্ত হয়ে যায়। এই শক্ত অংশকে বীজ বলে। বীজের সঙ্গে তাপালের বাকি গুড় মিশিয়ে দেয়া হয়। স্বল্পক্ষণের মধ্যে গুড় জমাট বাঁধতে শুরু করে। তখন এই গুড় মাটির হাড়ি বা বিভিন্ন আকৃতির পাত্রে রাখা হয়। গুড় জমাট বেঁধে পাত্রের আকৃতি ধারণ করে। এবং এটাই তখন পাটালি হিসেবে বিবেচিত হয়। মাঝারি আকৃতির দশ থেকে পনেরো ভাঁড় রস জ্বাল দিলে এক ভাঁড় গুড় হয়। এই এক ভাঁড় গুড়ের ওজন হয় ছয় থেকে আট কেজির মতো। পিঠা-পুলি তৈরিতে রস রস জ্বাল দিয়ে যে গুড় তৈরি করা হয় তার আবার রকমফের আছে। যেমনÑ পাটালি গুড়, ঝোলা গুড়। পাটালির মতো কিছুটা শক্ত গুড়কে বলে পাটালি গুড়। আর অপেক্ষাকৃত পাতলা গুড়কে বলা হয় ঝোলা গুড়। এসব গুড় আবার বিভিন্নভাবে খাওয়া হয়। রসের পিঠার স্বাদ একেবারেই অন্যরকম। চালের গুড়ি পানিতে গুলে মাটির তৈরি বিশেষ খোলে নারকেলের মালা দিয়ে তৈরি হাতার মতো পাত্রের মাধ্যমে ঢেলে জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা। একে স্থানভেদে খোলমুচি বা কাচিপোড়া পিঠে বলা হয়। জ্বলন্ত চুলার উপর বিশেষ খোলটি বসিয়ে তার খোলে গুড়ি ঢালা হয়। এরপর মাটির তৈরি সরা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। একটু পর সরা উঠিয়ে কাচি দিয়ে খুঁচিয়ে পিঠা নামিয়ে নেয়া হয় এবং পাশেই রাখা হাঁড়িতে গরম রসের মধ্যে ডুবিয়ে দেয়া হয়। অনেক সময় এই রসের মধ্যে নারকেল কুচো দেয়া হয়। এভাবে তৈরি হয় রসের পিঠা বা ভাপা পিঠা। সম্ভবত কাচি দিয়ে খুঁচিয়ে খোল থেকে পিঠা তোলা হয় বলে একে কাচিপোড়া পিঠা বলা হয়ে থাকে। এই কাচিপোড়া পিঠা গুড় দিয়ে মাখিয়ে খেতে খুবই সুস্বাদু লাগে। খেজুর গুড়ের পুলি পিঠা, দুধের পিঠা, সেম পিঠাÑ আরো কত কী! পাটালি গুড় দিয়ে মুড়ি, ঝোলা গুড় দিয়ে মুড়ি অনেকেরই প্রিয় খাবার। অনেকে তো গুড় এমনি এমনিই খায়। খেজুর গুড়ের সন্দেশের স্বাদ অপূর্ব। অনেকে শখ করে খেজুর গুড়ের চা-ও খান। যশোরের যশ খেজুরের রস বাংলাদেশে সেই সুদূর অতীত থেকে খেজুর গাছের আধিক্য গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকায়। অর্থাৎ বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, খুলনা, নদীয়া ও চব্বিশ পরগনায় বরাবর খেজুর গাছ জন্মে বেশি। এক সময় প্রধান অর্থকরী ফসল বলতে ছিল খেজুরের গুড়। তখন জনসংখ্যা ছিল কম। ধান উৎপাদনে জমির ব্যবহার ছিল স্বল্প। পড়ে থাকত অকর্ষিত দিগন্তজোড়া মাঠ। বন-জঙ্গলে ভরা। আর সেখানে বিনা রোপণ ও বিনা পরিচর্যায় বুনোলতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠত খেজুর গাছ। তা থেকে রস বের করে তৈরি হতো উৎকৃষ্ট গুড়। যে কেউ ভালো গাছ কাটতে কিংবা রস বের করতে পারেন না। কখন, কিভাবে, কোন্খানে কেমন করে পোঁচ দিতে হবে এবং যার ফলে গাছ মরে যাবে না, অথচ বেশি রস পাওয়া যাবেÑ তা একজন দক্ষ গাছি-ই জানেন। আর এই দক্ষতার দিক থেকে যশোর অঞ্চলের গাছিরা একটু এগিয়েই আছেন। এজন্যই বলা হয়Ñ  ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস।’ এটি হয়তো একদিন প্রবাদবাক্যে পরিণত হবে। যশোর জেলার মাটি বেলে দো-আঁশ। এই মাটির অম্লত্ব কম এবং এখানে বৃষ্টিপাতের হারও কম। এসব কারণে যশোরে অনায়াসে খেজুরগাছ জন্মায়। একটু উঁচু জমিতে বীজ পড়লেই গাছ হয়। সাধারণত বসতবাড়ির আশপাশে, রাস্তার ধারে, আবাদি জমির চার দিকে এবং কোনো কোনো জমিতে সারিবদ্ধভাবে খেজুরগাছ লাগানো হয়। সাধারণ হিসেবে এক বিঘা জমিতে ১০০টি খেজুরগাছ লাগানো যায়। পরে ৩০-৪০ বছর পর্যন্ত তা একটি বার্ষিক লাভের সম্পত্তি হয়ে থাকে। কৃষি বিভাগের হিসাব মতে যশোর জেলায় এখনো ৪০ লাখ খেজুরগাছ আছে। যশোর খেজুরে চিনির গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী। ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, এক সময় চিনি ছিল যশোরের প্রধান অর্থকরী পণ্য। সেটা ছিল খেজুরের চিনি। এই চিনি তৈরির জন্য এখানে কোনো মিল ছিল না। গাছিরা দেশীয় প্রযুক্তিতে খেজুরের গুড় থেকে এই চিনি উৎপাদন করতেন। এই চিনি উৎপাদনের কৌশল ছিল এমনÑ প্রথমে গুড় চুবড়ি বা পেতেতে (ঝুড়ি) রাখা হতো। পেতেগুলো নাদা বা নান্দার (মাটির তৈরি বড় পাত্র) ওপর বসানো হতো। পেতে থেকে গুড়ের রস গলে নাদায় পড়ত। পেতের গুড় রাখার তৃতীয় দিন গুড়ের বেঁকি (রস গলার পর শক্ত অংশ) ভেঙে দিতেন গাছিরা। এই ভাঙার কাজকে বলা হতো মুটানো। পরদিন ওই গুড়ের ওপর শেওলা দিয়ে ঢেকে দেয়া হতো। সব শেওলায় এ কাজ হতো না। কপোতাক্ষ নদে চিনি উৎপাদন করার উপযোগী এক প্রজাতির শেওলা জন্মায়, তার নাম চিনিয়া শেওলা বা পাটা শেওলা। গুড়ের ওপর এই শেওলা দেয়ার সাত দিন পর পেতের গুড়ের ওপরের অংশ সাদা হয়ে চিনিতে রূপান্তরিত হতো। পরে তা কেটে তুলে নিয়ে আবার মুটিয়া নতুন শেওলা দিয়ে ঢেকে দেয়া হতো। এভাবে চার-পাঁচবার করলে এক পেতের গুড় সব চিনি হয়ে যেত। এই চিনিকে বলা হতো দলুয়া চিনি। এই চিনি সরস, সুস্বাদু ও চিকন দানাযুক্ত। ময়রাদের কাছে এই চিনি অত্যন্ত প্রিয় ছিল। মিষ্টি তৈরির কাজে তা বেশি ব্যবহৃত হতো। দলুয়া চিনির আবার শ্রেণীভাগ ছিল। পেতের গুড় থেকে প্রথম যে চিনি তৈরি হতো তার নাম ছিল আখড়া। আর অপেক্ষাকৃত লাল চিনিকে বলা হতো চলতা। দ্বিতীয়বার প্রাপ্ত চিনিকে বলা হতো কুন্দো। দলুয়া চিনি বেশি দিন শুকনো অবস্থায় রাখা যেত না। দ্রুত মেতে বা ভিজে উঠত। এ কারণে দলুয়া চিনিকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য পাকা করে নেয়া হতো। পাকা করার প্রক্রিয়া ছিল এমনÑ দলুয়া চিনি কড়াইয়ে জ্বাল দিয়ে তার সাথে দুধ মেশালে ওই চিনির গাদ বা ময়লা বের হয়ে যেত। পরে তা ছিদ্রযুক্ত পাত্রে রেখে আগের মতো পাটা শেওলার সাহায্যে চিনি করা হতো। এই প্রক্রিয়ায় অপেক্ষাকৃত সাদা ও দানাযুক্ত যে চিনি তৈরি হতো, তাকে বলা হতো দোবরা চিনি এবং লালচে চিনির নাম ছিল একবরা। পাকা চিনি তৈরির আর একটি প্রক্রিয়ার কথা জানা যায়। এ প্রক্রিয়াটি হচ্ছে গুড় বস্তায় ভরে ঝুলিয়ে রাখা। বস্তার দুই পাশে দু’টি বাঁশ দিয়ে চেপে বেঁধে গুড়ের মাৎ বা রস নিংড়ানো হতো। এভাবে নিংড়ানোর পর শুকনো গুড়ে পানি মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে দুধ মিশিয়ে গাদ তুলে ফেলে পাটা শেওলা ব্যবহার করে আগের প্রক্রিয়ায় চিনি তৈরি করা হতো। পরে ওই চিনি পিটিয়ে গুঁড়া করে নিলে উৎকৃষ্ট চিনি হতো। যশোরের খেজুরে চিনি কেবল স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতো তা নয়। ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে রফতানিও হতো। শীতকালের শেষভাগে বরিশালের ব্যবসায়ীরা বড় বড় নৌকা ভর্তি করে চাল এনে বিক্রি করে চিনি কিনে নিয়ে যেতেন। চিনির সাথে তারা প্রচুর গুড়ও নিয়ে যেতেন। তৎকালীন যশোরের কোটচাঁদপুর ও কেশবপুর ছিল প্রধান চিনি মোকাম। এ ছাড়া চৌগাছা ও ত্রিমোহিনীতে চিনির ব্যবসায় চলত। অন্যান্য স্থানের মধ্যে রাজারহাট, খাজুরা, মনিরামপুর, ঝিকরগাছা, বসুন্দিয়া, নওয়াপাড়া প্রভৃতি স্থানও চিনি উৎপাদন ও ব্যবসায়ের জন্য উল্লেখযোগ্য ছিল। ঝিকরগাছা, যাদবপুর, কালিগঞ্জ, নওয়াপাড়া প্রভৃতি স্থানে চিনির চেয়ে গুড়ের হাট বড় ছিল। কোটচাঁদপুরে শতাধিক কারখানায় হাজার হাজার লোক কাজ করতেন। কেশবপুরে কারখানাপাড়া ও কলকাতাপট্টি ছিল। কলকাতার বড় ব্যবসায়ীরা এসে সেখানে চিনির ব্যবসায় করতেন। চৌগাছা ও ত্রিমোহিনীতেও বহু কারখানা ছিল। বাঘারপাড়ার ছাতিয়ানতলায় গুড়ের বড় হাট ছিল। শীতকালে প্রতি বৃহস্পতিবার এক হাজারেরও বেশি গরুর গাড়িতে গুড় আসত ওই হাটে। ছাতিয়ানতলার মতো প্রায় সমান গুড়ের হাট ছিল কালিগঞ্জ, মনিরামপুর, ঝিকরগাছা, যশোর ও যাদবপুরে। ইতিহাসের এক তথ্যে জানা যায়, কোটচাঁদপুরে ১৮৭৪ সালে ৬৩টি চিনি কারখানায় ৯ লাখ ৩৮ হাজার ৮৫০ টাকা বিনিয়োগ করে এক লাখ ৫৬ হাজার ৪৭৫ মণ চিনি পাওয়া যায়। ১৮৮৯ সালে আট-নয় লাখ টাকা বিনিয়োগ করে উৎপাদন হয় সাড়ে ১৭ হাজার মণ চিনি। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা চিনির ব্যবসায় করতে এখানে আসেন। ব্ল্যাক সাহেব নামে এক ব্যবসায়ী কোটচাঁদপুর ও ত্রিমোহিনীতে কুঠি স্থাপন করেন। সে সময় নিউ হাউজ সাহেব কোটচাঁদপুরে এবং সেন্টস বারি সাহেব ত্রিমোহিনী কুঠির দায়িত্ব পান। ওই সময় গ্লাসস্টোন ওয়াইলি অ্যান্ড কোম্পানি চৌগাছায় এসে চিনির কারখানা স্থাপন করেন। প্রথমে স্মিথ ও পরে ম্যাকলিয়ড কোম্পানির ম্যানেজার ছিলেন। ম্যাকলিয়ড প্রথমে স্থানীয় সব খেজুর রস কিনে নিয়ে গুড় ও চিনি তৈরি করতেন। কোটচাঁদপুর, কেশবপুর, ত্রিমোহিনী, ঝিকরগাছা ও নারিকেলবাড়িয়ায় এই কোম্পানির কারখানা ছিল। ১৮৬১ সালে নিউ হাউজ সাহেব চৌগাছা কারখানার শাখা হিসেবে তাহিরপুরে একটি চিনিকল স্থাপন করে ইউরোপীয় মতে চিনি তৈরি করতে থাকেন। এখানে উৎপাদিত চিনি জাহাজ ভর্তি করে ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হতো। তাহেরপুরে ভৈরব নদের জাহাজঘাটের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আজো জাহাজ বেঁধে রাখার সেই পিলার এবং চিনি কারখানার পরিত্যক্ত জিনিসপত্র পড়ে আছে। কিন্তু লোকসানের কারণে দেনা বাড়তে থাকলে ১৮৮০ সালে এমট চেম্বারস কোম্পানির কাছে কারখানা বিক্রি করে দেন। নতুন লোক এসে কারখানা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা যথেষ্ট উন্নয়ন করেন। তারা হাড়ের গুঁড়ো দিয়ে চিনি পরিষ্কার করার নতুন পদ্ধতি চালুর চেষ্টা করেন। কিন্তু লাভজনক অবস্থায় ফিরতে পারলেন না। বাধ্য হয়ে ১৮৮৪ সালে কোম্পানি উঠে গেল। বন্ধ হয়ে গেল কারখানা। ওই সময় বালুচরনিবাসী রায় বাহাদুর ধনপতি সিংহ কারখানা কিনে নেন। ১৯০৬ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত এ কারখানা চালু ছিল। কমে যাচ্ছে খেজুর গাছ আশঙ্কার কথা হচ্ছে, দিন দিন খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বৃক্ষ নিধনকারীদের নজর পড়েছে বেশ কিছুকাল আগে থেকেই। তারা উচ্চ মূল্য দিয়ে ইটভাঁটার জন্য খেজুর গাছ কিনছে। অন্যান্য অর্থকরী ফসলের চাষাবাদের দরুন খেজুর গাছের উপর মানুষের নির্ভরতা কমে গেছে। এখন পেশাদার গাছিদের তেমন একটা দেখতে পাওয়া যায় না। পরিকল্পিতভাবে খেজুর গাছ লাগানোর কোনো উদ্যোগও নেই। অর্থনৈতিকভাবে চাষিদের কাছে এটা তুলে ধরার সরকারি উদ্যোগও নেই। তবুও গাছিরা আছেন। আগে একজন গাছিকে যেখানে একটি এলাকা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হত, এখন তাদের কয়েকটি পাড়া কিংবা গ্রামে কাজ করতে হয়। শীত পড়লেই দিন শেষে বাঁক বোঝাই ভাঁড় নিয়ে তারা ছোটেন খেজুর বাগানে। ধারালো দা-এর কোপে বৃক্ষের বুক বিদীর্ণ করে বের করে আনেন মিঠা রস। ‘গাঁও-গেরামের’ অভাবী সংসারও রস, গুড়, পিঠা-পায়েসের মৌ মৌ গন্ধে ভরে যায়। আর খেজুর গাছ শুধু রস দিয়েই ক্ষান্ত হয় না। খেজুর পাতা দিয়ে পাটি তৈরি হয়। অনেক এলাকায় একে বেদে পাটি বলা হয়। খেজুর পাতা দিয়ে এক ধরনের সাহেবী টুপিও তৈরি হয়। খেজুর পাতা, ডাল এবং গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গ্রামে মোরুব্বা তৈরিতেও খেজুর কাটার ব্যবহার আছে। শীতের কুয়াশা ঢাকা সকালে, খুব ভোরে পল্লীগাঁয়ের ছেলেমেয়েরা ঘুম থেকে উঠেই খড়কুটোয় আগুন জ্বেলে আগুন পোহায়। অপেক্ষা করে কখন শরীরটা একটু গরম হয় এবং রোদ ওঠে। তখন রোদ পোহাবে। অপেক্ষার আরো একটি কারণ আছে। তা হলো খেজুর রস। কখন রস আসবে সে অপেক্ষায় বসে আছে তারা। এ দৃশ্য এখনও চোখে পড়ে। আর তোমরা যারা গ্রামে থাকো, এটা তো তোমরা নিজেরাই করো। খুব ভোরে গাছিরা খেজুর গাছ থেকে ঠিলে ভর্তি রস নিয়ে বাড়িতে আসেন। ভোরবেলার হিমশীতল রস খাওয়ার স্বাদই আলাদা। এ সময় রস খেলে শীত আরো জাঁকিয়ে বসে। শীতে শরীর কাঁপতে থাকে। শীত লাগে লাগুক না, তবুও রস খাওয়ার বিরাম নেই। এক গেলাস, দুই গেলাস খাওয়ার পর কাঁপতে কাঁপতে আরো এক গেলাস মুখে তুলে রোদ পোহানো। রসের সঙ্গে মুড়ি নিলে তার স্বাদ যায় আরো বেড়ে। শীতের সময়ে খেজুরের রসের আসলেই কোনো তুলনা চলে না। তাই খেজুর গাছের প্রতি আমাদের যতœবান হওয়া দরকার। নিজেদের প্রয়োজনেই এই এতিহ্যকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কেননা, এর উপর দেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মানুষের জীবিকা নির্ভর করে। আর দেশী খেজুরেরও অনেক পুষ্টি গুণ আছে এর রস ও গুড়-পাটালির মতো।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ