আহ বৃষ্টি কত মিষ্টি

আহ বৃষ্টি কত মিষ্টি

প্রচ্ছদ রচনা আবদুল হালীম খাঁ জুলাই ২০২৩

বৃষ্টি! আহ কত মিষ্টি! রিম ঝিম। ঝিম ঝিম। ঝুম ঝুম। কত রকম শব্দ। কত ছন্দ। কত গন্ধ। কত স্বাদ। কত সুর। কত মধুর। কত ভাব। কত প্রভাত। বৃষ্টি মনের গহনে গোপনে গোপনে কত ভাব করে সৃষ্টি! আহ্ বৃষ্টি! কত মিষ্টি!

বৃষ্টি শুধু আকাশ থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঝর ঝর পানি নয়, অনন্তের বাণী। শুধু জল নয়, রহস্য ভাবে অতল। টল মল ছল ছল। কল কল চঞ্চল। ভাব বিহবল হৃদয় অঞ্চল। 

বৃষ্টি আকাশ বাতাস এবং মানব মনপ্রাণকে দারুণভাবে প্রভাবিত ও আন্দোলিত করে। মূক মানুষের মুখে ভাষার বন্যা আনে। তপ্ত সুপ্ত ঘুমন্ত মন প্রাণ জাগিয়ে তোলে। ভাবায়। স্বপ্ন দেখায়। কবিতা লেখায়। ছবি আঁকায়। ভাবের অনন্ত গগনে ওড়ায়। ঘুরায়। কোথা থেকে ভেসে আসে অনির্বচনীয় বাণী! অন্ধজনের চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠে হিরণ আলো!

বৃষ্টি তার কোমল পরশ দিয়ে অনুর্বর মাঠ-ঘাট পথ-প্রান্তর করে সরস। শ্যামল। শহর বন্দরের অতি গলির ধুলো ময়লা আবর্জনা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দেয়। বন প্রান্তরে এবং রাস্তার দু’পাশে অগণিত বৃক্ষ দিন রাত দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টির প্রতীক্ষা করে। বৃষ্টি এলে দূর থেকেই মাথা নেড়ে শাখার পাতা নেড়ে সালাম জানায় আসুন আসুন-আহলান সাহলান। তারপর প্রতীক্ষিত বৃক্ষ ও মাঠের ফসলগুলো আনন্দে গোসল করে। তপ্ত শরীর জুড়ায়। বৃক্ষের পাতায় জমে থাকা ধুলোগুলো ধুয়ে যায়। পাতাগুলো সরস ও সজীব হয়ে ওঠে। ওরা আনন্দে হেসে ওঠে। সূর্যের আলোতে সবুজ পাতাগুলো উজ্জ্বলতায় চিকচিক করে। ছোটো ছেলে মেয়েরা বৃষ্টিতে ভিজে যেমন আনন্দে নাচানাচি করে, বৃক্ষরাও তেমনি শাখা নেড়ে পাতা নেড়ে আনন্দ প্রকাশ করে। বৃষ্টি! আহ কত মিষ্টি!

খরাদগ্ধ মাঠ ঘাট বৃষ্টির পানিতে ভরে যায়। মাঠের ফসল, বৃক্ষের ফল বাগানের ফুল আনন্দে হাসে। দিবসের আয়নায় মুখ দেখে। ফুলের কলিগুলো পর্দার আড়াল থেকে মুখ বের করে তাকিয়ে তাকিয়ে পৃথিবী দেখে। আহ! পৃথিবী কত সুন্দর!

বৃষ্টি ভেজা শীতল বাতাস বৃক্ষের শাখায় প্রশাখায় আনন্দে দোল খায়। পাখিরা আনন্দে গান ধরে-কুহু কুহু-পিউ পিউ। পাখিরা কী গান করে! আমাদের মতো ওদের কি ভাষা আছে! ওরা কি বইপত্তর পড়ে। ওদের কি স্কুল কলেজ আছে! হ্যাঁ ওদেরও ভাষা আছে। ওরা লেখাপড়া করে। প্রকৃতির বিশাল রাজ্য জুড়ে ওদের স্কুল কলেজ। ওরা রোদ বৃষ্টি আলো বাতাস আকাশ মেঘ গ্রহ নক্ষত্র আরো অনেক বড়ো বড়ো বই পড়ে। ওরা বৃক্ষের ডালে ডালে বাসা বাঁধে। ফল খায়। পানি খায়। অসীম আকাশে ডানা মেলে ওড়ে। পুকুরে ডোবা নালায় ঝিমিয়ে পড়ে থাকা ব্যাঙগুলো বৃষ্টির পরশ পেয়ে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর বাজনা বাজাতে শুরু করে। মাঠে মাঠে কৃষকের ক্ষেত নিড়ায়, ধান কাটে আর গান করে। পানিতে জেলেরা জাল টেনে মাছ ধরে আর গান করে। মাঝিরা নায়ে পাল তোলে। হাল ধরে গান গায়। 

মানব মনে ও প্রকৃতির রাজ্যে এই যে নানা ভাবের অভিনব প্রভাব এবং পরিবেশ সৃষ্টি করে,- সে কে! বৃষ্টি। শুধু বৃষ্টি। শুধু বৃষ্টি। 


বৃষ্টির যাদুকরী ক্ষমতা আছে

বৃষ্টি মাঠ ঘাট ভাসায়। 

কখনো বাড়ি ঘর ভাসায়। 

নদ নদী খালবিল ভরে। 

ঝরনা ধারায় নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। 

বৃক্ষ লতাপাতায় নব রূপ দান করে। 

মানুষকে প্রভাবিত ও আন্দোলিত করে মনে প্রাণে আনন্দের বান আনে। 

আহ বৃষ্টি কত মিষ্টি!

আহ! বৃষ্টি ভেতরে বাইরে কত কী করে সৃষ্টি!

বৃষ্টি মহান আল্লাহর অপূর্ব দান। আল্লাহর অসীম রহমত। 

দীর্ঘ খরার পর আকাশে জলে ভরা এক খণ্ড কালো মেঘ মানুষের মনে আশার সঞ্চার করে। এই তো এক্ষুনি ঝর ঝর বৃষ্টি নামবে। আর যখন ঝর ঝর, ঝুম ঝুম বৃষ্টি ঝরতে শুরু করে, তখন কী যে আনন্দ লাগে! তখন ভিজে ভিজে গোসল করতে ভালো লাগে। ঘরে বসে ভাবতে ভালো লাগে। জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। বৃষ্টির ধারাপাত পাঠ শুনতে ভালো লাগে। গান গাইতে ভালো লাগে। আহ বৃষ্টি কত মিষ্টি!

বৃষ্টি কি শুধু মানুষের মনপ্রাণকে আনন্দে প্রভাবিত করে! নদ-নদী বিলে ঝিলে পুকুরের মাছগুলো বৃষ্টি শুরু হলে আনন্দে ছোটাছুটি করে। সাট মারে বারে বারে। ডোবা নালায় আটকে পড়া মাছগুলো মুক্তির আনন্দে স্রােত ধারায় ছুটতে থাকে। 

বৃষ্টির সাথে বর্ষার অন্তরঙ্গ মিতালি আছে। বৃষ্টি এলে বর্ষা আসবেই। আর বর্ষা এলে বৃষ্টিও আসবেই। বৃষ্টি আর বর্ষার পানিতে নদ-নদী মাঠ-ঘাট পুকুর পগার যখন ডুবে একাকার হয়ে যায়। তখন সে কী যে আনন্দ! বড়শি জাল জালি দিয়ে মাছ ধরার ধুম পড়ে যায়। ছেলে-মেয়েরা আর ঘরে বসে থাকতে পারে না। তারা আনন্দে নেচে ওঠে। মাছ ধরতে যায় ছড়া কাটতে কাটতে :

বর্ষা এলো খালে বিলে ধানের ক্ষেতে ভাই,

আয়রে সবাই জাল নিয়ে মাছ ধরতে যাই।

মাছ ধরবো হাসি খুশি বৃষ্টি জলে ভিজে

এমন দিন গান গেয়ে আনন্দ সে কী যে!


সত্যি আনন্দ! অপূর্ব আনন্দ। এমন আনন্দ আর নেই। 

বর্ষা আর বৃষ্টি অভিন্ন হৃদয়। এক প্রাণ এক সুর। দু’জন এক সময় আনন্দে নূপুর বাজিয়ে প্রকৃতির মঞ্চে এসে নাচ গান আর অভিনয় শুরু করে। কখনো ওরা আসে আকাশে বাতাসে ঢাকঢোল বাজিয়ে দ্রিম দ্রিম যুদ্ধের বাদ্য বাজনা বাজিয়ে বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিকে দিকে। দুর্বার গতিতে। 

বর্ষা কী যে দুরন্ত। কী যে অবুঝ চঞ্চল। আমাদের আনন্দ হাসি দেখে ওরা হাসতে হাসতে এসে নদীর কূল ভাঙে, জমি জিরাতের ফসল ডুবিয়ে দেয়। বাড়ি ঘর ভাসিয়ে দেয়। কী যে দুরন্তপনা শুরু করে! তখন সত্যি সত্যিই আমাদের মন খারাপ হয়ে যায়। আমাদের আদরের ছেলেমেয়েরা যেমন মাঝে মাঝে রাগ করে থালা গ্লাস ভাঙে তাতে তো আমরা রাগ করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিই না, মারিও না। এমনি আর কি। বৃষ্টি মাঝে মাঝে আমাদের ক্ষতি করে। তবু ওদের ছাড়া আমাদের চলে না। আমরা ওদের আদর করি। খুব ভালোবাসি। 

বৃষ্টি শুধু আমাদের মাঠে ফসল ফলায় না, বৃক্ষে ফল ফলায় না, বাগানে ফুল ফুটায় না, নদ-নদী বিলে পানি দেয় না, বৃক্ষ তৃণলতা সজীব সরস করে না, বৃষ্টি আমাদের কাব্য সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে, কানায় কানায় ভরে তুলেছে। বৃষ্টি ভুবন মোহন রূপে প্রভাবিত হয়ে যুগে যুগে আনন্দ সুখে আপ্লুত হয়ে শতশত কবি কত মজার যে নানা রঙের ছবি এঁকেছেন তার হিসেব নেই। আর সে সব হয়েছে অপূর্ব সুন্দর। বিশ্বজন নন্দিত। বৃষ্টির পায়ের নূপুরের রিনি ঝিনি রূম ঝুম ঝুম ঝুম সুরে মুগ্ধও বিমোহিত হয়ে আমাদের শত শত কবিরা কাব্য সাহিত্য রচনা করেছেন। সে সব কতই না সুন্দর! কতই না মধুর! বৃষ্টি নিয়ে গান-কবিতা, ছড়া প্রভৃতি লেখা শুরু হয়েছে বাংলা সাহিত্যের আদিকাল থেকে। সেইযে শুরু তার রেশ এখনও চলছে। এমনকি আজকের দিনে যারা কবিতা লিখছেন, তারা পর্যন্ত বৃষ্টিকে ধারণ করছেন। এ এক অনন্ত বৃষ্টিপ্রেম!

এরপরও যে সকল কবি আসবেন, তাদেরও এই বৃষ্টি প্রেম আচ্ছন্ন করবে বলে মনে করি। বিখ্যাত কবিদের বৃষ্টি বর্ষা সম্পর্কে অনেক অনেক কবিতা ও ছড়ার বই প্রকাশিত হয়েছে। অনেক ছড়া কবিতা পাঠ্য পুস্তকে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে শিশু কিশোরদের প্রিয় কবি ফররুখ আহমদ এর দুটি ছড়া তুলে দেওয়া হলো : 

১. 

বৃষ্টি নামে রিম ঝিমিয়ে

রিম ঝিমিয়ে রিম ঝিমিেিয়

টিনের চালে গাছের ডালে 

বৃষ্টি নামে হাওয়ার তালে। 

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর

বৃষ্টি নামে মিষ্টি মধুর। (শ্রাবণের বৃষ্টি)


২. 

বৃষ্টি এলো কাশবনে

জাগল সাড়া ঘাসবনে

বকের সারি কোথায়রে

লুকিয়ে গেল বাঁশবনে। 

(ফররুখ আহমদ, বৃষ্টির ছড়া)

বৃষ্টি সমাজের সকল শ্রেণি মানুষের অন্তর দারুণভাবে প্রভাবিত ও আন্দোলিত করে। সবার হৃদয়ের রুদ্ধ দরজা জানালা খুলে দেয়। কবিরা ছড়া কবিতা ও গান রচনা করেন, অশিক্ষিত সাধারণ মানুষও তাদের ভাষায় ছড়া কবিতা ও গান রচনা করেন। এগুলোকে লোকসাহিত্য বলে। লোক সাহিত্যে রয়েছে ছড়া, গীত, গাঁথা ইত্যাদি। এগুলো খুবই জনপ্রিয়। 

দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে মাঠ ঘাট রোদে খরায় ফেটে চৌচির হয়ে যায়। নদী পুকুর খাল বিল শুকিয়ে যায়। মাঠের ফসল ও তৃণলতা শুকিয়ে মরতে শুরু করে। পানির হাহাকার পড়ে যায়। চারদিকে খাঁ খাঁ রোদ্দুর। তখন গ্রামের ছেলেরা একত্র হয়ে দল বেঁধে শরীরে কাদা কালি মেখে বাড়ি বাড়ি উঠোনে গড়াগড়ি করে গান গায় : 

আল্লাহ মেঘ দে পানি দে

ছায়া দে রে তুই

আল্লাহ মেঘ দে...

জমিন হলো টুটা ফাটা

আসমান হলো তামা

মানুষ গরু ক্ষুধায় মরে

অন্তর হলো কালা!

আল্লাহ মেঘ দে পানি দে

ছায়া দেরে তুই 

আল্লাহ মেঘ দে...


এরপর এক সময় যখন আকাশে এক ফালি কালো মেঘ দেখা যায় তখন ছেলেমেয়েরা সমবেত কণ্ঠে কাটতে থাকে-

বিষ্টি আয় ঝাইক্কা

পাতা দিমু কাইট্টা

গুড় মুড়ি খাবি

নয়া জামা পাবি

মাঠ ঘাট উঠান

দিয়া যা ভাইস্যা....


বৃষ্টি তো এক সময় আসে। যখন অতিরিক্ত বর্ষণ শুরু হয়। লোকজন ঘর থেকে বের হতে পারছে না। কাজ করতে পারছে না। কখনো হয়তো বৃষ্টি হচ্ছে আবার রোদও ঝিলিক দিয়ে উঠছে। তখন ছেলেমেয়েরা ছড়া কাটতে শুরু করে :

রোদ হচ্ছে বিষ্টি হচ্ছে

খেঁক শিয়ালের বিয়ে হচ্ছে-


বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এমনি আরো অসংখ্যা লোক ছড়া গীত-গাল ছাড়িয়ে রয়েছে। এই সব ছড়া গীত-গান থেকে মানব মনের বিচিত্র ভাব আবেগ চিন্তা ভাবনা সহজেই বোঝা যায়। আবার প্রকৃতির বিচিত্র রূপ রঙ সাজ আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বৃষ্টির বিচিত্র রূপ আমাদের মন ভরে আছে। মন প্রাণ জুড়ে আছে। 

বৃষ্টি আমাদের সুখ দুঃখ আনন্দ হাসি এবং কৃষি শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির প্রধান উৎস ও উপাদান। বৃষ্টি আমাদের সজীব সচেতন সতেজ সরস এবং সুন্দর করে, কর্মে প্রেরণা দান করে। 

বৃষ্টি মহান আল্লাহর এক অপূর্ব নিয়ামত ও সৃষ্টি। আহ বৃষ্টি! কত সুন্দর! কত মিষ্টি!

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ