আল্লাহর সাথে মহানবী সা. এর সাক্ষাৎ

আল্লাহর সাথে মহানবী সা. এর সাক্ষাৎ

বিশেষ রচনা মে ২০১৫

এইচ এম মুশফিকুর রহমান#

রজনী দ্বিপ্রহর। ঘন অন্ধকারে আকাশ আচ্ছন্ন। নির্জন চারিদিক। কোন দিকে পাখির ডাক নেই। আর নেই কোন কোলাহল। অন্য দিনের চেয়ে প্রকৃতির স্বভাব আজ ভিন্ন রকম। কাবাঘরের চত্বরে ঘুমিয়ে আছেন মহানবী সা:। এমন সময় তিনি শুনতে পান, কে যেন তাঁকে ডাকছে ‘মুহাম্মাদ’ ডাক শুনে মহানবী সা:-এর ঘুম ভেঙে গেল। জেগে দেখেন ফেরেশতা জিবরাইল আলাইহিস সালাম শিয়রে দাঁড়িয়ে আছেন। অদূরে ‘বোরাক’ নামক একটি অদ্ভুত আলোকিত বাহন। ডানাবিশিষ্ট অশ্বের মতো তার রূপ, ক্ষিপ্র তার গতিবেগ। জিবরাইল আলাইহিস সালাম প্রথমেই মহানবী সা:-এর হৃদয় পরীক্ষা করলেন ও শক্তিশালী করে দিলেন। তারপর মহানবী সা:কে সেই বোরাকে চড়বার জন্য ইঙ্গিত করলেন। মহানবী সা: বোরাকে আরোহণ করলেন। মুহূর্তের মধ্যে বোরাক মহানবী সা:কে নিয়ে জেরুসালেমের শীর্ষদেশে এসে উপনীত হলো। জিবরাইল আলাইহিস সালামের ইঙ্গিতে মহানবী সা: সেখানে নামলেন। বোরাক বাইরে রেখে তিনি জেরুসালেমের মসজিদে প্রবেশ করলেন এবং পরম ভক্তিভরে দুই রাকাত সালাত আদায় করলেন। এই মসজিদকে কিবলা করে মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতদিন সালাত আদায় করতেন। আজ সেই পবিত্র স্থান স্বচক্ষে দেখে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করলেন। এখান থেকে জিবরাইল আলাইহিস সালাম মহানবী সা:কে নিয়ে ঊর্ধ্বাকাশ পানে রওনা দেন। মুহূর্তের মধ্যে তাঁরা প্রথম আসমানের প্রবেশদ্বারে এসে উপনীত হন এবং দরজা খুলতে বলেন।  ভেতর থেকে পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হলো, জিবরাইল আলাইহিস সালাম স্বীয় পরিচয় প্রদান করলেন। অতঃপর জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনার সঙ্গে কে আছেন? জিবরাইল আলাইহিস সালাম বললেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আছেন। তারপর মুবারকবাদ জানিয়ে দরজা খোলে দিলেন ফেরেশতারা। তাঁরা গেটের ভেতরে প্রবেশ করে তথায় আদম আলাইহিস সালামকে দেখতে পান। জিবরাইল আলাইহিস সালাম মহানবী সা:কে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, তিনি আপনার আদি পিতা আদম আলাইহিস সালাম। তাঁকে সালাম করুন। মহানবী তাঁকে সালাম করলেন। তিনি সালামের উত্তর দানে “সুযোগ্য পুত্র ও সুযোগ্য নবী” আখ্যায়িত করলেন এবং খোশ আমদেদ জানালেন। জিবরাইল আলাইহিস সালাম এবার মহানবী সা:কে নিয়ে দ্বিতীয় আসমানের দ্বারে পৌঁছলেন এবং দরজা খুলতে বললেন। এখানেও আগের মতো কথোপকথন হলো এবং শুভেচ্ছা মুবারকবাদ জানিয়ে দরজা খোলা হলো। ভেতরে প্রবেশ করে তথায় ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম ও ঈসা আলাইহিস সালামের সাথে সাক্ষাৎ হলো; তাঁদের উভয়ের নানী পরস্পর ভগ্নি ছিলেন। জিবরাইল আলাইহিস সালাম মহানবী সা:কে তাঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সালাম করতে বললেন, মহানবী তাঁদেরকে সালাম করলেন। তাঁরা মহানবী সা:-এর সালামের উত্তর প্রদান করে : ‘সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী’ বলে খোশ আমদেদ জানালেন। তারপর জিবরাইল আলাইহিস সালাম মহানবী সা:কে নিয়ে তৃতীয় আসমানের দ্বারে পৌঁছলেন এবং দরজা খুলতে বললেন। আগের মতোই কথোপকথনের পর শুভেচ্ছা স্বাগত জানিয়ে দরজা খোলা হলো। তারা ভেতরে প্রবেশ করে ইউসুফ আলাইহিস সালামের সাক্ষাৎ পান। জিবরাইল আলাইহিস সালাম মহানবী সা:কে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সালাম করতে বললেন; মহানবী সা: তাঁকে সালাম করলেন। তিনি সালামের উত্তর দান করে ‘সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী’ বলে মুবারকবাদ জানালেন। অতঃপর জিবরাইল আলাইহিস সালাম মহানবী সা:কে নিয়ে চতুর্থ আসমানের কাছে পৌঁছলেন এবং দরজা খুলতে বললেন। সেখানেও আগে মতো প্রশ্নোত্তরের পর শুভেচ্ছা স্বাগত জানিয়ে দরজা খোলা হলো। ভেতরে প্রবেশ করে তথায় ইদরিস আলাইহিস সালামের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। জিবরাইল আলাইহিস সালাম মহানবী সা:কে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সালাম করতে বললেন। মহানবী সা: তাঁকে সালাম করলেন। তিনি সালামের উত্তর দিলেন এবং ‘সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী’ বলে মারহাবা জানালেন। এরপর জিবরাইল আলাইহিস সালাম মহানবী সা:কে নিয়ে পঞ্চম আসমানে পৌঁছলেন এবং দরজা খুলতে বললেন। এই স্থানেও আগের মতোই প্রশ্নোত্তর চলার পর শুভেচ্ছা ও মুবারকবাদ জানিয়ে দরজা খোলা হলো। ভেতরে প্রবেশ করে হারুন আলাইহিস সালামের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। জিবরাইল আলাইহিস সালাম মহানবী সা:কে তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সালাম করতে বললেন। মহানবী সা: তাঁকে সালাম করলেন। তিনি সালামের উত্তর দিলেন এবং ‘সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী’ বলে খোশ আমদেদ জানালেন। অতঃপর জিবরাইল আলাইহিস সালাম মহানবী সা:কে নিয়ে ষষ্ঠ আসমানের দরজায় পৌঁছলেন এবং দরজা খুলতে বললেন। এ স্থানেও পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হলো জিবরাইল আলাইহিস সালাম স্বীয় পরিচয় দান করেন, অতঃপর সঙ্গে কে আছে জিজ্ঞাস করা হলো। তিনি বললেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তৎক্ষণাৎ শুভেচ্ছা ও মুবারকবাদ জানিয়ে দরজা খোলা হলো। তথায় প্রবেশ করে মূসা আলাইহিস সালামের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। জিবরাইল আলাইহিস সালাম মহানবী সা:কে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সালাম করতে বললেন। মহানবী সা: তাঁকে সালাম করলেন। তিনি সালামের উত্তর প্রদান করলেন এবং ‘সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী’ বলে মুবারকবাদ জানালেন। তারপর জিবরাইল আলাইহিস সালাম মহানবী সা:কে নিয়ে সপ্তম আসমানে  আরোহণ করলেন এবং দরজা খুলতে বললেন। এ স্থানেও আগের মতোই সকল প্রশ্নোত্তরের পর দরজা খুলে শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানানো হলো। তথায় ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। জিবরাইল আলাইহিস সালাম মহানবী সা:কে বললেন, তিনি আপনার বংশের আদি পিতা, তাঁকে সালাম করুন। মহানবী সা: তাঁকে সালাম করলেন। তিনি সালামের উত্তর দিলেন এবং ‘সুযোগ্য পুত্র ও সুযোগ্য নবী’ বলে মারহাবা ও মুবারকবাদ জানালেন । মহানবী এবার সিদরাতুল মোনতাহার নিকট উপনীত হন। জিবরাইল আলাইহিস সালাম মহানবী সা:কে বললেন, সিদরাতুল মোনতাহা হলো একটি কুলবৃক্ষের নাম। এই বৃক্ষের এক একটা কুল হজর অঞ্চলে তৈরি বড় বড় মটকার মতো এবং তার পাতা হাতির কানের ন্যায়। জিবরাইল আলাইহিস সালাম এখানেই থেমে গেলেন, আর অগ্রসর হলেন না। কিন্তু মহানবী সা: থামেননি। তিনি একাই বোরাকে করে অগ্রসর হন। বায়তুল মামুর পর্যন্ত গিয়ে বোরাক থেমে যায়। মহানবী সা: ‘বায়তুল মামুর’ পরিদর্শন করেন। তথায় প্রতিদিন ইবাদাতের জন্য সত্তর হাজার ফিরেশতা উপস্থিত হয়ে থাকেন। যে দল একদিন সুযোগ পায় সেই দল চিরকালের জন্য দ্বিতীয় দিন সুযোগপ্রাপ্ত হয় না। এক অপূর্ব জ্যোতিতে এ স্থান চির¯িœগ্ধ-চিরমনোরম। এখানে এসে মহানবী সা: আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করেন। একটা পর্দার আড়াল টেনে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় রাসূল সা:কে আত্মরূপ দর্শন করান। উভয়ের মধ্যে অনেক গোপন কথা হয়। আল্লাহ তাআলা মহানবী সা:-এর শরিয়তে প্রত্যেক দিন পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করে দেন। মহানবী সা: ফেরার পথে মূসা আলাইহিস সালামের নিকটবর্তী পথ অতিক্রমকালে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, বিশেষ আদেশ কী লাভ করেছেন? মহানবী সা: বলেন, পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত। মূসা আলাইহিস সালাম বললেন, আপনার উম্মত প্রতিদিন পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতে সক্ষম হবে না। সুতরাং আপনি রবের দরবারে আপনার উম্মতের জন্য এই আদেশ আরও সহজ করার আবেদন করুন। মহানবী সা: রবের খাস দরবারে ফিরে গেলেন। রব (দুইবারে পাঁচ পাঁচ করে) দশ ওয়াক্ত কম করে দিলেন। এরপর মূসা আলাইহিস সালামের পরামর্শক্রমে মহানবী সা: একাধিকবার আল্লাহর দরবারে ফিরে যান এবং সালাত কমানোর আবেদন করেন। সবশেষে মহানবী সা:-এর জন্য প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত নির্দিষ্ট করে দিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত নিয়ে মূসা আলাইহিস সালামের নিকট পৌঁছার পর মহানবী সা:কে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী আদেশ লাভ করেছেন? মহানবী সা: বললেন, প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের আদেশ প্রদান করা হয়েছে। মূসা আলাইহিস সালাম বললেন, আপনার উম্মত প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাতও আদায় করতে পারবে না। আপনি আবার রবের দরবারে ফিরে আরও কম করার আবেদন জানান। মহানবী সা: এবার বললেন, রবের দরবারে অনেকবার আসা-যাওয়া করেছি; এখন আবার যেতে লজ্জা বোধ হচ্ছে, আর যাবো না বরং পাঁচ ওয়াক্তের ওপরই সন্তুষ্ট রইলাম এবং তা বরণ করে নিলাম। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর উম্মতের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত সালাত নিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই কাবাঘরে ফিরে আসেন। এসে দেখেন দুনিয়া যেমন চলছিল, ঠিক তেমনই চলছে। অজুর পানি এখনো গড়িয়ে যাচ্ছে, যে পানি দিয়ে রাসূল সা: মিরাজে যাওয়ার সময় অজু করে গিয়ে ছিলেন। সত্যিই! এ এক অন্যরকম মোজেজা, বিস্ময়কর ঘটনাই বটে, যা কেবল আল্লাহর নির্দেশেই সম্ভব এবং এই অলৌকিতা একমাত্র প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা:-এর ভাগ্যেই জুটেছে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ