আরিজের ঈদ

আরিজের ঈদ

তোমাদের গল্প জুলাই ২০১৫

মাহবুবুল হক#

আরিজের বয়স কতো হবে? বড়জোর সাত। এর মধ্যে সে তিন ক্লাস পড়ে ফেলেছে। প্লে গ্রুপ ও নার্সারি শেষ করে এখন সে কেজি ওয়ানে পড়ছে। ওর দাদার সাথে এ নিয়ে তার প্রায় ঝগড়া হয়। ওর দাদা বলেন, ক্লাস ওয়ানে উঠতে উঠতে তুমিতো বুড়া হয়ে যাবে। আর আমিতো কবরে চলে যাবো। আরিজ বলে, তুমিতো গ্রামের পচা স্কুলে পড়েছো আর আমি পড়ছি ঝকঝকে তকতকে সুন্দর স্কুলে। আমরা খেলতে খেলতে পড়ি আর তোমরা মার খেতে খেতে পড়েছো। আমরা তো একদম মার খাই না। শুধু আদর, আদর আর আদর। মিসরা আমাদের কতো আদর করেন। আমরা প্রতিদিন নতুন টিফিন খাই। আর তোমরা ভাত খেয়ে স্কুলে গিয়েছো আবার স্কুল থেকে এসে ভাত খেয়েছো, এ জন্যই তো তোমার পেট এতো মোটা। দাদা চোখ মুছেন।
- তুমি কাঁদছ দাদা! কেন কাঁদছ? ছেলেবেলার কথা বললেই তুমি শুধু কাঁদ, না তোমার সাথে আর গল্প করা যাবে না।
- যাবে, যাবে দাদাভাই। তোমার বড় আব্বার কথা, অর্থাৎ আমার আব্বার কথা মনে পড়ে যায়। তোমার আব্বা যেমন ডাক্তার, আমার আব্বা ছিলেন স্বাস্থ্য কর্মচারী। অল্প বেতনের চাকুরে ছিলেন। আমরা ছিলাম ৮ ভাই ৩ বোন। সংসারে অভাব না থাকলেও টানাটানি ছিল। আমরা বড়রা কম খেয়ে ছোটদের খাওয়াতাম। ছোটরা বুঝতো না। সকাল ৯টায় ডিম ভাত ঘি, ভাত আলু, ভাত বা ডাল ভাত খেয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুল থেকে এসে বিকালে আবার ভাত খেতাম। মাঝে দুপুরে কিছু খেতাম না।
- তোমরা আমাদের মতো মাছ, গোশত খেতে না?
- খেতাম, তবে কিনে নয়। আব্বা অফিস থেকে এসে শীবসাগর, জুলুম সাগর- এসব নামের বড় বড় দিঘিতে ছিপ ফেলতেন। ছিপে মাছ উঠে আসতো। বড় বড় মাছ।
- ছিপ কী দাদা?
- মাছ ধরার ছোট্ট যন্ত্র বা ব্যবস্থা। এতে একটা সরু বা চিকন লাঠি থাকে, একে বলে ছিপ। ছিপের আগায় থাকে শক্ত সুতা। সুতার অগ্রভাগে থাকে বড়শি। এই বড়শিতেই থাকে মাছের জন্য শক্ত ও আঠালো খাবার। খাবারটা গিললেই মাছের গলায় বড়শি আটকে যায়। এভাবেই বড় বড় মাছ আসতো আমাদের বাসায়।
- দাদা, আমাকে ছিপ বা বড়শি দেখাবে?
- অবশ্যই দেখাবো, এইতো আমাদের লেকের পাড়ে গেলেই দেখতে পাবে কতজন ছিপ নিয়ে বসে আছে।
- আচ্ছা দাদা, ছোটকালে তোমাদের কি ফ্রিজ ছিলো?
- না তো দাদা ভাই, ফ্রিজতো কিনলাম আমার আমলে, আমার আব্বার আমলে আমাদের ফ্রিজ ছিলো না।
- তবে বড় বড় মাছগুলো কোথায় রাখতে, কিভাবে রাখতে?
- সে এক মহা কাহিনী।
- বলই না।
- আব্বা মাছ না নিয়ে কোনো দিন বাসায় ফিরতেন না। ছিপে না পেলে দিঘির মালিকরা জাল দিয়ে হলেও একটা রুই মাছ, কাতলা মাছ আব্বার হাতে তুলে দিতেন। ফিরতে ফিরতে কোনো কোনো দিন আব্বার দুপুর রাত হয়ে যেতো। ঐ রাতেই মাছটিকে আব্বা তিন ভাগ করতেন। এক ভাগ পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে বিলি বণ্টন করতেন। রাতে না পারলে সকালে। দুই ভাগের মধ্য থেকে বেশ কিছুটা দিতেন সহকারীদের, যারা আব্বার সাথে মাছ ধরতে যেতেন। আমরা বড়রা, যারা জেগে থাকতাম বা আব্বা এলে জেগে যেতাম, তাদের ভাগ্য ছিলো বড় ভালো। ঐ রাতেই আমরা আম্মার কল্যাণে একটুকরা মাছ ভাজি খেতাম। এটা ছিল আব্বার এক ধরনের শখ। অবশিষ্ট মাছ আম্মা ভাজি করে বা জাল দিয়ে রেখে দিতেন। আম্মা নানাভাবে সেসব মাছ রান্না করে আমাদের খাওয়াতেন।
- তা হলে তো তোমরা ভালোই ছিলে!
গল্প করতে করতেই ইফতারের সময় হয়ে এলো। আজ ২৯ শে রমজান। আরিজ আজ রোজা রেখেছে। ওর মা ও দাদী আরিজের জন্য স্পেশাল ইফতার বানাচ্ছেন। ওর বাবা ডা: বান্না নানা রকম ফল নিয়ে মাত্র ঘরে প্রবেশ করেছেন। এই মুহূর্তে ঘরটা যেন আনন্দে থৈ থৈ করছে। নানা রকম খাবারের সুবাসে ঘরটা মৌতাত হয়ে আছে। আরিজের দাদা বললেন, চলো দাদা ভাই টিভি খুলি। টিভিতে ইফতারের অনুষ্ঠান দেখি। ‘নব’ ঘোরাতে ঘোরাতে এনটিভিতেই থিতু হলেন দাদা। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক জয়নুল আবেদিন আজাদই উপস্থাপনা করছেন।
সুন্দর সুন্দর কথা বলছেন। সবসময় তিনি চমৎকার অনুষ্ঠান উপহার দেন। আজও দরাজ গলায় বলছেন, মহান আল্লাহ শুধু সৃষ্টিকর্তা নন, মালিক নন, তিনি সর্বময় ক্ষমতার মালিক, তিনি ইলাহ। ইলাহ মানে কি জানো? ইলাহ এর অর্থ আল্লাহ একমাত্র হুকুমদাতা, একমাত্র আদেশদাতা, একমাত্র নিষেধদাতা, একমাত্র উপদেশদাতা, একমাত্র আইনদাতা, একমাত্র বিধানদাতা। দুনিয়া ও আখিরাতে আর কোনো আইন ও বিধানদাতা নেই। অথচ দেখো দুনিয়া, এমনকি আমাদের দেশেও আল্লাহর আইন ও বিধান চালু নেই। আমরা আল্লাহর কথা শুনছি না বা মানছি না আমাদের দেশ এবং আমাদের সমাজ যেসব আইনের দ্বারা চলছে, সেসব আইন ও বিধান আল্লাহর নয়, অন্য দেশের, অন্য জাতির, এমনকি অন্য ধর্মেরও ...। আরিজ মন দিয়ে শোনে। বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু সব কিছু ভালোভাবে বুঝতে পারে না।
হঠাৎ দাদা ভাই আরিজের গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলেন, এই দাদা ভাই, এবার তুমি ক’টা রোজা রেখেছো?
- দাদা ভাই, তুমি না সব ভুলে যাও, তোমাকে না ভিটামিন বি কমপ্লেক্স খেতে হবে। আরে একবারই তো আমি প্রথম রোজা রেখেছি। এর আগের বছরতো রেখেছি দিনে ২টা। তখনতো আমি ছোট ছিলাম।
- দাদা হেসে বলেন, এবার বড় হয়েছো না। তা এবার ক’টা রোজা রেখেছো?
- শুরুতে দু’টা, মাঝে একটা আর শেষে রাখবো দু’টা। তার একটাতো আজ হয়ে যাচ্ছে। আগামীকাল তো শেষ রোজা! কালকের রোজা তো আমি রাখবোই।
- ইনশাআল্লাহ বলো। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া রোজা রাখবে কী করে? কালতো ঈদও হতে পারে।
মনটা খারাপ হয়ে যায় আরিজের। কাল ঈদ হলে আর একটা রোজা রাখা হলো না। রোজা রেখে ইফতার করতে ওর খুব মজা লাগে।
- কী ব্যাপার চুপ করে গেলো সে।
- না, ঈদ হলে আমার যে রোজাটা রাখা হবে না।
- আরে পাগল, ঈদওতো আনন্দের, অনেক আনন্দের, অনেক মজার। ঈদে সবাই মিলে আনন্দ করলে আল্লাহ খুশি হন।
কথার মাঝেই মাগরিবের আজানের ধ্বনি শোনা যায়।
সবাই ঝটপট ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ে। ছোট্ট দোয়া সেরে সবাই ইফতার শুরু করে। টেবিলে তিন ধরনের ইফতার। প্রতিবেশীদের পাঠানো ইফতার, বাসায় বানানো ইফতার এবং বাজার থেকে ক্রয় করা ইফতার।
নামাজ শেষ হতেই চারদিক থেকে শোরগোল শোনা যায়। টিভিটা খোলাই ছিল। সেখান থেকে ভেসে আসছে ওমন ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। সব বাসার সব টিভি থেকে একটি গানই ভেসে আসে। জাতীয় কবি নজরুলের অবিস্মরণীয় গান।
দাদা সবাইকে নিয়ে ছাদে যান। ফ্ল্যাটের ছেলেমেয়ে সবাই ছাদে উঠেছে। ঐ তো, ঐতো বলে পাশের বাসায় বাবুল চিৎকার করে উঠলো। সবাই যার যার মতো বাবুলের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে তাকালো। দেখেছ, দেখছি বলে শুধু কিশেরাই হইচই করতে লাগলো। দাদা বললেন, সবাই মিলে আলহামদুলিল্লাহ বলো। সবাই গলা ছেড়ে বললো- আলহামদুলিল্লাহ।
হইচই করতে করতে সবাই যার যার বাসায় চলে গেল। দাদা আরিজের বাবা ডা: বান্নাকে ডেকে বললেন : কারো কোনো কেনাকাটা বাকি আছে কি না।
- হ্যাঁ আব্বু, সবার জন্য দুই সেট করে ঈদের কাপড় কেনা হয়েছে। কিন্তু কাজের মেয়েদের জন্য কেনা হয়েছে মাত্র এক সেট করে।
- দাদাভাই দাদাভাই এটা কি ঠিক হলো?
- না, দাদাভাই এটা ঠিক হয়নি। আমাদের প্রিয় নবী (সা:) বলেছেন তোমরা যা খাবে, গৃহকর্মীদর তা-ই খাওয়াবে। তোমরা যা পরবে, তাদেরকে তাই পরাবে।
- চলো তা হলে এখনই বাজারে খাই, স্বপ্ন ও মমতার জন্য আরেক সেট করে কাপড় কিনে আনি।
- যাবো, অবশ্যই যাবো, তার আগে আমার আম্মা অর্থাৎ তোমার বড় মাকে ঈদের সালাম জানাই। ঈদের সালাম জানাই তোমার সকল দাদা ভাইও দাদুকে।
- এই আরিজের দাদা, আতর লাগবে, সুরমা লাগবে আর লাগবে গোলাপপানি আর মেহেদি- পাশ থেকে আরিজের দাদী কথা বলেন।
- তোমরা জন্য কাজল লাগবে না?
- লাগবে, বিয়ের কাজল দানিটা এখনও আমার কাছে আছে। তুমি বরং বৌমার জন্য এক শিশি আলতা নিয়ে আসবে।
এশার আজান পড়ে। পাশেই ধানমন্ডি-৭ এর বিশাল মসজিদ। আরিজ, আরিজের বাবা ও দাদা মসজিদে যান। নামাজ শেষে ওরা নিউমার্কেটে যান। তালিকা অনুযায়ী সব কিছু কিনেন।
আরিজ বলে, দাদাভাই, এক সেট কাপড় বেশি করে কিনে নাও, যদি আবার কারো লাগে। তোমাদের ঐ গল্পটা মনে নেই? আমাদের প্রিয় নবী (সা:) ঈদের দিন রাস্তায় বস্ত্রহীন এক কিশোরের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। এবার তো দেশে অভাব, হয়তো ঈদের মাঠে বস্ত্রহীন কোনো ছেলেকে পাওয়া যাবে। দাদাভাই আরিজের কপালে বিশাল এক চুমু খেয়ে বললেন, বেঁচে থাকো দাদাভাই, বেঁচে থাকো। তুমি অনেক ভালো কথা বলেছো। চলো আরেক সেট কাপড় আমরা কিনে নিই।
আরেক সেট কাপড় দেখে স্বপ্ন ও মমতার খুশি দেখে কে!
ইবাদত-বন্দেগি, রান্নাবান্না, এসএমএস ও ঈদ মোবারক বলে ফোন করতে করতে রাতটা কেটে যায়। আরিজের চোখে ঘুম নেই। সে একবার কিচেনে বুবুমনি (দাদী) ও মায়ের কাছে, আবার দাদাভাইয়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। তার মনে অনেক প্রশ্ন, অনেক আনন্দ আর অনেক জিজ্ঞাসা।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ