আমার বন্ধু কেমন হওয়া চাই

আমার বন্ধু কেমন হওয়া চাই

ফিচার আবদাল মাহবুব কোরেশী জুন ২০২৩

“কু সঙ্গে সং, গলায় ঢং ঢং” অথবা “সঙ্গ গুণে লোহা জলে ভাসে” ছোটোবেলা থেকে এ প্রবাদ দুটি মরহুম দাদাজান প্রায়ই বলতেন। অসংলগ্ন কোনো দুষ্টুমি করেছি অথবা কোনো ধরনের আদবের খেলাপ করেছি- তো রক্ষা নেই। কান ধরে উঠবস করা আর লন্বা হন্নার ছড়ির (জালি বেতের লাঠি) দু-তিন ঘা ছিল অবধারিত, সাথে এ প্রবাদ দুটির সরব উচ্চারণ ছিল দাদার ঠোঁটস্থ বুলি। শাসন-বারণে যা আমাদের হজম করতে হতো প্রতিনিয়ত। অনেক সময় পাঠ্যবই পড়ার আগে দাদার সাথে কোরাস কণ্ঠে প্রবাদ দুটি সুর করে জপতে হতো। তৎকালীন সময়ে প্রবাদ দুটির ভাবার্থ ঠিক না বুঝলেও সময়ের ব্যবধানে এখন তা বেশ বুঝতে পারি। বুঝতে পারি দিন, কাল, সময় ও বোধশক্তি একেক সময় একেক ভাবে মানুষকে চালিত বা আসক্ত করে। বিশেষ করে একটি বয়েসের কথাই ধরা যাক, হাঁটিহাঁটি পা-পা করে একটি শিশু যখন বর্ণমালার পাঠ চুকিয়ে কিশোর বয়সে পা রাখে তখন থেকেই শুরু হয় তার অনন্ত রঙিন স্বপ্ন দেখার খোয়াব। এ খোয়াবে কখনো সে রাজপুত্র, কখনো এলাকার তথাকথিত বড়োভাই, কখনো নায়ক, কখনো গায়ক কখনো শিল্পী আরো কত কী! এ সমস্ত আজগুবি খোয়াব দেখা একটি কিশোরের জন্য কোনো অপরাধ নয়, অমূলকও নয়। বরং এটা তার বয়সের দাবি- সে এ বয়সে এসব স্বপ্ন দেখতেই পারে, দেখাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা হলো- সময় ও বয়সের সাথে তাল রেখে একটি শিশু যখন আপন গণ্ডি অর্থাৎ তার পরিবার থেকে বের হয়ে বাইরের আবহাওয়ার সাথে পরিচিত হয় যখন তার মুক্ত ডানা আর উড়ন্ত মনে ভর করে প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধব, স্কুলের সহপাঠী ও সমবয়সী শুভাকাক্সক্ষীরা। কিশোররা এদের নিয়েই তার একটি আলাদা জগৎ তৈরি করে নেয়। এ সময় সে তার বন্ধু-বান্ধবকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে তাদেরকেই পৃথিবীর সবচেয়ে আপনজন হিসেবে মনে করে। কোনো কোনো সময় রক্তের আপন ভাই-বোনের চেয়েও বেশি। ঠিক এ সময়ই একজন বিচক্ষণ অভিভাবকের তার সন্তানের দেখভাল করা, তার চলাফেরার নির্দেশনা দেওয়া ও তার বন্ধু-বান্ধবের খোঁজ খবর রাখা মুখ্য ভূমিকা হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় অভিভাবকের উদাসীনতা ও দায়িত্বের একটু শিথিলতা তার সন্তানের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে, যার মাশুল দিতে হয় জীবনভর। এ ক্ষেত্রে আমাদের মরহুম দাদাজানের সঠিক অভিভাবকত্বের নির্দেশনা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা যায়। আমরা কে, কোথায়, কেমন, কার সাথে মেলামেশা করি, কে আমার বন্ধু,  তার ষোলআনা হিসাব কষে তাকে খুশি করতে হতো। হিসাবের গরমিল হলেই রক্ষে ছিল না। খাওয়া-দাওয়া তো বন্ধ হতোই সাথে বোনাস হিসেবে পিঠে ক’ঘা নাজরানা হিসেবে, ছক্কা-চার খেতেই হতো। এখানে কারো কোনো ধরনের আপিল করা ছিল মস্ত বড়ো অপরাধ। তাই যৌক্তিক কারণেই কোনো কুসঙ্গীর সাহচর্য, এমনকি কোনো বিশেষ কারণ ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। এমন কড়া শাসনের জালে ছিল আমাদের বেড়ে ওঠা। সঙ্গত কারণে আমাদের সে অভিজ্ঞতা আর বর্তমান পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে কিশোর বন্ধুদের জন্য আমার এ লেখার প্রয়াস। আশা করি বন্ধুরা লেখাটা সাদরে গ্রহণ করে নিক্তির ওজনে যথার্থ মূল্যায়নের মাধ্যমে বিচার বিশ্লেষণ করে নিজের সঙ্গী বেছে নেবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

সঙ্গত কারণে প্রথমে আমরা জানতে চেষ্টা করি ‘কু সঙ্গে সঙ গলায় ঢং ঢং’ অথবা ‘সঙ্গ গুণে লোহা জলে ভাসে’ প্রবাদ দু’টির মূল ব্যাখ্যাটা কী? সাধারণত আমরা কু শব্দটি কুৎসা, দোষ, খারাপ, নিন্দা ইত্যাদি অর্থে অন্য শব্দের আগে ব্যবহার করে মূল অর্থটা প্রকাশ করে থাকি যেমন-কুসঙ্গ, কুকথা, কুশিক্ষা, কুকাজ, কুপ্রবৃত্তি, কুধারণা, কুচিন্তা ইত্যাদি। আর ঢং শব্দের অর্থ ঘণ্টার আওয়াজ, ছলাকলা, ভান, ন্যাকামি, চলচাতুরী ইত্যাদি। সুতরাং এ দুটি শব্দের অর্থ একজন মানুষের জীবনে কতটুকু মানানসই তা বিশ্লেষণ করার দাবি রাখে বটে। সঙ্গী বা বন্ধুর প্রভাব এতটাই প্রবল যে, নিজের অজান্তে আপন চরিত্রে তা কতটুকু জায়গা দখল করে নেয় তা কল্পনা করাটাই দুষ্কর। ‍সুতরাং জীবনের সূচনাতেই যদি কুসঙ্গী বা খারাপ বন্ধু বেছে নেই তা হলে তার কাছ থেকে কুকথা, কুশিক্ষা, কুকাজ, কুপ্রবৃত্তি, কুধারণা, কুচিন্তা শিখা ছাড়া ভালো কিছু শিখা আশা করাটাও অপরাধ, যা বানরের গলায় মালা দেওয়ার নামান্তর। সঙ্গীর প্রভাবে বাঘ যেমন ভেড়া হয় তেমনই খারাপ সঙ্গী বা বন্ধুর প্রভাবে মানুষও তখন অমানুষ হয়।


বন্ধু কাকে বলে

এক কথায় বলতে গেলে, বন্ধু হলো অন্ধকার রাস্তায় আলো জ্বালিয়ে পথ দেখিয়ে সামনে নেওয়া মানুষটির নাম। যে মানুষটি আপনার হাজারো সমস্যার বেড়াজাল থেকে জীবনবাজি রেখে সঠিক সমাধানের পথ বের করে দেয় এবং আত্ম অহঙ্কারী না হয়ে মহান আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করে। যার সাহচর্য চরম দুঃখ- বেদনায়ও আপনাকে স্বর্গীয় পরিবেশে ডুবিয়ে রাখে। শুধু তাই নয় আপনার সকল যন্ত্রণার ভাগ আপন কাঁধে তুলে আপনাকে অবিচল থাকার সাহস জোগায় তার নামই বন্ধু। অন্যকথায় বলতে গেলে বন্ধু হলো নিরাশা মনে আশার আলো, যে কি না আত্মার আত্মীয়। সুতরাং বন্ধু কোনো ছেলেখেলার নাম নয়, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আপনার শ্বাস-নিঃশ্বাসে তার নামটি জড়িত। তাই ভেবে চিন্তে এ মানুষটিকে বাছাই করা বুদ্ধিমানের কাজ। তাই বন্ধু নির্বাচনে আমরা কয়েকজন মনীষীর অভিমতকে গুরুত্ব দিতে পারি। যেমন- বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিখ্যাত মনীষী কবি শেখ সাদী (রহ.) বলেছেন- সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। একজন নেককার ভালো বন্ধু যেমন খারাপ বন্ধুর জীবনধারা পাল্টে দিতে পারে; ঠিক তেমনি একজন খারাপ কুরুচিপূর্ণ বন্ধুর প্রভাবে একজন ভালো বন্ধু খারাপ পথে ধাবিত হতে পারে।

হযরত ইমাম গাজ্জালি (রহ) বলেছেন, ‘যার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে তার মধ্যে পাঁচটি গুণ থাকা চাই। আর তা হলো- ‘বুদ্ধিমত্তা, সৎ স্বভাবের অধিকারী হওয়া, পাপাচারী না হওয়া, বেদআতি না হওয়া এবং দুনিয়াসক্ত না হওয়া।’

হযরত ইমাম জাফর আস-সাদিক (রহ) বলেন, ‘পাঁচ ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সমীচীন নয়। তারা হলো-মিথ্যাবাদী, নির্বোধ, ভীরু, পাপাচারী ও কৃপণ ব্যক্তি।’

হযরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘নির্বোধের বন্ধুত্ব থেকে দূরে থাকো। কারণ সে উপকার করতে চাইলেও তার দ্বারা তোমার ক্ষতি হয়ে যাবে।’

তাই আমরা নির্ধিদ্বায় বলতে পারি নিজের জীবন সুখময় করতে অবশ্যই আমরা বন্ধু নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন করবো।


বন্ধু নির্বাচনে কুরআন হাদিসের নির্দেশনা

আমরা অপকটে কোনো শর্ত ছাড়া স্বীকার করি যে, ইসলাম হলো একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান আর রাসূলে করিম (সা) হলেন সমগ্র মানবজাতির আদর্শ। সে হিসেবে ইসলাম তথা কুরআন এবং রাসূলের আদর্শ বন্ধু নির্বাচনে আমাদের সঠিক পথ দেখাবে না তা কি ভাবা যায়? অবশ্যই না। তাই বন্ধু নির্বাচনে পবিত্র কুরআন এবং হাদিস কী বলে তা অবশ্য আমাদের জানা প্রয়োজন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অসংখ্য জায়গায় বন্ধু নির্বাচনে আমাদের পথ নির্দেশনা দিয়েছেন তার মধ্যে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো-

যেমন সূরা তওবার ৭১ নাম্বার আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কথা শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই ওপর আল্লাহ তাআলা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশীল, সুকৌশলী।’ 

একই সূরার ১১৯ নম্বার আয়াতে বলেন- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী বা বন্ধু হও।’ 

সূরা ফুরকানের ২৭-২৮ নম্বর আয়াতে দুনিয়ায় খারাপ বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে- কেয়ামতের দিন একদল মানুষ নিজের হাত কামড়ে চিৎকার দিয়ে বলবে- ‘হায়! আমার আফসোস। হায় আমার দুর্ভোগ! যদি আমি দুনিয়াতে অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। অবশ্যই সে আমাকে বিভ্রান্ত করেছিল আমার কাছে উপদেশ বাণী কুরআন পৌঁছার পরও; আর শয়তান হলো মানুষের জন্য মহা প্রতারক।’ 

ঠিক তেমনি রাসূল (সা)-এর আদর্শ থেকে আমরা সঠিক বন্ধুত্বের মাপকাঠি নির্ণয় করতে পারি। নবী করিম (সা) বলেন-, মানুষ তার বন্ধুর রীতি নীতির অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকের খেয়াল রাখা উচিত সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে। (সুনান আবু দাউদ: ৪৯৩৩, আত-তিরমিযি: ২৩৭৮) 

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বন্ধুত্বের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘সৎ সঙ্গী এবং অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ হচ্ছে আতর বিক্রয়কারী এবং কামারের হাপরের মতো। আতর ওয়ালা তোমাকে নিরাশ করবে না; হয় তুমি তার কাছ থেকে আতর ক্রয় করবে নয়তো তার কাছে আতরের সুঘ্রাণ পাবে। আর কামারের হাপর, হয় তোমার বাড়ি জ্বালিয়ে দেবে, নয়ত তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে আর না হলে তার কাছ থেকে তুমি দুর্গন্ধ পাবে।’ (বুখারি)

বন্ধুত্ব প্রসঙ্গে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘একাকী নিঃসঙ্গতার চেয়ে ভালো বন্ধু উত্তম আর মন্দ বন্ধুর চেয়ে নিঃসঙ্গতা উত্তম।’ তার মানে হলো, একা নিঃসঙ্গ থেকে একজন ভালো বন্ধু উত্তম আবার একজন মন্দ ও অযোগ্য বন্ধুর চেয়ে নিঃসঙ্গতা উত্তম। 

এ সব সত্যবাণী বিবেচনা করে আমরা পরিশেষে বলতে চাই জীবনের দীর্ঘ সময়ে সঠিক পথে চলতে বন্ধুর ভূমিকা অগ্রগণ্য। মনের গভীরের আনন্দ বেদনা দুঃখ-কথা ব্যক্তিগত সমস্যা একমাত্র বন্ধুর কাছেই প্রকাশ করা যায়। তাই বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন বন্ধু অবশ্যই আমাদের তালাশ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে এই দুনিয়াই সব কিছু নয়। দুনিয়ার সকল কার্যাবলির হিসাব পরকালে মহান মাবুদের দরবারে পেশ করতে হবে। প্রত্যেকের বন্ধুত্ব হতে হবে পরকালের কল্যাণে মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য। তাই সার অংশে বলতে চাই একজন পূর্ণ ঈমানদারই হবে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু, এ ব্যাপারে কুরআনের এ নির্দেশই হবে আমাদের বন্ধু নির্বাচনের একমাত্র উৎকৃষ্ট পথ- যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে বলেন-‘তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং মুমিনগণ, যারা নামাজ কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং বিনম্র হয়।’ (সূরা : মায়িদা, আয়াত : ৫৫) 

অতএব দুনিয়া ও আখেরাতের জীবন সুন্দর ও সার্থক করতে আমাদের বিচক্ষণ ভালো বন্ধু নির্বাচন করা একান্ত প্রয়োজন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ