আমার গুরু কবি আল মাহমুদ । মুহাম্মদ জাবেদ আলী

আমার গুরু কবি আল মাহমুদ । মুহাম্মদ জাবেদ আলী

স্মৃতিকথা জুলাই ২০১৯

আমার গুরু কবি আল মাহমুদ । মুহাম্মদ জাবেদ আলী২০০২ সালের কথা। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা এসেছি। টানাটানির সংসার পড়ালেখার পাশাপাশি একটা চাকরি করা দরকার। আর কবি হওয়া। থাকি নিউমার্কেটের পেছনে আইয়ুব আলী কলোনিতে। দেয়ালে দেয়ালে প্রতারণামূলক চাকরির বিজ্ঞপ্তি। দুই-চার জায়গায় গিয়ে ঠকেছি। শেষে নীলক্ষেতে নগদ পনেরো শ’ টাকা দিয়ে এক প্রাইভেট মিডিয়ার সদস্য হলাম। আল্লাহর অশেষ রহমত, এক সপ্তাহের মধ্যেই দুটো টিউশনি পেয়ে গেলাম। একটা টিঅ্যান্ডটি বোর্ডের চেয়ারম্যান শাহজাদী আঞ্জুমান আরার মেয়ে শ্যামা লুবাবা পূর্ণতা। নবম শ্রেণীর ছাত্রী। আরেকটা কল্যাণপুরে সোনারগাঁও হোটেলের রিসিপসনিস্ট আজাদ সাহেবের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র দ্বীপ। এবার কবি হতে হবে। পত্রিকায় লেখা ছাপাতে হবে। রাতে ঘুমাতে পারি না। কবে পত্রিকায় একটা লেখা ছাপা হবে? 
নিউমার্কেট থেকে হেঁটে আসি কলাবাগান। দুই টাকা ভাড়া দিয়ে কল্যাণপুর। ফেরার পথে সায়েন্সল্যাব নেমে দৈনিক খবরপত্রের অফিসে ধরনা দেয়া। কবিতা ছাপা হয়। আমার লেখা কবিতা ব্যবচ্ছেদ করে ছাপাতেন আবুল কালাম আজাদ স্যার। বুঝতাম কবিতা মানসম্মত হয়েছে এই মর্মে ছাপাতো না, কবিতা প্রকাশ করতো আমার প্রতি মায়া করে। যখন শুনতেন শুধু কবিতার জন্য ঠাকুরগাঁও থেকে ঢাকা এসেছি। প্রতিদিন নীলক্ষেতের মোড়ে সাভার, ধামরাইয়ের ৯ নম্বর গাড়িগুলো যেখানে থামে; সেখানে দৈনিক সংগ্রামের পত্রিকা ওয়ালে লাগানো থাকতো। বাঙালি যেনো ফ্রি পড়তে পারে।
দুপুরের রোদ উপেক্ষা করে পত্রিকা পড়ছি। এক কোনায় চোখ আটকে গেলো। কিশোরকণ্ঠের সাহিত্য সভা হবে বৃহস্পতিবার। থাকবেন কবি আল মাহমুদ। ওরিব্বা! অবশ্য এর-ই মধ্যে দৈনিক ইত্তেফাকের অফিসে কবি শামসুর রাহমানের সাথে দেখা হয়ে গেছে। দিন-ক্ষণ গোনা শুরু করলাম। 
দিন আর কাটে না। এবার আমাকে পায় কে? কবি আল মাহমুদকে নিয়ে কবিতা লিখলাম। একটা দুটো না, বারোটা। নিজেকে কবি হিসেবে জাহির করতেই হবে। এলো সেই দিন। বৃহস্পতিবার দিন। অনুষ্ঠান পাঁচটার পরে। আমি বারোটা বাজে রওয়ানা হলাম। পকেটে কুড়ি টাকা আছে। পুরানা পল্টন হেঁটে যেতে হবে। কী আর করা। টিএসসি, শাহবাগ ফুলের দোকানগুলো হয়ে শিশুপার্ক গেলাম। জিজ্ঞেস করছি আর হাঁটছি। হায়! বাবা জাবেদ আলী। দেড়টার সময় আমি বাংলা একাডেমির সামনে। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম,
- ভাই, পুরানা পল্টন কোন দিকে?
- ওই দিকে। উনি প্রেস ক্লাবের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন। গেলাম প্রেস ক্লাব পর্যন্ত। 
- আরে এখানে তো এসেছি। ট্রাফিক পুলিশকে জিজ্ঞেস করলাম,
- স্যার পল্টন যাবো।
- অই সামনে পল্টন মোড়। গেলাম পল্টন মোড়ে। এভাবে জিজ্ঞেস করে করে সাড়ে ৪টায় কিশোরকণ্ঠের অফিসে পৌঁছলাম। সম্পাদক নূরুল ইসলাম ভাই আরো কয়েকজন বসে আছেন। 
সালাম দিলাম। জিজ্ঞেস করলেন,
- কোথা থেকে আসা হয়েছে ভাই?
- নিউমার্কেট থেকে এসেছি। বাড়ি ঠাকুরগাঁও। ব্যানার টাঙানো হচ্ছে। ধীরে ধীরে কবিগণ আসছেন। মহিউদ্দিন আকবর, নুরুজ্জামান ফিরোজ, আব্দুল কুদ্দুস ফরিদী, মানসুর মুজাম্মিল, নজরুল ইসলাম শান্তু ভাইসহ আরো অনেকে। এরপর এলেন ড. দ্বীন মুহাম্মদ, ইনকিলাবের সাহিত্য সম্পাদক, সংগ্রামের সাহিত্য সম্পাদক সাজজাদ হোসাইন খান, কবি মোশাররফ হোসেন খান ভাই। কিন্তু আমার প্রিয় মানুষ কই? সাহিত্য আসর কবি-লেখকে গমগম করছে। মনে হয় সময়টা রোজার সময় হবে। 
এবার উৎফুল্ল ধ্বনি,
- আসছে, আসছে। 
উনি এলেন, শুভ্র দাড়ি। লাল ফতুয়া। মানানসই চশমা। প্রফুল্ল মুখচ্ছবি। বয়স তাঁকে কাবু করতে পারেনি। শুরু হলো বক্তব্যের পালা। জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য। এবার কবি আল মাহমুদের পালা। কবি উঠে দাঁড়ালেন। টেবিলে ভর দিয়ে উনার কবি হওয়ার গল্প শোনালেন। কেন বিনাদোষে জেল খাটলেন। 
জেলখানায় কী হয়েছিলো। তাঁর সাংবাদিক জীবনের কাহিনী। এরপর কবিতা পাঠের পর্ব। সবাই কবিতা পড়ছে। এখন যে কথা মনে করে আমার হাসি পাচ্ছে, তা হলো আমি কবিতা লিখতে পারতাম কিন্তু অন্ত্যমিল, পর্ব, মাত্রা কিছু বুঝতাম না। ভাবসর্বস্ব ছাতা-নাতা কবিতা। কবিতা পাঠে এবার আমার পালা। সিনা টানটান করে স্বরচিত কবিতা ‘জাগো’ আবৃত্তি করলাম। একশো লাইনের কবিতা। কী লিখে কী আবৃত্তি করেছিলাম, তা জানি না। অনুরোধ করলাম আল মাহমুদকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছি। অনেকে বিরক্তি প্রকাশ করলেন। আমার গুরু আমাকে কাছে ডাকলেন। কবিতাটি হাতে নিয়ে পড়লেন। আসর কক্ষ নীরব, নিস্তব্ধ। কিছু কাটাকাটি করে কবিতাটি মহিউদ্দীন আকবর ভাইয়ের হাতে দিলেন। আকবর ভাই আমার হাতে দিয়ে বললেন,
- পড়েন। 
আমি কাঁপাকাঁপা স্বরে পড়লাম। আবেগে কেঁদেও ফেলেছিলাম।
সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রেখে কবিতাটি নিচে তুলে ধরলাম,

আল মাহমুদ
আল মাহমুদ তুমি মোর প্রিয় কবি,
তোমাকে দেখবো এটা আমার Hobby.
তোমাকে দেখবো বলে,
ঠাকুরগাঁ থেকে এসেছি চলে।
তুমি কবিদের নেতা, আমার প্রিয় কবি।
আল মাহমুদ তোমার মায়ের নাকের নোলকখানি,
খেয়ে ফেলেছে নদীর পানি।
তুমি অনেক বড়ো কবি,
আমি জানি, আমি জানি।

প্রিয় কবি, তুমি চলে গেছো, না ফেরার দেশে। কিন্তু তোমার সামান্য সাহচর্য বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে, ইনকিলাব অফিসে আমাকে আজো রোমাঞ্চিত করে। আমি তোমাকে চোখ বড় বড় করে দেখেছি আর ভেবেছি কোনদিন আমিও তোমার মতো বিখ্যাত কবি হবো। তোমার মতো ভালো ভালো কবিতা লিখতে পারবো। আল্লাহ আমার গুরু কবিকে বেহেশত নসিব করুন।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ