আনন্দের ঢেউ    -কামরুল আলম

আনন্দের ঢেউ -কামরুল আলম

গল্প জুন ২০১৭

‘আব্বু আব্বু আমার ঈদের জামা কই?’
‘এই তো বাবা, এই নাও। তোমার লাল টুকটুক ঈদের জামা।’
আকিবের হাতে ঈদের জামাটি ধরিয়ে দিলেন এহসানুল কুদ্দুস। প্রাইম ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল তিনি। আকিব তাঁর ছোট ছেলে। বয়স মাত্র আড়াই বছর। মেয়ে সুমাইয়া জান্নাত পড়ে ক্লাস ফাইভে। এ বছর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দেবে। তাই পড়ালেখা ছাড়া আর কিছু চিন্তা করতে পারে না ও। এ প্লাস তাকে পেতেই হবে।
‘কি গো, আকিবের জন্য কেমন জামা আনলে?’ রান্নাঘর থেকে আওয়াজ করলেন আকিবের মা, মিসেস তামান্না।
‘এই তো, আকিবের কাছে দিলাম। যাও বাবা আকিব, তোমার আম্মুকে জামাটা দেখাও।’
‘শুধু আকিবের জন্য জামা আনলে, সুমাইয়ার জন্য কিছু আনোনি?’
‘আনবো আনবো। সুমাইয়া আমাদের লক্ষ্মী মেয়ে। ওর জন্য কিছু না এনে কি পারি? ঈদের তো এখনও দিন দশেক বাকি আছে। আগে বেতনটা পাই, সবার জন্য সবকিছু আনা হবে। তোমার জন্য, আমাদের সুমাইয়ার জন্য। আকিবের জন্যও।’
‘আব্বু আমার জন্য আরো জামা কিনবে?’ খুশিতে গদগদ হয়ে জানতে চাইল আকিব।
‘হ্যাঁ আব্বু, তোমার জন্য আরেকটা জামা আনবো। যখন তোমার আপ্পির জন্য জামা কিনতে যাব, তখন তোমার জন্যও নিয়ে আসব।’
কী মজা, কী মজা, আমার জন্য আরেকটা জামা আনবে আব্বু। আপ্পি, আপ্পি, শুনেছো, আব্বু আমাকে দুইটা ঈদের জামা কিনে দেবে!
‘তোকে তো আব্বু বেশি ভালোবাসে, তাই।’ সুমাইয়া মুখ ভারের ভান করে বলল। ছোট ভাইটিকে সেও যে অনেক বেশি ভালোবাসে।
‘আব্বু, তুমি কি সত্যি আমাকে বেশি ভালোবাস?’ জানতে চাইল আকিব।
‘হ্যাঁ বাবা, তোমাকে তো আমরা সব্বাই অনেক বেশি ভালোবাসি। আচ্ছা তুমি কাকে বেশি ভালোবাস?’
‘আমি কাকে বেশি ভালোবাসি আব্বু?’ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে লাগল আকিব।
‘মানে তুমি কাকে বেশি ভালোবাস? তোমার আম্মুকে নাকি আমাকে? নাকি তোমার আপুকে?’ আকিবকে ভাবনায় ফেলে দিলেন এহসানুল কুদ্দুস। কিছুক্ষণ ভেবে আকিব উত্তর দিল, ‘আমি তোমাদের সব্বাইকে বেশি ভালোবাসি।’
আকিবের উত্তরে সবাই খুশি হলেন। ছেলেটি এই বয়সেই অনেক পেকে গেছে। বুদ্ধি করে উত্তর দিতে শিখে ফেলেছে। কাউকে অখুশি করতে চায়নি।
স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে উত্তরার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন এহসানুল কুদ্দুস সাহেব। প্রাইভেট স্কুলের জব। ফিক্সড বেতন, মাত্র পনেরো হাজার টাকা। বাদ বাকি দুটো টিউশনি থেকে ছয় হাজার টাকা আসে। সব মিলিয়ে মাসের ইনকাম একুশ হাজার। কিন্তু প্রতি মাসে ত্রিশ হাজারের অধিক খরচ পড়ে। বাড়ি ভাড়া চলে যায় বারো হাজার টাকা। গ্যাস বিল, পানির বিল, ইলেকট্রিক বিল, পেপার বিল, মোবাইল বিল, ডিশ বিল আরো কত কী! বেতনের টাকা পনেরো হাজার হাতে পাওয়ার পর একদিনও সেটা হাতে রাখতে পারেন না তিনি। তার ওপর সংসারের নানা খরচ। সংসারটা কিভাবে চলে যাচ্ছে কিছুই টের পান না এহসান সাহেব। যখনই নিজের পকেটের দিকে তাকান, দেখা যায় মুক্ত পকেট।
ইউসুফ আদনান এহসানুল কুদ্দুস সাহেবের পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। পথে ঘাটে দেখা হয় মাঝে মধ্যে। নিজের মোটরবাইকে মাঝে মধ্যে এহসানুল কুদ্দুসকে লিফট দিয়ে যায় ইউসুফ আদনান। দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক এতটুকুই। কেউ কারো সম্পর্কে তেমন একটা জানে না। রমজানের শেষ দিকে বসুন্ধরায় ইউসুফের সঙ্গে দেখা হলো এহসানুল কুদ্দুস সাহেবের। দু’জনেই ঈদের কেনাকাটায় ব্যস্ত। ‘কী খবর ইউসুফ ভাই, ভাবীর জন্য শাড়ি কিনলেন বুঝি? তা ভাবীকে সঙ্গে নিয়ে এলেই পারতেন।’ এহসান সাহেবের কথা শুনে ঢোক গিলল ইউসুফ। এহসান সাহেব জানেনই না যে ইউসুফ অবিবাহিত। পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকেন তবুও। এমনটা ইদানীং প্রায়ই ঘটে। ইউসুফের চেহারায় ‘পূর্ণ বয়স্ক’ ছাপ পড়ে গেছে হয়তো বা। অনেকের এ জাতীয় প্রশ্ন এড়িয়ে যায় ইউসুফ। কিন্তু এহসান সাহেবের প্রশ্ন এড়িয়ে গেল না। আফটার অল তিনি তার প্রতিবেশী। আজ না হয় কাল জানবেনই।
‘না মানে, আপনার ভাবী সাহেবা তো এখনও....’
‘এখনও মোটর বাইকে চড়তে অভ্যস্ত হননি। কী যে বলেন ইউসুফ ভাই।’ ইউসুফের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিলেন এহসান সাহেব। ইউসুফ কিছুটা ধীরগতিতে কথা বলে। এ জন্যই বোধ হয় তার কথা শেষ হবার আগেই অন্যরা কথা কেড়ে নিতে পারে।
‘আসলে আপনি তো জানেন না, আমি এখনও ব্যাচেলর’। ইউসুফ কোনো মতে কথাটি বলল এহসান সাহেবকে।
‘আশ্চর্য! আপনি ব্যাচেলর। তাইতো বলি। তা বিয়ে শাদি কবে করবেন ভাই?’ এহসান সাহেব কথার মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছেন, বুঝতে পারল ইউসুফ।
‘আল্লাহর হুকুম যখন হবে।’ স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল ইউসুফ।
‘স্যরি, আসলে আমি আপনার প্রতিবেশী হয়েও আপনার সম্পর্কে বিস্তারিত তেমন কিছুই জানি না।’
‘না জানারই কথা। এই নগরে সবাই নিজকে নিয়ে বড় বেশি ব্যস্ত থাকে। কেউ কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায় না।

ঈদের আর মাত্র এক দিন বাকি। ইউসুফ আদনানের হাত একদম খালি। বড় ভাই আমেরিকা থেকে যে টাকা পাঠিয়েছিলেন আর তার হাতে যা ছিল তার সবই খরচ হয়ে গেছে। বাসার সকলের ঈদের কেনাকাটা শেষ করেছে ইউসুফ। কেবল নিজের জন্য কিছু কিনতে পারেনি। ওদিকে ইউসুফদের কাজের বুয়া বায়না ধরল ওকে একটা শাড়ি কিনে দিতে হবে। আর ওর বাচ্চার জন্য একটা শার্ট। ইউসুফ ওদের বিষয়টি আগে মাথায় আনেনি। এই বুয়া এহসানুল কুদ্দুস সাহেবের বাসাতেও কাজ করে। ওখানে এহসান সাহেবের ছেলেই নাকি বুয়ার ছেলেকে উসকে দিয়েছে। ইউসুফ বিষয়টি জানতে পারে বুয়ার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে।
‘দেখ বুয়া, তুমি ও তোমার ছেলে তো আরো দু একটা বাসায় কাজ কর। উনারা কিছু দেয় নাই? আমি তো একটু সমস্যায় পড়ে গেছি, হাত একদম খালি হয়ে গেছে।’
‘সাহেব কী যে কন্? আপনারা হইলেন বড়লোক মানুষ। ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকেন। তার উপর আমেরিকান। আপনাগো হাত কি আর খালি হইবার পারে?’ বুয়াটি যেন নাছোড়বান্দা। ইউসুফদের ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিল। ওপাশের ফ্ল্যাট থেকে আকিব দৌড়ে এসে বুয়ার ছেলেকে তার নতুন জামা দুটি দেখিয়ে বলতে লাগলো, ‘আমার আব্বু আমাকে দুইটা ঈদের জামা কিনে দিয়েছে, তোমার আব্বু তোমাকে কয়টি জামা দিয়েছে?’ আকিবের কথা শুনে ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো বুয়ার ছেলে। ইউসুফ আদনান আকিবকে কাছে ডাকল। বলল, ‘ঈদ মানে কি আকিব, তুমি কি জান?’
‘না আংকেল, আমি তো জানি না।’
‘কেন তোমার আব্বু তোমাকে বলেনি? ঈদ মানে হলো আনন্দ, ঠিক আছে।’
‘আনন্দ মানে কি আংকেল?’ আকিব পাল্টা প্রশ্ন করল ইউসুফকে।
‘এই যে তোমার ঈদের জামা যা তোমার আব্বু তোমাকে কিনে দিয়েছে, এটা তোমার ভালো লাগেনি?’
‘হ্যাঁ লেগেছো তো।’
‘এটাই হলো আনন্দ। এবার বল তো ঈদ মানে কি?’
‘ঈদ মানে আনন্দ।’ বলল আকিব। ঈদের মানে জানতে পেরে তার আনন্দ যেন আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেল।
‘ঈদের এই আনন্দকে ভাগ করে নিতে হয়। না হলে আনন্দ চলে যায়। আনন্দের জায়গায় কষ্ট চলে আসে। সেটা কি তুমি জান আকিব?’
‘জি না আংকেল।’
‘এই যে বুয়ার ছেলে শিপলু, ওর আব্বু তো রিকশা চালায়। ওর আব্বুর কাছে টাকা না থাকায় ওকে ঈদের জামা কিনে দিতে পারেনি। এখন ও কাঁদছে। অথচ তোমার আব্বু তোমাকে দুটো ঈদের জামা কিনে দিয়েছেন। তোমার আনন্দটা শিপলুর সঙ্গে তুমি যদি ভাগ করতে পারতে তাহলে শিপলুও খুশি হতো, আনন্দ করতে পারতো। এভাবে ভ্যাঁ করে কাঁদতো না।’
‘আংকেল আমার তো দুইটা ঈদের জামা, একটা যদি শিপলুকে দিয়ে দেই, ও খুশি হবে?’
‘হবে তো। আর সেটাই হবে ঈদের প্রকৃত আনন্দ। তবে তুমি সেটা তোমার আব্বু আম্মুকে জিজ্ঞেস করে তারপর দিও। কারণ কোনো কাজ করার আগে বড়দের অনুমতি নিতে হয়।’
ইউসুফ নিজের মায়ের একটা পুরাতন শাড়ি বুয়াকে দিয়ে দিল। আর বলল, ‘দেখ, আকিব যদি ওর বাবা-মাকে বলে একটা জামা শিপলুকে দিয়ে দেয় তাহলে তো হয়েই গেল। না হলে আমাকে জানাবে।’
ঈদের দিন সকালবেলা একটি পুরাতন পাঞ্জাবি পরে ঈদগাহের উদ্দেশে বের হলো ইউসুফ আদনান। রাস্তায় দেখা পেল কাজের বুয়ার। বুয়া ইউসুফকে সালাম দিয়ে বলল, ‘সাহেব, আল্লাহ আপনের মঙ্গল করুক। আপনের প্রচেষ্টা সাকসেস হইছে। আমাগো আকিব তার একটা নতুন জামা শিপলুকে দান করেছে।’
বুয়ার কোলে শিপলুর দিকে তাকালো ইউসুফ। ও নতুন জামা পরে অনেক খুশি হয়েছে। ওর আনন্দই ইউসুফের মনে আনন্দের ঢেউ তুলে দিল। সে ভুলে গেল নিজের পাঞ্জাবিটা কেনা হয়নি এবারের ঈদে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ