আজও মনে গহিন বনে  -সামছুল আরেফীন

আজও মনে গহিন বনে -সামছুল আরেফীন

ভ্রমণ আগস্ট ২০১৮

ভোর ৬টা। খুলনার রূপসা ঘাটে পৌঁছলাম আমরা কয়জন। কোলাহলমুখর শহর ছেড়ে কয়েক দিনের জন্য আমরা যাচ্ছি নেটওয়ার্কের বাইরে। যাচ্ছি বাঘের আবাসস্থল সুন্দরবনে। ঘাটে পৌঁছে আমরা দেখলাম ভ্রমণসঙ্গী আরো অনেকে পৌঁছে গেছেন। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা। এরপর এক সাথে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় আমরা ট্যুরিস্ট লঞ্চ ‘এমভি রয়েল’ এ পৌঁছলাম। এই জাহাজেই আমাদের থাকতে হবে কয়েকদিন। আমাদের স্বাগত জানালেন কালো শ্মশ্রুমণ্ডিত ও সুঠাম দেহের অধিকারী দি রয়েল ট্যুর এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ফারুক। তিনি খুলনার কেডিএ এভিনিউয়ে অবস্থিত হোটেল রয়াল ইন্টারন্যাশনালেরও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। নিজেই পরিচয় দিলেন এবং আমাদের সঙ্গেই যাচ্ছেন এ কথাও জানালেন। আমাদের ভালোই লাগলো কারণ খোদ লঞ্চের মালিক যাওয়াতে ভ্রমণসেবা পুরোপুরিই পাবো আমরা। একই সাথে বিদায় জানাতে হলো আমাদের খুলনার সহকর্মী আবদুর রাজ্জাক রানাকে।
ইতঃপূর্বে আরো দু’বার সুন্দরবন গেলেও এবারই প্রথম সপরিবারে যাচ্ছি। তাই এক অন্য রকম অনুভূতি। আমার সিনিয়র সহকর্মী মুহাম্মদ নূরুল হুদাও সপরিবারে যাচ্ছেন আমাদের সাথে। রয়েছেন, আরেক সিনিয়র সহকর্মী, চির তরুণ সাংবাদিক শেখ এনামুল হক। ইতোমধ্যে লঞ্চ চলতে শুরু করেছে। কেবিনে যেন কেউ থাকতে চাইছিলো না। প্রায় সবাই লঞ্চের তিনতলায় সুপরিসর নাস্তার টেবিলে চলে এলেন। রূপসা নদী দিয়েই আমাদের যাত্রা। অনেক সময় ধরে যাওয়ার পর পড়বে শিবসা এবং পোরশা নদী যা দেখতে বিশাল।
সুন্দরবন ভ্রমণ অনেক কারণেই আকর্ষণীয়; তবে একটি কারণে তা একেবারেই অনন্য। ট্যুর কোম্পানিকে ভ্রমণের টাকা দেয়ার পর আপনি থাকতে পারেন হাত-পা ঝাড়া হয়ে। পুরো ভ্রমণে আর কোনো খরচ নেই। তিন-চার দিন সুন্দরবনের সৌন্দর্যে মোহিত হবেন, অথচ পকেটের ভাবনা থাকবে না। সময়মতো হাজির হবে সকালের নাশতা, দুপুর ও রাতের খাবার। এরচেয়ে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে!
অবকাশের জন্য সুন্দরবনের চেয়ে ভালো জায়গা আর নেই। নিসর্গ উপভোগ করা, লঞ্চ থেকে নেমে নৌকায় সূর্যোদয় দেখা, কুমির, বাঁদর, হরিণ, সাপ, হাজারো পাখি প্রভৃতি দেখার আনন্দই আলাদা। খুলনা-মংলা হয়ে সুন্দরবন যাওয়া যায়; মংলা থেকে কিছুদূর গেলেই শুরু হয়ে যায় সুন্দরবন। এরপরই কচিখালী হয়ে যাওয়া যায় কটকা পর্যন্ত। আবার সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালিনী দিয়ে, জামতলা হয়েও যাওয়া যায়। দূরের গন্তব্য কটকা বা হিরণ পয়েন্ট। সুন্দরবন গেলে একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সুন্দরবন হলো প্রাণীদের এলাকা, তাদের বিরক্ত করা একেবারেই উচিত হবে না।
সকাল ৮টার কাছাকাছি সময় বেলের শরবত, ব্রেড, বাটার, জেলি, মধু, ডিম, কলা, পেঁপে ও চা-কফি দিয়ে আমরা প্রাতঃরাশ করলাম। নদীর দু’তীরে জঙ্গলের মাঝে মধ্যে বিশালদেহী হরিণ এবং বানর দেখতে পেলাম। নিস্তব্ধতা ভেদ করে ছুটে চলছে এমভি রয়েল। সুন্দরবন এখনও অনেক দূরে। দিন শেষে আমরা একটি বড় খালে প্রবেশ করলাম। আমাদেরকে জানানো হলো ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আমরা কটকায় পৌঁছে যাবো। ইতোমধ্যে সকাল সাড়ে ১১টায় চা বিরতিতে ভেজিটেবল পাকুরা চা-কফি এবং বেলা দেড়টায় মধ্যাহ্নভোজে সাদাভাত, ভর্তা, ভেজিটেবল ভেজ, বিভিন্ন রকমের শাক, ভেটকি মাছের দোপিয়াজো, সামুদ্রিক মাছের ফ্রাই, গরুর গোশত, ডাল ও সালাদ এবং বিকেল ৫টায় সান্ধ্যকালীন টি ব্রেকে ভেজিটেবল শিঙ্গাড়া চা-কফি দিয়ে আপ্যায়িত করা হলো। রাত ৮টার দিকে আমরা সাগর তীরবর্তী কটকায় নদীর মোহনায় পৌঁছলাম এবং লঞ্চ নোঙর করা হলো। আগে থেকে কয়েকটি লঞ্চ নোঙর করা ছিল। সকালে এ সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। ইতোমধ্যে আমরা মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে চলে এসেছি। শহুরে কোলাহল, কাজের চাপ, সব কিছু ছাড়িয়ে আমরা এখন শুধুই বনে জঙ্গলে ছুটে বেড়াচ্ছি।
রাতেই আমাদেরকে বলা হলো যেন ভোর ৪টার পূর্বেই উঠে প্রস্তুতি নিই। সে মোতাবেক সুস্বাদু ডিনারে আপ্যায়িত হয়ে যার যার মতো কেবিনে চলে গেলাম।
এমভি রয়েলের ধারণক্ষমতা ৫৪ জনের। সেই যাত্রায় আমরা সব মিলে ছিলাম ৩৯ জনে। একটি আধুনিক হোটেলের সব ধরনের ব্যবস্থাই রয়েছে লঞ্চে। ৩ দিনের থাকা খাওয়ার পুরো প্রস্তুতিই যাত্রা শুরুর আগে সম্পন্ন করতে হয়। এমনকি খাবার পানি, গোসলের পানিও সাথে নিয়ে যেতে হয়। সুন্দরবনের ভেতরে কিংবা চলার পথে এগুলো সংগ্রহের কোনো সুযোগ নেই।
ভোরে লঞ্চ থেকে আমাদেরকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে বাগেরহাটস্থ শরণখোলার কটকা ফরেস্ট রেঞ্জ এলাকায় নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা গিয়েছিলাম ২০১৪ সালের মার্চে। তাই সেখানে সিডর বিধ্বস্ত হওয়ার দৃশ্যের ছাপ তখনও দৃশ্যমান হলো। ফারুক সাহেব একটি ছেলেকে সাথে করে নিয়ে গেছেন যাতে দা দিয়ে বড় বড় গাছের কিছু ডাল-পাতা কেটে দিলে হরিণ খেতে পারে। ইতোমধ্যে আমরা একটু এগুতেই সবাই চিৎকার করে উঠলো সাপ, সাপ বলে। একটি মৃতপ্রায় গাছে দা দিয়ে কোপ দেয়াতে সাপটি বেরিয়ে এসেছে। অনেকেই ছবি তুললেন, আমরা আস্তে আস্তে ঘন জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। এক লাইনে আমরা সরু পথে এগিয়ে চলছি। দুই পাশে গাছ আর কাঁটা। এ দিগ সেদিক হলেই কাঁটায় বিদ্ধ হওয়ার ভয়। নিচে সাপ, আছে বাঘেরও ভয়। আমাদের সাথে এবং একেবারে পেছনে বন বিভাগের বন্দুকধারী ২ জন নিরাপত্তাকর্মী। দলছুট না হতে কঠোরভাবে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। ঘন বনে প্রবেশ করায় একটু রোমাঞ্চ, একটু শিহরণ সৃষ্টি হলো। জঙ্গলে প্রবেশ করে শঙ্কার মধ্যে মৌমাছিকে ফুল থেকে মধু আহরণ করতে দেখলাম। প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্যের ছবি তুলতে কেউ কার্পণ্য করেনি। বেশ কয়েক দফা হরিণের দৌড়াদৌড়ি, বানর এবং বনমোরগ দেখাই আমাদের এ যাত্রা শেষ। এক দফা গ্রুপ ছবি তুলে প্রাতঃকালীন এই ভ্রমণ শেষ হলো।
বাংলায় ‘সুন্দরবন’-এর আক্ষরিক অর্থ ‘সুন্দর জঙ্গল’ বা ‘সুন্দর বনভূমি’। সুন্দরী গাছ থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে, যা সেখানে প্রচুর জন্মায়। অন্যান্য সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এরকম হতে পারে যে, এর নামকরণ হয়তো হয়েছে ‘সমুদ্র বন’ বা ‘চন্দ্র-বান্ধে (বাঁধে)’ (প্রাচীন আদিবাসী) থেকে। তবে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় যে সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর বিশ্বের ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) সুন্দরবন। এখানকার সব কিছুই বিস্ময়ে ভরা। প্রায় ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এই সুন্দরবন ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ছয়বার তার রূপ বদলায়। সুন্দরবনের করমজল বন্য ও কুমির প্রজনন কেন্দ্র, হারবাড়িয়া ইকো সেন্টার, কটকা, কচিখালী ও নীলকমল অভয়ারণ্য, শেখেরহাট টেম্পল, কলাগাছিয়া ইকো ট্যুরিজম সেন্টার, মান্দারবাড়িয়া অভয়ারণ্য নামের স্পটগুলো পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত। এসব স্পটে কুমির প্রজনন, অসুস্থ হরিণের পরিচর্যা, হাজার বছরের পুরনো স্থাপনার ধ্বংসাবশেষসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। ভাগ্য সহায় হলে হাঁটতে হাঁটতে বানর, হরিণ, গুইসাপ, কাঁকড়া অথবা কুমিরের ঘুরে বেড়ানো দৃশ্যও দেখতে পারেন।
সুন্দরবন বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী প্রশস্ত বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকায় বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা জুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে।
বিকেলের আগেই একদফা খালে নিয়ে যাওয়া হলো। বিকেল ৩টার দিকে জামতলা সি বিচ গেলাম। কটকার জেটির উত্তরে খালের চরজুড়ে থাকা কেওড়ার বনেও দেখা মেলে দলবদ্ধ চিত্রা হরিণ, বানর আর শূকরের। আবার শীতের সময় দেখা মিলে যেতে পারে রোদ পোহানো লোনা জলের কুমির। কটকা বন কার্যালয়ের ঠিক ওপারে একটি ছোট খাড়ি চলে গেছে সোজা পূর্ব দিকে। এই পথে কিছু দূর যাওয়ার পরে হাতের ডানে ছোট্ট জেটি এবং ওপরে ওয়াচ টাওয়ার। কটকার ওয়াচ টাওয়ারটি চারতলা বিশিষ্ট। ৪০ ফুট উচ্চ টাওয়ার থেকে উপভোগ করা যায় সুন্দরবনের অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
একটি সুন্দর সমুদ্রসৈকত আছে এখানে। পর্যবেক্ষণ টাওয়ার হতে ফেরার সময় হেঁটে বিচের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। পূর্বে দীর্ঘ বন আর মাঝে মিঠা জলের পুকুর। এই পুকুরের পানি পান করেন কর্মরত কোস্টগার্ড, ফরেস্ট অফিসার ও স্থানীয় জেলেরা। এখান থেকে আশপাশে তাকালে দেখা মেলে সুন্দরবনের প্রায় বিপন্ন প্রাণীদের। এ ছাড়া ওয়াচ টাওয়ার থেকে খানিকটা সামনে এগুলে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি খালের মাঝেও দেখা মেলে বিপুলসংখ্যক বন্যপ্রাণীর। সব মিলিয়ে কটকা অভয়ারণ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ ভূমি।
সুন্দরবনে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। এর মধ্যে, গাছ রয়েছে ৩৩৪ প্রজাতির, শৈবাল ১৬৫ প্রজাতির, অর্কিড ১৩ প্রজাতির। এ মধ্যে সুন্দরী গাছ আছে ৭৩% এবং গেওয়া গাছ আছে ১৬%, বাকিগুলো মিলে ১১%।
সুন্দরবনের বনজ সম্পদের অন্যতম হলো গোলপাতা। নাম গোলপাতা হলেও পাতাগুলো গোল নয়। লম্বা লম্বা ঠিক নারকেল পাতার মতো। সুন্দরবনে বিভিন্নরকম ফার্ন জন্মে। আরালি, বাইল, কেওড়া, ওড়া, ধুন্দুল, খলসি, গরান, গেওয়া, তনুশা, পশুর, টাইগারফার্ন প্রভৃতি। এই টাইগারফার্ন লবণাক্ত এলাকায় জন্মে। এর ঝোপে বাঘ লুকিয়ে থাকে, বিশ্রাম নেয়, তাই এর নাম টাইগার ফার্ন।
সুন্দরবনে বিভিন্ন প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদের গাছ রয়েছে। এই সব ঔষধি গাছ বিক্রি করে সরকার প্রত্যেক বছর প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব আয় করে থাকে। যেমন: কাঁকর, সিংড়া, আমুর ধানসি, পানিয়াল, গাব, কালিলতা, জাম, বনলিচু, কেওয়াকাটা, নোনা ঝাউ, বামন হাট্টি, মাকাল ইত্যাদি। এ ছাড়াও ভোল, গিলালতা, বড়সালকান, কিরপা, গরান, হারগোজা, বুম্বা, ভাতকাঠি, স্বেতপলি, হেতলি, গোলপাতা, হোগল, কেওড়া, বাটুল, গেওয়া, তুলসিপাতা, বাসোকপাতা, উলটকম্বল, লজ্জাবতী, লোটকুড়াল, তিতবেগুন, শিয়ালকাটা ইত্যাদি মূল্যবান উদ্ভিদ সুন্দরবনের অন্যতম বনজ সম্পদ।
সুন্দরবন বাংলাদেশের মধ্যে বন্যপ্রাণীর সবচেয়ে বড় আবাসভূমি। ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী এর সম্পদ। এদের মধ্যে, স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে ২৭.৬০%, সরীসৃপ ২৪.৪৭%, উভচর ৩৬.৩৫%, পাখি ৩৪.৫৭%।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার সুন্দরবনের প্রধানতম অধিবাসী। বিশ্বে একমাত্র সুন্দরবনেই এই বাঘ পাওয়া যায়। এর সৌন্দর্য ও বন্যতার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। ২০১৫ সালের ক্যামেরা পদ্ধতিতে বাঘ গণনার জরিপ প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১০৬টি। ২০০৪ সালে বন বিভাগ এনএনডিপির সহায়তায় প্রথমবারের মতো বাঘের পায়ের ছাপ গুনে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করেছিল ৪৪০টি। ২০০৬ সালে ক্যামেরা পদ্ধতিতে গণনা করে ২০০টি বাঘ পাওয়া যায়।
বাঘ ছাড়া সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য প্রাণী হলো চিত্রলহরিণ, মায়াহরিণ, বন্যশূকর, বানর, শেয়াল, বাঘডাস, হনুমান, উদবিড়াল, কাঠবিড়াল, সজারু, বনমোরগসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। এই বনে ৩০০টির বেশি প্রজাতির পাখি আছে। এর মধ্যে কিছু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সুন্দরবনের পাখিগুলোর মধ্যে সাদাচিল, সাদা ঈগল, শকুন, কানিবক, চিতাবক, রাগঘাবক, কজ, লালচিল, মাছরাঙ্গা, মদনটাক, ঘুঘু, গাংচিল, শংখচিল, কাঠঠোকরা, কাদাখোঁচা, শংখচিল, ডুঙ্গো, কাকাতুয়া, হলদে পাখি, পানকৌড়ি, হড়িকেল, বনমোরগ, সারস, জলকবুতর, মুনিয়া, দোয়েল, বুলবুলি, ফিঙে বেশি দেখা যায়।
নিজস্ব প্রজাতির পাশাপাশি ঋতুভেদে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি সুন্দরবনের আকাশ কলকাকলিতে মুখরিত করে রাখে। প্রায় ৫০টিরও বেশি প্রজাতির পাখির নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে সুন্দরবনে। IRMP (Integrated Resource Management Project) এর ১৯৯৬-৯৭ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে সুন্দরবনে, হরিণ রয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার, বানর রয়েছে ৫০ হাজার, কুমির রয়েছে ২০০টি, বন্যশূকর রয়েছে ২৫ হাজার। সুন্দরবনে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়া, বিছা, শামুক, ঝিনুক। এ ছাড়াও সামুদ্রিক কাছিম ও হাঙ্গর মাঝে মাঝে দেখা যায়। উভচর প্রাণীর মধ্যে ব্যাঙ (সবুজব্যাঙ, গেছোব্যাঙ, কুনো ব্যাঙ) রয়েছে সবচেয়ে বেশি।
সুন্দরবনে বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কুমির চন্দ্রবোড়া, গোখরা, অজগর, রাজগোখরা, দারাস সাপ, গুইসাপ, গিরগিটি, টিকটিকি সহ সামুদ্রিক সাপ। প্রজাপতি, মাকড়সা, গুবরে পোকা, মৌমাছি সহ বিভিন্ন প্রজাতির কীটপতঙ্গ রয়েছে সুন্দরবনে। এদের মধ্যে মৌমাছির তৈরি মোম ও মধু থেকে প্রত্যেক বছর প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব সরকার আদায় করে থাকে।
কটকা ওয়াচ টাওয়ারকে পিছু ফেলে সোজা উত্তরে প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে গেলে জামতলা সমুদ্রসৈকত। টাইগার পয়েন্ট অন্যান্য বনের মতো এই জামতলাতেও রয়েছে। কারণ বাঘিনী বাচ্চা ডেলিভারি দেয়ার পর এখানকার কেয়া বনে বাচ্চাকে আগলে রাখে পুরুষ বাঘ থেকে রক্ষা করার জন্য। তাই সারিবদ্ধভাবে যাওয়ার পথে একটু ভয়ও কাজ করছিল। আসা যাওয়ার পথে প্রায় ৬ কিলোমিটার পথ। তাই কেউ পিছিয়ে পড়লে অন্যদেরও থামতে হতো। কারণ দলছুট হওয়া চলবে না। যাওয়ার পথে একজনের পা কেটে গিয়েছিল। তার জন্য আমাদের পুরো বহরটাই ধীরে চলতে হয়েছে। আমাদের একমাত্র মেয়ে আকিফার বয়স তখন তিন বছর। সে অনেকটা পথ হেঁটেছে। তা দেখে বড়দের প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে শেষ দিকে এসে তাকে কোলে নিয়ে বাকি পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
পথে চলতে চলতে বিভিন্ন আকারের জামগাছ সৈকতটির নামের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। জামতলা সৈকতটি নির্জন এবং পরিচ্ছন্ন। বেলাভূমিজুড়ে শুধুই দেখা যায় কাঁকড়াদের শিল্পকর্ম। কোথাও কোথাও দেখা যায়, জোয়ারের ঢেউয়ের ধুয়ে যাওয়া গাছের শেকড়। সৈকতটি সোজা পুবে গিয়ে শেষ হয়েছে কচিখালিতে। হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সৈকতে পৌঁছে সবাই খুব উল্লসিত হয়ে ওঠে। তবে জামতলা সমুদ্রসৈকতটি গোছল জন্য আদর্শ জায়গা নয়।
সন্ধ্যায়ই লঞ্চে ফিরে এলাম এবং নৈশকালীন মজাদার বারবিকিউ খাবার, পরটা, চিকেন বিবিকিউ, বিবিকিউ ফিস, হাঁসের গোশত ভুনা ও ফলের কাস্টার্ড দিয়ে আপ্যায়িত করা হলো। এর মধ্য দিয়েই আমাদের ভ্রমণ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হলো। রাতের খাবারের পরপরই জেনারেটর বন্ধ হয়ে যায়। গভীর রাতে, গহিন বনে, গা ছমছম করা অন্ধকারে লঞ্চের ছাদে বসে থাকার অনুভূতিটাই আলাদা। তবে শেষ দিন ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়ে পড়লাম একটু আগেই। ঘুম ভাঙলো লঞ্চ চলার শব্দে। ভোর হওয়ার পথে। বাইরে এসে দেখলাম কটকা ছেড়ে অনেক দূর এসে পড়েছি আমরা। রাত ৩টায়ই জোয়ারের সময় আমাদের লঞ্চ চলা শুরু করেছে। পরদিন বেলা ২টা নাগাদ আমরা খুলনা এসে পৌঁছলাম।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ