আকাশ ডাকে নদী ডাকে

আকাশ ডাকে নদী ডাকে

গল্প ডিসেম্বর ২০১১

জুবাইদা গুলশান আরা..

চাদরের এ মাথা টানলে ও মাথায় টান পড়ে। বৃষ্টি হোক, রোদ্দুর বা শীতের বাতাস, ওইটুকুই সম্বল। তাতে কী? পাশাপাশি শুয়ে জড়িয়ে ধরে বন্ধুর গলা। তারপর এক সময় কেউ একজন উঠে বসে, ঘুম চোখ ডলতে ডলতে চেঁচিয়ে ওঠে,
- এই রবি আমার চাদ্দরের কোনা কই লইয়া গেছত ব্যাডা? আমার জব্বর ঠাণ্ডা লাগতাছে। দে তাড়াতাড়ি!
- আমি লই নাই। তুই ঠ্যালা মাইরা ফালাইছস, ঘুমের বাতালে ঠাহর আছে নি? কই যায় তর মাথা, কই যায় ঠ্যাং। শুরুটা ঝগড়ার সুরে হলেও শেষ হয় হাসতে হাসতে। ঐ চাদরে দুই ছোকরার পা অবদি ভালো করে ঢাকার কথা নয়। গরমের দিন বলে এক চাদরে গা ঢেকে মশা আর হাওয়া থেকে বাঁচার চেষ্টা চালানো যায়। এর পায়ের পাতা ওর গোড়ালি টানাটানি করে ঢাকে। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ে দুই কিশোর।
ছেলে দুটো একেবারে হা-ঘরে নয়। গাঁও গেরাম আছে, বাপ মায়ের ঘরে আদরেই ছিলো। কিন্তু রবিউল্লার মা মরে গেল বন্যার সময়ে সাপের কামড়ে। কষ্টে মষ্টে বেনো দুর্ভোগ কাটলে বাজান আবার বিয়ে করে বসলো। ব্যস শুরু হলো কঠিন অনাদর, অবহেলা। বাজান অবশ্য বলতো, মাঠে যায়, ইস্কুলে যায়, দুইডা ভাত অরে বেশি দিবার চাও না ক্যান শশীর মা? নতুন মা বলতো, তয় পোলারে লইয়া থাকেন, আমি যামুগা।
এরকম চলতে চলতে অসহ্য হয়ে উঠলো জীবন। বন্ধুদের সঙ্গে গরুর ল্যাজ ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে একদিন পলিথিনের ব্যাগে একটা লুঙ্গি আর শার্ট নিয়ে বাড়ি থেকে পালালো রবিউল। সে চলে গেলে বাজান কষ্ট পাবে এটা ঠিক। কিন্তু রোজকার অশান্তি থেকে তো বেঁচে যাবে! যদি ইচ্ছে করে খুব, তখন বাড়ি ফিরবে। ছলিম মাঝির মাছ ধরা নৌকায় চড়ে লুকিয়ে চলে গেল রবিউল। একেবারে নারায়ণগঞ্জে। কখনও মাছের বাজারে, কখনও সবজি বাজারে আবার কখনও কাঠ ফাড়াইয়ের কারখানায় কাজ করতে গিয়ে ভাব হয়ে গেল তারই মতো আর একজন বন্ধুর সঙ্গে। সলিমও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে শেষে এক লঞ্চ মালিকের কাছে কাজ পেয়ে বেঁচে গেছে। ঘাট থেকে ঘাটে মাছধরা, দূর নদীতে ভেসে যাওয়া, মাছ ধরা নৌকায় রাত কাটানো, এই সব দিনের মাঝখানে দেখা হয়ে গেল রবিউলের সঙ্গে।
- সারেং চাচা, অয় বাড়ত থন চইল্যা আসছে আমাগো লগে কাম করবার চায়।
কাশেম আলী সারেং তীক্ষè চোখে জরিপ করলো রবিউলকে। তারপর বললো, কই থন আইছস? পলাইছস ক্যান? শেষে তোর বাপে পুলিশ কেস না কইরা বসে।
রবিউল বলেছিলো না চাচা, আমি নিজে পলাইয়া আইছি।
- বাজানের ওপর গোসা করছস? বাপ মায়ের ওপর গোসা কইরা লাভ নাইরে ব্যাটা, পরে বুঝবি।
- না চাচা, বাজানের ওপর না। ওই হতাই মায়ের অইত্যাচারে..., বলতে বলতে তার জীবনের সব গল্প বেরিয়ে এলো, চোখের পানির মধ্য দিয়ে।
- আইচ্ছা আইচ্ছা বাস বাস। কয়দিন এই হানে থাক। অহন কাম করস কোন হানে?
- ওই করাতকলে, পশ্চিম বাজারে।
আসলে করাতকলে কাজ করতে ঘাম ছুটে যায় রবিউলের। বড্ড পরিশ্রমের কাজ। তাই মওকা পেলে অন্য কোথাও কাজ খুঁজে নেবার চেষ্টায় আছে। শেষ অবধি কাশেম মিয়ার লঞ্চে কাজ পেয়ে একটু আশার আলো দেখলো রবিউল। কাশেম মিয়া লঞ্চে মাছ চালান দেয়া নেয়া করে। বিভিন্ন আড়তে মাছ যায় তার লঞ্চে। ভালো ব্যবসা। ব্যবহারও ভালো। দূর দূর নদীতে মাছ ধরতে যায় তার নিজস্ব সব জেলেরা। মাছের নৌকায় বরফ দিয়ে মাছ বোঝাই করা, প্যাকিং বাক্সে করে চালানে পাঠানো, জেলেদের খাওয়া দাওয়া, রান্না করা এসব কাজে জড়িয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে ওঠে রবিউল আর সলিমের দিনগুলো। ওরাও জান পরান দিয়ে কাজ করে। আগে আগে কাশেম সারেং নিজেও লঞ্চ নিয়ে দূর নদীতে যেতো। এখন বয়স হয়েছে তাই একটু কম যায়। বিশ্বস্ত লোকজনই তার কাজ করে। কাশেম মিয়ার দুই ছেলে বিদেশে আছে। রবিউল ভাবে, বড় হয়ে সে-ও বিদেশ যাবে। তখন সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে। বাজান খুশি হবে। সৎ মা-ও আর বাজে কথা বলবে না। সারাদিন কাজের পরে সলিম আর সে নিজেদের টিনের ছাউনি দেয়া ছাপড়ায় ঘুমায় দু’জন। এ ঘরে প্রচুর মালপত্র, নৌকার মালসামান, মাছের ঝুড়ি বোঝাই। চৌকির এক পাশে মাঝিদের জিনিসপত্র থাকে। হোগলার পাটি বিছিয়ে এক চিলতে জায়গায় দুই বন্ধু শুয়ে ঘুমায়। সারেং একটা চাদর দিয়েছে গায়ে দেবার জন্য। খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস আসে। বৃষ্টিও ছিটকে ফুটো টিনের চালে বাজনা বাজায়। গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে চাদর নিয়ে টানাটানি হাসাহাসি করে দুই বন্ধু।

সেদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল সলিসের। কী জানি কেন, ফেলে আসা ছেলেবেলার ছবিগুলো স্বপ্নের মধ্যে ফিরে ফিরে আসে। মেলা দেখতে গিয়েছিলো সলিম। বাজান তাকে চরকিতে চড়িয়েছিলো। অনেক বাঁশি, মাটির পুতুল  বেলুনও কিনেছিলো সে। কিন্তু হঠাৎ ভীষণ ভিড়ের মধ্যে বাজানের হাত থেকে ছিটকে পড়েছিলো সলিম। চিৎকার করে সারা মেলা তোলপাড় করেছিলো। শেষ পর্যন্ত একটা লোক তাকে হাত ধরে নৌকায় তুলে নেয়। বলে, লও বাড়িত লইয়া যাই।
- আমার বাজান কই? কুঁকরে কুঁকরে কেঁদেছিলো সলিম। কয়েকদিন লোকটির বাড়িতে ভালোই ছিলো সলিম। শেষে একদিন সে একদল লোকের পিছু পিছু রাস্তা বেয়ে বেরিয়ে গেল। তার গ্রামের নাম কালীগঞ্জ। বাবার নাম হারেস মিয়া। যেমন করে হোক বাড়ি পৌঁছাবে সলিম। কিন্তু সেই খোঁজা আর শেষ হয়নি। একটা দাড়িওয়ালা মোটা সোটা মানুষ তাকে আদর করে বিস্কিট খাওয়ায়। গুটি শুটি মেরে বেঞ্চিতে শুয়ে ভারী ঘুম পায় তার। ঘুম ভেঙে দেখে ঢাকা শহরের বাঁধানো ঘাটে এসে পৌঁছেছে। লোকটা তাকে চায়ের দোকানে কাজ করতে দেয়। বলে, যা গেছে, তাতো আর ফিইরা পাবি না বাপ, এইখানে কাজ কাম শিইখা থাইকা যা। ভাইগ্যে থাকলে কোন দিন বা তর বাজানের লগে তার দেহা হইবো?
সেই স্বপ্নই দেখে ঘুম ভেঙে গেছে সলিমের। বুকের কাছে ধরে রাখা খেলনাগুলো ছিটকে পড়েছে তার। বাজানকে হারিয়ে চোখ ভিজে উঠেছে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে সলিম। সে কান্নায় ঘুম ভেঙে গেছে রবিউলেরও।
- স্বপ্ন দ্যাখছস? কান্দিস না ভাই, কাইন্দা কী হইবো? ল’ ঘুমাইয়া পড়। সলিমের গায়ে চাদরটা টেনে দেয় রবিউল। যতœ করে ঢেকে দেয়। পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। ঠিক যেন দুই ভাই।

ক’দিন ধরে আকাশের চেহারা গোমরাচ্ছে। আগে আগেই ফিরে এসেছে মাছধরা নৌকা আর ট্রলার। সলিম আর রবিউলও সারাদিন আড়তে বরফ আর মাছের বাক্স প্যাকিং করেছে। তারই মধ্যে সামান্য একটা ভুলের জন্য আচমকা রবিউলকে একটা জোর থাপ্পড় মেরে বসে মাঝিদের মাতবর।
- মাছ কম পড়লো ক্যান? কই থুইছস?
- আমি ঠিক গুইন্যা থুইছি মাছ। আসলে কিছু মাছ অন্যেরা সরিয়ে ছিলো। দোষটা পড়লো ছেলেদের ঘাড়ে। অভিমানে চোখে পানি এসে গেল। রবিউল সলিমকে বললো, থাকুম না। যামু গিয়া। সারেং চাচা অগো কিছু কইলো না ক্যান?
-চাচায় সব জানে। দেখলি না, আমাগো কিছু কইলো না? আয় ঘুমাবি না?
রাতের ঝোড়ো বাতাসে চাদর নিয়ে টানাটানি করলো দু’জন। আসলে তো শখের ঝগড়া! শেষ রাতে গুম গুম করে মেঘ ডেকে উঠে ঘুম ভাঙিয়ে দিলো ওদের। গায়ের চাদরটা ফুলে ফুলে উঠছে নৌকার পালের মত। আকাশে অদ্ভুত নীল আর পাঁশুটে রঙের মেঘ। কুয়াশার মতো বৃষ্টির নরম ধারা নামছে নদীতে। দুই কিশোর যেন স্বপ্ন দেখছে। বাবা মা, ভাই বোন, দুরন্ত শৈশব, ফসলের মাঠ, সবাই ওদের ডাকছে যেন।
পাশাপাশি দু’জনই হেঁটে গেল ঘাটের দিকে। সারি সারি নৌকা, শক্ত করে বাঁধা। একটা ছোট্টো ডিঙি নৌকা খুলে ওরা উঠে গেল। লগি না, বৈঠা নয়, শুধু বিশাল রহস্যময় স্রোতে ভেসে হারিয়ে যাওয়া। গলুইয়ে দাঁড়িয়ে তাকালো নদীর দিকে, তাকালো প্রশান্ত আকাশের দিকে। ঘরে ফিরতে চায় ওরা। কিন্তু সে ঘর কোথায় ওরা জানে না। শুধু জানে ফিরতে হবে। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া উঠে এলো। ডিঙিটাকে নিয়ে যেন উল্টো পাল্টা স্রোতে  খেলায় মেতে উঠলো। ওরা স্থির দাঁড়িয়ে। অন্ধকার আরো গাঢ় হয়ে ওদের ঘিরে ধরলো।

সারেং পাড়ায় ভীষণ তোলপাড় উঠেছে। ছেলে দুটো কি পালিয়ে যাচ্ছিলো? শেষ রাতের তুফানে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে। ডুবে যাওয়া ভিঙিটা মাইলখানেক উজানে পাওয়া গেছে। দুই কিশোরকেও পাওয়া গেছে।
চাদর দিয়ে ঢাকা শরীর দুটো দেখে সবারই চোখে পানি আসে। হাসিখুশি দুইটা ছেলে। সব হারিয়ে গিয়ে ভাসতে ভাসতে এখানে এসেছিলো। কাশেম মিয়া বলেন, আসলে অরা বাড়ি ফিইরা যাইতে চাইছিলো। তার কথা শুনে কি একটু নড়ে চড়ে ওঠে নিস্প্রাণ শরীর দুটো। আসলেই তো সারেং চাচা ঠিক বুঝেছে। পুলিশ যতোই জটিল প্রশ্ন করুক, মূল কথা একটাই। ওরা দু’জনেই ঘরে ফিরে যেতে চেয়েছিলো।
চাদর দিয়ে ঢাকা শরীর দুটো যেন চুপি চুপি কথা বলে- ওই রবিউল চাদ্দরডা টান দিস ক্যান, ঠাণ্ডা লাগে না?
ফিক ফিক করে হাসে অন্যজন। যেন মস্করা করে বলে, আর অহন কিছুতে কাম নাই, চল ঘুমাইয়া পড়ি।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ