আঁধার রাতের অতিথি   -মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ্

আঁধার রাতের অতিথি -মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ্

গল্প অক্টোবর ২০১৬

খলিফা আল মনসুরের রাজত্বকাল। কুফা নগরীতে বাস করতেন এক ধনবান লোক। সৌরভে সুশোভিত বাগানবাড়ি। সুরম্য প্রাসাদ। কৃত্রিম ঝরনাধারা। মেঝেয় মসৃণ কার্পেটের আস্তরণ। চাকর-নফরের সমাবেশ। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের আনাগোনায় মুখর। অর্থ আর ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যে লোকটি দারুণ আনন্দে দিনাতিপাত করছিলেন। তাঁর সংসারের কোথাও ছিল না অভাবের চিহ্ন।
দিনের পর আসে রাত। আলোর অনুপস্থিতিতে নামে অন্ধকার। দু’কূল প্লাবী নদ-নদীতে আসে ভাটার হাহাকার। ঠিক তেমনি কালের আবর্তে এসে শেষ বয়সে ধনবান লোকটি হয়ে পড়লেন কপর্দকহীন গরিব, নিঃস্ব। চারদিকে দুঃখ আর দারিদ্র্যের হাতছানি। প্রতি পদে পদে ব্যর্থতার গ্লানি। এ দুঃখ-দারিদ্র্যের দিনে বন্ধু-বান্ধবও দূরে সরে গেছে একে একে। আনন্দঘন সুরম্য প্রাসাদ আজ যেন প্রেতপুরী, দোজখখানা।
কুফা নগরী ধনে-জনে, শক্তি-সামর্থ্যে বলীয়ান। লোকটি ইচ্ছা করলে যে কোন আত্মীয়-স্বজন থেকে ধার নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন। মুখ খুলে একটু সাহায্যের আবেদন জানালে শত শত দিরহাম এসে জমা পড়বে। কিন্তু না; লোকটি ছিল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। আত্মসম্মানবোধের প্রতি খুব সচেতন। হাজার দুঃখ-কষ্ট হজম করতে রাজি তবু কারো কাছে ভিক্ষার হাত প্রসারিত করতে একটুও রাজি নয়। লোকটি বলতো, “আল্লাহ্ ও তার পেয়ারে হাবিব ভিক্ষাবৃত্তি পছন্দ করেন না। আমি কী করে লোকদের কাছে গিয়ে বলবো ওগো, বড় কষ্টে আছি, কিছু সাহায্য দাও।”
লোকটি তাই ঘরের সোনা-চান্দি, আসবাবপত্র, উপহার-উপঢৌকন বিক্রি করে কোন রকমে দিনাতিপাত করছিলেন।
মাত্র কিছুদিন আগেও যিনি ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে সুদূর বাগদাদের ব্যাবিলন উদ্যানে প্রমোদ বিহারে যেতেন, কারবালায় যেতেন হোসেন (রা.)-এর মাজার জিয়ারতে, তাইগ্রিস উপকূলে যেতেন বাসন্তী ভ্রমণে। আজ তিনি বড়ই নিঃসঙ্গ। ব্যবসা-বাণিজ্য জমাজমি বিক্রি করে চার দেয়ালে বন্দী।
একেবারে কর্মহীন বসে থাকলে যে কুঁড়েমি, অলসতা এসে সাড়ে তিনহাত দেহকে করে দেবে অবসন্ন। মাথায় চাপবে শয়তানি কুমন্ত্রণা। তাই লোকটি সদর দরজা থেকে বাড়ির আঙিনা পর্যন্ত সুবিন্যস্ত ফুল বাগানটি উপড়ে ফেললেন। তাতে ফলাতে শুরু করলেন শাক-সবজি, মৌসুমি ফল-ফলাদি। কিন্তু হাঁড়িতে ভাত না থাকলে পাতিলের সবজিতে তো আর পেট ভরে না!
একদিন সকালে লোকটি সবজি বাগানে কাজ করছিলেন। তাঁর ছোট মেয়েটি আনমনে পুতুল তৈরি করছিলো দহলিজে বসে। তার মা বারান্দায় বসে মেয়েটির কামিজের ছেঁড়া অংশটি সেলাই করছিলেন। এমন সময় এক ফেরিওয়ালা রাস্তা দিয়ে শসা বিক্রির জন্য হেঁকে-ডেকে যাচ্ছিলো। ফেরিওয়ালার কাছে তাজা শসা দেখে মেয়েটির খেতে ইচ্ছা করলো। ফেরিওয়ালাকে দরজায় বসিয়ে মেয়েটি বারান্দায় বসা মায়ের কাছে দৌড়ে গেল পয়সার জন্য। কিন্তু বেচারি মা কোত্থেকে পয়সা দেবেন। তাঁর কাছে যে একটি পয়সাও নেই। মেয়ে পয়সা না পেয়ে রাগে, অভিমানে হাউ মাউ কান্না জুড়ে দিল। বাবা দূরে দাঁড়িয়ে এসব দেখছিলেন।
মা কান্নারত মেয়েটিকে কাছে ডেকে আদর করে বুঝিয়ে বললেন, মামণি কেঁদো না; ওগুলো শীতল শসা। শসা খেলে তোমার বুকে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। তোমার না কাশি। কাল তোমার আব্বু বাজার থেকে বাগদাদী আঙ্গুর নিয়ে আসবেন। আমরা সবাই মজা করে খাবো। তোমার বন্ধু তানিয়াকেও কাল আসতে বলবো। আর কেঁদো না। যাও ফেরিওয়ালাকে বিদায় দাও। নইলে বেচারা আমাদের খারাপ ভাববে।
মায়ের কথায় মেয়েটির মন সহসায় আনন্দে ভরে উঠলো। মায়ের কথামতো ফেরিওয়ালাকে বিদায় দিয়ে এলো। মা ও মেয়ের এ অবস্থা দেখে পিতার চোখে নামলো অশ্রুধারা। শিশু- মেয়েটিকে আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করতে বললেও ঘরে যে একটি পয়সাও নেই। তবে কী করে কাল বাজার থেকে মেয়ের জন্য আঙ্গুর আনবে? ভাবলেনÑ এভাবে আর কতদিন চলবে? পরিবারের জন্য যে একটা কিছু করা চাই?
একে একে আত্মীয়-স্বজনের মুখচ্ছবি তাঁর মানসপটে ভেসে উঠলো। অতীতে কোন বন্ধু, কোন প্রতিবেশী তাঁর প্রাসাদে আসত, বিভিন্ন ফায়দা লুটতো, সুখের- আনন্দের ভাগীদার হয়ে বাহবা জোগান দিত, এসব মনে করে লোকটি হাঁপিয়া উঠলেন। মনে মনে বললেন, সুদিনে যখন আমর সব ছিল এরা সবাই বন্ধুবেশে ভিড় জমাতো। আজ আমার কিছু নেই বলে কেউ আর খোঁজ নিতে আসে না। সবাই স্বার্থপর মতলবের ফকির। শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন “মজলিসে বরকত” যাবেন।
মজলিসে বরকতÑ ইমামে আজম হজরত আবু হানিফা (রহ)-এর দরবার। কুফা নগরীর একপ্রান্তে অবস্থিত। এই মজলিসে বরকতের সুনাম ছিল দেশজুড়ে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, পার্থিব বা পারলৌকিক যেকোনো বিষয় হোক না কেন, সেখান থেকে কেউ কিছু না নিয়ে খালি হাতে ফেরেনি কখনও।
সালাতুল আসর শেষে ইমাম সাহেব তাঁর দরবারে বসেছেন। ভক্তবৃন্দের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন অনেকে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। দারিদ্র্যপীড়িত লোকটি বড় আশা নিয়ে দরবারের এক কোণে এসে বসলেন। এ সময় কেউ ইমামের কাছ থেকে জানতে চাইলেন মাসয়ালা-মাসায়েল। কেউ জটিল রাজনৈতিক বিষয়। আবার কেউ বিচারসংক্রান্ত কোন রায় জেনে নিলেন। অন্যদিকে দু’একজন প্রয়োজনীয় দয়া-দাক্ষিণ্য গ্রহণ করলেন নীরবে। লোকটি নির্বিকার হয়ে সবকিছু দেখছিলেন। নিজের সমস্যার কথা বলি বলি করেও বলা হয়নি। বলবেন কিভাবে? যিনি কোন দিন কারো কাছে দৈন্যের হাত প্রসারিত করেননি, আজ কিভাবে বলবেন, হুজুর, আমি খুব সমস্যাগ্রস্ত। ঘরে একটি কানা-কড়িও নেই। আমাকে সাহায্য করুন।
পাশের মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের সুমধুর আজান ধ্বনি ভেসে এলো। সালাতুল মাগরিব আদায় করতে হবে। একে একে সবাই মজলিস থেকে মসজিদের দিকে ছুটলেন। লোকটি কিছু না বলে অন্যদের অনুসরণ করলেন। লোকটির না-বলা কথা ইমামে আজমের অন্তর্দৃষ্টি এড়ালো না। সবাই মসজিদে গেলেন। ইমাম সাহেব লোকটির ব্যথাহত হৃদয়ের অনুভূতি হৃদয়ঙ্গম করে নামাজে শরিক হলেন।
অমাবস্যার রাত। মাগরিবের পরই কালো আঁধার ছেয়ে গেছে কুফা নগরী। প্রতিদিন মাগরিবের নামাজ শেষে ইমাম সাহেব অনেক নফল নামাজ ও দোয়া-দরূদ পাঠ করেন। মুসল্লিদের সাথে কুশল বিনিময় করেন। আজ আর তা করলেন না। তাড়াতাড়ি নামাজ সেরে একাকী মসজিদ থেকে বেরিয়ে পড়লেন। নির্দিষ্ট দূরত্বের ব্যবধানে লোকটিকে অনুসরণ করলেন। চুপি চুপি চিনে এলেন লোকটির বাড়িঘর।
ইমামে আজমের কোনো অভাব ছিল না। লক্ষ দিরহামের রেশমি কাপড়ের ব্যবসার জন্য তিনি খ্যাত ছিলেন। আইনবিদ হিসেবে ছিল তার প্রচুর সুনাম। নিজ বাড়ি এসে কোষাগার থেকে একটি থলেতে পুরে নিলেন কিছু দিরহাম। অপেক্ষা করতে থাকলেন, কখন ঐ অভাবী লোকটির দ্বারে গিয়ে তা পৌঁছাবেন।
নিঝুম রাত। কুফা নগরী শান্ত হয়ে এসেছে। বাইরে দু’একটি ঝিল্লি পোকার একটানা গান নীরবতা ভাঙছে। ইমামে আজম এই আঁধার রাতে লোকটির বাড়ি গিয়ে সদর দরজায় দাঁড়ালেন। ভেতরে কোনরূপ আলোর চিহ্ন নেই। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ইমামে আজম দরোজার কড়া নাড়লেন। ভেতরে থেকে কোনো সাড়া পেলেন না। আবারো কড়া নাড়লেন, ডাকলেন। এবার স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই সমস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কে? আপনাদের অতিথি। Ñ ইমামে আজম জবাব দিলেন।
অতিথি! লোকটির অবিশ্বাস্য মনে হলো। গেল এক বছরে কোনো মেহমানই তিনি চোখে দেখেননি। ভাবলেন, দুষ্ট কোন লোক আসেনি তো? আবার মনে মনে বললেন, ধনহীনের ঘরে ধন চুরি করার মতো কুফা নগরীতে কেউ নেই। ক্ষণিকের মধ্যে অনেক কিছুই ভেবে এগিয়ে গেলেন সদর দরোজায়। আস্তে করে খুলে দিলেন দ্বার।
ভেতরে গৃহস্বামী। বাইরে অতিথি। কালো আঁধারে কেউ কারো মুখ দেখলেন না। ইমামে আজম লোকটির সামনে দিরহাম ভর্তি থলেটি রেখে বললেন, দেখ! তোমার সামনে একটি থলে রাখা আছে। এটি তোমার জন্য।
এ কথা বলেই ইমাম সাহেব নিজ গন্তব্যে ছুটলেন। ‘আঁধার রাতের অতিথিকে’ লোকটি ঘরে নেয়ার আবেদন করারও সুযোগ পেলো না।
লোকটি থলেটি কুড়িয়ে নিলেন। ঘরে গিয়ে দিলেন স্ত্রীর হাতে। স্ত্রী থলেটি হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বললো, সোবহান আল্লাহ! থলেটি যে দিরহামে ভর্তি! কে দিয়েছে এটি? স্বামী-স্ত্রী দু’জনে তড়িঘড়ি খুললেন! দেখলেন থলের মুখে এক টুকরো কাগজ। লোকটি তা হাতে নিয়ে পড়লেন। তাতে লেখা : আবু হানিফা এই অর্থ নিয়ে এসেছিলো। এটি হালাল উপায়ে অর্জিত। প্রয়োজনে তুমি তা খরচ করে তৃপ্তি লাভ করতে পার।
ইমামে আজমের এরূপ অসংখ্য গোপন দানে অনেক দরিদ্র লোক ফিরে পেয়েছিলেন সুখের পরশ। লোকটিও ইমামপ্রদত্ত অর্থ দিয়ে শুরু করেছিলো ব্যবসা। একদিন তার ঘরে ফিরে এলো অতীত দিনের মতো আনন্দের উচ্ছলতা।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ