আ আ তি তি

আ আ তি তি

সাইন্স ফিকশন আতিয়া তাসনিম প্রমা মার্চ ২০২৪

সময়টা এখন পৌষ মাস নিশ্চয়ই। আমাদের বাড়িতে কোনো বাংলা ক্যালেন্ডার নেই। তাই বাংলা মাস কোনটি কখন আসছে- যাচ্ছে তা বিশেষ বোঝা যায় না। তবে ঋতুর পালাবদল দেখে বুঝতে অত একটা অসুবিধা হয় না। দিনের চাইতে রাতের দৈর্ঘ্য বেড়েছে। সূর্যটাও আমার মতো আলসেমি করে মেঘের চাদর গায়ে জড়িয়ে চুপটি করে ঘুমিয়ে থাকে। আমার ওই প্রিয় গোলাপি রঙের নরম কম্বলটার মতো, সূর্যেরও কি আকাশের মেঘগুলো খুব প্রিয় হয়ে ওঠে এই শীতকালে?

মেঘের ফাঁক ফোকর দিয়ে সূর্যের আলো ইতোমধ্যেই উঁকি দিতে শুরু করছে। বাড়ির বাইরে বিশাল রেইনট্রি গাছের ডালে দুটো কাকাতুয়া পাখি বসে আছে। ওদের কি শীত করে না? এই সাত সকালে, ওভাবে কুয়াশা মেখে বসে আছে কেন? আমার চোখ থেকে ঘুমের রেশ এখনও কাটেনি। তিনশো পেজের মোটা হিস্ট্রির বইটা হাতে নিয়ে ঢুলে ঢুলে পড়ছি। বাবার ইচ্ছে ছিল আমাকে সাইন্সে পড়াবেন। কিন্তু আমার গোবর পোড়া মাথা সেটা হতে দেয়নি। এ নিয়ে বাবার দুঃখ আছে কি না তা কখনো জানতেও চাওয়া হয়নি।

আমার বাবা একজন নামকরা বিজ্ঞানী ও গবেষক। তার সব আবিষ্কারগুলো যেমন চমৎকার তেমনি অনন্য। এই যেমন Evanish spray টার কথাই বলি। এটি এমন এক স্প্রে, যা যে-কোনোকিছুকে বারো ঘণ্টার জন্য অদৃশ্য করে ফেলতে পারে। স্প্রেটি কোনো বস্তুর ওপর প্রয়োগ করলে বস্তুর ওপর একটি বর্ণহীন কেমিক্যাল লেয়ার তৈরি হয়। এই লেয়ার থেকে আলো প্রতিফলিত হওয়ার সময়ে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে ১০০-৩০০ ন্যানোমিটার হয়ে যায়। কিন্তু দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ৩৮০-৭৮০ ন্যানোমিটার হওয়ায় বস্তুটিকে তখন আর দেখা যায় না।

এছাড়া ভালো মানুষ আর খারাপ মানুষে পার্থক্যকারী চশমাটার নাম হলো Glass of mind. শরীরের ওপর আলো ফেলতেই দেহের অভ্যন্তরে থাকা হার্ট, কিডনি, ফুসফুস এমনকি ব্লাড সার্কুলেশন অব্দি খালি চোখে দেখা যায়- এমন টর্চটার নাম বাবা দিয়েছন অন্তর্ভেদী টর্চ। Miraculous Cooker এমন একটি যন্ত্র, যা মস্তিষ্কের সিগন্যালের মাধ্যমেই তৈরি করে দিতে পারে যে-কোনো খাবার। মন ভালো করার স্টিমুলেটরটার নাম হলো Mi amigo. Mi amigo একটি স্প্যানিশ শব্দ, যার অর্থ হলো My friend.

আমি বারান্দায় বসে পড়ছি, আর বাবা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে পঙ্খির কথা বোঝার চেষ্টা করছেন। পঙ্খি আমাদের বাড়ির নতুন অতিথি। ও দেখতে পাখির মতন হলেও ওর স্পেসিস সঠিকভাবে বলা বেশ কঠিন। পঙ্খি আকারে প্রায় শকুনের মতো বড়ো। তবে ওর মাথার দিকটা টিয়া পাখির মতো। ওর নিচের ঠোঁটটা ছোটো। আর ওপরের ঠোঁট বড়শির মতো নিচের দিকে বাঁকানো। পঙ্খির শরীরটা গাঢ় ধূসর বর্ণের। ওর ডানার পালকগুলো কালো ও নীল রঙের মিশেলে অদ্ভুত রকম সুন্দর। সাধারণ পাখিদের তুলনায় পঙ্খির শরীরের পালক পাঁচগুণ বেশি ঘন আর স্তরীভূত। তাই অন্যান্য পাখির চেয়ে পঙ্খির শীত সহ্য করার ক্ষমতা অনেক বেশি। তাছাড়া ওর চোখ দুটিও বেশ অদ্ভুত। বাবা পরীক্ষা করে বলেছেন, পঙ্খির চোখ  সাধারণ পাখিদের মতো নয়। ওর চোখের ধরন পুঞ্জাক্ষি ধরণের। প্রজাপতি, ঘাসফড়িং এসব পোকামাকড়দের যেমন সহস্রাধিক সংবেদী একক নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ চোখ গঠিত হয়। পঙ্খিরও তেমনি পুঞ্জাক্ষি আছে। আবার বেড়ালের যেমন চোখে টেপিটাম লুসিডাম নামক রঙিন কোষস্তর থাকার কারণে রাতের অন্ধকারে ওদের চোখ জ্বলে। পঙ্খির চোখেও হয়তো এমন কিছু আছে। কারণ ওর চোখেও অন্ধকারে নীলাভ-সবুজ আলো জ্বলতে দেখা যায়। বাবার ধারণা পঙ্খির দৃষ্টি শক্তি অন্যান্য পাখিদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত।

বাবা পঙ্খিকে পেয়েছিল এক জাপানিজ ভদ্রলোকের কাছ থেকে। লোকটির নাম মাকাতো হিরোশি। বাবার সাথে তার পরিচয় কীভাবে হয়েছিল, সে বড়ো লম্বা কাহিনী। মাকাতো পেশায় একজন পাখি ব্যবসায়ী। সে কেমন করে পঙ্খিকে পেয়েছিল সে গল্পটা বাবা আমায় বলেননি। তবে পঙ্খি যে সাধারণ পাখি নয়, সে কথা মাকাতোও বুঝেছিল। তাই ওর ব্যাপারে গবেষণা করার জন্যই সে পাখিটা বাবার কাছে দিয়েছিল।

পঙ্খির একমাত্র সমস্যা হলো সে কথা বলে না। প্রতিটা প্রাণীর নিজস্ব কিছু কায়দা থাকে; স্ব-জাতীয়  প্রাণীদের মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য। পঙ্খি যেন সেই সবকিছুর উর্ধ্বে। বাবা একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। নাম Frequency Translator দেখতে সাধারণ ব্লুটুথ স্পিকারের মতো হলেও যন্ত্রটির ক্ষমতা অভাবনীয়। প্রতিটি প্রাণীই বিভিন্ন কম্পাঙ্কের শব্দ তৈরি করে। মানুষের মতো তারাও একে অপরের সাথে কথা বলে। সে কথা আমাদের কাছে কেবল মিউ মিউ বা কিচিরমিচির শোনালেও তা যথেষ্ট অর্থবহ। ট্রান্সলেটরটা তার আশেপাশে থাকা প্রাণীদের বিভিন্ন ফ্রিকুয়েন্সির সাউন্ড ওয়েভ ক্যাপচার করে তা মানুষের ভাষায় ট্রান্সলেট করে শ্রোতাকে শোনাতে পারে। আপাতত ট্রান্সলেটরটা কেবল বাংলা আর ইংরেজি ভাষাতেই ট্রান্সলেট করতে পারে। ভবিষ্যতে এটার ওপর কাজ করে আরো কিছু ভাষা অ্যাড করা যাবে।

বাবা যে কতবার এই ট্রান্সলেটর ব্যাবহার করে পঙ্খির ভাষা বোঝার চেষ্টা করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। তবে যতবারই চেষ্টা করেন, ব্লুটুথে কেবল শনশন আওয়াজই শোনা যায়। অর্থাৎ একমাত্র পঙ্খির ক্ষেত্রেই বাবার এই ফ্রিকোয়েন্সি ট্রান্সলেটরটা কাজ করে না। বাবা বলেছেন, হতে পারে এই পাখিটি এতই নিম্ন অথবা উচ্চ মাত্রার কম্পাঙ্ক তৈরি করে কথা বলে, যে তা এই ট্রান্সলেটরের ক্যাপচারিং ক্যাপাসিটিকে সাপোর্টই করে না। অথবা এমন অন্য ধরনের কম্পাঙ্ক পঙ্খি ব্যবহার করে, যার কথা হয়তো আমরা এখনো জানি না।

পঙ্খি কেবলমাত্র একটি শব্দতেই সাড়া দেয়। আর তা হলো, “আ আ তি তি”। এছাড়া তার নাম ধরে ডাকা হোক, বা অন্য যাই-ই বলা হোক, ও সাড়া দেয় না। পঙ্খি তখন বাড়িতে এসেছে দিন দুয়েক হয়েছে। ওর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য আমি বা বাবা আমরা যাই করি না কেন, সে থাকে নির্বিকার। এটা সেটা বলার ফাঁকে আমার মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে যায় এই অর্থহীন শব্দ। তাতেই দেখি পঙ্খি আমাদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছে। আমি আর বাবা তো বিস্ময়ে পারি না বোবা হয়ে যাই। এরপর যত বার ‘আ আ তি তি’ বলা হয়, পঙ্খি সাড়া দেয়।

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পঙ্খির দিকে তাকালাম। বাবা ততক্ষণে ওর কথা বোঝার যুদ্ধে হাল ছেড়ে ঘরে চলে গেছেন। আমি ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলাম। আমায় অগ্রাহ্য করে ও অন্য দিকে তাকালো। আমি অপমানিত বোধ করলাম। সে তো একটা পাখি, তার এত দেমাক কীসের? আমি অসন্তুষ্ট হয়ে মনে মনে বললাম, ‘এমন কেন তুই পঙ্খি? আ আ তি তি  ছাড়া অন্য কিছু বললে সাড়া দিতে কি হয় তোর?’ 

আমি অবাক চোখে দেখলাম, আমার মনে মনে আ আ তি তি বলার সাথে সাথেই পঙ্খি পুনরায় আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছে!

দুই.

সকাল থেকে মা প্রচণ্ড রেগে আছেন। কারণ পঙ্খি নাকি তার অনুপস্থিতিতে রান্নাঘরে গিয়ে সব মাছ ভাজা খেয়ে ফেলেছে। এই নিয়ে মা বেশ বিরক্ত। তবে রাগের পাশাপাশি তিনি কিছুটা শঙ্কিতও। কারণ মা যখন রাগ করে ঘরে গিয়ে বসেছিলেন; পঙ্খি তখন নিজে নিজেই ফ্রিজ থেকে মাছ বের করে মসলা মাখিয়ে, আবার মাছ ভেজে দিয়েছে। আমি আর বাবা তা দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলাম। 

পঙ্খির পায়ের মাসল এবং নখ অন্যান্য পাখির চেয়ে অনেক আলাদা আর শক্তিশালী, এ আমরা জানতাম। তবে সে যে মাথা খাটিয়ে মাছ ভাজি করে ফেলবে, এ আমরা চিন্তাও করতে পারিনি। মায়ের ধারণা, আমাদের এই পঙ্খি আসলে একটি জীন। পাখির রূপ ধরে আমাদের বাড়িতে এসেছে। বাবা মায়ের কথায় কেবল হাসে। মা বলেছে, এই ভুতুড়ে পাখিকে শীঘ্রই বিদায় না করলে তিনি মামাবাড়ি চলে যাবেন।

পঙ্খি যে কেবল আজই আমাদের অবাক করল তা নয়। এই তো গত সপ্তাহের কথা। বাবা তার গবেষণার ঘরে নতুন একটি কেমিক্যাল নিয়ে কাজ করছিলেন। কিন্তু বাবা কিছুতেই কাক্সিক্ষত ফলাফল পাচ্ছিলেন না। এই নিয়ে তার হতাশার শেষ ছিল না। বাবা যখন ল্যাবে কাজ করেন, পঙ্খিকে তখন অন্যত্র খুব কমই দেখা যায়। বাবার কাজ করার পুরো সময়টাতেই পঙ্খি ল্যাব কেবিনেটের ওপর বসে বাবার কাজ মনোযোগ সহকারে দেখতে থাকে। বাবা যখন হতাশা নিয়ে তার অসম্পূর্ণ কেমিক্যাল মিক্সচারটা ফেলেই দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখনি পঙ্খি কোথা থেকে মুখে করে একটা ছোট্ট লোহার টুকরো নিয়ে এলো। সেই সাথে তার পায়ের আঙুলের সাহায্যে আনলো গ্লাইঅক্সালে ভর্তি একটা রিয়েজেন্ট বোতল। বাবা কিছু বুঝে ওঠার আগেই পঙ্খি ওই মিক্সচারে লোহার টুকরোটা দিয়ে দিলো। কয়েক মুহূর্তেই সেটা উজ্জ্বল নীল বর্ন ধারণ করল। এরপর মিনিটখানেক পর সেখানে কয়েক ফোঁটা গ্লাইঅক্সাল দিতেই টেস্টটিউবের সমস্ত মিশ্রণ একটি নাম না জানা গোলাপি গ্যাসে রূপান্তরিত হলো। নলের সাহায্যে গ্যাসজারে ওই গ্যাসটা নেওয়ার কাজখানাও পঙ্খিই করল। বাবা এ ঘটনায় পুরো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। যে গ্যাস আবিষ্কারের জন্য তিনি টানা তিন মাস ধরে কাজ করছিলেন। তার ইতি কি না টানলো একটা পাখি! পঙ্খি!

এখানেই শেষ নয়। পঙ্খি তার অনুভূতির কথা জানান দেয় তার শরীরের বর্ণ পরিবর্তন করে। বাবা এটা বহুদিন ধরে খেয়াল করে তারপর নিশ্চিত হয়েছেন। পঙ্খি যখন খুশি হয় তখন ও উজ্জ্বল গোলাপি আর হলুদের সংমিশ্রণে মিষ্টি একটি বর্ণ ধারণ করে। রেগে গেলে সেই বর্ণ ক্রমশ লালচে হয়ে আসে। রাগের মাত্রার সাথে ওর পালকের রং আরো গাঢ় হয়। লালচে থেকে বাদামি এমনকি ডার্ক মেরুন কালারও হয়েছিল একদিন। পঙ্খির যেদিন মন খারাপ থাকে, সেদিন ওর শরীরের বর্ণ অনুজ্বল ধূসর বা সাদাটে হয়ে যায়। এমনকি ওর স্বাভাবিক নীলচে ডানাও তখন সাদা হয়ে যায়।

এতকিছুর পরে বাবা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, পঙ্খি অবশ্যই কোনো সাধারণ পাখি নয়। সে জেনেটিকভাবে মডিফাইড করা একটি পাখি। যে বা যারা ওকে তৈরি করেছে তাদের নিশ্চয়ই কোনো বড়ো উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা আছে। সে কারণেই পঙ্খি অন্য পাখিদের চাইতে এত বেশি আলাদা আর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। সে যেমন একটি সাধারণ পাখির সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করে; তেমন তার রয়েছে মানুষেরই মতো চিন্তা শক্তি আর কাজ করার ক্ষমতা। সে যেমন বিজ্ঞান বোঝে, তেমনই বোঝে রঙের ব্যবহার। এমন একটি পাখিকে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থিত করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। পাশাপশি গবেষণার কাজেও ওকে ব্যবহার করা যাবে। যেহেতু ওর স্বতন্ত্র চিন্তাশক্তি রয়েছে।

এসব ব্যাপারে মাকাতো লোকটিকে বাবা এখনও কিছু জানায়নি। বাবার দৃঢ় বিশ্বাস পঙ্খিকে যারা তৈরি করেছিল, তারা এখন ওকে পাগলের মতো খুঁজছে। কারণ এ ব্যাপারে বাবার কোনো সন্দেহ নেই, যে পঙ্খি সেখান থেকে অনেক দিন আগে পালিয়ে এসেছে।

তিন.

‘আ আ তি তি!’

পঙ্খি আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। আমি বললাম, ‘বেদানা খাবি?’

স্বভাবতই সে কোনো জবাব দিলো না। আমি বেদানা কেটে আনলাম। একটা পিরিচে কতগুলো দানা দিয়ে ফের বললাম, ‘আ আ তি তি!’

পঙ্খি খেতে শুরু করল। আজকে বাড়িতে সবারই কম বেশি মন খারাপ। নানাভাই অসুস্থ, মা তাই গ্রামে গেছেন। আমার কলেজে পরীক্ষা চলে বলে আমি যেতে পারিনি। বাবাও আমার জন্য থেকে গেছেন। আজ আমরা দু’জনে মিরাকিউলাস কুকারেই রান্না করে খেয়েছি। সকালে বাবার কাছে এক অদ্ভুত ভয়েস মেইল আসে। সেই জাপানিজ ভদ্রলোক মাকাতোর মেইল। মেইলের শুরুতেই সে বলেছে,

“আমি অনেক দুঃখিত জনাব। আপনার কাছে ওই অদ্ভুত পাখিটিকে পাঠানো বোধ হয় আমার উচিত হয়নি। এটি একদমই কোনো সাধারণ পাখি নয়, বরং বিপজ্জনক একটি জিনিস। আমি নানা জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে জীবিত পাখি শিকার করে নিজের কাছে এনে রাখি। সেভাবেই এটিকে পাওয়া। কিছুদিন যাবত এটির জন্য আমার কাছে হুমকিস্বরূপ চিঠি আসছে। কে বা কারা এটা করছে তা আমার জানা নেই। তারা কেবল পাখিটিকে ফেরত নিতে চায়। আমি তাদের জানিয়েছি বর্তমানে ওটা আমার কাছে নেই। তারা বলেছে, পাখিটা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, তারা ওকে খুঁজে বের করবে। এবং তাদের জিনিস তারা নিয়েও নিবে। আপনি প্লিজ সাবধানে থাকবেন।

আপনার শুভার্থী

মাকাতো হিরোশি

টোকিও।”

বাবাকে এ নিয়ে যতটা না আতঙ্কিত দেখবো বলে আশা করেছিলাম, ততটা দেখলাম না। বাবার লাইসেন্স করা বন্দুক আছে বলেই হয়তো। তবে পঙ্খির মন বোধ হয় আজকে বড্ড খারাপ। ওই ভয়েসমেইল আমাদের সাথে পঙ্খিও শুনেছে। বুঝেছেও নিশ্চয়ই। সকাল থেকে সে কেমন বিবর্ণ হয়ে আছে। সারাদিন একরকমভাবে কেটে গেলেও রাতে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। বাবা পঙ্খিকে লোহার খাঁচায় পুরে রাখছেন। সেই সাথে পুরো খাঁচাটাকে Evanish spray দিয়ে অদৃশ্য করে দিলেন! আসার পর থেকে পঙ্খিকে খাঁচায় রাখার প্রয়োজন পড়েনি একদিনের জন্যও। আজ তবে কি হলো? তাও আবার অদৃশ্য করে! বাবা কি কোনো বিপদের আশঙ্কা করছেন?

পরীক্ষার আগের রাতে আমার রাত জেগে পড়ার অভ্যাস আছে। সারা বছর ফাঁকি দিলে তো এমন হবেই। কাল আমার ইকোনোমিক্স পরীক্ষা। কিন্তু হতচ্ছাড়া সূত্রগুলো কোনোভাবেই মনে থাকছে না। আচ্ছা, বাবা তো এমন একটা কিছু আবিষ্কার করতেই পারেন আমার জন্য, যাতে না পড়েও পরীক্ষায় ভালো করা যায়! বলে দেখব বাবাকে। যদিও মনে হয় না উনি এমন কিছু করবেন। 

মাঝরাতে আমার তেষ্টা পেয়ে গেল। পানির বোতলটা হাতে নিয়ে দেখি ওটা একদম খালি। আড়মোড়া ভেঙে বোতল নিয়ে ডায়নিং রুমে গেলাম। হঠাৎ আমার ঘাড়ের কাছে গরম কিছু অনুভব করলাম। ওটা কি কারো নিশ্বাস ছিল? আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি কেউ আমার পেছনে আছে। কিন্তু কে? আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। তার আগেই আমার নাকে একটা রুমাল চেপে ধরল কেউ। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ পেলাম। বুঝতে বাকি রইল না এটা কীসের ঘ্রাণ। ক্লোরোফর্মের!

আমার যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমার সারা শরীরে ব্যথা। কতটা সময় কেটেছে বুঝে উঠতে পারলাম না। যে ঘরটায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম, সেটা আমার বাবার ঘর। ঘরের ভেতর আবছা আলো। নিভু নিভু চোখে সামনে তাকাতেই বাবাকে দেখলাম। বাবা হাত উঁচিয়ে সারেন্ডারের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার পাশে প্রায় ছয়ফুট লম্বা কেউ দাঁড়িয়ে আছে। লোকটিকে দেখে আফ্রিকান মনে হলো। বাবার লাইসেন্স করা পিস্তলটা তার হাতে। আমার গলা শুকিয়ে এলো। আজই কি তবে আমরা সবাই মারা পড়ব? মায়ের মুখটা খুব মনে পড়ছে। মাকাতো লোকটি কি তবে এই বিপদের কথাই বলছিল? কিন্তু পঙ্খি! ও কোথায়?

আমি সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে পঙ্খীকে খুঁজে চললাম। পেয়েও গেলাম। ঘরের কোণে এক জায়গায় টিম টিম করে দুটো আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। নীলাভ সবুজ আলো। আমি বুঝলাম ওগুলো পঙ্খির চোখ। স্প্রে দিয়ে খাঁচাসমেত পঙ্খিকে অদৃশ্য করা গেলেও ওর চোখ দুটোকে অদৃশ্য করা যায়নি। তবে পঙ্খি যেহেতু এখনো অদৃশ্য, তার মানে বারো ঘণ্টা এখনও পেরোয়নি।

আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম বাবার অসহায় মুখটা। উনি আমার জন্য বেশি চিন্তা করছেন। যে মহিলাটি আমার মুখে রুমাল ছুঁয়েছিল, সেই আমার হাত দুটো দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে। ওরা এখনও পঙ্খিকে খেয়াল করেনি। তাই ক্রুদ্ধস্বরে বাবাকে ক্রমাগত জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে, ‘কোথায় লুকিয়েছ ওটাকে? আমাদের জিনিস আমাদের কাছে ফেরত দাও। কত কোটি কোটি ডলার ইনভেস্ট করে আমরা এটাকে বানিয়েছি। অবশ্যই বাড়িতে পোষার জন্য নয়।’

বাবা আর আমি ছাড়া ঘরে আরো চারজন মানুষ। তাদের কেউ-ই যে এদেশীয় নয় তা তাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বাবাকে নিশ্চুপ দেখে আমার পাশে দাঁড়ানো মহিলাটি আমার মাথায় বন্দুক ঠেকালো। বাবার উদ্দেশে সে ক্রুর হেসে বললো, ‘যদি তুমি চুপ থাকো, তাহলে আমি মেয়েটিকে গুলি করবো।’

ঘরের আবছা আলোতেও বাবার ভেজা চোখ দুটো আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম।  মহিলাটি বন্দুকের ট্রিগার চাপতেই যাবে এমন সময় একটা বিকট আওয়াজ হলো। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। দেখলাম পঙ্খির চোখ দুটো যেখানে জ্বলছিল, সেখানে আগুনের মতো রক্তাভ লাল দুটি আলোর ফুলকি দেখা যাচ্ছে। এটা কি পঙ্খির চোখ? তবে সেই নীলাভ সবুজ আলো এমন অগ্নি স্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠল কেন?

এর পরের কয়েকটা মুহূর্তের কথা আমি জীবনেও ভুলব না। আমদের চোখের সামনে পঙ্খি তার শরীরে প্রথম স্তরের লোমগুলো ঝরিয়ে ফেলল। ফলে সে আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হতে লাগল। পঙ্খির এই ক্ষমতার কথা আমাদের অজানা ছিল। যখন পঙ্খি দৃশ্যমান হলো তার সমস্ত শরীর কুচকুচে কালো বর্ণ ধারণ করেছে। ওর শরীরটা স্বাভাবিকের তুলনায় আরো কয়েক গুণ বেশি বড়ো দেখাচ্ছে। পালকের ফাঁক ফোকর দিয়ে যেন আগ্নেয়গিরির হল্কা বের হচ্ছে। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো যে আমাদের পঙ্খি ওই লোহার খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে এসেছে! পঙ্খি ঝড়ের গতিতে উড়ে এসে আমার মাথায় বন্দুক ধরা মহিলাটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে মহিলাটির নাক মুখ ছিলে কেটে রক্তাক্ত হয়ে গেল। অন্য তিনজন লোক মহিলাটিকে বাঁচাতে ছুটে এলো। পঙ্খি তাদেরও ক্ষত বিক্ষত করে দিলো ওর শক্ত ঠোঁট আর ধারালো নখর দিয়ে। এ মুহূর্তে আমার পঙ্খিকে দানব ছাড়া আর কিছুই মনে হলো না।

আমি দেখলাম পঙ্খি ওই মহিলাকে ছেড়ে দিয়ে ঘরের বাইরে কোথায় উড়ে গেল। মিনিটখানেক না পেরুতেই সে আবার ফিরে এলো। তার মুখে বাবার তৈরি করা সেই গোলাপি গ্যাসের বোতল। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই পঙ্খি বোতল খুলে সেই গ্যাস ওই চারজন ভিনদেশি মানুষের মুখের ওপর ছড়িয়ে দিলো। বাবা তৎক্ষণাৎ হাত দিয়ে নিজের আর আমার নাক চেপে ধরলেন। গ্যাসের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে লোকগুলো কাশতে শুরু করল। কাশতে কাশতে তাদের একজন অপরজনকে বললো, ‘আমার বিষয়টা ভালো ঠেকছে না প্রফেসর মিল্ডহাম! দ্রুত এখান থেকে সরে পড়া উচিত!’

লোকগুলো পত্রপাঠ বিদায় নিল। কিছুক্ষণ বাদে আমারা বাড়ির বাইরে জিপ গাড়ি ছাড়ার আওয়াজ পেলাম। ঘরের মধ্যে এখন পিনপতন নীরবতা। আমার আর বাবার নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায় কেবল। হঠাৎ পঙ্খিকে আমার দিকে আসতে দেখে আমি অবাক হলাম। তার আকৃতি আর বর্ণ আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবে তার ঠোঁট আর নখে এখনও ওদের রক্ত লেগে রয়েছে। পঙ্খি কিছুক্ষণ থেমে বাবার দিকে তাকিয়ে সুললিত বাংলাভাষায় বললো, ‘ভালো থাকবেন স্যার। বন্যরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’

বাবা কোনো জবাব দিলো না। পঙ্খি আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি খুব ভালো একটি মেয়ে তুলতুল।  তোমার মতো বন্ধুকে আমি অনেক বেশি মিস করবো।’

পঙ্খির মুখে প্রথমবার আমার নাম শুনে, অথবা এই ধকল সইতে না পেরে; যে কারণেই হোক, আমি ফের সংজ্ঞা হারালাম।

পঙ্খি নেই আজ মাস খানেক পেরিয়েছে। ঐ রাতের পর আর কোনোদিন পঙ্খি আমাদের সামনে আসেনি। পরদিন সকালে আমি নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় পেয়েছিলাম। আমার শরীরে তখন তীব্র জ্বর। বাবাকে জিজ্ঞেস করতেই বাবা বলছিলেন, আমি জ্ঞান হারানোর পরেই পঙ্খি না কি কোথায় উড়ে চলে গেছে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল। খুব কষ্ট জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আচ্ছা বাবা! ওটা কি গ্যাস ছিল? ঐ যে গোলাপি রঙের?’

‘ওটা Oblivion gass’

‘ওটার কাজ কি?’

‘মানুষের মস্তিষ্কে ভালো খারাপ দু’ধরনেরই চিন্তা বা পরিকল্পনা থাকে। এই গ্যাস প্রশ্বাসের সাথে শরীরে প্রবেশ করার মিনিট দশেকের মধ্যে মানুষ জ্ঞান হারায়। যখন জ্ঞান ফিরে তখন তার মস্তিষ্কে আর কোনো খারাপ চিন্তা থাকে না। মস্তিষ্কের যেই নিউরন সেলগুলোতে খারাপ চিন্তার স্মৃতিশক্তি থাকে, এই গ্যাস স্পেসিফিকভাবে সেই সেলগুলোকেই নষ্ট করে দেয়। ফলে খারাপ পরিকল্পনা বা চিন্তাগুলোর কথা মানুষের আর মনেই থাকে না। পঙ্খি একটা দারুণ কাজ করেছে জানিস! ওদের জন্য এর চেয়ে বড়ো শাস্তি আর কিছুই হতে পারত না।’

আমি বলেছিলাম, ‘ওরাও কি তবে সব ভুলে যাবে বাবা?’

বাবা আমার প্রশ্নের কি উত্তর দিয়েছিলেন, কে জানে! ঠিক মনে নেই আমার। কারণ কথা বলতে বলতেই আমি ফের ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

আমি কলেজের জন্য তৈরি হচ্ছি আর মা নাশতা বানাচ্ছে। বাবা মাকে সেবার কি বলে বুঝ দিয়েছিল কে জানে! তবে পুরো সত্যি ঘটনাটা মায়ের অজানা। আমি ব্যাগে বই গোছাচ্ছি, এমন সময় বাবার গলা শুনলাম।

‘তুলতুল! এই তুলতুল! শিগগিরি আয়! দেখে যা কি সাংঘাতিক কাণ্ড!’

আমি হন্তদন্ত হয়ে বাবার ল্যাব রুমে ছুটে এলাম। বিস্ময় আর উত্তেজনায় বাবা হাপাচ্ছেন। একটা নোটবুক আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বাবা বললেন,‘দেখ, এই ইকুয়েশনটা আমি সপ্তাহ খানেক ধরে সলভ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুতেই হচ্ছিল না। আজ সকালে দেখি কি সেই ইকুয়েশন সলভড! কিন্তু দেখ, ওখানে শেষ তিন লাইন! ওটা তো আমার হাতের লেখা না! ওটা কে লিখলো তবে?’

আমি টের পেলাম আমার হৃদস্পন্দন বাড়ছে। আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ মেঝেতে পড়ে থাকা একটা জিনিস দেখে আমার চোখ আটকে গেল। আমি আস্তে করে ওটা তুললাম। বাবা আমার হাতে ওটা দেখেই চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। আর আমি? আমার হাতে থাকা ওই পালকটা নিষ্পলক দেখে গেলাম কেবল। নরম, তুলতুলে পালকটা থেকে আমার খুব পরিচিত একটা ঘ্রাণ পেলাম। হালকা গোলাপি আর হলুদের মিশেলে অদ্ভুত সুন্দর একটা মিষ্টি রং ওই পালকটার। পঙ্খি! আমার মনে হতে লাগলো পঙ্খি এই ঘরেই আছে, আমাদের খুব কাছে। আমি আ আ তি তি বলার সাথে সাথেই আমাদের চমকে দিয়ে সে হাজির হয়ে যাবে। কেননা আর যাই হোক, এই আ আ তি তি ডাকটা সে কোনোদিন অগ্রাহ্য করেনি। আমি আপন মনেই বলে উঠলাম, ‘আ আ তি তি!’

কিশোরকণ্ঠ সায়েন্স ফিকশন লেখা প্রতিযোগিতা ২০২৩-এর প্রথম স্থান অধিকারী সায়েন্স ফিকশন

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ