অহঙ্কারের পরিণতি অনুবাদ :   -আসিফ হাসান

অহঙ্কারের পরিণতি অনুবাদ : -আসিফ হাসান

অনুবাদ গল্প আগস্ট ২০১৫

অনেক অনেক দিন আগের কথা। তখনো হল্যান্ডের সাথে ফ্রিজল্যান্ড যুক্ত হয়নি। সেই সময়ে ফ্রিজল্যান্ডের বৃহত্তম আর সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহর ছিল স্টাভোরেন। শহরটি বিশাল বিশাল প্রাসাদে ভরা ছিল। বড় বড় ধনী ব্যবসায়ী বাস করতেন সেসব প্রাসাদে। অগাধ সম্পদের অধিকারী হওয়ায় তারা ছিলেন বেশ অহঙ্কারী। দুনিয়ায় কাউকেই তারা পরোয়া করতেন না। মনে করতেন সবকিছুই তাদের হাতের মুঠোয়। এমনকি অলসভাবে বসে থাকলেও তাদের সম্পদ কোনোদিন কমবে না বলে তারা বিশ্বাস করতেন।
শহরটির ঐশ্বর্যের কারণ ছিল সেখানকার অত্যন্ত সুন্দর একটি বন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে অনেক জাহাজ ভিড় করতো। সারা দুনিয়ায় বাণিজ্য করে এখানেই থামতো জাহাজগুলো। ক্রমে ক্রমে ধনী জাহাজমালিকরা এই শহরেই বসবাস করা শুরু করলেন। এভাবেই ক্রমাগত ঐশ্বর্যশালী হয়ে উঠতে লাগলো শহরটি। আর সেইসাথে এই শহরের ব্যবসায়ীরাও আরো ধনী হতে লাগলেন। তারা যতই ধনী হলেন, তাদের প্রাসাদও তত ঝলমলে হয়ে উঠতে লাগলো। দুনিয়ার সেরা আসবাবপত্র তারা সংগ্রহ করলেন। এমনকি বাথরুমেও সোনার ফিটিংস ব্যবহার করতে লাগলেন। আশপাশ শহরগুলোর দিকে তাকিয়ে তারা অহঙ্কারে বলতেন, কত গরিব সেগুলো। তারা শুধু ধন-সম্পদ নিয়েই ভাবতেন। আর কিছু যে থাকতে পারে, সেই ভাবনাই তাদের ছিল না। তাদের সারা জীবনের একমাত্র সাধনা ছিল কিভাবে আরো সম্পদ বানানো যায়।
শহরটির ধনীদের সবাই ছিলেন দাম্ভিক। এদের মধ্যে সবচেয়ে দাম্ভিক ছিলেন এক ধনী বিধবা। তার স্বামীও অনেক জাহাজের মালিক ছিলেন। মারা যাওয়ার আগে তিনি এতো সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন যে তার কোনো হিসাব ছিল না। স্বামী মারা যাওয়ার পর মহিলাটি আরো অহঙ্কারী হয়ে উঠলেন। বিলাস-ব্যসনে মত্ত হয়ে গেলেন। সবসময় রতœখচিত পোশাক পরতেন। রাস্তায় তিনি যখন বের হতেন, তখন তার পোশাকের ঝলকে সবার চোখ ঝলসে যেত। রাস্তায় সবাই তাকে সালাম দিত। কিন্তু তিনি সালাম না নিয়ে ঘার সোজা করে চলে যেতেন। সবাই তাকে বেশ ভয় পেত।
একদিন এই ধনী বিধবার একটি জাহাজ বহু মূল্যবান মালপত্র নিয়ে বিদেশে যাবে বাণিজ্যে। মালপত্র বোঝাই হয়ে গেছে। এমন সময় বিধবার মনে একটি ভাবনা এলো। তিনি ভাবলেন, ‘আমার সম্পদের তুলনায় অন্যদের যে কিছুই নেই, তা প্রমাণ করে দিতে হবে। আর তা করতে পারলে আমাকে অন্য ধনীরাও আরো বেশি সমীহ করবে। সবাই আমার প্রশংসা করবে।’
তিনি তখনই জাহাজের ক্যাপ্টেনকে ডাকলেন। বললেন, ‘আমার হুকুম, তুমি জাহাজ ভরে মালামাল নিয়ে রওনা হও। আর এই মালামাল বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে তা দিয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান, সবচেয়ে সুন্দর জিনিস কিনে আনবে। দামের জন্য কোনো পরোয়া করবে না। প্রয়োজনে একটা জাহাজ ভরে শুধু সোনার মোহর নিয়ে যাও।’
ক্যাপ্টেন বিনয়ের সাথে বললো, ‘আপনার হুকুম তামিল করবো। দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর আর দামি জিনিসটাই আমি আপনার জন্য কিনে আনবো।’
জাহাজ রওনা হলো। একদিন তার সব মালামাল বিক্রি করলো। তারপর এক শহর থেকে আরেক শহর ঘুরতে লাগলো তার মালিকের সেই দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর আর দামি জিনিসটি কিনতে। নানা শহরে যে হীরার আংটি, মতির মালা, সোনার হার, হাতির দাঁতের অলঙ্কার, মূল্যবান পোশাক, অবাক করা খেলনা অনেক কিছুই দেখলো। কিন্তু কোনো কিছুই তার পছন্দ হলো না। আসলে সে ছিল সাদাসিধে ধরনের লোক। এসব জমকালো জিনিস তার মন ভরাতে পারলো না। সত্যি কথা বলতে কী, স্টাভোরেন শহরে সে বসবাস করলেও সে আসলে সেখানকার লোক ছিল না। সে জন্মেছিল অনেক দূরের এক গাঁয়ে। সে বেড়ে উঠেছিল সবুজ মাঠে বেড়িয়ে বেড়িয়ে। তার কাছে হাতির দাঁত, সোনার অলঙ্কারের খুব একটা মূল্য ছিল না। তার কাছে এগুলো ছিল নিছকই লোক দেখানো খেলনা। কিন্তু তার মালিক দুনিয়ার সবচেয়ে দামি আর সুন্দর জিনিস আনার নির্দেশ দিয়েছেন। কী করা যায়? কোথায়ও মনের মতো জিনিস সে খুঁজে পেল না। তাই দুশ্চিন্তায় ঘুম আসছিল না। একদিন ভাবতে ভাবতে একটি শহরের মধ্য দিয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ একটা জিনিস দেখে সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। একটা গুদামে সোনালি রঙের গম। ঝমমক করছে।
সে ভাবল, এর চেয়ে দামি ও সুন্দর জিনিস আর কী হতে পারে? গম থেকে আটা হয়। সেই আটা থেকে হয় রুটি। সেই রুটি খেয়েই মানুষ বাঁচে। হাতির দাঁত, সোনা, হীরা যদি কোনোদিন দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়, তবুও দুনিয়ার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। কিন্তু গম যদি হারিয়ে যায়, একটি মানুষও বাঁচবে না। এই চিন্তা করতে করতেই তার ম্লান মুখ হাসিতে ভরে উঠলো।
সে ভাবল, ‘হায়, আমার এই বুদ্ধি এতদিন কোথায় ছিল? আমার গাঁয়ের ছোট্ট ছেলেটাও জানে দুনিয়ার সবচেয়ে দামি আর সুন্দর জিনিস কী। আর আমি তা নিয়ে এতো ভাবছি! আমি এখন পেয়েছি, আমার মালিক যা চান। আমি তার জন্য জাহাজ বোঝাই করে এই গম নিয়ে যাবো।’
গম দিয়ে জাহাজ বোঝাই করে সে চললো তার শহরের দিকে। এদিকে তার মালিক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তার জন্য। তিনি বলে বেড়াচ্ছেন তার জাহাজে করে দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর আর দামি জিনিস আসছে। সবার কাছে এবার পরিষ্কার হয়ে যাবে তার সম্পদের পরিমাণ কত! অন্যরাও তার কথা শুনে শুনে বিষয়টা কোথায় গড়ায় তা জানার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
অবশেষে একদিন জাহাজটি বন্দরে ভিড়লো। শহরের ধনীরা তো গেলই, এমনকি ছেলে-বুড়ো, গরিবরাও ভিড় করলো বন্দরে। সেই বিধবা মহামূল্যবান পোশাক পরে বেশ দাম্ভিকভাবে উপস্থিত হলেন বন্দরে। জাহাজ থেকে ক্যাপ্টেন নামামাত্র বিধবা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার জন্য কী এনেছ তুমি? আসল জিনিস আনতে পেরেছ তো?’
ক্যাপ্টেন গর্বের সাথে জবাব দিল, ‘এই দুনিয়ার সবচেয়ে দামি আর সুন্দর জিনিস এনেছি আপনার জন্য।
‘তাই! তা শুনি জিনিসটা কী? নাম কী তার?’
‘গম! এক জাহাজ ভর্তি গম।’
‘কী? গম! তুমি আমার জন্য গম এনেছ?’
বলতে বলতে বিধবার গলা কেঁপে উঠলো। কথাই বেরুচ্ছিল না তার মুখ থেকে। বুক চিড়ে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো। মনে হলো তার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।
অন্যরাও কথাগুলো শুনে ফেলেছে। তারাও বিধবার গর্ব চূর্ণ হওয়াতে খুশি হয়ে নানা বিদ্রুপ করতে লাগলো। এতে বিধবা আরো রেগে গেলেন।
অনেক কষ্টে রাগ চেপে তিনি ক্যাপ্টেনকে বললেন, ‘তুমি তোমার এই দামি জিনিস ওই সমুদ্রে ডুবিয়ে দাও। আমি যেন তা আর চোখে দেখি না।’
ক্যাপ্টেন তার এই হুকুম যেন বুঝতে পারলো না। সে বেশ অবাক আর দুঃখের সাথে বললো, তা কী করে হয়? খাদ্য জিনিস ফেলে দেয়া অন্যায়। আপনার যদি এই গম পছন্দ না হয়, তবে গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিতে পারেন। অনেক গরিব এই গম খেয়ে বাঁচতে পারবে। এই গম এভাবে ফেলে দিলে গজব আসতে পারে।’
এ কথা শুনে বিধবা আরো রেগে গেলেন। তিনি রেগে আগুন হয়ে আঙুল থেকে একটি দামি আংটি খুলে সমুদ্রে ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘এমনি করে সব গম ফেলে দাও। আমি কোনো গজবকে ভয় পাই না।’
উপস্থিত লোকদেরও কেউ বিধবার কথার প্রতিবাদ করলো না। সবাই পরম অবজ্ঞার সাথে গমের দিকে তাকালো। গম তাদের কাছেও কোনো দামি জিনিস মনে হলো না। ক্যাপ্টেন আর কী করবে। সে তো চাকরি করে। বিষণ্ন ভাবে সে হুকুম পালন করলো। সব বস্তা পানিতে ফেলে সে প্রতিজ্ঞা করলো এমন মালিকের অধীনে সে আর চাকরি করবে না। সে এমন মালিক খুঁজে নেবে, যে সত্যিকারের দামি জিনিস চেনে।
দাম্ভিক মহিলা বিষণœভাবে বাড়ি ফিরে গেলেন। তারপর বাড়ি থেকে বেরুনোই তার জন্য কঠিন হয়ে গেল। রাস্তায় বেরুলেই দুষ্টলোকেরা তাকে বিদ্রুপ করতো। এমনকি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেও কেউ কেউ তাকে বিদ্রুপ করতো।
দিন পাঁচেক পরের কথা। বিধবা হুকুম দিলেন, ‘আজ দুপুরে মাংস খাবো না, মাছ চাই।’ চাকর একটু পরে দৌড়ে এসে বললো, ‘হুজুর, যে মাছটা কিনে আনা হয়েছে, তার পেটে এই আংটিটা পাওয়া গেছে।’ দেখে বিধবার মুখ কালো হয়ে গেল। তিনি চিনতে পারলেন, এটা তারই আংটি। তিনি আংটিটা সমুদ্রে ফেলে দেয়ার সময় গর্বভরে বলেছিলেন, ‘গম সমুদ্রে ফেলে দাও। এই আংটি যেমন আমার কাছে ফিরে আসবে না, তেমনি ফেলে দেয়ার জন্য কোনো বিপদও আমার ওপর আসবে না।’ আজ আংটি ফিরে এলো। তবে কি সেই বিপদ আমার ওপর হানা দেবে?
কয়েক মিনিট পরই খবর এলো, ঝড়ে তার একটা জাহাজ ডুবে গেছে। এরপর কয়েকদিন পরপর এ ধরনের আরো খারাপ খবর আসতে লাগলো।
পরের বসন্তকালে দেখা গেল, বন্দরের বাইরের মুখে সবুজ পাতায় ছেয়ে গেছে। সকলে খোঁজ নিয়ে দেখলো, পানিতে ফেলে দেয়া সেই গম থেকে চারা গজিয়ে এই কান্ড ঘটেছে। ঘন গাছ-পাতার সঙ্গে বালু জমে জমে তিন মাসের মধ্যে বন্দরের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। স্টাভোরেন বন্দরে জাহাজ ভেড়ার পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।
শহরটির ঐশ্বর্যের মূলে ছিল এই বন্দর। বন্দরটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় জাহাজমালিকদের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেল। তাদের জাহাজগুলো আর বাণিজ্যে যেতে পারে না। এতদিন তারা মনে করেছিল তাদের সম্পদ কোনোদিন ফুরাবে না। কিন্তু আসলে দেখা গেল, ধন বেশিদিন থাকে না। খুব দ্রুত তাদের হীরা-জহরত, সোনা-দানা, দালান-কোঠা যেন জাদুমন্ত্রে উবে গেল।
শহরটি ছোট থেকে আরো ছোট হতে লাগলো। একদিন যে শহরের প্রাসাদের চূড়াগুলো দূর-দূরান্ত থেকে দেখা যেত, সেটা এখন ছোট্ট একটা পাড়াগাঁয়ে পরিণত হলো। সেখানে কুঁড়েঘর বানিয়ে কিছু অসহায় গরিব বাস করতে লাগলো। আশপাশের লোকেরা এখনো সেই গর্বিতা বিধবার কাহিনী তাদের সন্তানদের শুনিয়ে বলে-
‘ওই তার অহঙ্কারের ফল
বন্দরের মুখে বালির চর।’
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ