অবহেলিত সরফরাজ খান

অবহেলিত সরফরাজ খান

খেলার চমক আবু আবদুল্লাহ সেপ্টেম্বর ২০২৩

যদি বলা হয় মাত্র ১২ বছর বয়সের একটি ছেলে ক্রিকেটে ৪৩৯ রানের ইনিংস খেলেছে- অনেকেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে; কিন্তু সেই অবিশ্বাস্য গল্পটা লেখা হয়েছিল ২০০৯ সালে ভারতের হ্যারিস শিল্ড স্কুল ক্রিকেটে। গল্পের নায়কের নাম সরফরাজ খান। সেদিনের সেই খুদে বালক এখন পরিণত যুবক। বয়সে যেমন পরিণত, তেমনি ব্যাট হাতেও। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের পর রান করে যাচ্ছেন। তবু অবহেলার শিকার হতে হচ্ছে তাকে। অজানা কারণে সরফরাজের জন্য এখনো খোলেনি জাতীয় দলের দরজা। দারুণ প্রতিভাবান এই ক্রিকেটারের গল্পই জানাবো এবার।

১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ে জন্ম সরফরাজ খানের। ছোটোবেলা থেকেই ক্রিকেটের নেশা পেয়ে বসে তার। তার বাবা নওশাদ খান স্থানীয় পর্যায়ের একজন ক্রিকেট কোচ। বাবার কাছেই মহল্লার মাঠে ক্রিকেটে হাতেখড়ি সরফরাজের। ছোটোবেলা থেকে পিটিয়ে খেলতে ভালোবাসতেন। শৈশবে তার দারুণ টাইমিং করার গুণটি চোখে পড়ে বাবার। যে কারণে ছেলের ব্যাটিংয়ের প্রতি যত্ন নিতে শুরু করেন তিনি।

প্র্যাকটিসে সরফরাজকে আউট করতে ঘাম ঝরতো বোলারদের। মাঝে মাঝে তাকে আউটের বিনিময়ে বোলারদের জন্য ৫০ রুপি পুরস্কার ঘোষণা করতেন নওশাদ খান। ছেলের ধৈর্য ও জিদ বাড়াতে এই কৌশল নিতেন তিনি।

প্রতিভার গুণে মাত্র ১২ বছর বয়সেই স্কুল ক্রিকেটে সুযোগ পান। তার স্কুলের নাম ছিল রিজভি স্প্রিংফিল্ড স্কুল। ২০০৯ মৌসুমে মুম্বাইয়ের হ্যারিস শিল্ড স্কুল টুর্নামেন্টে নিজ দলের হয়ে খেলতে নেমে ইতিহাস গড়েন সরফরাজ। তিন দিনের ম্যাচে খেলেন ৪৩৯ রানের ইনিংস। সারা বিশ্বেই স্কুল ক্রিকেটে এটি ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংস। ৪২১ বলের ইনিংসে ছিল ৫৬টি চার ও ১২টি ছয়। এই হ্যারিস শিল্ড টুর্নামেন্ট থেকেই উত্থান হয়েছিল ভারতীয় ব্যাটিং জিনিয়াস শচীন টেন্ডুলকারের। শচীনও মুম্বাইয়ের সন্তান। সেদিন শচীনের রেকর্ডই ভেঙেছিলেন সরফরাজ। ১৯৮৮ সালে এই টুর্নামেন্টে শচীন টেন্ডুলকার খেলেছিলেন অপরাজিত ৩২৬ রানের ইনিংস।

শচীনের রেকর্ড ভেঙে ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করা সরফরাজ দ্রুতই লাইমলাইটে আসেন তার এই ইনিংস দিয়ে। সারা দেশে হইচই পড়ে যায় তাকে নিয়ে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়ে খবরটি। এরপর মুম্বাইয়ের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ডাক পান এই কিশোর। ২০১২ সালে মুম্বাই অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে দারুণ খেলার পরের বছরই ভারতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দলের দরজা খুলে যায় তার জন্য। সরফরাজের বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর। ওই বছর দক্ষিণ আফ্রিকা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিপক্ষে ৬৬ বলে ১০১ রানের ইনিংস খেলার পর দলে জায়গা পাকা হয়ে যায়।

ফলস্বরূপ ২০১৪ ও ২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ^কাপে তিনি ছিলেন ভারতীয় টপঅর্ডারের অটো চয়েস। ২০১৪ আসরে ৬ ম্যাচে ৭০.৩৩ গড়ে ২১১ রান করেন। যা দেখে ৫০ লাখ রুপিতে তাকে দলে ভেড়ায় রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু। ২০১৫ সালে ১৭ বছর ১৭৭ দিন বয়সে আইপিএল খেলে ইতিহাস গড়েন সরফরাজ। ২০১৬ মৌসুমে আরসিবি যে তিনজন খেলোয়াড়কে ধরে রেখেছিলেন তাদের মধ্যে একজন সরফরাজ। বাকি দু’জন ছিলেন বিরাট কোহলি ও এবিডি ভিলিয়ার্স। এই দু’জনের পাশে সরফরাজের নাম দেখে অবাক না হয়ে উপায় আছে! একই বছর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ^কাপে আবার জাদু দেখান এই তরুণ। ৬ ইনিংসে ৩৯৫ রান করেন ৭১ গড়ে। দুই বিশ^কাপ মিলে সর্বোচ্চ ৭টি হাফ সেঞ্চুরি করেন, যেটি অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের বিশ^রেকর্ড।

এর আগেই অবশ্য প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় সরফরাজের। ২০১৪ সালেই তিনি মুম্বাইয়ের হয়ে খেলতে নামেন রঞ্জি ট্রফিতে। এই টুর্নামেন্ট ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের আসর (৪ দিনের ম্যাচ)। এক মৌসুম মুম্বাইয়ের হয়ে খেলার পর যোগ দেন উত্তর প্রদেশ দলে। তবে এক বছর পর আবার ফিরে আসেন মুম্বাই দলে। ২০১৯-২০ মৌসুমে প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরির দেখা পান সরফরাজ।

২২ বছর বয়সের আগেই একটা ছেলে এতকিছু করে ফেলায় ভারতীয় মিডিয়া এবং ক্রিকেটাঙ্গনে সবাই সরফরাজকে জাতীয় দলের আগামী দিনের তারকা হিসেবে ধরে নেন; কিন্তু তবুও তার ওপর নজর পড়েনি ভারতীয় নির্বাচকদের। চলতি বছর জুলাই মাস পর্যন্ত সরফরাজের পরিসংখ্যান হচ্ছে- ৩৯ প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৩ হাজার ৫৫৯ রান। গড় ৭৪, সেঞ্চুরি ১৩টি। আইপিএল খেলেছেন বেঙ্গালুরু, কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব ও দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে।

২০২১-২২ রঞ্জি ট্রফিতে ৯ ইনিংসে করেছেন টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ ৯৮২ রান। গড় ছিল ১২৩, সেঞ্চুরি ৪টি। তার আগের মৌসুমে ৯ ইনিংসে করেছিলেন ৯২৮ রান। গড় ৭৯, সেঞ্চুরি ৩টি। সর্বশেষ ২০২২-২৩ মৌসুমে ৯ ইনিংসে ৩ সেঞ্চুরিতে করেছেন ৫৫৬ রান।

এতকিছুর পরও সরফরাজ ভারতীয় ক্রিকেটে অবহেলার শিকার। নির্বাচকরা বারবার বঞ্চিত করেছেন। তাকে ভারতের জাতীয় দলে না দেখে অনেকেই হতাশ হয়েছেন। সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের দলে সরফরাজকে না দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে সাবেক অধিনায়ক সুনীল গাভাস্কার বলেছেন, বন্ধ করে দাও রঞ্জি ট্রফি, বলে দাও এই টুর্নামেন্টের কোনো দরকার নেই। আরো অনেক ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ সরফরাজকে ভারতীয় দলে না দেখে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাদের বক্তব্য, ঘরোয়া ক্রিকেট রানের পর রান করেও যদি কেউ জাতীয় দলে সুযোগ না পায়, তাহলে সে কেন ক্রিকেট খেলবে?

একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সরফরাজ বলেছেন, ২০২১-২২ রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে শতরান করার পর জাতীয় দলের একজন নির্বাচক তাকে বলেছিলেন বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজের জন্য প্রস্তুত হতে; কিন্তু পরে তাকে আর ডাকা হয়নি। 

এভাবেই প্রতিভাবান এই ক্রিকেটার অবহেলার শিকার হচ্ছেন। এ বছরের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের দলে তাকে না নেওয়ার অজুহাত হিসেবে ফিটনেস সমস্যার কথা বলেছেন নির্বাচকরা। শৈশব থেকেই একটু ভারী স্বাস্থ্যের অধিকারী সরফরাজ। তবে এই স্বাস্থ্য তার পারফরম্যান্সে প্রভাব যে ফেলেনি সেটা তো দেখাই যাচ্ছে। তবুও অনেকে মনে করেন, ‘মোটা’ হওয়ার অজুহাতেই তাকে দলে নেওয়া হচ্ছে না। সরফরাজের শৃঙ্খলায় ঘাটতি আছে বলেও দাবি করেছেন নির্বাচকরা।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারী স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক মহাতারকার আবির্ভাব হয়েছে। শ্রীলঙ্কার অর্জুনা রানাতুঙ্গা, পাকিস্তানের ইনজামাম উল হক দাপটের সাথে বিচরণ করেছেন ক্রিকেটে। তবুও ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের পর রান করে অবহেলিত থেকে যাচ্ছেন সরফরাজ। তার সাথে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলা শ্রেয়াস আইয়ার, সঞ্জু স্যামসন, দিপক হুদা, কুলদীপ যাদবরা ভারতের হয়ে খেললেও সরফরাজের কপাল কবে খুলবে কেউ জানে না।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ