অপুর অভিমান

অপুর অভিমান

গল্প আগস্ট ২০১৩

জাফর তালুকদার মার কাণ্ড দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গেল অপু। সাপ খেলা দেখার মতো গোল হয়ে সবাই ঘিরে আছে মার চারপাশ। মা টিনের ভাঙা স্যুটকেশটা খাটের তলা থেকে টেনে এনে উপুড় করে ধরলেন মেঝেতে। মুহূর্তে দুর্গন্ধে চুর হয়ে গেল জায়গাটা। সবাই দাঁত বের করে হাসছে। কেউ আবার মজার চোখ করে ফিরে তাকাল অপুর দিকে। লজ্জায় কান কাটা গেল বুঝি। সবার সামনে থেকে দ্রুত পালাতে পারলে বেঁচে যায় সে। আসলে অতো কিছু ভেবে কাজটা করেনি অপু। এবার মেলায় মা তাকে যে বিশটা টাকা দিয়েছিলেন তা দিয়ে কিনে আনল কয়েকটা বনরুটি। একটা হাতকাটা ছেলে ডেকে ডেকে বিক্রি করছিল রুটিগুলো। কিন্তু কেউ পাত্তা দিচ্ছে না দেখে তার কেমন মায়া হয়।  অবশ্য দোকানের চিন্তাটা মাথায় আসে রুটি কিনে বাড়ি ফেরার পর। খাটের তলায় একটা ভাঙা স্যুটকেশ পড়ে ছিল দীর্ঘদিন। সেটা ঝেড়েমুছে রুটিগুলো সাজিয়ে রাখল তাতে। তারপর ডালার মুখ বন্ধ করে সেই যে লুকিয়ে রাখল আর খোলার নাম নেই। এতদিন পর পচা গন্ধটা খুঁজতে গিয়ে মা এটা বের করেছেন খাটের তলা থেকে। ভেতরে ফেঁপে-ওঠা রুটিগুলো পচে সবুজ রঙ ধরে গেছে। মা চোখ পাকিয়ে ডাকলেন, ‘অপু।’ ‘জী, মা।’ ‘তুমি এভাবে রুটি রেখেছ কেন?’ ‘দোকান দেয়ার জন্য।’ ‘দোকান, তুমি রুটির  দোকানদার হবে!’ মায়ের ঠোঁট বিদ্রƒপে বেঁকে গেল। ‘হ্যাঁ, হব।’ অপু যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। ‘যাবে না, দাঁড়াও!’ বাবার গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল দরজার আড়াল থেকে। অপুর মুখ চুন হয়ে গেল। বাবা মেজাজি মানুষ। তিনি হঠাৎ এসে পড়েছেন দেখে সবাই চলে গেল সুড় সুড় করে। মা স্যুটকেশটা এককোণে সরিয়ে রাখলেন বিরস মুখে। বাবার সামনে থেকে রুটিগুলো আড়াল করাই তার উদ্দেশ্য। ‘এই শোনো, ওগুলো নিয়ে এক্ষুনি ওকে হাটে পাঠিয়ে দাও দোকনদারি করতে।’ বাবার গলায় মিলিটারি নির্দেশ। মা অপুর হাত ধরে পথ আগলে দাঁড়ালেন, ‘ছেলেমানুষ, না বুঝে একটা কাজ করেছে। এ নিয়ে অতো রাগারাগির কী আছে?’ ‘সে তুমি বুঝবে না। ও খুব বাউণ্ডেলে হয়েছে আজকাল...।’ ‘আচ্ছা, বেশ হয়েছে। এখন তুমি যাও তো।  চা দিয়েছি। মতি চাচু বসে আছেন।’ বাবা গজ্ গজ্ করে চলে যেতেই অপু হাওয়া হয়ে গেল। মা পেছন থেকে কি যেন বললেন কানে গেল না অপুর। বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ। তবে বাগানটা শীতল। এই দিনদুপুরেও কেমন নির্জন আর ছায়া ছায়া। কাঁচামিঠে আমগাছটার নিচে এসে একটু বসল। এবার অজস্র আম ধরেছে গাছটায়। প্রতিবার এই আম নিয়ে পাখিদের মধ্যে মাতামাতি পড়ে যায়। চমৎকার চোখকাড়া রঙ দেখে উড়ে আসে রাজ্যের পাখি। পাকার আগেই ঠুকরে ঠুকরে সব নষ্ট করে দেয় ওরা। তার মতো বোকা-পাখিগুলোরও তর সয় না কিছুতেই। অপুর বুক চিরে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস বেরুল। বহুক্ষণ হলো পেট চোঁ চোঁ শুরু করেছে। হাতের কাছে কিছু নেই যে মুখে পুরবে। এই বাগানটা নানারকম গাছগাছালিতে ঠাসা। বুনো লতাপাতার ঝোপও এন্তার। সে খুঁজে পেয়ে কিছু পাকা ডুমুর, বেতফল আর আমলকী খেয়েছে বটে, কিন্তু খিদেটা ক্ষান্ত হয়নি তাতে। যতই কষ্ট হোক, সে কিছুতেই ঘরে ফিরে যাবে না। সে তো বাউণ্ডেলে...। বাগানটা ভারি নিঝুম। একটা তক্ষক পাখি ডাকছিল ধরা গলায়। রাতের বেলা কি একটা পাখি ডাকে কুপ্কুপ্ করে। এখন সেটা ঘুমিয়ে গেছে বোধ হয়। ও পাশে রাজকড়াই গাছের ডালে দুটো ঘুঘু মনের আনন্দে ডাকাডাকি করল কিছু সময়, তারপর কি যেন কথাটথা  বলে ফুড়–ত ফুড়–ত উড়ল এ ডাল থেকে ও ডালে, হঠাৎ কি মনে হল পিছুটান দিয়ে সোজা  উড়ে গেল বিলের দিকটায়। বাগানের এপাশে, যেখানে ঝোপঝাড় একটু গাঢ়, লতাপাতার আড়ালটিও   বেশ, সেখানে ছোট্ট মতো একটা খন্দ যে লুকিয়ে আছে তা আগে দেখেনি কখনও। একটু নিচু হয়ে সেখানে ঢুকে পড়ল অপু, তারপর কিছু না ভেবেই সেই ঘেরাটোপের নরম ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল টান টান হয়ে। ক্ষুধা, ক্লান্তি আর বিপুল অভিমানে একটু পরই গভীর ঘুমে হারিয়ে গেল অপু। মৃদু বাতাসে চিরল পাতারা আলতো প্রলেপ বুলিয়ে দিচ্ছে তার গায়ে। ঘুমের রাজ্যে ডুব দিয়ে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখল অপু। সেই ছেলেবেলার মতো বাবা তাকে কাঁধে বসিয়ে নিয়ে গেছেন রূপসাগরের মেলায়। লালসালু আর সামিয়ানাঘেরা  দোকানপাট, লোকজনের আনাগোনা, বানর আর পুতুলনাচের ডুগডুগি, গান, বায়োস্কোপ, মিঠে মাঠাইয়ের গন্ধ, পানের সুরভি, নাগরদোলার ক্যাঁচরম্যাঁচর, বাঁশির প্যাঁপোঁÑ সবমিলিয়ে অফুরান আনন্দে জমে গেল মেলার জায়গাটা। মেলা ঘুরে ঘুরে ঝুমঝুমি, বেলুন, বাঁশি, তালপাখা, নকশি রূমাল, মাটির ঘোড়া, কাগজের ফুল কত কি কিনে দিলেন বাবা। মুড়ি-মুড়কি, জিলাপি, বাতাসা, তিলের খাজা, বাদাম, কুলফি কিছুই বাদ গেল না। সবশেষে, নাগরদোলায় দোল খেতে খেতে কুলকুলিয়ে হেসে উঠলেন বাবাÑ কিরে অমন শক্ত  হয়ে আছিস কেন, ভয় পেয়েছিস নাকি?’ ‘হ্যাঁ, ভয় পাচ্ছি। পরে যাবো নাতো বাবা?’ ‘আরে না, পড়বি কেন, আমি পাশে আছি না...।’ কথাটা শেষ হয়নি তখনও, হঠাৎ দড়ি ছিঁড়ে নাগরদোলার বাক্সটা ঝপাত করে ছিটকে পড়ল মাটিতে। অপু হঠাৎ ধড়মড়িয়ে উঠে বসল ছোট্ট খন্দটার ভেতর। হালকা অন্ধকারে চোখ কচলে তাকাল এদিক ওদিক। পরম বিস্ময় আর উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাবা হাউমাউ কেঁদে জড়িয়ে ধরলেন তাকে, ‘ওরে তুই এখানে লুকিয়ে আছিস, আর আমরা চারদিকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। কী পাগল ছেলে তুই বলতো!’ অপু কথা বলল না। বিশাল অভিমানে বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল কেবল।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ