অন্তুর মা

অন্তুর মা

গল্প অক্টোবর ২০১৩

তমসুর হোসেন

অন্তুর সৎ মা যখন রান্নাঘরে ভাত রাঁধে তখন সে বাগানে পাখির সাথে কথা বলে। সবুজ রঙের একটি অচেনা পাখি। পাখিটা গাছের ডালে বসে তাঁকে আদর করে ডাকতে থাকে, ‘অন্তু সোনা কোথায়? একটু আসনা সোনা। অন্তু সোনা কোথায়?’ পাখির ডাক শুনে অন্তু বাগানে যায়। বাগানের বকুল গাছের নীচু ডালে শান্ত মনে বসে থাকে পাখিটা। অন্তুকে দেখে পাখা নেড়ে আনন্দ প্রকাশ করে। সে অন্তুকে ফল খেতে দেয়। ফলগুলো দারুণ মিষ্টি। ফল খেয়ে অন্তু বলে, ‘আমি এখন যাই। দেখলে আমার মা রাগবে।’ ‘তোমার মায়ের খুব রাগ, তাই না?’ ‘উনি আমার আপন মা নন। জান না সৎ মায়ের কেমন রাগ!’ ‘সাবধান অন্তু। মায়ের কথা মেনে চলবে।’ পাখিটা চলে গেলে অন্তু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। বাগানের এই গাছটার তলে দাঁড়িয়ে থাকতে তাঁর খুব ভালো লাগে। বাবা যখন অফিস চলে যায় তখন কারণে অকারণে সৎ মা তাকে বকা দেয়। নানারকম কাজের কথা বলে তাকে ব্যস্ত করে তোলে। এঘর ওঘর ছুটাছুটি করে অন্তু হাঁফিয়ে ওঠে। স্কুল খোলা থাকলে বাবা তাকে স্কুলে দিয়ে যায়। কিন্তু যেদিন স্কুল থাকে না সেদিন অন্তুকে অনেক ফরমায়েস করতে হয়। অন্তু বাগানে এলে তার সৎ মা লুতফুন গলা চড়িয়ে চিৎকার দেয়, ‘কোথায় গেলরে নবাবজাদী। বললাম ঘর ঝাঁড়তে। আর তখনই হাওয়া।’ ‘এই যে আম্মু। বাগানে ময়লা ফেলছি।’ ‘তোমাকে ময়লা ফেলতে বলেছি? কী দেখতে বাইরে যাও। ঘরে মন থাকে না?’ পাখিটা অন্তুর সাথে অনেক গল্প করে। ওকে বলে, ‘জান অন্তুমা, আজ এক কাণ্ড দেখে আসলাম। দিঘীর পাড়ে বাচ্চা রেখে কাজ করছিল এক মা । কাজে ব্যস্ত থাকায় সে বাচ্চার কথা ভুলেই গিয়েছিল। আর এদিকে বাচ্চাটা হামাগুড়ি দিয়ে পানির দিকে যাচ্ছিল। আমি এ দৃশ্য দেখে প্রমাদ গুনলাম। আমি তো জানি না কোনটা তার মা। উপয়ান্তর না দেখে ওর সাথে খেলা করতে লাগলাম আমি। মা এসে দেখে বাচ্চা আমার সাথে মনের আনন্দে খেলছে। এ দৃশ্য দেখে মা কাঁদতে লাগল। এরকম অবহেলার জন্য আমি তাকে ভর্ৎসনা করলাম। বাচ্চাটা তাকে দিয়ে আমি চলে আসলাম।’ ‘কষ্ট করে আবার এদিকে আসলে কেন?’ ‘বারে, আমি আমার মাকে দেখতে আসব না।’ ‘তুমি পাখি হয়ে আমাকে মা বলছ। মানুষ কখনও পাখির মা হয়?’ ‘সে অনেক কথা। আর একদিন বলব তোমাকে।’ অন্তু বলল, ‘এখন থেকে দুপুরে এস তুমি। সকালে মা রান্না করে। আমাকে তার সাথে কাজ করতে হয়। দুপুরে উনি খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম করেন। তখন অনেক কথা বলব। আব্বাও তখন বাসায় থাকেন না। আর একটি কথা, ওই বাচ্চাটাকে আমার কাছে নিয়ে আসলে না কেন? ওকে যে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। জানো তো, আমার কোন ভাই নেই।’ অন্তুর কথা শুনে পাখিটা কাঁদল। তার কান্না দেখে অন্তুর চোখেও পানি এল। অনেকক্ষণ কেঁদে অন্তুকে আদর করে ডানা মেলে উড়ে গেল পাখিটা। সারাদিন অনেক ভাবল অন্তু। ভাইয়ের কথা বলায় পাখিটা কাঁদল কেন? সে শুনেছে তার মা প্রসবের সময় মারা গেছে। মৃত সন্তান প্রসব করেছিল মা। তাহলে পাখিটা কি মায়ের এসব কথা জানে? জানলই বা, তাতে তার কান্নার কী আছে। ভেবে অন্তু বড় অস্থির হয়ে পড়ল। রাতে তার চোখে ঘুম এল না সহজে। গভীর রাতে জানালায় শিশির ঝরলে ঘুমের কাঠি দিয়ে কে যেন তাকে ঘুম পাড়াল। ঘুমের নদীতে সাঁতরাতে লাগল অন্তু। সাঁতরাতে সাঁতরাতে একটা ছোট্ট দ্বীপে এসে পৌঁছল সে। যেখানে ডালে ডালে গান গায় মরকত রঙা ক্ষুদ্র আবাবিল। বন ঝাঁউয়ের সবুজ পাতায় রোদের ঝিলিক দেখে মাকে খুঁজতে লাগল অন্তু। কারা যেন বলতে লাগল, ‘অন্তুর মা, দেখ এসে। তোমার অন্তু এসেছে।’ মেঘ কাতান শাড়ি পরে, টোগো পাহাড়ের সুরমা চোখে অন্তুর পাশে এসে বসল মা। মাকে সে কোনদিন দেখেনি। মনে হল শরীরে ভোরের আল্পনা মেখে তার মা হাসছে। অন্তু কোন কথা বলল না। যে মা তাকে কোনদিন কোলে নেয়নি। ওকে একা ফেলে যে মা ঘুমাতে পারে, তার সাথে কোন কথা নেই অন্তুর। মায়ের দিকে না তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে থাকে সে। মা সব বুঝতে পারে। অন্তুর মুখে চুমু দিয়ে তাকে আদর করে। সমুদ্রের বুক থেকে খুশির তরঙ্গ এনে তনুতে ছড়িয়ে দেয়। চোখে মেখে দেয় পর্বতশৈলীর অবিচল স্বপ্ন। অন্তু বলে, ‘আমাকে একা ফেলে তুমি কোথায় থাক?’ ‘আমি যে এখানে একা থাকি সোনা।’ ‘এখানে থাক কেন। তোমার বাড়ি আছে না? সেখানে গিয়ে থাকবে।’ ‘ফেরেশতারা এখানে নিয়ে এসেছে আমাকে। আমি তো আর তোমাদের সাথে থাকতে পারি না।’ ‘ওদের বল। আমার অন্তুকে একা ফেলে এখানে থাকা সম্ভব না।’ ‘তা হয় না মা। এখানে যারা আসে তারা আর পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারে না।’ মায়ের কথা শুনে অন্তু কেঁদে বুক ভাসায়। সে বুঝতে পারে মা তাকে ফেলে কোন জগতে চলে এসেছে। তার ছোট ভাইটিও তাকে ফেলে এই অচেনা জগতে চলে এসেছে। মা তাকে বলে, ‘খোদার কাছে দোয়া করে আমি একটা বিশেষ ক্ষমতা পেয়েছি। আমি যেন আমার অন্তুকে দেখে আসতে পারি।’ ‘তুমি তো আমাকে দেখতে যাও না। আমি তো রোজ তোমাকে মনে মনে খোঁজ করি।’ ‘তোমার বাগানের সেই পাখিটাকে চিনতে পারনি তাহলে? ওটা তোমার মায়ের আত্মা।’ ‘সত্যি বলছ?’ ‘আমার মাকে মিথ্যা বলতে পারি?’ মা তাকে সব বলে। মা তখন ছোট। এক দরবেশের সাথে তার দেখা হয়। দরবেশ মায়ের হাত দেখে বলে, একটি কন্যা জন্মের পর সে আবার গর্ভবতী হবে। সেই সন্তান প্রসবকালে তার মৃত্যু হবে। তার সে মৃত্যু হবে খুবই বেদনাদায়ক। দরবেশ তাকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে বলে। যেন মৃত্যুর পর সে বেহেশতী পাখি হয়। আর সে যখন খুশি পৃথিবীতে তার কন্যাকে দেখতে আসতে পারে। তার প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করেন। তাই সে পাখা মেলে উড়ে এসে তাকে দেখে যেতে পারছে। সকালে ঘুম ভেঙে অন্তু দেখে বাবা তার শিয়রে বসে কুরআন পাঠ করছেন। বাবার কণ্ঠ এত ভাল। অন্তুর শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। একটা সূরা বাবা প্রতিদিন পাঠ করে অত্যন্ত আন্তরিকভাবেÑ ‘তাবারাকাল্লাজী বিইয়াদিহিল মুলক ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির’ অংশটুকু বাবার পড়া শুনে তার মুখস্থ হয়েছে। একা একা পাঠ করে অন্তু এ আয়াতটুকু। বাবা তাকে কুরআন পাঠের জন্য মৌলভী রেখে দেবেন বলে বলেছেন। কিন্তু মা ওসব বেশি একটা পছন্দ করেন না। অন্তুকে একটা দোয়াও শেখায়নি তার মা। ভাল কোন কথা, কোন উপদেশ কিংবা কোন গল্প বলে অন্তুকে আনন্দ দানের কোন ইচ্ছা তার নেই। আজ অন্তুর স্কুল বন্ধ। মা তাকে অনেক কাজের বোঝা চাপিয়ে দিল। দুপুরে খাওয়ার পর মা ঘুমিয়ে পড়লে অন্তু বাগানে গেল। যেয়ে দেখে তার অপেক্ষায় পাখিটা অধির আগ্রহে বসে আছে। অন্তুকে দেখে সে বলতে লাগল, ‘আমার মা সোনা কেমন আছে?’ ‘কেমন থাকবে তোমার মা সোনা। কাজের মেয়ের সব কাজ তাকে করতে হচ্ছে।’ ‘কেন? তোমাদের বাসায় কাজের মেয়ে নেই।’ ‘ছিল, এখন নেই। পানির গ্লাস ভেঙেছে বলে তাকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে মা। এখন আমাকেই সব কাজ করতে হচ্ছে।’ ‘তোমার বাবা কী বলেন?’ ‘বাবা এসব জানেন কিনা আমি জানি না।’ ‘বাবাকে এসব বলনি তুমি?’ ‘বললে কি ভাল হবে। মা তাহলে আমাকে আচ্ছা করে পিটাবে।’ কিছুক্ষণ কোন কথা হয় না তাদের মধ্যে। মেয়েকে দেখতে এসে কী লাভ! মেয়ের কোন কষ্ট যদি লাঘব করা না যায় তাহলে তাকে শুধু শুধু দেখে লাভ কী! মেয়েকে একটা পালক দিয়ে সে বলল, এই পালক দিয়ে স্পর্শ করলে তার সব কাজ ফেরেশতা এসে করে দিয়ে যাবে। তবু সে যেন মায়ের অবাধ্য না হয়। যতদিন তার মায়ের পরিবর্তন না হবে ততদিন এ ব্যবস্থা চলবে। এ কথা শুনে অন্তু বলল, ‘আমার গত রাতের স্বপ্ন কি সঠিক?’ ‘কী স্বপ্ন দেখেছ? আমাকে খুলে বল।’ ‘তুমি কি আমার আপন মা? সঠিক করে বল। একটুও মিথ্যা বলবে না।’ ‘তোমার কী মনে হয়? তোমার মনে যা হয় তাই।’ ‘ওসব কথা আমি বুঝি না। আমাকে সব খুলে বল।’ ‘মা আমার! আল্লাহ তোমাকে সঠিক ঘটনা জানিয়ে দিয়েছেন। আমিই তোমার অভাগী মা।’ ‘আমার সৎ মাকে তুমি একটা শাস্তি দাও না? ও আমার সাথে খুবই খারাপ আচরণ করে। আমার আর সহ্য হচ্ছে না।’ ‘একটু ধৈর্য ধর। মানুষকে সংশোধনের সুযোগ দিতে হয়। উনার ভুল উনি একদিন বুঝতে পারবেন।’ অন্তুর বাবার বদলী হয়ে গেল অন্য এক জেলায়। সপ্তাহে একদিনও সে বাড়ি আসতে পারে না। যার জন্য অন্তুর সমস্যা আরও বেড়ে গেল। তাকে একা পেয়ে সৎ মা অনেক কাজ বাড়িয়ে দিল। সারাদিন কাজ আর কাজ। অন্তুর খানাপিনা এবং ঘুমের সময় পর্যন্ত থাকল না। দুপুরে সে তার মায়ের সাথে কথাও বলতে পারে না। প্রায়ই তার সাথে কথা না বলেই মা ফিরে চলে যায়। সেদিন দুপুর বেলা অন্তু খেতে বসেছে। এমন সময় তার সৎ বোন সান্তনা বিছানায় মলত্যাগ করেছে। সৎ মা বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। নিজে না উঠে সে অন্তুকে বাধ্য করল মল পরিষ্কার করতে। ক্ষুধায় অন্তুর পেট জ্বলে যাচ্ছে। তবুও সে বাথরুমে বাচ্চাকে নিয়ে গেল খাওয়া বন্ধ করে। ঠাণ্ডা পানি গায়ে লেগে বাচ্চাটা একটু কান্না করতেই তার সৎ মা এসে তাকে চেলা কাঠ দিয়ে পিটাতে লাগল। অন্তুর হাতে তার মায়ের দেয়া পালক ছিল। সে পালক তার গায়ে লাগিয়ে অন্তু বলল, ‘যে হাতে তুমি আমাকে মেরেছ তা অবশ হয়ে যাক। জীবনে ওই হাতে তুমি কোন কাজ করতে পারবে না।’ অন্তু কথা ফলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার সৎ মায়ের ডান হাত অবশ হয়ে গেল। খবর শুনে কর্মস্থল থেকে অন্তুর বাবা এল। অনেক চিকিৎসা চলল। কিন্তু তার হাত ভাল হল না। অন্তুর বাবা বুঝতে পারল কেন এমনটা হয়েছে। অন্তুর উপর সৎ মায়ের নির্যাতন যে সীমা ছাড়িয়ে গেছে তা তার অজানা নয়। প্রতিবেশীর কাছ থেকে তিনি সব জানতে পারলেন। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আন্দাজ করতে পারেন কিভাবে তার প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে। কিন্তু কী করবেন তিনি! কত অনুনয় করে তিনি স্ত্রীকে বলে যান যাতে মা-হারা মেয়েটার কোন কষ্ট না হয়। কিন্তু লুতফুন তার কথা মোটেই গ্রাহ্য করেন না। হাত অবশ হয়ে যাওয়া যে তার সীমালঙ্ঘনের ফল এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্তুর বাবা সাতদিনের ছুটি নিয়েছেন। অন্তুকে জ্বালাবার জন্য সে কাজের মেয়েকে ছুটি দিয়েছে তা তিনি এতদিনে বুঝতে পারলেন। সারাটা দিন বাড়ির সব কাজ তিনি অন্তুকেই করতে দেখলেন। মেয়েকে কাছে ডেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এসব কাজ তুমি করছ কেন অন্তুমা?’ ‘আমিই তো এসব কাজ করি বাবা। কাজের মেয়েকে আম্মু নিষেধ করে দিয়েছেন।’ ‘তুমি বল কী! প্রতিমাসে কাজের মেয়ের মাইনের টাকা তো আমি দিয়ে যাচ্ছি।’ ‘সেটা আম্মু বলতে পারবে। কাজ না করলে এ বাড়িতে কি আমার ভাত হবে? কাজ করেই ভাত পাচ্ছি না।’ ‘তুমি এতদিন আমাকে এসব কথা বলনি কেন?’ ‘তোমাকে বললে কী করতে?’ ‘আমি এর ব্যবস্থা করতাম। আমার মেয়েকে যে কষ্ট দেয় তাকে আমি ছেড়ে দেব ভাবছ?’ ‘ওসব কথা বল না। তোমাকে কিছুই করতে হবে না। যার শাস্তি সে নিজেই অর্জন করেছে।’ বাবা লক্ষ্য করল অন্তু সব করতে পারে। থালা বাসন পরিষ্কার, ভাত-মাছ, শাক-সব্জি, পেলাও-গোশত রান্না করা, সব পারে অন্তু। এতবড় বাড়িটা সে একাই ঝাঁট দেয়। সব কাপড় চোপড় সুন্দর করে ধুয়ে আলনায় ভাঁজ করে রাখে। মোটকথা অন্তু যেন সংসারের প্রতিটি বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং পারদর্শী। ডান হাত অবশ হয়ে যাওয়ায় অন্তুর সৎ মা যদিও তত একটা কাজ করতে পারে না, তবু সে মুখের ভাষায় অন্তুকে পিষতে থাকে। বাবা কর্মস্থলে চলে যাওয়ার পর অন্তুকে নির্যাতন করার জন্য সে তৎপর হয়ে ওঠে। সে বলতে থাকে, ‘নবাবজাদীর বেটি, খুব তো বাবাকে দেখালে। বলি এত বাড়টা তুমি বেড়েছ কিসের জন্য? তোমাকে যদি আচ্ছা করে সায়েস্তা করতে না পারি আমার নাম লুতফুন নয়।’ ‘আমি তো কোনই বাড়িনি মা। তুমি যা যা বলছ সবই তো করছি। আমার সাথে তুমি অমন কর কেন? একটু ভাল করে কথা বলতে পার না?’ ‘আমাকে কথা বলা শিখাতে হবে তোমাকে? আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন।’ লুতফুন একটা চেয়ার তুলে অন্তুর দিকে নিক্ষেপ করে। ভাগ্য ভাল অল্পের জন্য চেয়ারখানা তার মাথায় লাগেনি। অন্তু খুব ব্যথিত হয় সৎ মায়ের কাণ্ড দেখে। যে মায়ের মন রক্ষার জন্য সে দিনরাত কাজ করে তার বিবেচনা দেখে অন্তু কেঁদে ফেলে। সে বলে, ‘তুমি যদি দেখেশুনে মিথ্যা কথা বল তবে তোমার ওই মুখ যেন খোদার আদেশে বিকল হয়। ওই মুখ দিয়ে আর যেন একটি কথাও বলতে না পার।’ অন্তুর শুধু বলাই বাকি। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সৎ মায়ের মুখ একদিকে বেঁকে অবশ হয়ে যায়। হাজার চেষ্টা করেও সে আর একটি কথাও বলতে পারে না। অন্তু নিজেও তাজ্জ্বব হয় তার কথার এমনটা প্রয়োগ দেখে। দুপুরে বাগানে সে তার পাখি মার সাথে দেখা করল। সব কথা বলল সে মাকে। বাবার কথা, সৎ মায়ের কথা সব বলল সে। তার সৎ মায়ের হাত এবং মুখ অবশ হওয়ার কথাও বলল। শুনে সে কিছুই বলল না। পৃথিবী এতটা নির্মম। একটা অবোধ বাচ্চাকে সয়ে নিতে পারে না মা তুল্য আরেক নারী। কী করবে এ বাচ্চাটা! সৎ মায়ের মন রক্ষার জন্য দিনের পর দিন কত না পরিশ্রম করেছে। শুধু মা বেঁচে না থাকার কারণে একটা শিশুকে কতটা অসহায় অবস্থায় জীবন যাপন করতে হয়। তবু সে অন্তুকে বলে, ‘একবার ভেবে দেখলে ভাল হত। বেচারীর কতটা কষ্ট হবে চিন্তা করেছ?’ ‘আমি কী করব? উনি তোমাকে জড়িয়ে যা তা বলছিল। চেয়ার তুলে আমার মাথায় ছুড়ে মেরেছে।’ ‘একটু সহ্য করলে ভাল হত তোমার। উনিও তো তোমার মা।’ ‘অমন মায়ের দরকার নেই, যে উঠতে বসতে মারধর করে।’ ‘তোমার বাবার কথা ভেবেছ? উনি কত কষ্ট পাবেন।’ ‘বাবা মোটেই কষ্ট পাবেন না। বাবা সব বুঝতে পেরেছেন।’ অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থেকে অন্তুর সৎ মা নিজের ভুল বুঝতে সক্ষম হলেন। তিনি অনুধাবন করলেন অন্তু সাধারণ মেয়ে নয়। কোন সাধারণ মেয়ের কথা এতটা কার্যকরী হতে পারে না। তাছাড়া অন্তুকে উনি যত কাজ চাপিয়ে দিয়েছেন সে সব কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেছে। তার হাতে মনে হয় জাদু আছে। অন্তুর বাবা এলে তাকে কাছে ডাকতে বলেন তিনি। অন্তু কাছে এলে তিনি তাকে বুকে জড়িয়ে নেন। তারপর চোখের পানিতে ভেসে নিজের ভুলের জন্য অনুশোচনা করেন। সৎ মায়ের চেহারায় অপ্রকাশ্য অনুনয় দেখে অন্তুর মন বিগলিত হয়ে যায়। সে তার বাক্স থেকে মায়ের দেয়া পালক এনে সৎ মায়ের মুখে এবং হাতে ছোঁয়া দিয়ে বলে, ‘আমার মা আগের মত সুস্থ হয়ে যাক।’ অন্তুর ছোঁয়া পেয়ে তার সৎ মা সুস্থ হয়ে উঠল।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ