অনিক ও গুইসাপ জাকির । আবু জাফর

অনিক ও গুইসাপ জাকির । আবু জাফর

গল্প ডিসেম্বর ২০১৮

বছরে একবার মাত্র গ্রামের বাড়ি আসে অনিকরা। এবারও এসেছে। এসেছে বাবা-মার সাথে। একমাত্র ছোট বোন প্রভাও সঙ্গে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। এই সময়টা প্রতি বছর একবারই আসে। বেশ আনন্দ নিয়েই আসে সময়টি। সারাটা বছর অপেক্ষায় থাকে এ সময়ের জন্য। একদিন আগে শেষ হলো পরীক্ষা। আজই এসে গেছে গ্রামের বাড়ি। অবশ্য অষ্টম শ্রেণী বলে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে হবে অনিককে। সুতরাং বেশি দিন থাকার সুযোগ নেই। প্রভা এবার পঞ্চম শ্রেণীতে উঠবে। ফলে তার সময় অফুরন্ত। প্রভা কিছুদিন বেড়ানোর পক্ষে। অনিকও। কিন্তু সমস্যা অনিকের বৃত্তি পরীক্ষা। অন্যদিকে অনিকের বাবার অফিস। প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি। বেশি ছুটি মেলে না। অনিকের মা অবশ্য গৃহিণী। তবুও তারা চারদিন থেকে তারপর যাবে ঢাকায়।

অনিকেরা যখন বাড়িতে এসে নামলেন তখন দুপুর ১২টা। অনিকের দাদী হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন অনিক ও প্রভাকে। চাচীও বেশ আদর করলেন। বাড়িতে দাদী, চাচা-চাচী ও চাচাতো ভাইবোন মিলে তাও চারজন।

অনিকের প্রথম আনন্দ তার দাদী। দাদীকে দেখলেই তার ভেতরে অন্যরকম আনন্দ খেলা করে। দাদীও আদরে আদরে ভরে দেন অনিকের বুক। দাদীর হাত ধরেই ঘরে ঢুকে অনিক ও প্রভা। জামা বদল করে এক গ্লাস ডাবের পানি খেলো অনিক। তারপরই দৌড়ে পুকুর পাড়ে।

এটি অনিকদের অনেক পুরনো বাড়ি। অনিকের দাদার দাদা এই বাড়ি বেঁধেছেন। বাড়ির সামনে একটি বড় পুকুর। পেছনেও একটা। পেছনের পুকুরটা একটু ছোট। একদম বাড়ির সদর দরজায় একটি মসজিদ। মসজিদ থেকে সোজা পথ এসে অনিকদের সদর দরজায় ঢুকেছে। বাড়ির চারপাশে বেশ জমানো গাছ গাছালি। অনিকরাসহ  বেশ কিছু পরিবার বসত করে এই বাড়িতে। অবশ্য আগে আরও দু’টি পরিবার ছিলো। তারা অনিকদের কাছে জমি-ভিটা বিক্রি করে চলে গেছে অন্যত্র। এখন অনিকেরাই বাড়ির বেশিরভাগ অংশ নিয়ে থাকে। অনিকের দাদী এবং চাচা-চাচী বেশ রক্ষণাবেক্ষণ করে বাড়ির আসবাবপত্র। বছরে একবার অনিকরা আসবে এটা সবার জানা। ফলে এ সময়টায় বেশ আয়োজন থাকে।

এসব আয়োজন করেন অনিকের চাচা। মোষের ঘন দধি তো থাকবেই। নদীর চিংড়ি মাছ, লরাকা মাছ, এসব মাছে ভরপুর। তা ছাড়া শীতের পিঠা। খেজুরের রস মজুদ রাখা চাই। অবশ্য তাই থাকে। এসব মজাদার খাবার অনিকের দারুণ পছন্দ। ফলে ডিসেম্বর এলেই এসব কিছু অনিকের মনে ভাসতে থাকে। খেজুরের রসের মতো জিহ্বায় রস আসে। ভাপা পিঠার ধোঁয়ার গন্ধ ভাসে নাকে। মোষের দুধের দধির স্বাদ জেগে ওঠে মুখে। তখন ছটফট শুরু হয় গ্রামে যাওয়ার জন্য। পরীক্ষা দিয়েই দে ছুট। সবকিছু গুছিয়ে অপেক্ষা। নির্দিষ্ট দিনে উড়ে যাওয়ার মতো করে দৌড়ে চড়ে গাড়িতে। পৌঁছে গেলেই মুক্ত পাখির মতো ডানা ছড়ায় নানা দিকে। বিশেষ করে বাড়ির পেছনের পুকুরপাড় খুবই প্রিয় অনিকের।

এ পুকুরের চারপাশে নানা রকমের গাছে ভরা। ছায়াদার গাছগুলোর ডালে ডালে পাখির কূজন। পশ্চিম পাড়ে একটি বড়সড় কড়ই গাছ ডালপালা ছড়িয়ে আছে। এই গাছটির ডালে বসে এক জোড়া ঘুঘু ডাকে ভরদুপুরে। ঠিক দক্ষিণ পাড়ের দেবদারু ছায়ায় বসে ডাক শোনে অনিক। গত চার বছর এ জোড়া ঘুঘুর গান দুপুর হলে বেজে ওঠে। আজ পুকুরপাড়ে এসেই খুঁজছিলো ঘুঘুদের। হ্যাঁ ওই তো ওরা মনের আনন্দে আকাশে উড়ছে। একটু পরেই কড়ই গাছের ডালে বসে শুরু করলো গান। ঘুঘুর গানে নিঝুম দুপুর যেনো দুলে উঠছে। রাত থেকে কুয়াশা ভয়াবহ রকম ঝরেছে। এমন দুপুর তবুও যেনো আকাশ ঘোলা হয়ে আছে কুয়াশার ভারে। ফলে রোদের তেজও নেই তেমন। আকাশ যেমনই থাকুক ঘুঘুজোড়া গান করবেই- এটাই যেনো ওদের পণ। অনিকের মনে হয় যেনো পাখি দু’টি তার আত্মীয়। তাকে শোনাতেই যেনো গান করছে ওরা। খুব মায়া জাগে পাখিদের প্রতি। সব পাখিই অনিকের প্রিয়। কিন্তু এ দু’টি ঘুঘু আজ চার বছর এক রকম একই জায়গায় বসে এ সময়টায় গান করে।

অনিক ভাবছে যখন সে থাকে না তখনও কি ঘুঘু দু’টি গান করে। যদি করে তবে তখন কে শোনে ওদের গান। এ গাছগাছালি, প্রকৃতিই হয়তো শোনে। হয়তো অন্য কোনো মানুষও শুনতে পারে। আচ্ছা পাখি দু’টি অন্য কোনো মানুষকে পছন্দ করে? তখন কি অনিককে ভুলে যায় ওরা। ভীষণ কষ্ট লাগে অনিকের। আবার গা ঝেড়ে চাঙ্গা হয়ে ওঠে- ধ্যুৎ আমার প্রিয় পাখিরা আমাকে ভুলবে না। কেন ভুলবে? আমি এদের জন্য ছুটে আসি ঢাকা থেকে। কতদূর পথ ফেলে আসি আমাকে কেন ভুলবে ওরা।

দেবদারু গাছের গোড়ায় বসে প্রতিদিনের মত গান শুনছিলো আর নানান কথা ভাবছিলো অনিক। ঘুঘুদের কাছ থেকে তার চোখ কখনো কখনো ছুটে যায় অন্য গাছে। দোয়েল, শ্যামা, টিয়ে আর শালিক পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। একগাছ থেকে লাফিয়ে ছুটছে। কোনো পাখি আবার দুষ্টুমিতে মেতে উঠেছে। একটিকে আরেকটি ঠোঁট দিয়ে কামড়ায়। অন্যটি আবার তাড়া করে তাকে। এভাবে পাখিদের আনাগোনা, নাচানাচি, মৃদু ঝগড়া এসব দেখছে অনিক। পাখির পেছনেই তার সময় চলে যায়। বসে বসে ভাবে যদি সেও পাখি হতে পারতো। তবে লেখাপড়ার এতটা ঝুট-ঝামেলা থাকতো না। পাখির সাথে হেসে খেলে, উড়ে বেড়িয়ে কেটে যেতো সময়। ওই দু’টি ঘুঘুর সাথে ডালে বসে ভাব জমাতো। আর নতুন গান করার জন্য বায়না ধরতো। কি মজাই না হতো। কি আনন্দ হতো তবে। পাখির নাচানাচি দেখতে দেখতে খেয়াল করলো অনিক তার ছায়া অর্ধেক পরিমাণ ভেসে উঠেছে পুকুরের পানিতে। মিহি বাতাসের ঝিরি ঝিরি কম্পন তার ছায়াকে কাঁপিয়ে তুলছে। তার ভারি ভালো লাগছে, ওই কম্পন- দোলা। এর মধ্যে একটি মাছ সম্ভবত কৈ মাছ হবে, টুপ করে ছাট দিলো। টুপ প্রবল শব্দটি বৃষ্টিতে ভেসে ওঠা ফোঁটার মতো জেগে ওঠে। এরকম ছাট দেয় কৈ মাছ। দেখতে দেখতে অনিক এখন মাছের এসব ভাষাও বোঝে। মাছটি তার ছায়াকে ভেঙে দিয়ে গেলো। অবশ্য সামান্য সময়। তারপর জেগে ওঠা পাতলা ঢেউ পাড়ে এসে মিলে গেলো। ঠিক আগের মতো আবার দেখা যাচ্ছে ওর ছায়া। মুগ্ধ হয়ে নিজের ছায়া দেখছে অনিক।

হঠাৎ পাখির পাখার ঝাপটা কানে বেজে উঠলো অনিকের। সেই সাথে কিছু কিছু শব্দ। তার কোনো এক পাশ থেকেই শব্দটি বেজে উঠলো। দ্রুত চোখ ফেরায় সে। আশপাশে দেখে খুব সতর্কতার সাথে। না কিছুই চোখে পড়ছে না। নিজের ছায়ার দিকে মন দেয় অনিক। ঠিক আবার বেজে উঠলো শব্দটি আগের মতো। উত্তরমুখী হয়ে বসে আছে সে। তার মনে হলো বাঁ পাশ থেকেই শব্দটি শোনা গেলো। বাঁয়ে দ্রুত দেখলো সে। অনিক যেখানে দেবদারুর গোড়ায় বসে আছে ঠিক তার পাঁচ সাত হাত দূরে একটি ডুমুর গাছ। গাছটির এখন কিশোর বয়স। তবে বেশ ডালপালা গজিয়েছে গাছটির।

একবার এই ডুমুর গাছেই একটি দোয়েলকে আরেকটি দোয়েল ঠুকরিয়ে পশম তুলে দিয়েছিলো। কিন্তু আক্রান্ত দোয়েলটি কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করেনি। নীরবে কেন দোয়েলটি এমন অত্যাচার সহ্য করেছিলো জানে না অনিক। হঠাৎ এই ঘটনা মনে পড়ায় অনিক ভাবছে আজো বুঝি ওই দোয়েলটি মার খাচ্ছে। তার সাথীর কাছে। তার খুব ইচ্ছে হলো দোয়েলটিকে খুঁজে বের করার। উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখছে অনিক। প্রতিটি ডালে চোখ বোলায় সে। কিন্তু না দোয়েলের মতো কোনো পাখি তার চোখে পড়ে না। আবার অন্য কিছুও তার চোখে পড়ছে না। বসে দেখতে দেখতে দাঁড়িয়ে গেলো সে। একরকম পুকুরের দিকে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করছে কিন্তু না কিছুতেই তো দেখছে না। এবার অনিক দেখলো পানিতে ডুমুর গাছের ছায়া। কেমন যেনো পানিতে সবুজ জমে আছে। প্রকৃতি সবুজ আর ছায়া সবুজ এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য খোঁজে অনিক। ঠিক তখন আবার সেই পাখির পাখা ঝাপটানি এবং কিচকিচ শব্দ। এবার খানিটা জোরে বাজলো কানে। এবং ডুমুর গাছের দিক থেকেই শব্দটা এলো। একটি গাছের চারা খেজুর গাছ, একটি মন্দা গাছ এবং একটি বন্য গাছের জন্য ডুমুর গাছের নিকটে পৌঁছা যাচ্ছে না।


ভীষণ অবাক হয়ে অনিককে বুকে টেনে নিলেন তার মা। মনে মনে ভাবলেন অনেক বড় হবে আমার অনিক।
তবুও খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে অনিক। ডুমুর গাছের পাশে আরেকটি দেবদারু ছায়া কিছুটা জমিয়ে দিয়েছে ডুমুর গাছটিকে। ফলে রোদ পড়ার কোনো সুযোগ নেই ডুমুর গাছে। রোদহীন গাছটি নিজের ছায়া আর দেবদারুর ছায়া নিয়ে অনেকটা অন্ধকার হয়ে আছে। অনিক চোখের আলো জ্বেলে দেখার চেষ্টা করছে। তবুও দেখে না কিছুই। কিন্তু অনিক এ বিষয়ে নিশ্চিত যে ডুমুর গাছের ভেতর থেকে দাপাদাপি কিংবা পাখার ঝাপটা ভেসে আসছে। বছরে একবার মাত্র গ্রামের বাড়ি আসে অনিকরা। এবারও এসেছে। এসেছে বাবা-মার সাথে। একমাত্র ছোট বোন প্রভাও সঙ্গে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। দেবদারুর একটি ডাল এক হাতে জড়িয়ে ধরে পানির দিকে ঝুঁকে গেলো অনিক। ঝুঁকে ডুমুর গাছের তলা দেখার চেষ্টা করছে। দেখতে দেখতে আরো একবার পাখার ঝাপটানি ভেসে এলো। এবার দেবদারুর গোড়ায় বসে পড়লো অনিক। বসে বাম হাত দিয়ে যতটা সম্ভব দেবদারুকে জড়িয়ে নিলো। তারপর শরীরের অর্ধাংশ বের করে ডুমুর গাছের তলায় চাইলো সে। ঠিক তখনি তার চোখে পড়লো একটি বড়সড় মাছরাঙা। মাছরাঙাটির একটি পা কামড়ে ধরে রেখেছে একটি গুইসাপ। মাছরাঙাটি প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। কিন্তু গুইসাপ কিছুতেই ছাড়বে না এমন ভাব ধরে আছে। মাছরাঙাটি ডানা ঝাপটায় আর ঠোঁট দিয়ে কামড় দিচ্ছে গুইসাপের মাথায়। মাছরাঙার কামড়ে গুইসাপ কাবু হচ্ছে না মোটেই। কিন্তু একটি পায়ের বেশি মাছরাঙাকে জব্দ করতেও পারছে না। কামড় দিয়ে ঝিম মেরে বসে আছে গুইসাপটি। অনিকের মনে হলো সম্ভবত গুইসাপটি কৌশল খাটাচ্ছে। পা কামড়ে পড়ে থাকলে পাখিটি অনবরত পাখা ঝাপটাবে। এভাবে ঝাপটাতে গেলে একসময় দুর্বল হয়ে পড়বে মাছশিকারি পাখিটি। আর তখনই খাবে তাকে। মাছরাঙাটির বিপদ দেখে অনিক খুব কষ্ট পেলো। সে সিদ্ধান্ত নিলো যে করেই হোক মাছরাঙাটির প্রাণ রক্ষা করতে হবে। কিন্তু কিভাবে? ভাবনায় পড়ে গেলো সে। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি উুঁকি দিলো তার। তখনি দ্রুত দৌড়। রান্নাঘরের পাশ থেকে একটি বাঁশ নিয়ে আবার দৌড়। সেই দেবদারুর গোড়ায় দাঁড়িয়ে টার্গেট করলো গুইসাপটিকে। ডুমুর গাছের তলায় যেখানে গুইসাপটি মাছরাঙার পা কামড়ে ধরে আছে ঠিক সেখানে বাঁশটির মাথা পৌঁছে দিলো। বাঁশের মাথা দিয়ে গুইসাপের মাথায় যতটা সম্ভব জোরে গুঁতো দিলো অনিক। গুঁতো খেয়ে গুইসাপটি রাগে ফুলে উঠছে। চোখ খানিকটা বড় করে যেনো অনিককে শাসাচ্ছে। কিন্তু মাছরাঙাকে ছাড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। একটু কায়দা করে আবার গুঁতো দিলো অনিক। গুঁতো খেয়েই গুইসাপটি ফুলতে ফুলতে কিছুটা বাঁয়ে সরে গেলো। এতটাই সরলো যে অনিক খুব সহজে গুঁতো দিতে পারছে না। দেবদারু গাছটাকে জড়িয়ে ধরে শরীরকে খানিকটা কুজো করে দেখলো। ভাগ্য ভালো মনে হলো এ জন্য যে এখনো কোনো গর্ত দেখা গেলো না। যদি কোনো গর্ত থাকতো তবে মাছরাঙাটি আরো আগেই শেষ হয়ে যেতো। কারণ গর্তের ভেতর গুইসাপ ঢুকে পড়লে মাছরাঙার আর বাঁচার সম্ভাবনাই থাকতো না। গর্ত নেই ভেবে একটু খুশিই হলো অনিক। বাঁশের গুঁতো দেয়ার চেষ্টা শুরু করলো। খানিক চেষ্টা করেছে গুইসাপের চোখে গুঁতো দেয়া যায় কি না। চেষ্টায় সে সফলও হলো। চোখ টার্গেট করে গুঁতো দিলো জোরে। এবার গুইসাপটি আরো বেশি রাগান্বিত হলো। গুইসাপের পেট ফুলে ফুলে উঠছে। কিন্তু সে কিছুতেই মাছরাঙাকে ছাড়ছে না। বরং অনিকের মনে হলো খানিকটা বেশি জোরে চেপে ধরেছে মাছরাঙার পা। মাছরাঙাটি আগের থেকে আরো জোরে পাখা ঝাপটাচ্ছে। সম্ভবত উদ্ধারকার্যের বিষয়টি পাখিটি বুঝতে পেরেছে। কিন্তু এতে কোনো কাজ হচ্ছে না। গুইসাপ মরিয়া হয়ে মাছরাঙার পা মুখে পুরে আছে। মাছরাঙাটি ভীষণ কাঁপছে। তার দুই চোখে ভয়ের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। পাখা ঝাপটাতে কখনো ক্লান্ত হয়ে যায়। তখন কাঁপুনিটা বেশ বেড়ে যায়। অনিকের খুব মায়া লাগছে পাখিটার জন্য। অনিক ভাবে সারা জীবন মাছশিকারি পাখিটা এখন নিজেই অন্যের শিকার হয়ে যাচ্ছে।
অনিকের খুব মায়া লাগছে পাখিটার জন্য। অনিক ভাবে সারা জীবন মাছশিকারি পাখিটা এখন নিজেই অন্যের শিকার হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো। যে করেই হোক মাছশিকারি পাখিটাকে সে উদ্ধার করবেই। এবার শরীরের শক্তিকে ডান হাতে জড়ো করার চেষ্টা করে অনিক। বাম হাত দিয়ে দেবদারুকে ধরে সম্ভাব্য সব শক্তি ডান হাতে আনার চেষ্টা করলো। আরো খানিকটা ঝুঁকে গেলো পুকুরের দিকে। নিশানা ঠিক করে গুইসাপের মাথায় ভীষণ জোরে গুঁতো দিলো। এতেই কাজ হলো চমৎকার। ব্যথার চোটে গুইসাপটা ফুঁসে উঠলো। ফুঁসে ওঠার সাথে সাথে মুখটা সামান্য হাঁ হয়ে গেছে। তাতেই মাছরাঙাটি মুক্ত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ডুমুর গাছের মগডালে বসলো। কিন্তু ঘটনাটা ঘটে গেছে অনিকের। জোরে গুঁতো দিতে গিয়ে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারলো না সে। ফলে গুইসাপটাকে গুঁতো দিয়েই ঝপাত করে পড়ে গেলো পুকুরে। পড়েই একরকম তলিয়ে যাবার দশা। বেশ সাহসিকতার সাথে সে ভেসে ওঠার চেষ্টা করছে। গত বছরই অনিকের চাচা ওকে সাঁতার শিখিয়েছে। না হলে এখন কী হতো! তবুও খানিকটা পানি খেতে হলো তাকে। নাকে মুখে পানির থাবায় বেশ কাবু হয়ে গেছে অনিক। তলিয়ে যাওয়া থেকে বেঁচে গেলো সে। পানির তল থেকে মাথা তুলে চাইলো ডুমুর গাছের দিকে। তার চোখ পড়তেই দেখে গুইসাপটি তার দিকে চেয়ে ভীষণ ফুঁসছে। চোখ দুটি জবা ফুলের মতো লাল। পেট বেলুনের মতো ফুলে ফুলে উঠছে। গুইসাপের চোখ দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো অনিক। বয়সের তুলনায় সে অনেক বেশি সাহসী। তবুও তার ভয় করছে সাপের ফোঁসে ওঠা দেখে। সে দ্রুত পাড়ে ওঠার চেষ্টায় এগোচ্ছে। ঠিক তখনই গুইসাপটি তাকে আক্রমণ করতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো এবার। মনের অজান্তে বাঁচাও বলে চিৎকার দিলো সে। কিন্তু তার উপস্থিত বুদ্ধি তাকে ছেড়ে যায়নি। চিৎকার দিয়েই সে ডুব দিলো। ডুব দিয়ে খানিকটা পুকুরের মাঝখানে চলে গেলো। পূর্বপাড় থেকে উঠানের দিকে কি যেনো কাজ করছিলো অনিকের দাদী। বাঁচাও শব্দটি কানে যেতেই সচেতন হলেন তিনি। এ যে অনিকের কণ্ঠ। তাড়াতাড়ি উঠে এলেন পুকুরের পাড়ে। পুকুরে নজর দিতেই তার চোখ ছানাবড়া। গুইসাপের সাথে যুদ্ধ করছে অনিক। অনিক ডুব দিয়ে যে দিকে যায় গুইসাপও ঠিক সে দিকে ছোটে। ডুব থেকে মাথা তুলেই বলে বাঁচাও। দৃশ্য দেখে অনিকের দাদীর কলিজা যেন চেপে ধরেছে কেউ। গায়ের সব শক্তি দিয়ে ডাকছে অনিকের বাবাকে চাচাকে। অনিকের বাবা কাপড় ছেড়ে রাস্তার দিকে গেছে একটু আগে। বাইরে থেকে চাচা এসে কেবল ঘরের সামনে দাঁড়ালো। ঠিক তখনই মায়ের চিৎকার শুনতে পেলো। দৌড়ে এলেন তিনি। ততক্ষণে হইচই আর বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার। অনিকের মায়ের কান্না, প্রভার কান্না দুপুরকে ভারী করে তুললো। অনিকের চাচা ঘটনা দেখেই অবাক। দক্ষিণ পাড়ের কাছে পানিতে ভেসে থাকা বাঁশ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অনিক তখন নানা দিকে ঘুরে পুকুরের মাঝখানে। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। দ্রুত সাঁতার কেটে পৌঁছে গেলো অনিকের চাচা। অনিকের পেছনে পিঠের দিকে এনে তার গলা ধরে ভেসে থাকতে বললেন। বাম হাত দিয়ে সাঁতার কাটছেন। আর ডান হাতে ধারা সেই বাঁশটি। অনিকের চাচাকে তীব্র বেগে সাঁতার কেটে বাঁশ হাতে আসতে দেখে খানিকটা ভয় পেয়ে গেছে গুইসাপটি। কিন্তু সে দমে যায়নি। তার মুখের খাবার কেড়ে নেয়ার শোক থেকে অসম্ভব রাগে সে প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করছে। চাচা-ভাতিজা দু’জনের দিকে তেড়ে আসার সাহস দেখাচ্ছে সাপটি। অনিকের চাচা অভয় দিয়ে বললেন, শক্ত করে ধরে থাক আমার গলা। আর তিনি ডান হাতে বাঁশটি উঠিয়ে যথাসম্ভব জোরে বাড়ি দিলেন ধেয়ে আসা গুইসাপের দেহে। সাপটাও বেশ চালাক। বাঁশের বাড়ি থেকে রক্ষা পেতে সেও ডুব দিলো দ্রুত। এ সময় দ্রুত সরে এলো অনিককে নিয়ে তার চাচা। কিছুক্ষণ পর গুইসাপটা ভেসে উঠলো। ভেসে উঠে ভীষণ ফুঁসছে। আবার ধেয়ে আসছে অনিকের দিকে। আগের মতোই। বাড়ি দিলো অনিকের চাচা। আবার সেই বুদ্ধি খাটালো সাপটি। তবে এবার শেষ রক্ষা হয়নি। পুরো বাড়ি না লাগলেও অর্ধেকটা খেয়েছে সে। তাতে খানিকটা কাবু হয়ে গেছে সাপটি। বাড়ি খেয়ে ডুব দিলো দ্রুত কিন্তু সহজে আর উঠলো না। এই ফাঁকে দ্রুত সাঁতরিয়ে অনিককে নিয়ে পাড়ে উঠে এলেন তার চাচা। ভয়ে অনিকের মুখ সাদা হয়ে গেছে। বুকে জড়িয়ে নিলেন অনিকের মা। দাদী মাথায় গায়ে হাত বুলাচ্ছেন। চুলে হাত বুলাচ্ছে প্রভা। কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করছে অনিকের চাচী। কেন পুকুরে নামলো, একা কেন এলো এসব নিয়ে বকাঝকা করছে অনিকের মা। কিন্তু অনিকের চাচা বেশ খুশি। তিনি অনিকের মাকে উদ্দেশ করে বললেন, ভাবী ওকে বকা দিবেন না। অনিক অনেক সাহসী কাজ করেছে। একটি শাপের সাথে লড়াই করে সুস্থ আছে সে। তাও খালি হাতে। এই বলে অনিকের পিঠে কোমল থাপ্পড় দিয়ে বললেন, সাবাস অনিক সাবাস! নাম রাখবে তুমি। ঠিক এই সময় গুইসাপটি ভেসে উঠলো পানিতে। রক্ত বেরুচ্ছে সাপটির মুখ দিয়ে। অনিকের চাচা দেখেই বাঁশ নিয়ে তেড়ে ছুটছিলেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে বাধা দিলো অনিক। বললো- সেও একটি প্রাণী। ওকে জানে মারবেন না। ছেড়ে দিন চাচা। ও বেঁচে থাক। অনিকের কথায় সবাই অবাক। ভীষণ অবাক হয়ে অনিককে বুকে টেনে নিলেন তার মা। মনে মনে ভাবলেন অনেক বড় হবে আমার অনিক।
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ