অনন্য কথাসাহিত্যিক আবু রুশদ

অনন্য কথাসাহিত্যিক আবু রুশদ

স্মরণ ফেব্রুয়ারি ২০১২

হারুন ইবনে শাহাদাত..

কথাসাহিত্যিক আবু রুশদ বাংলা সাহিত্যে মানবচরিত্রের একজন অসাধারণ রূপকার। উর্দুভাষী পরিবারে জন্ম এবং ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক আবু রুশদ অসাধারণ সব সাহিত্যকর্ম উপহার দিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠককে।  ফেব্র“য়ারি মাস এলেই তাঁকে বেশি বেশি মনে পড়ে। কারণ তিনি ২০১০ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি ইন্তেকাল করেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি লেখালেখি থেকে দূরে ছিলেন। বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা, সভা-সেমিনারও এড়িয়ে গেছেন। আর এ কারণে ঘরের বাইরের পৃথিবীর সাথে তার যোগাযোগ বলতে গেলে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে প্রখ্যাত এ লেখকের মৃত্যুসংবাদ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ইন্তেকালের দুই দিন পর ২৫ ফেব্র“য়ারি। তার এ স্বেচ্ছানির্বাসনের কারণ জানা যায়নি। হতে পারে তিনি এভাবেই শান্তি পেয়েছেন। অথবা বন্ধু-বান্ধবদের সান্নিধ্য তাঁর শেষজীবনে এসে আর ভালো লাগতো না। আবার এমনটাও হতে পারে বার্ধক্যই তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলো বাইরের পৃথিবী থেকে। আত্মজীবনীতে আবু রুশদ নিজেই লিখেছেন, ‘প্রচণ্ড কোনো আকাক্সক্ষার বশবর্তী হয়ে আমি কখনও এমন কিছু করিনি, যাতে আমার মানসিক শান্তি বিঘিœত হতে পারে।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘সাহিত্যিক হিসেবে আমি তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে যেন তেমন আলোচিত বা সমাদৃত হতে না পারি, সে  চেষ্টা যারা করতেন তাঁদের মধ্যে তাঁর দু-একজন বন্ধু, স্থানীয় লোকও ছিলেন।’
আবু রুশদের জন্ম ১৯১৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তাঁর পুরোনাম আবু রুশদ মতিন উদ্দিন। দশ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সেজো। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি হুগলীর মুহসীন কলেজে ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করেন। তিনি ১৯৫১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করতে যান। তিনি ইসলামিয়া কলেজ (কলকাতা), ঢাকা কলেজ, রাজশাহী কলেজ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তিনি বিদেশী দূতাবাসেও চাকরি করেছেন, ইংরেজি পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। তিনি শিক্ষকতা থেকে ১৯৮২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ২০১১ সালের ৮ আগস্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘অধ্যাপক আবু রুশদ মতিন উদ্দিন মোমোরিয়াল ট্রাস্ট ফান্ড’ নামে একটি বৃত্তি চালু হয়েছে। তাঁর অন্তিম ইচ্ছেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিকট আবু রুশদের পতœী আজিজা রুশদ ট্রাস্ট ফান্ডের ৫ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করেছেন। ইংরেজি বিভাগের স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীর চূড়ান্ত পর্বে সেরা ফলাফল অর্জনকারী দরিদ্র একজন ছাত্র ও ছাত্রীকে এই ট্রাস্ট ফান্ডের বৃত্তি প্রদান করা হবে।
আবু রুশদের লেখায় আমাদের দেশের মানুষের সহজ সরল জীবনের ছবি পরিস্ফুটিত হয়েছে। তিনি পৃথিবীর  বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছেন, চাকরির সুবাদে। এরফলে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে জমা হয়েছে বিচিত্র জীবনযাপন প্রক্রিয়ার দুর্লভ সব ছবি। আমাদের সমাজ ও জীবনের সাথে মিলেমিশে ধরা দিয়েছে এসব দুর্লভ জীবনপ্রবাহ তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিতে। তিনি ১৯৭১ সালে আমেরিকার ওয়াশিংটনে শিক্ষা কাউন্সিলর থাকা অবস্থায় চাকরি  ছেড়ে  সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত সংগ্রহ ও ফান্ড কালেকশনের জন্য কাজ করেছেন। স্বদেশের প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা। আবু রুশদ দেখেছেন, শত অভাব ও দুর্দশার মধ্যেও এ দেশের মানুষ হাসতে পারে। আশির এক ভয়ঙ্কর বন্যার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, গৃহচ্যুত এক কিশোরী পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে অমলিন হাসি হাসছে। আবার অন্য দিকে (যুবসমাজ সম্পর্কে) তার এও মনে হয়েছে, ‘...আর্থিকভাবে  যে বিড়ম্বিত বা অন্যভাবে দুর্দশাগ্রস্ত তাঁর পক্ষে সামান্য আত্মত্যাগ করাও কঠিন।’
বিদেশে গিয়ে প্রান্তর ও খামারের সবুজ শ্রী  দেখে ‘সহসা তীক্ষè ব্যথার মতো’ তাঁর ‘দেশের কথা মনে পড়ে যেত।’ ‘মাটি সব জায়গাতেই সমান, সর্বংসহা ও মমতাময়ী।’ (সূত্র : প্রথম আলো, ৯-৪-২০১০)।
তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম : এলোমেলো (১৯৪৬), সামনে নতুন দিন (১৯৫১) ডোবা হলো দীঘি (১৯৬০), নগর (১৯৬৩), অনিশ্চিত রাগিনী (১৯৬৯) প্রভৃতি। সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি, তঘমা-ই-ইমতিয়াজ (১৯৬৩), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৯৬), হাবিব ব্যাংক পুরস্কার (১৯৭০), একুশে পদক (১৯৮১), নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৯২), অলক্তা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯২), বাংলা সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৯৩), শেরে বাংলা পুরস্কার (১৯৯২), লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৯২), রোটারি ক্লাব পুরস্কার (১৯৯৫) লাভ করেছেন।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ